আরেকবার ঘড়ির দিকে তাকালাম আমি।সকাল ১০.৩০।
মেজাজটা খারাপ হতে শুরু করেছে।মোর্শেদকে বারবার বলে দিয়েছি সকাল ১০টার মধ্যে চলে আসবি, দেরী যেন কোনভাবেই না হয়।ইতিমধ্যেই আধা ঘন্টা বেশি পেরিয়ে গেছে, নবাবজাদার আসার কোন নাম নেই।
মোবাইলটা প্যান্টের পকেট থেকে বের করলাম।নাহ, কোন মিসকল নেই।
মোর্শেদের নম্বর ডায়াল করলাম।এনগেজড।
টুট... টুট... মনে মনে মোর্শেদকে গালি দিলাম।শালা, একেতো লেট, তার ওপর ফোন এনগেজড।নিজেও ফোন দেবে না, কারো ফোন রিসিভও করবে না।
আবার ঘড়ির দিকে তাকালাম। ১০.৩৫।
মোর্শেইদ্দা... মনে মনে আবার টুট টুট চলল।
১৩ ফেব্রুয়ারীর সকাল, পহেলা ফাল্গুন। বসে আছি হাফ ওয়ালে, ক্যাম্পাসে।আমার চারপাশে হলুদ শাড়ি-গাদা ফুল আর সাদা পাঞ্জাবি-জিন্সে গিজগিজ করছে।এদের মাঝে আমিই একমাত্র কুচকানো শার্ট আর পুরনো জিন্স পড়ে বসে আছি।নিজেকে মনে হচ্ছে হাজার হাজার “জাগো” কর্মীর মাঝে একজন পথশিশু!
হঠাত দেখি ক্যাফেটেরিয়া থেকে বেরিয়ে আসছে সেলিম।আরে পাশে এটা কে?
ঐ সেলিম।আমি ডাক দিলাম।
ক্যাফে থেকে বান্ধবীসমেত বেরিয়ে হঠাৎ নিজের নাম শুনে একটু চমকে গেল সেলিম।আমি হাত নাড়লাম। এদিকে।
অবশেষে আমাকে দেখতে পেল সেলিম।মেয়েটিকে কি যেন বলল, তারপর এগিয়ে আসতে লাগল আমার দিকে।
কিরে দোস্ত, কি খবর? সেলিম জানতে চাইল।
কি বললি? আমি ভ্রু নাচালাম।
কাকে কি বলব? সেলিম যেন লুকাতে চাইল।
ঐ ব্যাটা, আমি কি আন্ধা? চোখের দুই পাতা কি একসাথে বান্ধা?
নাহ, বললাম দুই মিনিটে আসতেছি।বল, কেন ডাকছিস?
শালা, সাথে একটা মেয়ে আছে , তাই এত ভাব?কেন ডাকছিস? বন্ধুর সাথে বসে দুইটা মিনিট কথা বলা যায় না? তোকে ডাকার জন্য আমার কারন লাগবে?
এমন আক্রমনে সেলিম অপ্রস্তুত হয়ে না মানে না মানে করতে লাগল।আমি ওকে সুযোগ না দিয়ে বললাম, ডাকছি আমার পাওনা টাকার জন্য। তোর কাছে না আমি দুই হাজার টাকা পাই।মানিব্যাগের স্বাস্থ্য দেখেতো মনে হচ্ছে ভালই টাকা আছে, দিয়ে যা।
সেলিম আমার হাত চেপে ধরল। দোস্ত আজকে পহেলা বসন্তের দিনে ওকে নিয়ে একটু ঘুরতে বের হইছি, আজকের দিনটা অন্তত এমন করিস না।
সেলিমের অবস্থা দেখে আমার হাসি পেল। মেয়েটা সরাসরি তাকাতে পারছে না, কিন্তু একটু পরপর দূর থেকে উকি দিয়ে বোঝার চেষ্ট করছে আমার আর সেলিমের মাঝে ব্যাপারটা আসলে কি।
আমি হেসে বললাম, আরে টেনশন করিস না। ফাজলামি করলাম।টাকা পড়ে দিলেও চলবে।
সেলিম যেন হাফ ছেড়ে বাচল।বাচাইলি।
আমি হাসলাম।
তুই এখানে একা একা কি করস?
মোর্শেইদ্দার জন্য বসে আছি।বদের হাড্ডিটা বলল সকালে বের হবে। ১০টায় টাইম দিলাম, এখনো লাট সাহেবের কোন খবর নাই।
থাকবে কেমনে?হল থেকে বের হওয়ার সময় দেখলাম শালা তখনো লুঙ্গি তুলে ঘুমাচ্ছে।
কি? এখনো ঘুম? মেজাজ সপ্তমে চড়ে গেল।
দশ মিনিট আগে হল থেকে বের হওয়ার সময়তো তাই দেখলাম।
শালারে আজকে দিব ভইরা... হলের দিকে পা বাড়াব, হঠাত যেন সময়টা থমকে দাঁড়াল।ক্যাম্পাসের গেট দিয়ে প্রবেশ করল এক হলুদ শাড়ি। মাথায় গ্রীক দেবিদের মত গাদা ফুলের ক্রাউন, কোমরে গাদা ফুলের বিছা।কোমরে সমুদ্রের ঢেউ তুলে চলতে লাগল সামনের দিকে,আমি আর সেলিম অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম।
এই, কি দেখ তোমরা?
কে রে বাবা এই বেরসিকটা?চোখের সামনে এথিনাকে (এথিনাই কি সৌন্দর্যের দেবী? নাকি অন্য কেউ? এই সুন্দরীর রুপের আগুনেতো আমার বুদ্ধিশুদ্ধি সব ঝলসে গেল।) দেখেও কি সে বুঝতে পারছে না আমরা কি দেখি?
পেছনে ফিরে তাকালাম।সেলিমের গার্লফ্রেন্ড।
আরে আমি আবার কি দেখব? জলদি চল, দেরি হয়ে গেল। সেলিম আর কিছু বলার সুযোগ না মেয়েটাকে নিয়ে বেরিয়ে গেল। পরিচয়টা পর্যন্ত করিয়ে দিল না। সব শালা বেঈমানের দল।
আমি মেয়েটির চলার পথের দিকে চেয়ে রইলাম।
আরে, মেয়েটাতো আমার দিকেই এগিয়ে আসছে।
আমি পেছনে ফিরে তাকালাম। আমার পেছনে কোন স্মার্ট, ড্যাশিং ছেলে দাঁড়িয়ে নেই তো?
নাহ, কেউ নেই। তার মানে আমার দিকেই এগিয়ে আসছে।
মেয়েটা আরেকটু কাছে এল। এইতো চেহারা স্পষ্ট হতে শুরু করেছে।
কেমন আছ? কানের পাশে একটা রিনরিনে কন্ঠ শুনতে পেলাম।
ঠিক এমনই এক কন্ঠ শুনেছিলাম আজ থেকে ছয় বছর আগে।সেই ছিল আমার সর্বনাশের শুরু।
০২.
সময়টা ছিল ২০০৬ সালের এপ্রিল মাস। ১৪ই এপ্রিল, পহেলা বৈশাখ।
সকালে বেরিয়েছিলাম কলেজে প্রোগ্রাম দেখব, ঘুরে বেড়াব, বন্ধুদের সাথে আড্ডা মারব বলে।কিন্তু কলেজের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখে চোখ চোখ দুটো ঢুলু ঢুলু হয়ে পড়া ছাড়া আর কোন অনুভূতি হচ্ছিল না।
হঠাৎ মোর্শেদ বলল, ধুর। এটা প্রোগ্রাম না প্রোগ্রামের মড়া? শুধু শুধু এখানে বসে পেইন খাচ্ছি।তারচেয়ে চল রাস্তা পার হয়ে মহসীন কলেজে যাই। ওদের প্রোগ্রাম আশা করি আমাদের চেয়ে ভাল হবে।
বাকি ছেলেপেলেরা সাথে সাথে বলে উঠল, আসলেই। চল, মহসীনেই যাই। এখানে সময় নষ্ট করার মানেই হয় না।
উল্লেখ্য, আমরা তখন চট্টগ্রাম কলেজে পড়ি। ফার্স্ট ইয়ারে।মাত্র কিছুদিন আগেই এসএসসি পাশ করেছি।এখন “খুব বড় হয়ে গেছি” ভাব নিয়ে প্রতিদিন কলেজে যাই।ক্লাসে যাই আর না যাই, প্রতিদিন গাছ তলায় বসে আমাদের আড্ডা আর মামার দোকানে চা আর সিগারেট চলতে থাকে।
এভাবেই চলছিল জীবন।এরই মাঝে এল পহেলা বৈশাখ ২০০৬, আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়া সেই দিন।
রাস্তা পেরুলেই মুহসীন কলেজ, আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী।
আমরা ভেতরে ঢুকে পড়লাম।
এখানকার অনুষ্ঠানের অবস্থাও তেমন সুবিধার না, দুই মিনিটেই সবাই বিরক্ত।
ঐ, এখন কি করবি? মোর্শেদ জানতে চাইল।
আমি কি বলব? তুইইতো মুহসীনে আসতে চাইলি।
আরে বাবা , ভুল হইছে।এখন কি করবি বল?
সি আর বি যাবি?
ঐখানকার প্রোগ্রাম কেমন হয়?
শুনছি ভাল হয়।
ভালতো ব্যাটা এটাকেও বলছিলি।
আরে ভাই, আমি আগে কখনো যাই নাই, কেবল শুনছি।কোয়ালিটির কোন গ্যারান্টি দিতে পারব না।
তো কি করবি?
তারচেয়ে চল আশেপাশে আমাদের আর পোলাপান আছে কিনা দেখি। সবাই আড্ডা টাড্ডা দিয়ে একসাথে লাঞ্চ করে বাড়ির পথে পাড়ি দেব।
ওকে। ছেলেপেলে রাজি হল।
সবাই ছড়িয়ে পড়লাম।দেখতে লাগলাম বন্ধুরা আর কে কোথায় আছে।আর তখনই শুনলাম সেই রিনরিনে কন্ঠস্বর।কেমন আছ?
আমি পেছন ফিরে তাকালাম। দেখি লালসাদা শাড়ি পরা এক পরী তার চুরি ভর্তি হাত দিয়ে আমার কাধে টোকা দিয়ে বলছে, এই, কেমন আছ?
ক্ষনিকের জন্য সময় যেন সময় গেল।আমি অবাক হয়ে চেয়ে রইলাম।একি মানুষ নাকি স্বর্গলোক থেকে নেমে আসা কোন পরী? আমার চারপাশে ভায়োলিনের শব্দ আর কানে ল৬কেবল বাজতে লাগল, এই, কেমন আছ?
মেয়েটা হাত নেড়ে বলল, তোমার শরীর খারাপ?
আমি কোন রকমে বললাম, না।
মেয়েটা হাসল আর ঠিক তখনই আমি ওকে চিনে ফেললাম।একসময় আমরা ক্লাসমেট ছিলাম। স্কুলে না, কোচিং-এ। আমি পড়তাম কলেজিয়েট-এ ডেশিফটে আর ও ছিল খাস্তগীরে ডে-শিফটে। তবে দুজনেই ছিলাম কোচিং-এ একই শিফটে।ও ছিল ওর ক্লাসের ফার্স্ট আর আমি আমার ক্লাসের। কোচিং-এ ফার্স্ট হওয়ার জন্য দুজনের মাঝে সেকি রেশারেশি। ঝট করে পুরনো অনেক কথা মনে পড়ে গেল।
মায়া। কেমন আছ তুমি?
মায়া হাসল।যাক, চিনতে পেরেছ তাহলে। যেভাবে অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলে, আমিতো ভাবলাম চিনতেই পারছ না আমাকে।
আমিও হাসলাম। না,না। চিনতে কেন পারব না? আসলে এতদিন পর হঠাত তোমাকে এভাবে দেখব সেটা ভাবিনি।
এতদিন কোথায়? দুবছরের কিছু বেশী হবে হয়ত।
তাই নাকি?
হ্যা। আব্বুর ট্রান্সফার হয়েছিল আমরা ক্লাস এইটে থাকার সময়।জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষা দেয়ার পর আমরা সবাই চিটাগাং ছেড়ে চলে যাই আব্বুর কাছে।
ও।তাহলেতো দুই বছরই মনে হয় হবে।তো আবার চট্টগ্রামে তুমি?
আব্বুর আবার ট্রান্সফার হয়েছে।এসএসসির পরই ফিরে এসেছি।
এসএসসির পরপরই? তাহলেতো অনেকদিন হয়ে গেল।
হ্যা, তা ঠিক।
জানালে না কেন? দেখা করতে পারতে?
কি জানাতাম? তোমার একসময়ের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী ফিরে এসেছে।এসো, দেখা করি। বলেই মায়া হাসল।
আমিও হাসলাম। কিসব দিন ছিল।একটা একটা পরীক্ষা হত কোচিং-এ আর কে কার চেয়ে বেশি নম্বর পেল তাই নিয়ে থাকত আমাদের টেনশান।স্যারকে বলতাম, স্যার, এখানে আমার নম্বর বাড়বে, আমিই হায়েস্ট পাব।মায়া বলত, না স্যার, আমিই হায়েস্ট পাইছি।
স্কুল লাইফে আমাদের দুজনের মাঝে কখনো সরাসরি কথাই হয়নি।কেবল স্যারের মাধ্যমে নিজের নম্বএর বাড়ানো আর বলা স্যার ওর এটা ভুল, আমার এটা ঠিক।ওফ কি যেন দিন ছিল।
কি ভাব? মায়া জানতে চাইল।
কিছু না।
তুমি অনেক বদলে গেছ।
তাই নাকি? কিরকম?
এই যে আমিতো ভাবতেই পারতাম না তুমি কোন মেয়ের সাথে সুন্দর করে কথা বলতে পার।অথচ এখন কি সুন্দর করে হেসে হেসে কথা বলছ আমার সাথে।
আমি আবার হাসলাম।
অবশ্য আরেকটা বড় পরিবর্তন তোমার মধ্যে এসেছে।
কি? জানতে চাইলাম আমি।
তোমার ভুড়িটা অনেক কমে গেছে।নাও ইউ আর লুকিং ড্যাশিং এন্ড হ্যান্ডসাম।বলেই হাসল মায়া।
তুমিও অনেক বদলে গেছ।
তাই নাকি?
আমাকে তুমি হ্যান্ডসাম বলছ। এটাতো সূর্য পশ্চিম দিকে ওঠার মতই ব্যাপার।
তাই নাকি? তুমিতো খুব সুন্দর উপমা দাও।
তুমি হয়েই গেছ এত সুন্দর। সুন্দর উপমা না দিয়ে উপায় নেই।
তাই নাকি? ভালই ফ্লার্টিং শিখছ।
ফ্লার্টিং না, সত্য বললাম।
তাই নাকি? তা কেন আমি সুন্দর হলাম?
কি জানি। হয়ত চোখে আর সেই চশমা নেই বলে, হয়ত দুটো ঝুটির বদলে এখন চুল খোলা রাখ বলে।
ওরে বাবারে। পুরাই কবি হয় গেছ দেখি।
ওর সাথে ফ্লার্টিং করতে ভাল লাগছিল।মায়া।
বল।
তুমি এখন মহসীনেই?
হুম।
আর আমি চট্টগ্রাম কলেজে।
আমি জানি। চট্টগ্রামে আসার পর আমি সবার আগে তোমার খবরই নিয়েছিলাম।
আমি অবাক হয়ে গেলাম। আমার খবর?
বাদ দাও সেসব কথা।মায়া বলল। আজকের প্ল্যান কি?
কোন প্ল্যান নাই।
তাহলে চল দুজন মিলে সিআরবিতে যাই। জান, এত বছর চট্টগ্রামে থেকেও আমি কখনো সি আর বি তে যাইনি।
আমরা দুজন?
হ্যা, কোন সমস্যা?
মোটেই না।চল তবে মায়াবতী।
সেই দিনটা আমার জীবনের অন্যতম সেরা দিন ছিল। মায়া নামের দুটো ঝুটি করা, চোখে চশমা পরা এই সিরিয়াস মেয়েটা যে এত প্রানোচ্ছ্বল হতে পারে, এতটা হাসতে পারে-সেদিন ওর সাথে দেখা নাহলে হয়ত আমার অজানাই থেকে যেত।
এখনো যখন পুরনো সেইসব দিনের কথা ভাবি, মনে হয়, হয়ত সামনের দিনগুলোতে আমাদের জন্য এত কান্না অপেক্ষা করছিল বলেই আমরা সেদিন এত প্রান খুলে হাসতে পেরেছিলাম।
০৩.
এরপরের দিনগুলীও কেটে যেতে লাগল চমৎকার ভাবেই।দুজনেই সকালে ক্লাস করতে নিজ নিজ কলেজে যাই, তবে খানিকক্ষন পর দেখা যায় হয় আমি মহসীন কলেজে গিয়ে বসে আছি, নতুবা মায়া এসে পড়েছে আমাদের কলেজে।একে অপরের কলেজে যাতায়াতের সুবাদে পরস্পরের বন্ধুদের সাথে আমরা পরিচিত হলাম, আমাদের ফ্রেন্ড সার্কেলটাও বড় হতে লাগল।
মায়া আর আমি মোটামুটি সবগুলো সাব্জেক্টই একই স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়তে শুরু করলাম।এখন আমাদের কলেজে দেখা হয়ই, আবার দেখা হয় স্যারের বাসায়ও।
তারওপর এল ডিজুস জমানা।রাতে গল্প, খরচ অল্প।সারাদিন একসাথে থাকার পরও রাতের বেলা দুজনের গুজুর গুজুর ফুসুর ফুসুর। এখন মাঝে ভাবি, সারাদিন একসাথে থাকার পরও এত কথা খুজে পেতাম কোথায়?
দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল স্বপ্নের মত।
এরই মাঝে এল ডিসেম্বর মাস। দুজনেরই টেস্ট পরীক্ষা শুরু হল। একসময়ের নিজ নিজ স্কুলের সেরা স্টুডেন্ট বলতে গেলে সারা বছর কোন পড়ালেখাই করিনি, এবার একটু সিরিয়াস হতেই হল।
টেস্ট পরীক্ষা চলে গেল।এরপরেই চলে এল মডেল টেস্টের দিনগুলো।কেউ কেউ ভাইয়াদের কাছে পরীক্ষা দিতে লাগল আর কেউ কেউ কোন কোচিং সেন্টারে। আমি আর মায়াও ঠিক করলাম দুজন একই জায়গায় মডেল টেস্ট দেব।
এরই মধ্যে বাসায় কিছু সমস্যা হয়ে গেল। আম্মু আমার পরিবর্তনগুলো লক্ষ্য করছিল। তার সারাসিন পড়ুয়া ছেলেটা হঠাত করেই বদলে গেছে, কলেজ আর স্যারের বাসার নাম করে সারাদিন বাইরে থাকে আর রাতের বেলা মোবাইলে গুজুর গুজুর ফুসুর ফুসুর আম্মুর চোখ এড়াল না।
এরই মধ্যে টেস্ট পরীক্ষায় রেজাল্টও খুব বেশি ভাল হল না। অপশনাল সহ কোনরকমে টেনেটুনে ফোর পেলাম।এরপর থেকেই আম্মু আমাকে চোখে চোখে রাখা শুরু করল।
মডেল টেস্ট শুরু হয়ে গেল। আম্মু হঠাত করেই নিয়মিত কোচিং সেন্টারে আসা শুরু করলেন।আমাকে পরীক্ষা শুরুর আগে দিয়ে যান, যতক্ষন পরীক্ষা হয় কোচিং সেন্টারের বাইরে অপেক্ষা করেন আর পরীক্ষা শেষে আমাকে বাসায় নিয়ে যান। আবার নিয়মিত বিরতিতে কোচিং সেন্টারের অফিসে গিয়ে খবর নেন পরীক্ষাগুলোতে আমি কেমন করছি।
কোচিং-এ আমাকে নিয়ে হাসাহাসি শুরু হয়ে গেল। এতবড় একটা ছেলে, দুদিন পর এইচ এস সি পরীক্ষা দেবে, তাকে কিনা তার মা কোচিং-এ আনা নেওয়া করে।
তবে সেটা আমার জন্য সমস্যা ছিল না। মানুষের কথায় কান লোক আমি কখনোই ছিলাম না।সমস্যা ছিল আম্মুর কারনে আমি মায়ার সাথে কোনরকম যোগাযোগ করতে পারছিলাম না। আম্মু সারাক্ষন গার্ড দেয় বলে কোচিং-এ ওর সাথে কথা বলা যায় না। টেস্ট পরীক্ষা হয়ে গেছে বলে কলেজেও যাওয়া হয় না।বিশাল পেইন।
এর মধ্যে আম্মু নতুন ফন্দি আটল আমাকে জব্দ করার। আগে আব্বু প্রতি মাসের শুরুতে আমার মোবাইলে ৩০০ টাকা রিচার্জ করে দিত। আম্মুর সুপারিশে হঠাত আমার সারা মাসের মোবাইল বাজেট হয়ে গেল ৫০ টাকা।অনেক গাইগুই করলাম। আম্মু তখন বলল, যদি ৫০ টাকায় না হয় তো আমাকে বলবা। আমার মোবাইল থেকে প্রয়োজনে ফোন করবা। কিন্তু তোমার মোবাইলে ৫০টাকার এক টাকাও বেশি দেয়া হবে না।
বাসায় চিল্লাপাল্লা করেও লাভ হল না।
অবশেষে সুযোগ এল।সেদিন ছিল কোচিং ফি জমা দেওয়ার শেষ দিন।আম্মুর আগে টাকা দিতে মনে ছিল না।আবার সদিন আমাদের এক আত্মীয়ের বিয়ে ছিল। আম্মুকে যেতেই হত। বললাম, আমাকে টাকা দিয়ে দাও। আমিই পরীক্ষার ফি দিয়ে দেব।
আম্মু অনিচ্ছা সত্বেও আমাকে টাকা দিল।
কোচিং-এ গেলাম মনে ব্যাপক ফূর্তি নিয়ে। আজ পরীক্ষা শেষে মায়াকে নিয়ে একটূ ঘুরব।আম্মু দেরী হওয়ার কারন জিজ্ঞেস করলে কিছু একটা অজুহাত দেয়া যাবে। আর হাতেও কিছু টাকা এসেছে।
কিন্তু বিধিবাম।সেদিন আমার আম্মু আসেনি বটে, কিন্তু মায়াকে নিতে এল ওর বড় ভাই। সেদিনও কোন কথা হল না দুজনের মাঝে
শুধু ক্লাস থেকে বেরোবার আগে মায়া হাতে একটা চিরকুট ধরিয়ে দিল।পহেলা ফাল্গুন কোন পরীক্ষা নেই, সেদিন দুজন মিলে দেখা করব।
আমি তখনো জানতাম না এই একটা চিরকুটই আমার জীবন চিরদিনের জন্য বদলে দেবে।
০৪.
চোখ খুললাম প্রচন্ড ব্যাথা নিয়ে।
কোথায় আমি?
চারপাশে তাকালাম।আম্মু একটু দূরে একটা চেয়ারে বসে আছে, তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
আমি উঠে বসার চেষ্টা করলাম।পারলাম না।উফ, ব্যাথা।
আম্মু। আমি ডাকলাম।
কি? আম্মুর এখনো পাথরের মত মুখ করে বসে আছে।
আমরা কোথায়?
হাসপাতালে।
কেন? আমি অবাক।
নিজের এ অবস্থা দেখেও প্রশ্ন করছ কেন?কিছু মনে পড়ছে না?
আমি মনে করার চেষ্টা করলাম। কিছু মনে পড়ল না।সব কেমন যেন ঘোলা ঘোলা লাগছে।
একজন তোমার সাথে দেখা করতে এসেছে।
কে?
ডেকে আনছি।
আম্মু বেরিয়ে গেল রুম থেকে।একটু পর ঢুকল মায়াকে নিয়ে।
পাঁচ মিনিট তোমাদের সময় দিচ্ছি। এরপর আমি আবার আসব। বলেই আম্মু বেরিয়ে গেল।
আম্মুর এমন রুদ্রমূর্তি আমি কখনো দেখিনি।কাহিনী কি?
মায়া বেডের পাশে রাখা চেয়ারটায় বসে পড়ল।আমার হাতটা চেপে ধরে ভেঙ্গে পড়ল কান্নায়।
এই, কাদছ কেন?
সরি।
কেন?
সবকিছুর জন্য।
মানে?
মানে আমি নিজেকে কিছুতেই মাফ করতে পারছি না।আমার জন্যই তোমার এই অবস্থা।
কি বলছ এসব?
হ্যা।
কিভাবে?
তোমার কিছু মনে পড়ছে না?
না।
আবার শব্দ করে কেদে উঠল মায়া।
আরে আশ্চর্য, কাদার কি হল? সব খুলেতো বলবা। নাকি?
মায়া আমাকে যা বলল তা সংক্ষেপে এরকমঃ আমি আর মায়া পহেলা ফাল্গুনে ঘুরতে বেরিয়েছিলাম। দূর্ভাগ্যজঙ্কভাবে মায়ার বড় ভাই আমাদের দুজনকে একসাথে দেখে ফেলেন। এরপর উনার সাথে কথাবার্তার এক পর্যায়ে উনি আর উনার দুই বন্ধু মিলে আমাকে পেটাতে আরম্ভ করেন। মোটামুটি আমাকে মেরে আধমরা করে রাস্তায় ফেলে মায়াকে নিয়ে সেখান থেকে চলে যান।আমি রাস্তায় অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলাম।কয়েকজন পথচারী আমাকে হাসপাতালে এনে ভর্তি করে। গত তিনদিন আমি সংজ্ঞাহীন অবস্থায় ছিলাম।
হোয়াট? এত কিছু হয়ে গেছে?
হ্যা।আমি শুধু তোমাকে সরি বলতে এসেছি।
মানে?
মানে আমাদের আর কখনো দেখা হবে না সাঈদ। ভাল থেকো।
মায়া কাদতে কাদতে বেরিয়ে গেল।সাথে সাথে আম্মু রুমে এসে ঢুকলেন।
আর কিছু জানার আছে তোমার? আম্মু জানতে চাইল।
আম্মু, আমি মায়াকে ভালবাসি।
আর সেই ভালবাসা তোমাকে মৃত্যুর মুখে নিয়ে গিয়েছিল।আম্মু বিরক্ত হয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
এরপরের ঘটনা খুব সংক্ষিপ্ত। মায়ার সাথে আমার আসলেই আর দেখা হয়নি। সুস্থ হতেই আমার মার্চ মাস লেগে গিয়েছিল। মে থেকে এইচ এস সি পরীক্ষা, তাই অন্য পড়াশোনা ছাড়া আমার আর অন্য কোনদিকে তাকানোর সুযোগ ছিল না।এইচ এস সি’র পর শুরু হল বুয়েট ভর্তি কোচিং। প্রচন্ড প্রেশার আর অসুস্থতার দিনগুলোতে আমার পাশে না থাকা- মায়ার ওপর রাগ করে আমিও আর যোগাযোগ করলাম না।
মায়া আমার জীবন থেকে হারিয়ে গেল।
০৫.
পাঁচ বছর পর। ফেব্রুয়ারী মাস, ২০১২ সাল।
এলার্মটা বেজে উঠল।আমি ঝট করে উঠে পরলাম।বিকাল পাচটা।
কি মিয়া, এত সাধের ঘুম থেকে উঠে পরলা?
হুম।টিউশানি।
ধানমন্ডি?
না, বনানী।
ফার্স্ট ইয়ারেরটা নাকি?
নাহ, এবার এস এস সি দেবে।
এটা আবার কবে শুরু করলা?
গত মাসে।
পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে না?
হ্যা।
তাহলে মাত্র দুই মাসের জন্য এই টিউশানি নিলা কেন?
টাকা।
মানে?
ছেলেটা টেস্ট পরীক্ষায় ফেল করছিল। বাপের ভাল টাকা আর পাওয়ার আছে, তাই দিয়ে এস এস সি তে সেন্টাপ করছে।বুয়েটের একটা টিচার চাচ্ছিল, যাতে অন্তত সব বিষয়ে পাশ করে আসে।
আর তুমি সুযোগটা নিলা?
হুম।
কত দিবে দুই মাসে?
পচিশ।
টাকার অঙ্কটা শুনে রুমমেটের চোয়াল ঝুলে গেল। দুই মাসে পচিশ?সত্যি?
হ্যা।এজন্যইতো নিলাম টিউশানিটা।
টাকাপয়সা কিছু দিছে?
হুম।এখন পর্যন্ত দশ পাইছি।
গুড গুড, চালায় যাও।
আচ্ছা।
আমি বেরিয়ে পড়লাম। আজিমপুরে এসেই উঠে পড়লাম ২৭ নম্বরে। ধানমন্ডি, ফার্মগেট আর বনানীর ঐতিহাসিক জ্যাম পেরিয়ে অবশেষে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার সময় এসে পৌছালাম ছাত্রের বাড়ি, টাকার হাড়িতে ।
স্যার।
বল।
আমি পরীক্ষায় পাশ করতে পারব না।
এসব আজেবাজে চিন্তা বাদ দিয়ে ভাল মত পড়।উপপাদ্যগুলা সব মুখস্থ হইছে।
মোটামুটি।
দেখি, তাহলে পীথাগোরাস আর সঞ্চারপথের উপপাদ্য দুইটা লেখা।
স্যার, সঞ্চারপথ আর পীথাগোরাস কখনো একসাথে আসে না। যেকোন একটা আসেনা।
বেশি কথা না বলে লেখ।
ছাত্র লিখতে শুরু করে।আমি পাশে বসে থাকি।
হঠাত করে কানে একটা মিষ্টি হাসির শব্দ আসে।আমি ছাত্রের দিকে তাকাই।
স্যার, আমার কাজিন।বেড়াতে আসছে।
ওউ।
ছাত্র আবার ঘাড় গুজে লিখতে থাকে, আমি পাশে বসে থাকি।অদ্ভূত এক নীরবতা।
কি ব্যাপার? এখনো নাস্তা আসছে না কেন? অন্যান্য দিনতো এই সময়ের মধ্যে নাস্তা চলে আসে।বিকালে কিছু খাওয়া হয়নি, খিদায় মারা যাচ্ছি।
পর্দাটা একটু নড়ে উঠল না। পর্দার কোন দিয়ে দিল ট্রে।
যাক, অবশেষে নাস্তা।
কিন্তু যার হাতে ট্রে ছিল তাকে দেখেই হঠাতই আমার হাসি উবে গেল। মায়া!
০৬.
দুদিন পর।
আরেকবার ঘড়ির দিকে তাকালাম আমি।সকাল ১০.৩০।
মেজাজটা খারাপ হতে শুরু করেছে।মোর্শেদকে বারবার বলে দিয়েছি সকাল ১০টার মধ্যে চলে আসবি, দেরী যেন কোনভাবেই না হয়।ইতিমধ্যেই আধা ঘন্টা বেশি পেরিয়ে গেছে, নবাবজাদার আসার কোন নাম নেই।
হঠাত সেলিমকে দেখতে পেলাম ওর গার্লফ্রেন্ডের সাথে। যতক্ষন মোর্শেদ না আসে, ততক্ষন সেলিম্যাকেই পেইন দেয়া যাক।
ওই সেলিম।আমি ডাকলাম।
বেচারা উপায় না পেয়ে আমার কাছে এল।কিছুক্ষন ওকে পেইন দিয়ে ভালই মজা লুটলাম।
ভাই আমি যাই। মায়া দাড়ায় আছে।
মায়া।
নামটা শুনলেই আজো বুকের মধ্যে কেমন যেন করে ওঠে। মনে হয় আমাদের গল্পটা অন্যরকম হওয়ার কথা ছিল।
সেলিম যাওয়ার জন্য উঠে দাড়াল, আমিও উঠে দাড়ালাম হলের দিকে যাওয়ার জন্য।হলের দিকে পা বাড়াব, হঠাত যেন সময়টা থমকে দাঁড়াল।ক্যাম্পাসের গেট দিয়ে প্রবেশ করল এক হলুদ শাড়ি। মাথায় গ্রীক দেবিদের মত গাদা ফুলের ক্রাউন, কোমরে গাদা ফুলের বিছা।কোমরে সমুদ্রের ঢেউ তুলে চলতে লাগল সামনের দিকে,আমি আর সেলিম অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম।
হাঁটতে হাঁটতে পরীটা এসে দাড়াল আমারই সামনে।তার চুরি ভর্তি হাত দিয়ে আমার কাধে টোকা দিয়ে বলছে, এই, কেমন আছ?
===========================================
গত পরশু গল্পটার প্রথম পর্ব পোস্ট করেছিলাম।ভেবেছিলাম ওটাতে ভাল রেসপন্স পেলে দ্রুত গল্পটা শেষ করে পোস্ট করব। একটু তাড়াহুড়া করেই আজকে দুপুরে এক বসাতেই পুরো গল্প শেষ করলাম। কোনরকম রিভিশন বা এডিটিং ছাড়াই পোস্ট করলাম পুরো গল্পটা। দেখি সবার কেমন লাগে।
ধন্যবাদ
===========================================
আমার লেখা আরও কিছু গল্পঃ
গল্পঃ যে কারণে ভালবাসি বলা হয় না
গল্পঃ ভালবাসার বৃষ্টি
গল্পঃ প্রিয়তমা, তোমার জন্য... ...
গল্পঃ তোমার বসন্ত দিনে ... ...
গল্পঃ তামাশা
গল্পঃ অতিথি
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে আগস্ট, ২০১৬ সকাল ৯:০২