কিশোরী হেনা দোররার শিকার হয়ে মারা গেছে।অবশ্যই একটা বেদনাদায়ক ব্যাপার।এটা মৃত্যু নয়, হত্যাকান্ড। এর বিচার হওয়া প্রয়োজন।অথচ এই ঘটনাকে প্রথম আলো আর কালের কন্ঠ পত্রিকায় দুইভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
প্রথম আলোর খবর
১৪ বছরের কিশোরী হেনা ৭০-৮০টি দোররার আঘাতের পর মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। তার আগে ছোট্ট এই মেয়েটি সয়েছে ধর্ষণের ভয়ংকর শারীরিক-মানসিক যন্ত্রণা। মৃত্যু তাকে হয়তো সব যন্ত্রণা আর এই কুৎসিত সমাজ থেকে মুক্তি দিয়েছে।
হেনার ফুফাতো বোনসহ আত্মীয়রা জানান, শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার চামটা গ্রামের দরিদ্র কৃষক দরবেশ খাঁর মেয়ে হেনা। গত রোববার দিবাগত রাতে মেয়েটি প্রাকৃতিক কাজে ঘরের বাইরে যায়। এ সময় তার দূর সম্পর্কের চাচাতো ভাই মাহাবুব (৪০) তার মুখে কাপড় গুঁজে দিয়ে পাশে তার পরিত্যক্ত একটি ঘরে নিয়ে ধর্ষণ করেন। মেয়েটির চিৎকারে প্রথমে মাহাবুবের স্ত্রী ও ভাই বেরিয়ে আসেন। কিন্তু তাঁরা মেয়েটিকে উল্টো মারধর করেন। একপর্যায়ে হেনার বাবা-মা, ভাই-বোনসহ বাড়ির লোকজন বের হয় এবং মেয়েটিকে উদ্ধার করে। হেনাদের ঘর থেকে মাহাবুবের ঘরের দূরত্ব ২০-২৫ গজ হবে বলে জানিয়েছে স্বজনেরা।
নড়িয়া থানা ও এলাকার সূত্র জানায়, ঘটনা জানাজানি হলে পরের দিন সোমবার চামটা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য ইদ্রিস ফকিরের নেতৃত্বে সালিস বৈঠকের আয়োজন করা হয়। সালিসে উপস্থিত হন চামটা আবুল বাশার মাদ্রাসার শিক্ষক সাইফুল ও গ্রামের মসজিদের ইমাম মফিজ উদ্দিন। ইদ্রিস ফকির, লতিফ মীরমালত, আক্কাস, ইয়াসিন ও জয়নাল মীরমালতের সমন্বয়ে পাঁচ সদস্যের বিচারক বোর্ড গঠন করা হয়। তাঁরা ইমাম ও মাদ্রাসার শিক্ষকের সঙ্গে পরামর্শ করে ধর্ষণকারী ও ধর্ষণের শিকার কিশোরী উভয়কেই দোররা মারার রায় দেন। মাহাবুবকে ২০০ দোররা ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা আর কিশোরী হেনাকে ১০০ দোররা মারার ঘোষণা দেওয়া হয়। কিন্তু ধর্ষকের শাস্তি অর্ধেক কমিয়ে তাৎক্ষণিক সালিসকারীরা তাঁকে ১০০ দোররা মারেন। হেনাকে ৭০-৮০টি দোররা মারার পর সে অচেতন হয়ে মাটিতে পড়ে যায়। স্বজনেরা তাকে উদ্ধার করে নড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করেন। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সোমবার রাতে হেনা মারা যায়।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা গোলাম ফারুক প্রথম আলোকে জানান, সোমবার রাতে জরুরি বিভাগে ভর্তি করার কিছুক্ষণ পরই হেনা মারা যায়।
সালিসকারীরা হেনার মৃতদেহ গ্রামে নিয়ে তড়িঘড়ি দাফনের উদ্যোগ নেন। খবর পেয়ে পুলিশ গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে মরদেহ উদ্ধার করে। পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে ইউপি সদস্য ইদ্রিস ফকির, ধর্ষক মাহাবুব ও সালিসকারীরা পালিয়ে যান। পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ধর্ষক মাহাবুবের স্ত্রী, জয়নাল মীরমালত, আলাবক্স করাতি ও ইমাম মফিজ উদ্দিনকে আটক করে। শরীয়তপুরের পুলিশ সুপার শহিদুর রহমান ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।
হেনার বাবা দরবেশ খাঁ কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমি গরিব হওয়ায় প্রভাবশালীরা আমার মেয়ের সঙ্গে এমন আচরণ করেছেন। এভাবে দোররা মেরে মেয়েটিকে মেরে ফেলা হবে, কখনো ভাবিনি। আমি মেয়ে হত্যার বিচার চাই।’
মাহাবুবের স্ত্রী দাবি করেন, তাঁর স্বামীর সঙ্গে অসামাজিক কাজ করায় গ্রামের মানুষ হেনাকে আটক করে মারধর করে। তিনি সেখানে উপস্থিত হয়ে তাকে মারধর করেছেন।
চামটা ইউপির চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন রাঢ়ী বলেন, ‘ঘটনাটি অত্যন্ত বেদনাদায়ক। ভাবতেই লজ্জা লাগছে। ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত।’
পুলিশের হাতে আটক সালিস বৈঠকে উপস্থিত থাকা আলাবক্স করাতি বলেন, ‘দোররা মারার ফতোয়া আমরা দিইনি। প্রভাবশালী সালিসকারীদের চাপের মুখে এর প্রতিবাদ করতে পারিনি। মেয়েটির এমন পরিণতি হবে বুঝতে পারলে প্রতিবাদ করতাম।’
আটক হওয়া ইমাম মফিজ উদ্দিন বলেন, ‘দোররা মারার রায় ঘোষণা করেছেন বিচারকেরা। উপস্থিত অন্যরা তা বাস্তবায়ন করেছেন। তবে সালিসকারীরা আমাদের সঙ্গে পরামর্শ করেছিলেন। আমরা বলেছি, ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকলে ছেলে ও মেয়ে উভয়কেই শাস্তি পেতে হবে।’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল মামুন গতকাল রাতে জানান, ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের ধরতে পুলিশকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
নড়িয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল খায়ের ফকির গতকাল রাত নয়টার দিকে জানান, হেনার মৃতদেহ উদ্ধার করে সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। এরপর ময়নাতদন্তের জন্য লাশ শরীয়তপুর সদর হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে। মেয়েটির বাবা বাদী হয়ে গ্রেপ্তার হওয়া চারজনসহ ১৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন।
পুলিশ সুপার এ কে এম শহিদুর রহমান প্রথম আলোকে জানান, অন্য আসামিদের গ্রেপ্তারে অভিযান চালানো হবে।
এইখানে মূল খবর
কালের কন্ঠের খবর
শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলায় পরকীয়া প্রেম সংক্রান্ত সালিস বৈঠকে ফতোয়াবাজদের দোররার শিকার এক কিশোরীর মৃত্যু হয়েছে। মৃত কিশোরীর নাম হেনা আক্তার (১৪)। গত সোমবার রাতে নড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। হেনা উপজেলার চামটা ইউনিয়নের চামটা গ্রামের দরবেশ খানের মেয়ে। এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে এক ইমামসহ চারজনকে আটক করেছে নড়িয়া থানার পুলিশ।
হেনার লাশ শরীয়তপুর সদর হাসপাতালে ময়নাতদন্ত শেষে গতকাল মঙ্গলবার পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। গতকাল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন শরীয়তপুরের পুলিশ সুপার এ কে এম শহিদুর রহমান পিপিএম। এ ঘটনায় মামলার প্রস্তুতি চলছে। হেনার সঙ্গে যার পরকীয়া প্রেম ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে, ঘটনার পর থেকে সেই মাহবুব পলাতক।
জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটককৃত ব্যক্তিরা হলেন স্থানীয় মাঝিবাড়ি মসজিদের ইমাম হাফেজ মো. মফিজ, মাহবুবের স্ত্রী শিল্পী আক্তার, স্থানীয় মাতব্বর লতিফ মীর মালত ও আলাবক্স করাতী। এ ছাড়া প্রধান ফতোয়াবাজ সাইদুর রহমান ও প্রধান মাতব্বর ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য ইদ্রিস শেখ পলাতক রয়েছেন।
স্থানীয় সূত্র ও হেনার মামা আশিক জানান, বেশ কিছুদিন ধরে হেনার সঙ্গে তার চাচাতো ভাই মাহবুবের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। মাহবুব চামটা গ্রামের রবিউল খানের ছেলে। তিনি ঢাকায় চাকরি করেন; তাঁর স্ত্রী থাকেন গ্রামে। মাঝেমধ্যে বাড়িতে এসে তিনি হেনার সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কে জড়ান বলে অভিযোগ রয়েছে। গত ২২ জানুয়ারি রাতে মাহবুব বাড়ি এসে হেনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় থাকাকালে তাঁর স্ত্রী শিল্পী তা দেখে ফেলেন। তখন শিল্পীর হৈচৈ ও চিৎকারে আশপাশের লোকজন ছুটে এসে মাহবুব ও হেনাকে ধরে মারধর করে। পরদিন শিল্পী গ্রাম্য মাতব্বরদের কাছে বিচার দেন। গত ২৪ জানুয়ারি চামটা ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য স্থানীয় মাতব্বর ইদ্রিস শেখ, আবদুল হাই মীর মালত, আবদুল মালেক মীর মালতসহ ১৫-২০ জন স্থানীয় মাতব্বর সালিস বিচারে বসেন। সালিসে মাহাবুব ও হেনাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়।
ওই সময় প্রধান মাতব্বর ইদ্রিস শেখ চামটা আলহাজ আবুল বাশার উলুম হাফিজিয়া মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক মো. সাইদুর রহমান ও স্থানীয় মাঝিবাড়ি মসজিদের ইমাম হাফেজ মো. মফিজ উদ্দিনকে ডেকে আনেন। উপস্থিত মাতব্বররা দুই ইমামের কাছে মাহবুব ও হেনার অপরাধের শাস্তি কী জানতে চান। তখন মো. সাইদুর রহমান এই অপরাধের জন্য ১০০ দোররা মারার ঘোষণা দেন। পরে স্থানীয় মাতব্বরদের নির্দেশে মাহবুব ও হেনাকে ১০০ দোররা মারার নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু ১২টি দোররা মারার পর হেনা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে দোররা মারা বন্ধ করা হয়।
এর পরদিন ২৫ জানুয়ারি হেনাকে শরীয়তপুর সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কিন্তু স্থানীয় মাতব্বরদের চাপের মুখে পরদিনই অসুস্থ হেনাকে বাড়ি নিয়ে আসতে বাধ্য হয় তার স্বজনরা। বাড়ি নেওয়ার পর অবস্থার আরো অবনতি হলে সোমবার বিকেলে হেনাকে নড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ওই দিন রাতেই তার মৃত্যু হয়।
নড়িয়া থানার এসআই আসলাম উদ্দিন মোল্লা জানান, সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরির সময় হেনার গালে কামরের চিহ্ন ও শরীরের একাধিক জায়গায় আঘাতের চিহ্ন দেখা গেছে। ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে চারজনকে আটক করা হয়েছে।
অভিযুক্ত ফতোয়াবাজ সাইদুর রহমান বলেন, ‘আমরা ফতোয়া দিইনি। আমাদের ডেকে নিয়ে অবৈধ কাজের মাছালা জিজ্ঞেস করা হয়েছিল। আমরা শুধু অবৈধ সম্পর্কের শাস্তির বিধান কী তা জানিয়েছি।’
জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক হাফেজ মো. মফিজ উদ্দিন বলেন, ‘আমাদের ডেকে মাসালা জানতে চাইলে প্রধান শিক্ষক সাইদুর রহমান অবৈধ সম্পর্কের মাসালা বলেন। পরে স্থানীয় লোকজন মেয়েটিকে ১২ দোররা মারে।’
হেনার বড় ভাই ইকবাল হোসেন বলেন, ‘আমার বোনকে হুজুরদের কথায় স্থানীয় মেম্বার তাঁর লোকজন দিয়ে ১০-১২টি দোররা মারে। শরীয়তপুর সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হলে মাতব্বররা আমাদের চাপ দেয় হেনাকে বাড়ি নিয়ে আসতে। তাদের চাপে বাড়ি নিয়ে আসি। কিন্তু হেনাকে আমরা বাঁচাতে পারিনি।’
চামটা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন বলেন, ‘দোররা মারার ঘটনা আমি শুনেছি। আমি ঢাকায় অবস্থান করছি। এলাকায় যাওয়ার পর বলতে পারব, আসলে কী ঘটনা ঘটেছে।’
নড়িয়া থানার ওসি আবুল খায়ের জানান, ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন পাওয়ার পরই হেনার মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করে বলা যাবে। বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। এ ঘটনায় হেনার বাবা বাদী হয়ে মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
এইখানে মূল খবর
যা দেখে অবাক হয়েছিঃ
** প্রথম আলো যেটিকে ধর্ষণ বলছে তাকে কালের কন্ঠ বলছে পরকীয়া।একই ঘটনাকে দুটো পত্রিকায় ভিন্নভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।ধর্ষণ আর পরকীয়া কখনোই এক নয়।জাতি সত্য জানতে চায়।
**দুটো পত্রিকাই ধর্ষক মাহবুবের ওপর ফোকাস করেনি, করেছে দোররা মারার ওপর।কেন??? কারণ শিরোনাম যদি হয় "ধর্ষক মাহবুবের বিচার চাই" তাহলে পাবলিক খাবে না। অথচ "দোররার আঘাতে কিশোরীর মৃত্যু" শিরোনাম হলে পাবলিক ঠিকই খাবে।
আফসোস।একজনের মৃত্যুর চেয়ে ব্যবসাটাই এখানে বড়।