somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ তামাশা

২৩ শে অক্টোবর, ২০১৪ দুপুর ২:৪৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




" আপনারা জানেন কিছুদিন আগে ঠিক এরকমই একটা ঘটনা ঘটেছিল। মালেশিয়ার এক বিমান যাত্রী যাত্রার ঠিক আগে তাদের প্লেনের ছবি ফেসবুকে পোস্ট করে বলেছিলেন 'কেমন হবে যদি এই বিমানটা হারিয়ে যায়?' ঠিক সেটাই ঘটেছিল। মালেশিয়ার সেই বিমানটা হারিয়ে গিয়েছিল। আজ নিখোজ হওয়ার কয়েক মাস পেরিয়ে গেলেও সেই বিমানটার কোন খোজ পাওয়া যায়নি। জানা যায়নি বিমানটি বা তার যাত্রীদের ভাগ্যে শেষ পর্যন্ত কি ঘটেছিল।

এই ঘটনার কয়েকমাস পর ঠিক একই ঘটনা ঘটল বাংলাদেশে। যমুনা নদীর বুক চিরে চলা এক লঞ্চ থেকে শাহরিয়ার নামক জনৈক যাত্রী লঞ্চের ছবি ফেসবুকে পোস্ট করে লিখেছিলেন, 'কেমন হবে যদি আমাদের সবাইকে নিয়ে লঞ্চটা এই অথই জলরাশির বুকে হারিয়ে যায়?'।

ঠিক সেটাই হয়েছে। কয়েকশ যাত্রী বোঝাই লঞ্চটির যমুনার বুকে সলিল সমাধি ঘটেছে। অল্প কিছু যাত্রী সাতরে নদী পার হতে সমর্থ হলেও আর স্থানীয় লোকজন ও উদ্ধারকর্মীদের ততপরতায় কছু যাত্রীকে উদ্ধার করা গেলেও এখন নিখোজ রয়েছেন শতাধিক যাত্রী, যাদের মধ্যে ফেসবুকে ছবি পোস্ট করা শাহরিয়ারও একজন।

ক্যামেরাম্যান মকবুলের সাথে আবুল হাসান,বাবুল টিভি।"

নদীর পাড়ে দাড়িয়ে আছি, যমুনার পাড়ে। আমার সাথে আছেন মহসিন ভাই, শাহরিয়ারের কাজিন।হ্যা, ঠিকই ধরেছেন। রিপোর্টার আবুল যে শাহরিয়ারের কথা বলছিলেন আমরা এসেছি সেই শাহরিয়ারকে খুজতে।

"ডিয়ার ভিউয়ার্স, আপনাদের কি মনে হয়? কেন এমন হচ্ছে? কেউ একজন পোস্ট করেন যদি হারিয়ে যাই আর সাথে সাথে তারা হারিয়ে যাচ্ছেন। শুরুটা হয়েছিল মালেয়শিয়ার বিমানের সেই রহস্যময় অন্তর্ধান দিয়া। আর বাংলাদেশে এই ঘটনা ঘটল দ্বিতীয়বারের মত।

প্রথমবার ঘটেছিল আহসানউল্লাহ ইউনিভার্সিটির ছয়জন ছাত্রের সেন্টমার্টিনে ডুবে যাওয়ার মধ্য দিয়ে যখন একজন স্ট্যাটাস দিয়েছিল, 'চলে যাচ্ছি নেটওয়ার্কের বাইরে।' সত্যি সত্যি তারা চলে গিয়েছিলেন নেটওয়ার্কের বাইরে। আর একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল আজ।ভিউয়ার্স, আপনাদের কি মনে হয়? এর সাথে কি কোন অভিশাপ জড়িত যা ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে জেগে ওঠে?"

আমি রিপোর্টারের দিকে তাকালাম। ববকাট চুলের এক তরুনী, পরনে জিন্স আর কামিজ, বয়স সম্ভবত আটত্রিশ চল্লিশ কিংবা কিংবা আশেপাশে।যদিও এমন ভাব করছে যেন চব্বিশ বছরের তরুনী। দেখেতো বুদ্ধিমতী বলেই মনে হয়।ফেসবুক পোস্ট দ্বারা কোন অভিশাপ জেগে ওঠে। এরা এধরনের গর্দভ মার্কা কথা বলে কি করে?

"ভিউয়ার্স, চলে এসেছি নদী পাড়ে দাড়িয়ে থাকা একজন মানুষের কাছে। তার কাছে জানতে চাইব, ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে একটা অভিশাপ জেগে উঠছে। এ ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কি?"

আমি লোকটার দিকে তাকালাম। মাথায় কাচাপাকা চুল, মুখে অল্প দাড়ি। পরনে একটা মলিন লুংগি আর ময়লা স্যান্ডোগেঞ্জি।নদীপাড়ের টিপিকাল দরিদ্র লোক। সারা গা ভেজা, চুল আর দাড়ি থেকে এখনো টপটপ করে পানি পড়ছে। উদ্ধারকর্মীরা আসার আগে যেকজন স্থানীয় লোক ডুবে যাওয়া যাত্রীদের বাচানোর চেষ্টা করেছে এই লোকটা তাদেরই একজন।আর আমাদের মহান টিভি রিপোর্টার তাকেই কিনা প্রশ্ন করছেন ফেসবুক অভিশাপ সম্পর্কে!!!

"কি জিগাইলেন বুঝতে পারলাম না। ফেসবুক না টেসবুক- এইডা আবার কি? এইডা অভিশাপ দেয় ক্যামনে?"

লোকটার উত্তর শুনে মেয়েটা বিব্রত হয়ে গেল। সম্ভবত সে বুঝতে পারেনি লোকটা ফেসবুক বলে কিছু চিনবে না।

মেয়েটা এবার এগিয়ে যেতে লাগল নতুন একজনের খোজে। এবার আর লুংগি-স্যান্ডোগেঞ্জি নয়, এগিয়ে গেল টিসার্ট-জিন্স পড়া একজনের দিকে যাকে দেখলে মনে সে ফেসবুক চেনে।মেয়েটি মনে হয় আজ ফেসবুক অভিশাপ নিয়ে রিপোর্ট করেই ছাড়বে।

"এক্সকিউজ মি ভাইয়া।" মেয়েটি টোকা দিল ছেলেটার কাধে।
"বলুন"ছেলেটা ফিরে তাকাল।মহসীন ভাই।
মহসিন ভাইকে দেখে বোঝার কোন উপায় নেই তিনি তার নিখোজ ভাইকে খুজতে এসেছেন।একেবারে শান্ত চেহারা, যদিও জানি ভেতরে ভেতরে নিখোজ ভাইয়ের জন্য টেনশানে তিনি মারা যাচ্ছেন।
"আমি এসেছি সিটিএন টিভি থেকে, এই লঞ্চ দূর্ঘটনার ওপর একটা রিপোর্ট করতে। আমার নদী পাড়ে উপস্থিত একজনের সাক্ষাতকার প্রয়োজন। আপনি কি আমাকে সাহায্য করতে পারবেন?"
"কি করতে হবে আমাকে?"
"একটু পরই আমরা লাইভ যাব।আমি আপনার সাক্ষাতকার নিতে চাইছি।"
"আচ্ছা"

মিনিট দশেক পর।
"ভিউয়ার্স, আমি চুন্নী সাহা দাড়িয়ে আছি যমুনার পাড়ে যেখানে লঞ্চডুবিতে নিখোজ যাত্রীদের অনুসন্ধান ও উদ্ধারকাজ এখনো চলছে।আমার সাথে এই মূহুর্তে আছেন নদী পাড়ে দাড়িয়ে থাকা একজন।আচ্ছা, আপনার নাম কি?"
"মহসীন" জবাব দিলেন মহসীন ভাই।
"আপনি এখানে কেন এসেছেন?" চুন্নী সাহার দ্বিতীয় প্রশ্ন।
আমার ইচ্ছা করল শালীকে একটা থাপ্পড় দেই। দুর্ঘটনাস্থলে কেউ কি তামাশা করতে আসে?
"আমার ভাইকে খুজতে। ও এই লঞ্চের যাত্রী ছিল।"মহসিন ভাইয়ের শান্ত জবাব।
"আপনার ভাইকে খুজে পেয়েছেন?"
"না"
"আপনার ভাই সম্পর্কে কিছু বলবেন?"
"এটা আমার ছোট ভাই শাহরিয়ার।"হাতে থাকা শাহরিয়ারের ছবিটা তিনি তুলে ধরলেন।"এই লঞ্চে যাচ্ছিল।"
আমাদের মহান চুন্নী সাহা ছবিটার দিকে লক্ষ্য করলেন। "এটা কি সেই শাহরিয়ার যে কিনা ফেসবুক স্ট্যাটাস দিয়েছিল যদি এই লঞ্চটা অথই জলরাশিতে হারিয়ে যায়?"
নিজের ভাইয়ের ফেসবুক স্ট্যাটাস নিয়ে একজন টিভি সাংবাদিকের মন্তব্য শুনে বেশ বিরক্ত হলেন মহসিন ভাই।তবুও নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রেখে জবাব দিলেন,"হ্যা"
এবার চুন্নী সাহাকে বেশ উতসাহিত মনে হল।উপযুক্ত লোক পাওয়া গেছে। এবার তিনি তার ফেসবুক অভিশাপ তত্ত্ব নিয়ে প্রশ্ন করবেন।
"এই লঞ্চ ডুবির পর থেকেই যেটা সবচেয়ে আলোচিত হচ্ছে তা হল ফেসবুক অভিশাপ।কোন যাত্রার ঠিক আগ মুহুর্তে যাত্রা নিয়ে ফেসবুকে কোন অশুভ পোস্ট করলেই তা সত্য হয়ে যাচ্ছে।অনেকেই বলছেন আপনার ভাইয়ের ফেসবুক পোস্টটা অভিশপ্ত ছিল। এ ব্যাপারে আপনার অনুভুতি কি?"

ঠাশশ....
হঠাত প্রচন্ড শব্দে চড় কশিয়ে দিলেন মহসিন ভাই।লাইভ টিভিতে মহসিন ভাইয়ের দানবিয় হাতের চড় খেয়ে মনে হল চুন্নী সাহা অনুভূতিহীন হয় পরল।গালে হাত দিয়ে অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে মহসিন ভাইয়ের দিকে।লাইভ টিভিতে নিজ চ্যানেলের দর্শকের সামনে চড় খাবে-এমনটা মনে হয় সে দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি।
"আমার ভাই গত তিনদিন ধরে নিখোজ আর তুই আমার সাথে ফেসবুক অভিশাপ *দাস? আপনার অনুভূতি কি *দাস?"মহসিন ভাই চিতকার করে উঠলেন।
চড় খেয়ে চুন্নী সাহা মাটিতে বসে পড়েছিলেন, ক্যামেরাম্যান তাকে ধরে ওঠালেন।"ম্যাডাম চলেন। পাবলিক খেপতেছে,খারাপ কিছু হওয়ার আগেই চলেন কেটে পড়ি।"

এমনিতেই নদীপারে অনেক মানুষ ছিল, চড়ের শব্দ শুনে উতসাহী লোকের ভীড় আরও বাড়ছে।

চুন্নী সাহা আর তার ক্যামেরাম্যান দ্রুত নিজেদের গাড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আমাকে ক্রস করার সময় শুনলাম ক্যামেরাম্যান নিজের মনে বিড়বিড় করে বলছে,"আগেই ম্যাডামরে বলছিলাম মানুষের অনুভুতি নিয়ে তামাসা না করতে।"

হঠাত পেছনে ভীড় থেকে এক পাটি জুতো উড়ে এল চুন্নী সাহাকে লক্ষ্য করে।ভীড়ের মধ্য থেকে এক অচেনা কন্ঠ জানতে চাইল,"আপনার অনুভুতি কি?"


===========================================


আমার লেখা আরও কিছু গল্পঃ


গল্পঃ যে কারণে ভালবাসি বলা হয় না

গল্পঃ ভালবাসার বৃষ্টি

গল্পঃ প্রিয়তমা, তোমার জন্য... ...

গল্পঃ তোমার বসন্ত দিনে ... ...

গল্পঃ তামাশা

গল্পঃ অতিথি

সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে জানুয়ারি, ২০১৫ রাত ১০:৪৬
২১টি মন্তব্য ২০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান।

লিখেছেন আহা রুবন, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৫০





ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান। আমরা দিন দিন কোথায় যাচ্ছি কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। আপনার দলের লোকজন চাঁদাবাজি-দখলবাজি নিয়ে তো মহাব্যস্ত! সে পুরাতন কথা। কিন্তু নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হচ্ছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। প্রধান উপদেষ্টাকে সাবেক মন্ত্রীর স্ত্রীর খোলা চিঠি!

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:০৩




সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে মুক্তি দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে খোলা চিঠি দিয়েছেন মোশাররফ হোসেনের স্ত্রী আয়েশা সুলতানা। মঙ্গলবার (২৯... ...বাকিটুকু পড়ুন

কেমন হবে জাতীয় পার্টির মহাসমাবেশ ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৫৬


জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিক্ষুব্দ ছাত্র জনতা আগুন দিয়েছে তাতে বুড়ো গরু গুলোর মন খারাপ।বুড়ো গরু হচ্ছে তারা যারা এখনো গণমাধ্যমে ইনিয়ে বিনিয়ে স্বৈরাচারের পক্ষে কথা বলে ,ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়াতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী

লিখেছেন সামিউল ইসলাম বাবু, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১২:১৩

ফিতনার এই জামানায়,
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী খুব প্রয়োজন ..! (পর্ব- ৭৭)

সময়টা যাচ্ছে বেশ কঠিন, নানান রকম ফেতনার জালে ছেয়ে আছে পুরো পৃথিবী। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে গুনাহ মুক্ত রাখা অনেকটাই হাত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×