ছোট শিশুরা শেখার ক্ষেত্রে মনোযোগী ও সক্রিয় হয়। তাদের মধ্যে যদি আগ্রহ তৈরী করা যায় তবে তারা অনেক ভাল অংশগ্রহনকারী হয়। অর জ্ঞান ও ভাষা শেখার কাজে তারা অর্থপূর্ণভাবে অংশ নেয়। ল্য করলে দেখবেন শিশুরা যে ভাষায় কথা বলে কিংবা যে অঙ্গভঙ্গি করে সেটি মূলত বড়দের অনুকরন করে। যে কারনে শিশুদের অর জ্ঞান ও ভাষা শেখানোর কাজে নিয়োজিত প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তিকে অনেক বেশী অভিব্যক্তিময়, সাড়ামূলক ও আনন্দদায়ক ব্যক্তিত্বের অধিকারী হয়।
শিশুকে ভাষা শেখানোর অন্যতম সহজ উপায় হলো গল্প বলা এবং সেই গল্প আবার শিশুর কাছ থেকে শোনা। গবেষনায় দেখা যায় শিশু গল্প শোনা ও গল্প বলার মধ্য দিয়ে অনেক নতুন নতুন শব্দ শিখতে ও ব্যবহার করতে পারে। এমনকি অনেক জটিল বাক্যও তারা এই পক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বলতে শিখে। গুছিয়ে কথা বলতে পারে। মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে।
গল্প আকারে শিশুরা কোন কিছু সবচেয়ে ভাল মনে রাখতে পারে। যে কারনে শিশুদের শিা নিয়ে কর্মরত অনেক বিশেষজ্ঞই শিশুদের পাঠক্রম তৈরীর ক্ষেত্রে গল্প বলা বিষয়টিকে কিংবা গল্পকে প্রাধান্য দিয়ে পাঠক্রম সাজানোকে গুরত্ব দিয়ে থাকেন। গল্প বলা বিষয়টিকে সঠিকভাবে কাজে লাগানো গেলে এর যে আকর্ষন শক্তি তাতে কোন কিছু মনে রাখা, আমোদিত হওয়া,অনুপাণিত হওয়া,সৃজনশীলতা, শেখা ও জানা অনেক সহজ হয়ে যায়।
ছোট শিশুদের অর জ্ঞান ও ভাষা শেখানোর েেত্র উচ্চস্বরে পড়া ও গল্প বলা উভয় পদ্ধতিই খুব কার্যকরী।
কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় আমাদের অধিকাংশ কিন্ডারগার্টেন,সরকারী কিংবা বেসরকারী শিশু শিা প্রতিষ্ঠানে এই বিষয়টিকে গুরত্ব দেয়া হয় না। কোথাও কোথাও পাঠক্রমে গল্প বিষয়টিকে রাখা হলেও গল্প বলার পরিবেশ কিংবা গল্প বলার কৌশল জানা না থাকায় বিষয়টি শিশুদের আকৃষ্ট করতে পারে না। শৈশবে বাড়িতে যৌথপরিবারে দাদাদাদী,নানা-নানী কিংবা অন্যকেউ এবং একক পরিবারে মা-বাবা শিশুকে অনেক ধরনের গল্প শোনায় কিন্তু স্কুলের কাশে গল্প বলার ঘটনা সেভাবে ঘটে না। প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ে (৩-৫) বছর বয়সী শিশুদের ভাষার দতা অর্জনে এটি খুবই গুরত্বপূর্ন। মনে রাখতে হবে গল্প বলা শিশুদের জন্য শুধুমাত্র বিনোদনের মাধ্যম নয়। শিশুরা গল্প শুনতে ও বলতে ভালবাসে এটা তাদের জন্য আনন্দের। আর আনন্দের বিষয়টিকে কাজে লাগিয়ে কাশ রুমে পড়ার সঙ্গে মিলিয়ে শিশুদের যদি মজার মজার গল্প শোনানো যায় এবং সেই গল্পগুলো পুনরায় তাদের কাছ থেকে শোনা যায় তবে অল্প পরিশ্রমেইছোট শিশুদের অর জ্ঞান ও ভাষা শেখানো যায়।
বইয়ে গল্প পড়া আর গল্প শোনা এই দুইয়ের মধ্যে বড় ধরনের পার্থক্য রয়েছে। কেউ যখন গল্প বলে তখন সেটি অনেক বেশী অনানুষ্ঠানিক হয়। বইয়ের পৃষ্ঠায় ছাপানো শব্দের মতো সেগুলো নি¯প্রাণ হয় না। বরং গল্প বলিয়ের ভাষা,অঙ্গভঙ্গি, মুখভঙ্গি ও চোখের ভাষা সবমিলিয়ে পুরো গল্পটি যিনি শোনেন তার কাছে জীবন্ত হয়ে উঠ্ ে। তিনি যেন সবকিছু তার চোখের সামনে ঘটতে দেখেন। এ কারনে গল্প বলা শিশুর ভাষা শেখার েেত্র জোরালো ভূমিকা পালন করে। গল্প বলা শিশুর মৌখিক ও লিখিতভাবে মনের ভাব প্রকাশের মতা বাড়ায়। তার শব্দের ভান্ডার বাড়ে। তখন সে জটিল বাক্যও তৈরী করতে শিখে।
ভাষার কাজ হলো যোগাযোগ ঘটানো। একজন মানুষ অন্য আরেকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে ভাষা ব্যবহার করে। গল্প বলিয়ের ভাষা ব্যবহার ও গল্প দুয়ে মিলে এমন একটি পরিবেশ তৈরী হয় যা শিশু মনকে আন্দোলিত করে। তখন তারা গল্প শোনার পর নিজেরাই সেই গল্পটি বলতে পারে। এভাবে গল্প বলতে গিয়ে দেখা যায় শিশু যে শব্দ ও ভাষা শুনেছে নিজে বলার সময় নিজে থেকে নতুন শব্দ ও বাক্য বিন্যাস করছে। নিজের ভাষায় গল্পটি বলতে গিয়ে ভাষার উপর তাদের দখল তৈরী হয়। গল্প বলা শিশুকে শ্র“তিলিখন ও গল্প লিখতে উৎসাহিত করে।
প্রারম্ভিক শৈশবকালীন বিকাশ নিয়ে যারা কাজ করেন তারা গল্প বলা বিষয়টিকে খুব গুরত্ব দিয়ে থাকেন। ইসিডি শিকগন যখন ছোট ছোট শিশুদের গল্প শোনান তখন গল্পের চরিত্রগুলো এমনভাবে ফুটিয়ে তোলেন যেন তার শ্রোতারা সহজেই বুঝতে পারে। নানা মুখভঙ্গি,অঙ্গভঙ্গি ও ছবি একে তারা গল্পটি এমনভাষায় বলেন যে শিশুরা সহজেই আমোদিত হয়। তারা আগ্রহ নিয়ে শোনে ও নেক সময় প্রশ্ন করে। অর্থাৎ শিশুরা গল্পে পুরোপুরি মিশে যায়। এর মাধ্যমে শিশুদের মাঝে গুছিয়ে কথা বলা ও মনের ভাব প্রকাশ করার সামর্থ্য তৈরী হয়।শিশুদের উপযোগী এবং বারবার বললেও মন ভরে না এমন গল্প শিশুদের বারবার শোনানো যেতে পারে। এ ধরনের গল্প শুনে শিশুরা কান্ত হয় না এবং আগ্রহ হারায় না।
গল্প বলিয়ে শিকের দায়িত্ব হলো শিশুদের মধ্যে মনোযোগ দিয়ে শোনার দতা বাড়ানো। সে সঙ্গে তাদেরকে অংশ নিতে উৎসাহিত করা। কারন গল্প বলা কার্যক্রমে সক্রিয় অংশগ্রহনের মাধ্যমে শিশু দ্রুততার সঙ্গে ভাষা শিখতে পারে।
সঠিক গল্প বাছাই করা সম্ভব হলে গল্পের মাধ্যমে ছোট শিশুকে অনেক কিছুই শেখানো যায়। শিশুর অংশগ্রহন নিশ্চিত করতে এমন গল্প বাছাই করতে হবে যেখানে কিছু শব্দ বা বাক্যের পুনরাবৃত্তি আছ্ ে। এই ধরনের গল্প বলার সময় দেখা যায় পুনরাবৃত্তিমুলক শব্দ বা বাক্য প্রথমবারের পরে যতবার ব্যবহার হচ্ছে শিশুরা নিজ থেকেই সেই শব্দ বা বাক্য বলছে।
গল্প শোনার মাধ্যমে শিশু শব্দ আকারে ভাষা শোনে যা তাকে ভাষা শিখতে আগ্রহী করে তোলে। গল্প শোনা ও গল্প বলার মাধ্যমে তারা গুছিয়ে কথা বলতে কিংবা নিজের ভাষায় একই গল্প শোনাতে পারে। প্রযুক্তির উৎকর্ষতার ফলে এখন কম্পিউটার ও ইন্টানেটের মাধ্যমে শিশুরা গল্প ছবি আকারে দেখতেও পারে। ছবিও শব্দসহ গল্প কম্পিউটার, টেলিভিশনে দেখা আর একজন গল্প বলিয়ের কাছ থেকে শোনার মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে। ইন্টারনেট, কম্পিউটার, টেলিভিশন কোনভাবেই শিশুকে ব্যক্তিগতভাবে গল্পের সঙ্গে মিশিয়ে দিতে পারে না যা একজন দ গল্প বলিয়ে করতে পারেন। তিনি ব্যক্তিগতভাবে শিশুকে গল্পের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে নিতে পারেন। পুরো কাজটি তিনি গল্প বলার মধ্য দিয়ে করেন। যা শিশুর শেখার েেত্র অনেক বেশী শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে।
সক্রিয় শ্রোতা হিসেবে শিশুরা যখন শিকের সঙ্গে মিলেমিশে নিজেও গল্প বানাতে শুরু করে তখন শিশুরা নিজের ভাষায় কথা বলা শুরু করে। এভাবে শিশুদের ভাষাজ্ঞান সমৃদ্ধ হয়। এর পর গল্প বলা শেষে গল্পের আঙ্গিকে যে প্রশ্নগুলো করা হয় শিশুরা স্বতস্ফূর্তভাবে তাতে অংশ নেয়। এ সময়ে সমাজের নানা অংশ থেকে কাশরুমে আগত শিশুরা তাদের নিজেদের মতো করে গল্পের ব্যাখ্যা দেয় এবং গল্পের সঙ্গে নিজের অভিঙ্গতার মিল খুঁজে বের কেরে। এ সময় তারা গল্পটি নিজের মতো করে পুনরায় বলে।
শিকের কাছ থেকে শোনা গল্পটি শিশুরা যখন নিজের ভাষায় পুনরায় বর্ণনা করে তখন শব্দ ও বাক্যের ধারনাগুলো অর্জন করে। একটি ভাললাগা র্গপ যখন শিক ও শিশুরা অনেকবার বলে তখন গল্পের বিষয়বস্তু ও ধারনাগুলো তাদের কাছে অনেক বেশী সুস্পষ্ট হয়ে উঠে। বারবার একই গল্প বললে শিশুদের অংশনেয়ার হারও বাড়ে। এ সময় তারা নিজেদের মতো করে গল্পের কাঠামো, চরিত্র ও বর্ননা বদলায়।
গল্প বলা শিশুদের কল্পনা শক্তি বাড়ায়। গল্প শুনতে শুনতে কিংবা বলতে গিয়ে শিশুরা কল্পনার জগৎ তৈরী করে যেখানকার সবকিছুই তারা দেখতে পায়। এভাবে শিশু প্রথমে গল্প শোনে,এরপর গল্প শুনতে শুনতে গল্প বলায় অংশ নেয় এবং সবশেষে শিশু নিজেই গল্প বলিয়ে হয়।
শিশুরা যখন গল্প বলা শুরু করে তখন যে তারা স্কুলেই গল্প বলতে ভালবাসে তা নয়। তারা বাড়িতে এসেও গল্প বলে। এসময়ে তাদের গল্প বলার চেষ্ঠাকে উৎসাহিত করা গুরক্ষপূর্ণ। আরেকটি বিষয় মনে রাখতে হবে গল্প বলার জন্য শিশুকে কখনো জোর করা যাবে না। সে যা কিছুই করুক না কেন সেটা স্বতস্ফুর্তভাবে করতে দিতে হবে। শিশুরা যখন গল্প বলবে তখন শিক প্রশ্ন করে তাদেরকে উৎসাহিত করতে পারেন। যেমন জিঙ্গাসা করতে পারেন , এরপর কি হলো? কিংবা তারপর তারা কি করলো? গল্প মোতাবেক প্রশ্ন করে গল্পটি শেষ করতে সহায়তা করতে হবে।
গল্প যে সবসময় কাশে একাকী বলা হয় তা নয়। দলগতভাবেও গল্প বলা যেতে পারে। দলগতভাবে গল্প বলার কয়েকটি কৌশল-
ক. একজনে একটি বাক্যঃ শিশুরা গোল হয়ে বসবে। এরপর প্রথম শিশুটি গল্পের এক লাইন বলবে। তারপাশের িিশশুটি প্রথমবলা লাইনটির সাথে মিলিয়ে গল্পের দ্বিতীয় লাইনটি বলবে। এভাবে গল্প এগোতে থাকবে। শেষ শিশুটির বলার মধ্য দিয়ে যদি গল্প শেষ না হয় তবে প্রথমজন আবারো বলবে। এভাবে গল্পটি শেষ না হওয়া পর্যন্ত চলবে। এই পক্রিয়ায় জানা গল্প যেমন বলা যায় তেমনি শিশুরা নতুন গল্পও তৈরী করতে পারে।
খ. বিষয়ভিত্তিক গল্পঃ এই ধরনের গল্পের জন্য প্রথমত সকলে মিলে একটি থিম বা বিষয়কে বেছে নেয়া হয়। যেমন একটি বিষয় হতে পারে দোয়েল পাখি। কিংবা শাপলা ফুল। কিংবা এক দেশে ছিল এক রাজা। ইত্যাদি।
গ. ছবি দেখে গল্প বলা ঃ এ ক্ষেত্রে বই থেকে কিংবা কোনো ছবি দেখে শিশুরা গল্প তৈরী করবে। এ েেত্র তারা কল্পনার মাধ্যমে ছবিটি নিয়ে গল্প বানাবে।
ঘ.গল্পের ঝুড়িঃ এক্ষেত্রে একটি ঝুড়িতে অনেক জিনিস রাখা হয়। শিশূরা চোখ বন্ধ করে একটি করে জিনিস ঝুড়ি থেকে তোলে। এরপর যে জিনিসটি সে ঝুড়ি থেকে তুলল তার ভিত্তিতে একটি গল্প বলবে।
সাধারণত শিশূ প্রথমে শিকের বলা গল্পটি তার মতো হুবহু বলার চেষ্ঠা করে। একসময় দেখা যায় শিশু গল্পের কাঠামো ঠিক রেখে নিজের মতো করে শব্দ ও বাক্য বলছে। এভাবে বলতে বলতে তার মধ্যে যখন আরো বেশী আত্মবিশ্বাস তৈরী হয়। তখন সে নিজ থেকেই গল্প বানাতে শুরু করে। এ সময়ে সে তার পরিচিত জগতের বিষয় নিয়ে ছোট ছোট র্গপ বলে। সে সব গল্পে তার জানা শব্তগুলো ব্যবহার করে। এভাবে তার কল্পনার জগত যত প্রসারিত হয় ততোই সে নতুন নতুন র্গপ তৈরী করে। একপর্যায়ে তারা গল্প শুধু মুখে বলা নয় লিখতেও শুরু করে। এভাবে তারা নিজের তৈরী গল্প অন্যকে শোনায় এবং লিখিত ফরম্যাটে গল্পগুলো পরবর্তীতে বারবার নিজেরা পড়ে। এসময় তার মনে সৃষ্টি করার আনন্দ তৈরী হয়। শিশুরা গল্প লিখেই থেমে যায় না অনেক সময় তারা গল্পের সঙ্গে মিলিয়ে ছবি আঁকে।
একজন উৎসাহী শিক যখন শিশূদের গল্প শোনায় তখন সে নিজেদের অর জ্ঞান ও ভাষা শেখাকে নানাভাবে প্রভাবিত করে।গল্প বলা ও গল্প শোনার মধ্য দিয়ে শিশু নিজেই গল্প বানাতে শুরু করে। একসময় শিশু গল্পের কাঠামো পরিবর্তন করতে শিখে। ভাষা ও শব্দ নিয়ে সে তখন নিজের অজান্তেই নানা ধরনের পরীা নিরিা করে। এভাবে শিশু ভাষা শেখে। তবে কে কতটা শিখবে সেটি নির্দিষ্ট শিশুর বয়স ও মেধার উপর নির্ভর করে। তবে এই পক্রিয়ার মধ্য দিয়ে প্রত্যেক শিশুই কিছু না কিছু শিখতে পারে।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১২ রাত ১১:৫৬