যেথা রঙধনু ওঠে হেসে, যেথা ফুল ফোটে ভালোবেসে,
সেথা তুমি যাবে মোর সাথে, এই পথ গেছে সেই দেশে!!!
এমন গুনগুন করে যখন সময় কাটছে ট্রেনের অপেক্ষায় ,তখনই ঘোষনা এল রাজশাহীগামী ট্রেনখানি আর কিছুক্ষনের মধ্যেই ষ্টেশনে এসে পৌছুবে ! অন্যান্য যাত্রীদের মত আমি আর আমার ভ্রমণসঙ্গী বন্ধুটিও ব্যাগপত্র পিঠে নিয়ে দৌড় দিলাম নির্দিষ্ট কামরার দিকে । ট্রেন সঠিক সময়ের কিছুটা দেরি করে আসলেও লেট বলতে যা বোঝায় তেমন লেট এবার হয়নি । তাই যাত্রার শুরুতেই মনটা ফুরুফুরে ।
লেখাপড়ার পাশাপাশি ফটোগ্রাফি বিষয়টা খুব বেশি উপভোগ করি এখন । আর এই উপভোগের বিষয়টাকে আরও উপভোগ্য রে তোলার জন্যেই এবারের যাত্রা দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলা রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ । ট্রেনের দুলনীতে চমৎকার একটা ঘুম দিয়েছইলাম হঠৎই বাংলার মধু মাস জ্যৈষ্ঠের মধুময় সুবাস পেয়ে জেগে দেখি পৌঁছে গেছি গন্তব্যে । রাজশাহীতে যে বন্ধুর বাসায় থাকবো সে আমাদের জন্যে আগেই গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছিলো । তারপর সোজা তার বাসায় । পরদিন সকলে শুরু হবে আমাদের মুল মিশন । তাই রাতটাও ঘুমিয়েই পার করলাম ।
খুব সকালে উঠে নাস্তা করে বের হলাম চাঁপাইনবাবগঞ্জের উদ্দেশ্যে । গন্তব্য বাংলাদেশের সব থেকে বড় আমের বাজার । গাছে গাছে ঝুলছে অসংখ্য কাঁচাপাকা আম। হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে গোপালভোগ, সূর্যপুরী, হিমসাগর, বৃন্দাবন, ল্যাংড়া, ফজলি এ জাতীয় অগণিত দেশী-বিদেশী হরেক রকমের আম। ‘চাঁপাইনবাবগঞ্জ’ নামোচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের চোখে এ রকমই একটি ছবি ফুটে ওঠে। তবে চাঁপাইনবাবগঞ্জ কেবল আমেরই জেলা নয়, বরং কাঁসা-পিতল, নকশীকাঁথা ও রেশমের মত ঐতিহ্যবাহী সামগ্রী এবং আলকাপ, গম্ভীরা ও মেয়েলি গীতের মত লোক-উপাদানে সমৃদ্ধ এ অঞ্চল প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে আবহমান বাংলার সবটুকু গৌরব ও প্রাচুর্যের স্মৃতিকে বুকে ধারণ করে আছে।
পথিমধ্যে আমরা সাতসকালে পদ্মাতীরের মানুষের নানা রকম কর্মকান্ডের চিত্রও দেখলাম খুব কাছ থেকে । নানা রঙের নানান রকম মানুষ তাদের এক এক জনের পেশাও আবার আলাদা আলাদা । তবে মূল কেন্দ্র ঐ একটাই পদ্মানদী , যাকে আকড়ে ধরে তাদের এই জীবন যাপন ।
খুব সকালেই গিয়েছিলাম আমরা নদীর ধারে । কারণ তখনও এভাবেই বেশিরভাগ নৌকা গুলা বাঁধা ছিলো পাড়ে ।
কিছু নৌকা অবশ্য ইতিমধ্যেই তার দিনের প্রথম যাত্রার জন্যে তৈরি হয়ে গেছে । নৌকার সামনে দাড়িয়ে মাঝি আরও দু-একজন যাত্রির আশায় এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখছে ।
কেউ এমন মুখে হাত দিয়ে বসে আছে । হয়তো সারা দিনের কর্মব্যস্তার কথা ভেবে আগেভাগেই একটু বিরক্ত কিংবা অন্য কিছু ।
এদিকে একজন কাজে যোগ দেবার আগে নিজেকে একটু গরম করে নিচ্ছে বিড়ি-সিগারেট এর সুখটানে ।
অনেকেই আপন মনে নিজের কাজ করে চলেছে এভাবে । সামনে বর্ষা কাল তাই উনি ব্যাস্ত সময় কাটাচ্ছেন নৌকাটাকে নতুন করে প্রস্তুত করে নেওয়ার জন্যে । কেউ একজন নতুন মানুষ যে তার একটু সামনে থেকে ছবি তুলছে সে দিকে তার তাকানোরও যেন সময় নেই ।
কঠিন হাতের কত নিপুন কারুকার্য । সত্যিই অতুলনীয় । কত সপ্ন বুনে চলেছে এই দুটি সবল হাত ।
এই ব্যাক্তি অবশ্য কিছুটা ভিন্ন । তিনি আমাদের দেখে নানা কথা জানতে চাইলেন । কোথা থেকে এসেছি কি করি এই সব আর কি ।
খানিকটা দুরেই এই লোকটি বসে বসে আমাদের কার্যকলাপ দেখছিলেন ।অনার কাছে জানলাম যে , পদ্মার চরে ভুট্টা চাষ করে সে গুলা ওখানেই মাড়ায় করে এই পারে নিয়ে আসা হচ্ছে । কারণ আজ এখানে "হাটবার "মানে বাজার বসেছে এই গুলা কেন বেচার জন্যে ।
বাজারে অবশ্য আরও অনেক কিছুই বিক্রি করতে দেখা যায় , যেমন এই মাটির তৈরি জিনিসপত্র ।
এরপর আমরা সময় নষ্ট না করে সরাসরি আমের বাজারের দিকে রওনা দিলাম । অবশ্য যাবার পথে একটা বড় ব্রিজের ওপর থেকে কিছু ছবি নিয়েছিলাম নদীমাতৃক বাংলাদেশের ।তার কয়েকটা দেখলে মন্দ হয় না ।
এই ছবিটা তোলার কারণ ঐ একটাই । এক ঘাটে একজন পুরুষ আর একজন মহিলা কিছুটা দুরত্ব বজায় রেখে গোষল করছেন । উপর থেকে দেখতে বিষয়টা বেশ চমকপ্রদ মনে হয়েছিলো তখন ।
এর পরের ছবি গুলো এদেশের চিরায়ত রুপ । নদী নৌকা আর মানুষের অপুর্ব মিলন ।
এদেশের রুপের বর্ননা আসলেই করা কঠিন ।
অবশেষে সেই দেশবিখ্যাত আমের বাজারে পৌছে তো চোখ সবার কপলে উঠে গেল । জীবনে এক সাথে এত আম কোন দিন দেখিনি । শুধু আম আর আম । আমের ছড়াছড়ি । নানা রং এর নানা ঢং এর আম । নাম গুলাও তেমন বাহারী । তবে শুধু আম'ই নয় হাজার হাজার ক্রেতা বিক্রেতার ভিড়ে ঠাসা ২/৩ কি.মি. এলাকা ।
তবে এত বেশি তো দেখাতে পারবো না , তবে তার কিছু অংশ দেখায় আপনাদের ।
পায়কারী খুচরা সব ধরনের ক্রেতা বিক্রেতায় দেখা যায় এখানে । এখান থেকে বড় বড় ট্টাকে করে দেশের নানা প্রান্তে এমনকি বিশেষ প্রক্রিয়ায় এগুলো বিদেশও রপ্তনী হয় ।
কেউ বা আবার তার আম নিয়ে ঠাট্টা-মশকরা করতেও দিধা করে না । এই আম'ই যে তার মহামূল্যবান সম্পদ ।
এই আম'এর বাজার কে কেন্দ্র করে অন্যান্য ব্যাবসাও গড়ে উঠেছে বেশ ভাল ভাবেই , যেমন ছোট ছোট হোটেল ব্যবসা ।
এখানে নানা বয়সের মানুষের কর্মসংস্থানেরও ব্যবস্থা হচ্ছে অনায়াসে ।
এই ছবিতে মুরব্বী চাচার টাকা হাতে তৃপ্তির হাসি দেখলেই বোঝা যায় অনেকটা ।
এরপর আমরা যায় একটু গ্রামের ভেতরে মৃতশিল্পিদের পল্লীতে । যেখানে আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে আজও মৃতশিল্পীরা কাঁদা-মাটি দিয়ে তৈরি করে চলেছেন প্রাচীন বাংলার ঐতিহ্যবাহী মাটির পাত্র ও গৃহস্থালী সরঞ্জাম ।
যদিও এদের সংখ্যা এই আধুনিন সভ্যতার ছোয়ায় কমতে কমতে অনেকটা তলানীতে ঠেকেছে । তবুও অনেকেই বাপ-দাদার ঐতিহ্যকে লালণ করে তাদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছেও রেখে যাচ্ছেন নিজের ইচ্ছেই ।
ছেলে বুড়ো , মেয়ে , বৌ সবাই এরা এই কাজের সাথে অভ্যস্ত ।
কি নিঁখুত তাদের এই কাজ গুলো । চাকা ঘুরছে , উপরে হাতের ছোয়ায় নরম কাঁদা-মাটি গুলো আকার নিচ্ছে এক এক রকমের পাত্রের মত ।
হয়তো সরকার কিংবা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের যথাযথ সহযোগীতা পেলে তারা এই দেশীয় ঐতিহ্যকে যাদুঘরে যাবার আগেই আবার নিজদের সৃষ্টিশীল কর্মের মধ্যমে বাঁচিয়ে রাখতে পারতেন আমাদের পরবর্তী আরও কেয়কটি প্রজন্মের জন্যে ।
আজ এখানেই শেষ করবো ।. কারণ এই ভ্রমনের গল্পের এখনও অনেক কিছুই বাকি যে গুলো দিয়ে আরও এমন দু-তিনটা গল্প লিখা যাবে । যেমন এর পরে আমরা আরও দুই দিন এই অঞ্চলের প্রাচীন ঐতিহ্যগুলো দেখে বেড়িয়েছি , প্রাচীন স্থাপত্ব ও রাজা-রানীদের ভিটেমাটি ।, তাই .. পরবর্তীতে আরও নতুন কোন জায়গার ছবি ও গল্প নিয়ে হাজির হওয়ার আশা নিয়ে আমি আর.এইচ.সুমন আপনাদের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছি ।
ভাল থাকুন , সুস্থ থাকুন , নিরাপদে থাকুন ।