কার্যত তিনি পাকিস্তানের এখনকার প্রজন্মের কাছে অচেনা, আর যাদের মনে থাকার কথা সেই পুরনো লোকদের কাছেও তার স্মৃতি ঝাপসা হয়ে আসার কথা। কিন্তু বাংলাদেশের আবির্ভাবের পর, ১৯৭১ সালের পর রাজা ত্রিদিব রায় পাকিস্তানের কাছে বিশেষ একজন ব্যক্তি ছিলেন বটে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমাদের বংশানুক্রমিক প্রধান ছিলেন ত্রিদিব। ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের দুই সাংসদের মধ্যে একজন, যারা নতুন দেশটিকে অস্বীকার করে পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছিলেন। দু'জনের অপরজন নূরুল আমীন।
পাকিস্তানে ১৬ ডিসেম্বরকে স্মরণ করা হয় 'ঢাকার পতন' হিসেবে। এ রকম এক অনুষ্ঠানে ইসলামাবাদে রাজা ত্রিদিব রায় দ্য হিন্দুকে বলেছেন, জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া এ সিদ্ধান্ত নেওয়ায় তার কোনো অনুতাপ নেই, বাংলাদেশ এখনও তার জনগণের বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক আচরণ করে যাচ্ছে।
পাকিস্তানের রাজধানীতে রায় সাহেবের বাড়ির গেটে ছোট একটি অস্পষ্ট ফলকে লেখা আছে 'চাকমা হাউস'। পত্রপল্লবে ছাওয়া ই-৭ সেক্টরে এই বাড়ি। বংশের পরিচয়সূচক ঢাল এখন সময়ের ফেরে ম্লান। ভেতরে থাকার ঘরে আসবাব সাধারণ। ঘরের দেয়ালে অল্প কিছু ছবি টাঙানো। এর মধ্যে দুটি বাঙালি শিল্পীর আঁকা। তাতে তারিখ দেওয়া নভেম্বর, ১৯৭১। ছবিতে চিত্রায়িত হয়েছে তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের কর্মবিমুখ গ্রাম-জীবনের ছবি।
ত্রিদিব রায় বললেন, '১৯৭১ সালে বিদ্রোহীদের সমর্থন না দিয়ে পাকিস্তানিদের সমর্থন দেওয়ার পেছনে আমার সবচেয়ে বড় যুক্তি ছিল, পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষ বাঙালি নয়। কিন্তু তখনকার পূর্ব পাকিস্তান সরকার ওই অঞ্চল ও আদিবাসী জনগণকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করছিল।'
তিনি বললেন, ১৯৬০ সালে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের মধ্য দিয়ে হাজার হাজার মানুষ চরম দুর্ভোগের মধ্যে পড়েছিল, তারপরও পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষ পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে থাকতেই অধিক নিরাপদ বোধ করছিল।
পরিবর্তিত ভূপ্রকৃতির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি 'আজও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার চিহ্ন স্পষ্ট। ভূমিপুত্ররা নিজেদের ভূমিতেই আজ সংখ্যালঘু।' রায় সাহেব ৩৮ বছর ধরে চাকমা ইস্যু নিয়ে সচেতনভাবে মুখ বন্ধ রেখেছেন। চুপ থাকার কারণও বলেননি। হতে পারে, নতুন বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে তিনি পাকিস্তানকে বিব্রত করতে চাননি।
পাকিস্তানের জন্য তার এই স্পষ্ট ভূমিকার জন্য জুলফিকার আলি ভুট্টো তাকে পুরস্কৃত করেছিলেন। ১৯৭১ সালে গঠিত ১২ সদস্যের মন্ত্রিসভায় তাকে দিয়েছিলেন সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রীর পদ, পর্যটনও ছিল তার এখতিয়ারে।
তিনি কখনোই পাকিস্তান পিপলস পার্টিতে যোগ দেননি এবং এখনও পাকিস্তানের কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য নন। তবু জেনারেল জিয়াউল হক তাকে আর্জেন্টিনায় রাষ্ট্রদূত করে পাঠান। সেখানে নজিরবিহীন ১৫ বছরের কাজ সেরে ১৯৯৬ সালে পাকিস্তানে ফেরেন ত্রিদিব রায়। তখনও মন্ত্রণালয়বিহীন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তিনি।
আগের দিনে জাঁকালো ব্যক্তিগত জীবনের জন্য তার সুনাম ছিল, বাড়িতে পার্টি দিতেন। এখন ৭৬ বছর বয়সে নিজের পূর্ববর্তী জীবনের প্রতিচ্ছায়া হয়ে আছেন। কিছু আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সংবর্ধনা ছাড়া আজকাল রায় সাহেব অনেকটাই নিঃসঙ্গ। তবু এখনও বেশ চটপটে মানুষ তিনি। সাধারণভাবে চলাফেরা করেন। গলফ আর ব্রিজ খেলেন। পাকিস্তানের ছোট বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর সঙ্গে কাজ আর ঘোরাফেরা করেন।
তিনি বলেন, 'আমি চাকমাদের ব্যাপারে সচেতন, কিন্তু কোনো চাকমা রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নই। কোনো গ্রুপের সঙ্গে আমার সম্পর্ক নেই। তারা আমার পরামর্শ চায় না, আমিও কাউকে বলি না কীভাবে তাদের নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করা উচিত।' ৭৬ বছর বয়সী এই বৌদ্ধ বলেন, 'আমার সার্বিক পরামর্শ হলো, নিজের অধিকারের জন্য শান্তিপূর্ণভাবে অবিশ্রাম লড়াই কর। কখনোই সহিংস হইও না, নিজেদের মধ্যে এবং অপরের সঙ্গে খুনোখুনি কর না।'
তিনি কিছুটা সংরক্ত হলেও মনে করেন পাকিস্তানের বদলে বাংলাদেশকে বেছে নিলেও নিজের মানুষের জন্য তিনি কিছুই করতে পারতেন না। তিনি বলেন, 'আমি যদি সেখানে থাকতাম আর সরকারের মর্জি অনুসারে কথা না বলতাম, পক্ষে কথা বলতে পারতাম না আমি। তাহলে পর্দার আড়ালে সরিয়ে দেওয়া হতো। কোনো না কোনো যুদ্ধে আমাকে স্তব্ধ করে দেওয়া হতো। আমি যদি উপহাসের পাত্রে পরিণত হতাম তাহলে সেটা চাকমাদের কী সাহায্য করত?'
রায় সাহেব মানুষের একটি ধারণার সংশোধন করতে চান। অনেকের ধারণা, তিনি পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণের পর ১৬ ডিসেম্বর পালিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি ১১ নভেম্বর যুদ্ধ শুরুর অনেক আগেই পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করেছিলেন। তিনি বলেন, 'পাকিস্তানের সরকার (ইয়াহিয়া খানের নেতৃত্বাধীন) আমাকে বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্য ডাকে। আমার ভূমিকা ছিল আসন্ন যুদ্ধের প্রাক্কালে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায় করা।'
যুদ্ধ শুরু হয় ৩ ডিসেম্বর। তখনও তিনি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে সফরে। তিনি বলেন, ১৬ ডিসেম্বর তিনি ব্যাংককে ছিলেন। পাকিস্তানে ফেরেন ২২ ডিসেম্বর। জুলফিকার আলি ভুট্টো তখন শাসনভার নিয়েছেন। তিনি তাকে মন্ত্রিসভায় যোগ দেওয়ার আহ্বান জানান। ত্রিদিব রায় ১৯৭০ সালের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে একমাত্র স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে পূর্ব পাকিস্তান থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন। আর নূরুল আমীন ছিলেন একমাত্র নন-আওয়ামী লীগার। বৌদ্ধ হিসেবে তিনি ছিলেন পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের একমাত্র অমুসলিম সদস্য।
ভুট্টোর এক সহযোগী ও মন্ত্রিসভায় তার জ্যেষ্ঠ এক সদস্য মুবাশি্বর হাসান তার কথা মনে করতে গিয়ে বলেন, 'তিনি ছিলেন তার মানুষের সমীহ ও শ্রদ্ধার পাত্র। তিনি ও নূরুল আমীনের উপস্থিতির কারণেই আমরা বলতে পারতাম, পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচনী এলাকার প্রতিনিধিবিহীন নই আমরা।'
প্রথমদিকে তাকে ফিরিয়ে নিতে উদ্যোগ নিয়েছিল বাংলাদেশ। ১৯৭২ সালে পাকিস্তানি প্রতিনিধি দলের নেতা হিসেবে নিউইয়র্কে গেলে শেখ মুজিব তার কাছে তার মাকে পাঠিয়েছিলেন, যাতে তিনি তাকে ফিরে আসার জন্য রাজি করাতে পারেন। মায়ের অনুরোধ সত্ত্বেও তিনি ফিরে আসেননি। তিনি ফিরে আসার পর তার এই বিশ্বস্ততার জন্য ভুট্টো ভোজসভার আয়োজন করেছিলেন।
স্ত্রীসহ তার পরিবারের অধিকাংশ সদস্য বাংলাদেশে থেকে গিয়েছিলেন। তিন সন্তান পরে তার কাছে এলেও বড় ছেলে দেবাশিস রায় মা ও বোনদের সঙ্গে থেকে যান। তিনি নতুন চাকমা প্রধান হিসেবে অভিষিক্ত হন। ঢাকায় তিনি একজন ব্যারিস্টার, সম্প্রতি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে ছিলেন তিনি।
রায় সাহেব আর কখনোই রাঙামাটিতে তার বাড়িতে ফেরেননি। এই বছরগুলোতে তিনি বাংলাদেশেও যাননি। বয়স্ক রাজা বলেন, 'অবশ্যই আমি আমার মানুষ, বাড়ি আর সম্প্রদায়কে মনে করি। কিন্তু পরিস্থিতি আর ইতিহাস আমার জীবনে বিশাল এক ভূমিকা পালন করেছে।'
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০১২ বিকাল ৫:৫৬