এক
আমি শরীফের পাশে বসলাম।
-কে ওটা? জানতে চাইল শরীফ।
-তোর ভাবী। আমি গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে জবাব দিলাম।
-সিরিয়াস? তুই বিয়ে করে ফেলছস?
-হ্যাঁ।
-সত্যিই? কবে? শরীফের চোখে এখনো অবিশ্বাস।
-এইতো, মাস ছয়েক হবে।
-দুচির ভাই, জানানোর প্রয়োজনবোধও করলি না?
-আসলে দোস্ত, সব এতো তাড়াতাড়ি হয়ে গেল, তাও হঠাৎ করে কাউকে জানানোর সুযোগই পাইনি।
-তাই?
-সত্যিই দোস্ত। বিশ্বাস কর।
আমি বুঝতে পারছিলাম শরীফ বেচারা মনে দুঃখ পেয়েছে। তার স্কুল-কলেজের বন্ধু বিয়ে করে ফেলল ছয় মাস আগে আর তাকে জানায়ওনি। দুঃখ পাওয়ার মতই ব্যাপার।
-পরিচয় করিয়ে দিবি না?
-চল।
আমি আর শরীফ উঠে পড়লাম, এগিয়ে গেলাম নাইসার দিকে।
-নাইসা। আমি ডাকলাম।
নাইসা ওর পাশে বসা একটা মেয়ের সাথে হাসাহাসি করছিল, মেয়েটা মনে হয় আমাদের কোন বন্ধুর স্ত্রী হবে।আমার কণ্ঠ শুনে ও ফিরে তাকাল।
-নাইসা, এটা আমার বাল্যবন্ধু শরীফ আর শরীফ, এটা তোর ভাবী নাইসা।
নাইসা হাসল।
-কেমন আছেন ভাবী? শরীফ জানতে চাইল।
-ভাল। আপনি?
-আমিও ভাল।আসুন, আমার বউয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দেই।
শরীফ কিছুক্ষণ এদিক সেদিক চেয়ে বউকে খুঁজল।ওইতো আমার বউ।শামীমা।
এক চোখ ধাঁধানো সুন্দরী ফিরে তাকাল। আসছি।
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। সাদা শাড়ি আর ব্লাউজে কাউকে এত সুন্দর লাগতে পারে- আমার ধারণাই ছিল না।নাইসাও অসম্ভব সুন্দর, কিন্তু শামীমার তুলনা হয় না।
শামীমা আমাদের সামনে এসে দাঁড়াল।
-শামীমা, এটা আমার বাল্যবন্ধু রাফি আর রাফির বউ নাইসা। রাফি, নাইসা, ইনিই আমার শামীমা।
শামীমা আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসল।
-হাই। আমি হাত বাড়িয়ে দিলাম।
শামীমা আমার হাত ধরেই ছেড়ে দিল।একদিন আসবেন ভাইয়া আমাদের বাসায়।ও প্রায়ই আপনার কথা বলে।
-তাই নাকি? আমি শরীফের দিকে তাকালাম।
-ওই আমাদের ছোটবেলার গল্প আরকি।
-আচ্ছা?
-তা ভাই, কি গল্প? আমিও একটু শুনি।ওতো কখনো আমার সাথে ওর ছোটবেলার গল্প করে না। নাইসা বলল।
-বলেন কি ভাবী? ও কখনো আমার গল্প করেনি?শরীফ অবাক হয়।
নাইসা বুঝতে পারে আমার বাল্যবন্ধুর সামনে ওর এভাবে বলাটা উচিত হয়নি।বেচারি একটু আমতা আমতা করতে থাকে।
এই অস্বস্তিকর পরিস্থিতি থেকে আমাদের বাঁচিয়ে দিল তামজীদ।কিরে, তোরা ওখানে কি করিস? এদিকে আয়।
-আসছি। আমি তামজীদের দিকে ফিরে জবাব দেই।এই চল।আমি শরীফের হাত ধরে টান দেই।
-চল।
-আপনারা গল্প করুন। আমি নাইসা আর শামীমার দিকে তাকিয়ে বলি।
তামজীদ বলে, বন্ধুগন, আজকে রাফির বাসায় এই পার্টির আয়োজন ওর বিয়ে উপলক্ষে।রাফির বিয়ে হয়েছে আমেরিকায়, তাই আমরা কেউ এটেন্ড করতে পারিনি। তারই ক্ষতিপূরণ হিসেবে রাফিকে চেপে ধরেছিলাম ওর বাসায় একটা পার্টির জন্য। অবশেষে আজকে সেই পার্টি হচ্ছে। আর রান্নাবান্না আর অতিথিদের সার্বিক দেখভালের দায়িত্বে আছেন রাফির নববিবাহিতা স্ত্রী নাইসা ভাবী। ভাবীর জন্য একটা তালি হয়ে যাক।
সবাই তালি দেয়। নাইসা হালকা করে হাসে।
এবার আমি উঠে দাড়াই। বন্ধু এবং বধুপত্নীগণ, এক্ষুনি খাওয়া দাওয়ার পর্ব শুরু হবে। প্রথম ব্যাচ টেবিলে বসে পড়ুন।
আমি নাইসার দিকে তাকাই। নাইসা সম্ভবত আমার চোখের ভাষা পড়তে পারে। কাজের লোকটাকে নিয়ে ও রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে যায়।
কয়েকজন টেবিলে বসে পড়ে। নাইসা ব্যস্ত হয়ে পড়ে অতিথিদের খাওয়া দাওয়া নিয়ে।
আমি এখনো শরীফের পাশে বসে আছি।শরীফ ওর পাশের ছেলেটার সাথে কি নিয়ে যেন খুব গুরুগম্ভীর আলোচনায় ব্যস্ত।
আমি শামীমার দিকে তাকালাম। একটা চেয়ার টেনে বসেছে ও, ওকে ঘিরে আরও তিনজন বসে আছে।শামীমার কথা তিনজনই খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছে।
আমি শামীমার দিকে চেয়ে রইলাম। শামীমা হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে হাসল। আমিও হাতে থাকা গ্লাসটা নাড়িয়ে ওর হাসির উত্তর দিলাম।
-কি দরকার ছিল? নাইসার কণ্ঠ শুনে ওকে কেমন যেন আপসেট মনে হল।
-মানে? আমি বিছানায় বসতে বসতে জানতে চাইলাম।
-আজকের পার্টির কথা বলছি।
-বাহ, আমেরিকা থেকে হঠাৎ বিয়ে করে চলে এলাম, বন্ধুদের কিছু জানানোর সুযোগইতো পেলাম না।একটা পার্টিতো ওরা দাবি করতেই পারে।
-আর বন্ধুর বউয়ের কাছে তুমি কি দাবী কর?
বুঝতে পারলাম নাইসা কি বলতে চাইছে, কিন্তু বিষয়টা অস্বীকার করা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না।
-কি বলতে চাইছ?
-ঢং করবা না। এই জিনিসটা আমার একদম পছন্দ না।
নাইসার কথার ধরণ শুনে মেজাজ খারাপ হয়ে গেল।
-যা বলতে চাও, স্পষ্ট করে বল। আজেবাজে কথা বলে মেজাজ খারাপ করবা না।
-শামীমার সাথে তোমার কি?
বুঝতে পারছিলাম নাইসা উত্তেজিত হয়ে পড়ছে।বিয়ের পর ছয় মাস পেরিয়ে গেছে, আজকের আগে ওকে এভাবে উত্তেজিত হতে দেখিনি।আমি যথাসম্ভব শান্ত কণ্ঠে বললাম, শামীমা আমার বাল্যবন্ধুর বউ। ব্যাস, এটুকুই।
-এটুকুই? তাহলে সেটুকুতেই রাখ। এরচেয়ে বেশি বাড়িও না।
-মানে?
-মানে আজকে সারাক্ষণ তুমি শামীমার দিকে তাকিয়ে ছিলে না?
-মোটেই না।
-তাই?
আমি চুপ।কিন্তু নাইসার শান্ত হওয়ার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছিল না।
-আর শামীমাকে নিয়ে তুমি একা একা ছাদে গেলে কেন?
-আশ্চর্য, আমাদের নতুন বাড়ি। শামীমা আমাদের বাসায় মেহমান, ও দেখতে চাইল, তাই নিয়ে গেলাম।
-ওই ছাদ দেখাতেই এক ঘণ্টা লাগল?
-হোয়াট?
নাইসা কোন জবাব দিল না। কিছুক্ষণ আমার দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল, এরপর হঠাৎ কাঁদতে শুরু করল।
-আরে আশ্চর্য, আমার বাবুটা কাঁদে কেন? আমি নাইসাকে জড়িয়ে ধরতে গেলাম আর ও আমাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল।
-ঘুমিয়ে পড়। সকালে অফিসে যেতে হবে তোমার।নাইসা বাতি নিভিয়ে দিল।
আমিও আর কথা বাড়ালাম না। এখন কথা বললে কথা বাড়বে। তারচেয়ে ঘুমিয়ে পড়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ।
দুই
ঘুম ভাঙল এলার্মের শব্দে।
ভাবলাম সকাল হয়ে গেছে। আমাদের বাংলো বাড়িটা শহর থেকে একটু দূরে, তাই সকাল সকাল না উঠলে সময়মত অফিসে পৌঁছানো যায় না।এজন্যই প্রতিদিন এলার্ম দিয়ে ঘুমাই।চোখ খুলে দেখি বাইরে এখনও অন্ধকার।
এবার ভালমতো লক্ষ্য করে বুঝলাম, এলার্ম না, বেজে চলেছে আমার মোবাইল ফোনটা।
আমি ফোনটা হাতে নিলাম।নাঈম।
-হ্যালো নাঈম , বল।
-জেগে আছিস?
-এতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলাম। তোর ফোনের শব্দে ঘুম ভাঙ্গল।
-সরি দোস্ত, এই মাঝ রাতে তোর ঘুম ভাঙ্গানোর জন্য।
-আর্জেন্ট কিছু?
-হ্যাঁ। তোর বাসায় পার্টি শেষে ফেরার সময় শরীফের গাড়ি অ্যাকসিডেন্ট করেছিল। শরীফ মোটামুটি সুস্থ আছে, ওর বউয়ের অবস্থা ভাল না।
-বলিস কি? ওরা এখন কোথায়?
আমি নাইমের কাছ থেকে হাসপাতালের ঠিকানা জেনে নিলাম।
হাসপাতালে যাওয়ার জন্য বিছানা ছেড়ে উঠব, হঠাৎ খেয়াল করে দেখি নাইসা আমার পাশে নেই।
বাথরুমের লাইট বন্ধ।অন্ধকার বাথরুমে বসে আছে নাকি?
বাথরুমের দরজায় ধাক্কা দিলাম। দরজা খুলে গেল সহজেই। নাহ, ভেতরে কেউ নেই।
দেলোয়ার কিছু করেনিতো আবার।
দেলোয়ারের রুমের দরজা খোলা। ভেতরে কেউ নেই।
শিট।এই মাঝরাতে দেলোয়ার আবার কোথায় গেল?
এজন্যই আমি দেলোয়ারকে আনতে চাইনি। তারপরও শ্বশুরবাড়ি থেকে জোর করে বলল, দেলোয়ার আমাদের পুরনো কাজের লোক।নাইসাকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছে। ও থাকলে ঘরের কাজকর্ম নাইসার জন্য সহজ হবে।
তা কাজকর্ম সহজ করতে এই হারামজাদাটা এখন গেল কোথায়?
-দেলোয়ার। আমি চিৎকার করলাম।
কোন জবাব এল না।
-দেলোয়ার।আবার ডাকলাম বুড়োটাকে।
এবারও কোন জবাব নেই। গেল কোথায়?
-নাইসা।
নাহ, কোন জবাব এল না।
পুরো ঘরের কোথাও নাইসা নেই।মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লাম।নাইসাকে খুঁজব নাকি শরীফকে দেখতে হাসপাতালে যাব-বুঝতে পারছি না।
হঠাৎ শুনি হুম হুম টাইপ একটা শব্দ আসছে কোত্থেকে যেন।আমি ড্রইং রুমে এসে দেখি বাসার বাইরে আগুন জ্বলছে, জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে।
আমি দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলাম।যা দেখলাম তাতে অবাক হয়ে গেলাম।
বাসার সামনে খোলা জায়গায় আগুন জ্বলছে, আগুনের কুণ্ডলীর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে আছে নাইসা। চুল খোলা, চোখ বন্ধ। ওর মুখ দিয়েই হুম হুম শব্দ বেরিয়ে আসছে।
-মামনি কিন্তু জাইগা নাই।
হঠাৎ কানের কাছে শব্দ শুনে চমকে উঠেছিলাম। তাকিয়ে দেখি দেলোয়ার, হাতে একটা চাদর। বুড়োটা আবার উদয় হল কোত্থেকে?
-মামনিরে নিয়া আসেন।
-তুমি কোথায় ছিলে? আমি জানতে চাইলাম।
-আমি চাদর আনতে গেছিলাম মামনির জন্য।
-আমি তোমাকে ডাকছিলাম। শোননি?
-নাতো।
শালা বুইড়া, ইনোসেন্ট সাজ? দাঁড়াও, সূর্য উঠুক।তোমার ইনোসেন্টগিরি বের করে দেব।
-চাদরটা দাও।
দেলোয়ার চাদর দিল। আমি নাইসার দিকে এগিয়ে গেলাম।
আগুনের কাছে যেতেই কপাল বেয়ে ঘাম ঝরতে শুরু করল।এত উত্তাপের মাঝে নাইসা বসে আছে কি করে?
আমি ওর গায়ে চাদর পড়িয়ে দিলাম।নাইসা চল।
নাইসা আগের মতই বসে রইল। এখনও ওর কণ্ঠ দিয়ে হুম হুম শব্দ বেরোচ্ছে।
-নাইসা।
কোন প্রতিক্রিয়া নেই।
-নাইসা ওঠ।আমি ওর হাত ধরে টান দিলাম।
আউচ, কিছু একটা কামড় দিয়েছে।তাকিয়ে দেখি আঙ্গুল থেকে রক্ত বের হচ্ছে।নাইসার হাতে কোন পোকা বসে ছিল নাকি? আমাকে কামড়াল কিসে?
নাইসাকে কোলে নেয়ার চেষ্টা করলাম। বাপরে বাপ।কি ভারী!মনে হল যেন পাথর তোলার চেষ্টা করছি।নাইসাকে ওর জায়গা থেকে এক চুলও নাড়াতে পারলাম না।
বুঝতে পারছিলাম নাইসা জেগে নেই।কিন্তু এই মাঝরাতে ও এখানে এল কি করে? আর আগুনটাই বা জ্বালল কে?
এসব ভাবতে ভাবতে তাকিয়ে দেখি দেলোয়ার ঘর থেকে বেরিয়ে আসছে। হাতে একটা বড় বালতি।
-বাবাজি, এই পানি দিয়া আগুন নিভায়া দেন।
-দাও।
যাক, বুড়োর আক্কেল জ্ঞান কিছু আছে তাহলে। এই মাঝরাতে আমি আর নাইসা ঘরের সামনে আগুন জ্বালিয়ে দাঁড়িয়ে আছি-এই দৃশ্য প্রতিবেশীরা কেউ দেখলে সমস্যা হতে পারে।তাড়াতাড়ি পুরো পানিটাই ঢেলে দিলাম আগুনের ওপর। আগুন নিভে যেতে সময় লাগল না।
-মামনি। দেলোয়ার ডাকল।
নাইসা হঠাৎ চোখ মেলে তাকাল। নিজেকে খোলা আকাশের নিচে অবাক হয়ে গেল।আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি এখানে কিভাবে এলাম?
-ভেতরে চল।
নাইসা আমার হাত ধরে উঠে দাঁড়াল।
তিন
হাসপাতালে পৌছাতে রাত তিনটা বেজে গেল।চেষ্টা করলে আরেকটু আগেই আসতে পারতাম। কিন্তু নাইসাকে ঘুম না পাড়িয়ে আসাটা নিরাপদ মনে হল না।
গাড়ি পার্ক করেই নাঈমকে ফোন দিলাম।
-দোস্ত, তোরা কয় তলায়? জানতে চাইলাম আমি।
-তুই আসছিস? নাঈম জানতে চাইল।
-হ্যা।
-পাঁচ তলায় আয়। আমরা আছি।
লিফট আসতে সময় লাগবে। সিড়ি দিয়েই ওপরে উঠে গেলাম।একটু এগোতেই পেয়ে গেলাম নাঈমকে ।
-কিরে, খবর কি?
-শরীফ ভালো আছে।ওর আঘাত তেমন গুরুতর না।
-সেন্স আছে?
-হ্যা, ডাক্তার বলল, কালকে সকালে রিলিজ করে দেবে।
-আর ওর বউ?
-অবস্থা সিরিয়াস।প্রচুর ব্লিডিং হয়েছে। সেন্স নেই।ডাক্তার বলছে রক্ত লাগবে। তোর এ পজিটিভ না?
-হ্যা।
-রক্ত দিতে পারবি?
-এখনই?
-হ্যা।
-পারব।
-ভেরি গুড। তাহলে তুই রেডি হ। আমি ভেতরে জানিয়ে আসি রক্ত পাওয়া গেছে।
-রক্ত লাগবে কয় ব্যাগ?
-বলল পাঁচ ব্যাগ।
-ম্যানেজ হয়েছে?
-না।
-ওকে আমি ম্যানেজ করতেছি। তুই ভেতরে গিয়ে ফর্মালিটি পূরণ করে আয়।
-ওকে।
নাঈম চলে যাচ্ছিল, ওকে আমি আবার ডাকলাম।
-অ্যাকসিডেন্ট হল কিভাবে?
-শরীফ বলছে কুয়াশার কারণে নাকি উলটো দিক থেকে আসাটা লরিটা ও দেখতে পায়নি। শেষে মূহূর্তে গাড়ি ঘোরাতে গিয়ে ওটা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাস্তার পাশের গাছের সাথে ধাক্কা খায়। আর লরিটা ওর গাড়ি ক্রসের সময় গাড়ির পেছনে আরেকটা ধাক্কা দেয়।
-এই সেপ্টেম্বরে কুয়াশা?
-তাইতো বলল।
-শামীমা কি শরীফের পাশেই বসে ছিল?
-হ্যা।
-তুই জানলি কখন?
-অ্যাক্সিডেন্টের সাথে সাথেই শরীফ আমাকে ফোন দেয়। আমার বাসাতো কাছেই। সাথে সাথেই ওখানে পৌছে যাই। এরপর দুজন মিলে শামীমাকে হাসপাতালে নিয়ে আসি।
-ঠিক আছে, তুই যা। আমি ব্লাড ম্যানেজ করছি। আর শরীফের সাথে দেখা করা যাবে?
-হ্যা, দেখে আয় ওকে।
নাঈম ভেতরে চলে গেল। যাওয়ার আগে আমাকে শরীফের কেবিন নম্বরটা জানিয়ে দিয়ে গেল।
আমি ফোন করে কয়েকজনকে রক্তের কথা বললাম। রক্ত ম্যানেজ হতে সময় লাগল না। রক্ত ম্যানেজ করেই আমি শরীফের কেবিনে ঢুকে পড়লাম।
শরীফ বিছানায় বসে ছিল। হাতে একটা ছোট ব্যান্ডেজ আর কপালে অল্প কাটা। সারতে মনে হয় না খুব বেশি সময় লাগবে।
-শরীফ।আমি ডাকলাম।
শরীফ আমার দিকে তাকাল শুন্য দৃষ্টিতে। ওর পাশে বসতেই আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল।
-দোস্ত, এটা কি হয়ে গেল? একটু আগে আমরা তোর বাসায় মজা করছিলাম আর এখন আমার বউটা মনে হয় বাঁচবে না।
-কি বলিস এসব? বাঁচবে না কেন?নাঈম বলল রক্ত ম্যানেজ করতে। একটু পর নাকি ডাক্তাররা অপারেশন শুরু করবে।
-কোন লাভ হবে না।
-মানে কি? তুই কিভাবে জানিস? তুই কি ডাক্তার?
-মানে আমি জানি।ওর ব্লিডিং বন্ধ হচ্ছে না। নাক দিয়ে, কান দিয়ে খালি রক্ত গড়িয়ে পড়ছে।
-তোকে এসব কে বলেছে?
-ওই বুড়িটা।
-বুড়ি? কোন বুড়ি?
-অ্যাকসিডেন্ট হওয়ার সাথে সাথেই আমি জ্ঞান হারিয়েছিলাম।জ্ঞান ফিরতেই দেখি এক বুড়ি শামীমার শরীর থেকে রক্ত চুষে খাচ্ছে। শামীমার রক্তে বুড়ির সারা শরীর ভিজে গিয়েছিল। আমার সাথে চোখাচুখি হতেই আমার দিকে দাঁত কেলিয়ে হেসে বুড়িটা হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।
-দোস্ত, তুই এখনো শকের মধ্য আছিস। একটু ঘুমানোর চেষ্টা কর।সকালে কথা হবে তোর সাথে।
-আমিও প্রথমে তাই ভেবেছিলাম।ওরা শামীমাকে অপারেশন থিয়েটারে ঢোকাল, তখন নাঈম বলল, শামীমাকে যেহেতু অপারেশন থিয়েটারে ঢুকিয়েই ফেলেছে, আমি যেন ডাক্তার দেখিয়ে নেই। আমার নিজেরও শরীরের অনেক জায়গায় কেটে গিয়েছিল। ব্যান্ডেজ করিয়ে এসে যেই না একটু শুয়েছি তখনই শুনি বুড়িটা বলছে, তোর বউ আর বাঁচবে না।আমি দৌড়ে অপারেশন থিয়েটারের দিকে গেলাম।দেখি বুড়িটা ওর পাশেই, ওর গলা চাটছে। আমি অনেক বলেছি ওদেরকে, কেউ আমার কথা শোনেনি। এমনকি নাঈমও আমার কথা বিশ্বাস করেনি। উলটো আমাকে ঘুমের ইঞ্জেকশান দিয়েছিল।
-ঘুমের ইঞ্জেকশান দেয়ার পরও তুই জেগে আছিস?
-হ্যা। দোস্ত, তুই শামীমাকে বাঁচা।
-আমি দেখছি কি করা যায়। তুই একটা বিশ্রাম নে।
আমি তাড়াতাড়ি বাইরে বেরিয়ে এলাম। বেচারা ভাল শক খেয়েছে-বোঝা যাচ্ছে। বউটার কিছু হলে না আবার পাগল টাগল হয়ে যায়।অবশ্য যে সুন্দরী বউ-এর জন্য পাগল হওয়া যায়।
ছি ছি, এসব কিভাবে ভাবছি আমি? মনে মনে নিজেকে গালি দিলাম।
-তোর ডোনাররা চলে আসছে।
নাঈম কখন আমার সামনে এসে দাড়িয়েছে আমি খেয়ালই করিনি।
-তাহলে চল রক্ত দিয়ে দেই।
-চল।রাফি।
-বল।
-কথা হয়েছে শরীফের সাথে?
-হ্যা।
-ওর আচার আচরণ স্বাভাবিক মনে হয়েছে?
-বেচারা ভাল শক খেয়েছে। বাদ দে সেসব। এখন যেটা জরুরী আগে সেটা করি চল।
রক্ত দিতে বেশি সময় লাগল না।আমি ছাড়া বাকি ডোনাররা সবাই আমার পরিচিত ছোট ভাই। ওদেরকে বললাম একটু অপেক্ষা করতে।সাথে গাড়ি আছে, ওদের সবাইকে নামিয়ে দেব। এই গভীর রাতে ওদের কষ্ট দেয়ার কোন মানে হয় না।
ওরা সবাই বসল।
আমি নাঈমকে খুঁজে বের করলাম।
-চল, ডাক্তারের সাথে কথা বলে আসি।এরপর ওদেরকে নামিয়ে দিয়ে আমি বাসায় যাব।
-তুই থাকবি না?
-সকালে একটা জরুরী প্রেজেন্টেশন আছে দোস্ত।তবে যত তাড়াতাড়ি পারি অফিস থেকে এখানেই আসব।আর এই ছেলেগুলা এর রাতে ঘরে ফিরবে কিভাবে?
-ওরাতো ছেলে। নাকি? এত রাতে যখন আসতে পারছে, তখন যেতেও পারবে।
-ভাই, আমি ওদেরকে আগেই বলছি, সাথে গাড়ি আছে, ওদের সবাইকে নামিয়ে দেব। এজন্যই ওরা আসছে।তাছাড়া তুইতো এখন আছিসই।শরীফ আর শামীমার বাসা থেকে এখনো কেউ আসেনি?
-এখন পর্যন্ত না। আমি ওদের কারো বাসায় কিছু জানাই নি। শরীফ কিছু জানিয়েছে কিনা জানি না।
আমার কথায় নাঈমকে খুব খুশি বলে মনে হল না।আমারো উপায় নেই। সকালে অফিসে যেতেই হবে।
হাসপাতাল থেকে বেরনোর আগে ডাক্তারের সাথে কথা বললাম। ডাক্তার খুব বেশি আসার বাণী শোনালেন না, আবার একবারে নিরাশও করলেন। বললেন, দোয়া করতে, বিশ্বাস রাখতে।
আমি বেরিয়ে পড়লাম।
চার
প্রেজেন্টেশন শেষ করতে করতে বারটা বেজে গেল।
প্রেজেন্টেশন শেষ হয়েছিল আগেই, এরপর কিছুক্ষণ ক্লায়েন্টদের সাথ আমাদের প্রপোজাল নিয়ে আলোচনা চলল। এরপর চা-নাস্তা আসতেই শুরু হয়ে গেল দেশ-দশ-ভ্যাটম্যান-ক্যাটম্যান ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা।ক্লায়েন্টরা কেউ উঠছে না, বস উঠছে না, স্বাভাবিকভাবেই আমিও বারটার আগে কনফারেন্স রুম থেকে বের হতে পারলাম না।
কনফারেন্স রুম থেকে বেরোতেই পিয়ন আমার দিকে এগিয়ে এল।
-স্যার।
-কি?
-আপনের কাছে পুলিশ আসছে।
-পুলিশ? আমার কাছে?
পিয়ন হ্যা-সূচক মাথা নাড়ল।
-কেন?
-জানিনা স্যার। আপনের রুমে বসায়া দিছি।
-কতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছে?
-আধাঘন্টা হবে।
-ঠিক আছে। আমি রুমে যাচ্ছি, তুমি উনার জন্য চা-নাস্তা পাঠিয়ে দাও।
-আইচ্চা।
পিয়ন চলে গেল।
আমার কাছে হঠাৎ পুলিশ আসার কোন যৌক্তিক কারণ খুঁজে পেলাম না। সাম্প্রতিক সময়ে এমন কিছুতেতো জড়াইনি যাতে পুলিশ আমার কাছে আসতে হবে।
এসব ভাবতে ভাবতে রুমে ঢুকে পড়লাম।
প্রথম দেখায় লোকটাকে পুলিশ বলে মনেই হল না।ক্লিন শেভড, চুল পরিপাটি করে আচড়ানো।টি শার্ট আর জিন্স পড়া। বয়স ত্রিশের আশেপাশে।
আমাকে দেখেই উনি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন।হ্যালো।
আমিও হাত বাড়িয়ে দিলাম।হাই, বসুন।
উনি আবার চেয়ারে বসে পড়লেন।আপনার রুমটা বেশ সুন্দর।
আমি হেসে বসে পড়লাম।জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম উনার দিকে।
-আমি এএসপি মাহফুজ আহমেদ।
-আমি রাফি হাসান।হঠাৎ আমার কাছে?
-সরাসরি পয়েন্টে আসি তাহলে।
-নিশ্চয়ই।
-আপনি শামীমাকে চেনেন? শামীমা খান?
-শরীফের স্ত্রী?
-হ্যা, শরীফ খানের স্ত্রী।
-ঠিক চিনি বললে ভুল বলা হবে। শরীফ আমার বন্ধু। গতকাল রাতে শামীমার সাথে ও পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল।
-কোথায়?
-গতকাল আমার বাসায় একটা ছোট অনুষ্ঠান ছিল।ক্লোজ বন্ধুদের দাওয়াত করেছিলাম। ওখানেই শরীফ ওর স্ত্রীকে নিয়ে এসেছিল।
-তারপর?
-রাতে ওরা আমার বাসায় খাওয়া দাওয়া করে, গল্পগুজব করেছি আমরা বেশ কিছু সময়। বন্ধুদের আড্ডায় যা হয় আরকি।আনুমানিক এগারটার দিকে ওরা আমার বাসা থেকে বের হয়।
-গতকাল রাতে ওদের অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। আপনি জানেন?
-হ্যা।নাঈম আমাকে জানায়।
-নাঈম কে?
-নাঈমও আমাদের বন্ধু। দূর্ঘটনার পর শরীফ প্রথম নাঈমের সাথেই যোগাযোগ করে। নাঈম আর শরীফ মিলেই শামীমাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়।
-আপনি কি হাসপাতালে গিয়েছিলেন?
-হ্যা, রাত তিনটার দিকে পৌছেছিলাম।
-তারপর?
-ডাক্তাররা শামীমার অপারেশনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। রক্তের দরকার ছিল। আমার আর শামীমার রক্তের গ্রুপ একই। আমি গতকাল রাতে রক্ত দিই।
-বাহ, এক রাতের পরিচয়েই রক্ত দিয়ে দিলেন?
-কি বলতে চাইছেন?
-এরপর কি হল?
-আমার অফিসে জরুরী কাজ ছিল।তাই আমি হাসপাতাল থেকে চলে আসি।
-শামীমার এখন কি অবস্থা?
-সকালে ফোনে কথা হয়েছিল নাঈমের সাথে। অপারেশন সফল হয়েছে।ব্লিডিং বন্ধ হয়েছে।
-তারমানে আপনি সর্বশেষ অবস্থা জানেন না?
-কি অবস্থা? কিসের কথা বলছেন?
-সকাল নয়টার দিকে শামীমার আবার ব্লিডিং শুরু হয়। আজ সকাল দশটার দিকে উনার মৃত্যু হয়।
শামীমার মৃত্যুর খবর শুনে আমি স্তম্ভিত হয়ে পড়ি। কি বলব ভেবে পাই না।
-রাফি সাহেব?
-বলুন।
-শরীফ সাহেবকে আপনার কেমন মনে হয়?
-মানে কি?
-মানে ব্যক্তি হিসেবে উনি কেমন? মানুষ হিসেবে উনি কেমন?
-শরীফ আমার দেখা সবচেয়ে ভাল মানুষদের মধ্যে একজন।
-হুম।
-মাহফুজ সাহেব।
-বলুন।
-আপনি এখানে কেন?
-পুলিশের কাজ সত্যটা খুঁজে বের করা। আমি সে চেষ্টাই করছি।
-কিসের সত্য?
-সিম্পল ব্যাপার।একটা অ্যাকসিডেন্ট হল, ড্রাইভিং সিটে বসা শরীফ সাহেবের কিছু হল না, অথচ তার স্ত্রী রক্তে ভেসে গেল।ব্যাপারটা অস্বাভাবিক মনে হয় না আপনার কাছে?
-ইট ওয়াজ জাস্ট এন অ্যাকসিডেন্ট।
-অ্যাকসিডেন্ট না মার্ডার-সেটা নির্ধারন করবে আদালত। একটা মামলা দায়ের হয়েছে, তদন্ত শুরু হয়েছে, আই এক্সপেক্ট ইয়োর ফুল কোঅপারেশন।
এমন সময় দরজা ঠেলে পিয়ন ভেতরে ঢুকল। চা আর বিস্কুট রাখল মাহফুজ সাহেবের সামনে।
-আজ উঠি। চা-নাস্তা হবে আরেকদিন।
মাহফুজ সাহেব বেরিয়ে গেলেন।
(ক্রমশ)
দ্বিতীয় পর্ব
শেষ পর্ব
বড় গল্প। মোট তিন পর্বে পোস্ট করার পরিকল্পনা আছে। আজ পোস্ট করলাম প্রথম পর্ব।আগামী দুই দিনে বাকি দুই পর্ব পোস্ট করব ইন শা আল্লাহ এই সময়ে।
==========================================
আমার লেখা অন্যান্য ভৌতিক গল্পগুলোঃ
১.পিশাচ কাহিনীঃ রক্তখেকো ডাইনী পর্ব-১ পর্ব-২ পর্ব-৩
২.পিশাচ কাহিনীঃ জানোয়ারের রক্ত (১৮+)
৩.পিশাচ কাহিনীঃ অন্ধকারে বিলীন
৪.পিশাচ কাহিনীঃ হোটেল একশ তলা
৫.পিশাচ কাহিনীঃ একশ তলায় আবার
৬.পিশাচ কাহিনীঃ রাতের আঁধারে
৭.পিশাচ কাহিনীঃ কন্ঠ
৮.পিশাচ কাহিনীঃ অতিথি
৯.পিশাচ কাহিনীঃ কান্নার শব্দ
১০.পিশাচ কাহিনীঃ শয়তানের পাল্লায়
১১.পিশাচ কাহিনীঃ নির্ঘুম রাত
১২.পিশাচ কাহিনীঃ জঙ্গল মঙ্গলপুর
১৩.পিশাচ কাহিনীঃ একটি ফটোগ্রাফ
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা মার্চ, ২০২৩ রাত ১০:১২