জীবনে কিছু একটা করে খেতে হবে, এমন চিন্তাভাবনা নিম্নবিত্ত ঘরের ছেলেদের বেশ আগেই করে নিতে হয় । কিশোর বয়স থেকে তাই যখন যে কাজ করে পয়সাকড়ি পাওয়া গেছে সেই কাজই আমিন করেছে । হোটেলের বেয়ারাগিরি থেকে শুরু করে সিটি কর্পোরেশনের ক্লিনার হিসেবেও কাজ সে করেছে । এমনি চলছিল, কিন্তু একদিন একটু অন্যরকম ঘটা আরম্ভ করল ।
সেবার আমিন একটি মাঝারি মানের হোটেলের বেয়ারার কাজ করছিল । একদিন সে হোটেলে স্থানীয় এক প্রভাবশালী যুবনেতার আগমন ঘটল । ফুটফরমাস খাটার কাজে আমিনের চটপটে ভাব দেখে নেতা খুশি হলেন ।
“নাম কি?”
“আমিন । ”
“শুধু আমিন? পুরা নাম বল!”
“মোহাম্মদ আল-আমিন ।”
বাহ! ভাল নাম । তা ওয়েটারি করে দিন কেমন চলে?
কোনমতে চলে যায় ভাইজান ।
“বাড়তি কামাইয়ের ইচ্ছা আছে?”
“আছে ।” আস্তে করে বলল আমিন ।
“আচ্ছা এই নাম্বারটা রাখ । আগামী সোমবার ফোন দিয়া আমায়র সাথে দেখা করবি । আর সবাই আমাকে বড়ভাই ডাকে, তুইও তাই ডাকিস । ”
যথাসময়ে ফোন দিয়ে বড়ভাইয়ের সাথে দেখা করতে গেল আমিন । বড়ভাই তার হাতে বেশ কিছু টাকা দিয়ে একটা জায়গায় পাঠালেন । সেখান থকে একটা বক্স তাকে দেয়া হল । নির্দেশমত প্যাকেট নিয়ে বড়ভাইয়ের কাছে পৌঁছে দেয়ার পর তাকে কটা কড়কড়ে বড় নোট দেয়া হল-
“এই নে! পাঁচশ টাকা । বৃহস্পতিবার দিন আবার দেখা করবি । ”
আমিনের বেশ আনন্দ হচ্ছে । সামান্য আসা যাওয়া করে মাসে কয়েক হাজার টাকা আমদানি তো মন্দ না । নতুন কাজটা বেশ মনে ধরল আমিনের । এভাবে তিনদিন পরপর গিয়ে ভালই আয় হতে লাগল আমিনের । খাইখরচার পরও কিছু টাকা বেঁচে যেতে লাগল তার ।
এভাবে টানা কয়েকমাস যাওয়ার পর কেমন যেন খটকামত লাগল আমিনের । ইদানীং ডেলিভারি নিতে যাবার সময় পরিচিত অপরিচিত অনেক লোক তাকে কেমন যেন একটা বাড়তি সমীহ দেখায় । একবার তো প্যাকেট সমেত এক দশাসই চেহারার পুলিশের কাছে ধরা পড়েছিল । দু-চারটা প্রশ্ন করতেই নেতার নাম চলে আসায় আমিন নিশ্চিত হাজতবাস থেকে রক্ষা পেল ।
আমিন বোকা নয়, এতদিনে সে বুঝে গেছে তার সাধের সাইড ইনকামের কাজটা আর যাই হোক, সাধুলোকের নয় । নিজের পেট চালানোর ধান্দায় নেশাখোরের পাল্লায় পড়ে গেছে সে । নিজেকে অনেক বুঝিয়েছে আমিন, কিন্তু শক্তভাবে কাজটা ছেড়ে দেবার সিদ্ধান্তটা নিতে পারছে না সে । ভাবল, কিছু জিনিস এদিক ওদিক করে একটু কামিয়ে নিলে ক্ষতি কি, আমি তো আর করছি না । এমন করেই কাটতে লাগল আমিনের দিন ।
একদিন রাতে বস্তিতে শুয়ে আমিন আকাশ পাতাল ভাবছে । সেদিন কেন জানি তার মৃত বাবার কথা মনে পড়ছে । আচমকা ছোটবেলায় বাবার বলা কিছু কথা মনে পড়ল তার ।
“তোর নাম কি ক দেহি।?”
“মোঃ আল আমিন ।”
“এই নাম অনেক ইজ্জতদার নাম । বুঝছস? জীবনে এমন কিছু করবি না যাতে এই নামের অপমান হয় । বুঝছস আমার কথা?”
“জ্বী, আব্বা ।“
এ কথা মনে হতেই চোখে পানি চলে এল আমিনের । যা হয় হোক, সে এই কাজ থেকে সে ফিরে আসবেই । হোটেলের চাকরিটাও ছেড়ে দিবে ভাবল । হয়ত এই ঝুপড়ি ঘরটাও যাবে, রাস্তায় রাস্তায় হয়ত কাটাতে হবে রাত । ভাবল সে, কিন্তু সে সিদ্ধান্ত পালটাবে না ।
দুমাস পরের কথা । একটি এটিএম বুথে সিকিউরিটি গার্ডের চাকরি পেয়েছে আমিন । যা কামাই হয় তা আগের প্রায় অর্ধেক, তার ওপর মায়ের কাছে টাকা পাঠিয়ে হাতে যা থাকে তা দিয়ে কোনমতে খাওয়ার খরচ হয়, বাকি যা থাকে তা দিয়ে রেললাইনের ধারের ঝুপড়িতেও থাক যাবে না । ডিউটি শেষে এখন আমিন হয় রাস্তায়, নাহলে পার্কের বেঞ্চে ঘুমিয়ে যায় । শীতের জন্য অনেক কষ্ট করে টাকা জমিয়ে একটা কমদামী ব্লেজার কিনেছে আমিন । নাইট ডিউটি না থাকলে রংচটা ব্লেজার পরিহিত আমিন রাস্তার পাশেই ক্লান্ত শরীরে ঘুমিয়ে পড়তে সে যে তৃপ্তি পায় তার মূল্য টাকাতে হয় না । (বিশেষ কৃতজ্ঞতাঃ ব্লগার জাহাজী পোলা ভাই )