খুলনা স্টেশনের বাইরের মলিন অবস্থা দেখে একটু দমেই গিয়েছিলাম প্রথম প্রথম । তিনজনে প্রায় ২০০কেজি+ এক রিকশায় চেপে শহরের শিববাড়ি মোড়ে হোটেল টাইগার গার্ডেনের দিকে যেতে যেতে কিছু বড় বড় বিল্ডিং দেখে স্বস্তি পেলাম । টাঈগাড় গার্ডেনে গিয়ে জানলাম এক রুমে চারজন থাকা যাবে না । আমাদের খুলনা-এক্সপার্ট বন্ধু আগে থেকেই সেখানে ছিল । কাজেই আর কি করা, ডাবল রুমই নিতে হল, তারমানে দুইদিনে প্রায় ১০২০টাকার ধাক্কা । হোটেলে উঠে গোসল করে নিলাম, এরপর একটু ভাল ভাল লাগতে লাগল । দুপুরে বেশ ভাল একটা খাওয়া দিলাম, প্রায় চারশ টাকার চাইনিজ খাওন ছিল । এরপর একটু রেস্ট নিয়ে ৬টার দিকে চিড়িয়াখানা দেখতে বের হলাম । যাওয়ার সময় খুলনা স্টেডিয়াম, মেরিন একাডেমী দেখতে পেলাম কোনভাবে ভিতরে যাইতে পারলে ভাল হত । ফুলবাড়ী মোড়ে নেমে অটো দিয়ে চিড়িয়াখানায় পৌঁছলাম ।
গোধূলীর আলোয় খুলনা নগর
খুলনা চিড়িয়াখানা বেশ ভালই সমৃদ্ধ । আসল বাঘ, চিতাবাঘ, ভাল্লুক, বান্দর, মদনটাক(একটা আবার দর্শকদের দিকে পিঠ দিয়ে ভাব ধরে বসেছিল), খরগোশ, হরিণ, ম্যাকাও, গিনিপিগ সহ আর কিছু জন্তু জানোয়ার ছিল । সবচাইতে আজব ব্যাপার হল, বাঘ আর হরিণের ডেরা একেবারে পাশাপাশি । চিড়িয়াখানাতে বেশিক্ষণ সময় থাকিনাই । একবার দেখা হয়ে গেলেই খুলনা শহরে ফিরে আসলাম ।
মুক্তিযুদ্ধ ভাস্কর্য, শিববাড়ী মোড়, খুলনা
রাতে আরেকটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে বাটার নান আর মুরগীর রোস্ট দিয়ে রাতের খাবার সেরে নিলাম । খরচ হইল প্রায় দুইশ টাকা । এরপরে হোটেলে ফিরে আসলাম । হোটেলে ফিরে কিছুক্ষণ টিভি দেখে নামাজ পড়ে ঘুমিয়ে পড়লাম ।
পরেরদিনের শিডীউলে ছিল বাগেরহাট ভ্রমণ । বাসস্ট্যান্ডে যাওয়ার জন্য অটোতে উঠে খুলনা শহর দেখতে দেখতে গেলাম । একটা মার্কামারা রেস্টুরেন্ট(আলিবাবা রেস্টুরেন্ট) আর এরশাদ শিকদারের বাড়ি “স্বর্ণকমল” দেখা গেল । ৬০টাকা লাগল, বাগেরহাট যেতেও প্রায় বেশ কিছুক্ষণ লাগল কিন্তু পরে দেখলাম দূরত্ব তেমন একটা বেশি ছিল না প্রায় ২৫-৩০ কিলোমিটারের মত হবে । যাই হোক, বাগেরহাট খান জাহান আলী(রহঃ) এর মাজারের সামনে গিয়ে দেখলাম, রোদের ভয়াবহ প্রকোপ । মাজারে ঢুকতে ঢুকতেই গরম জেঁকে ধরল । শুনেছি মিশরের কায়রোতে নাকি দোকানদাররা পথচারীদের ডাকতে ডাকতে কিছু সময় পাশাপাশি হাঁটেও, এখানের অবস্থা সেরকম না হলেও অনেকটা কাছাকাছিই । খাবারের দোকানগুলো, আগরবাতি-মোমবাতির দোকানগুলো থেকে সমানে দোকানদারদের বিরক্তিকর ডাকাডাকি চলছিলো । আর সত্যি কথা বলতে, আমি মাজারকে ঘিরে এই ধরণের ব্যবসা ও মাজারে ইসলামের নামে অদ্ভুত অদ্ভুত রীতি-নীতি পালন একেবারেই পছন্দ করি না । যাই হোক, মাজারের আশেপাশে আমার এতদিনের পরিচিত ইসলামকে দেখতে না পেয়ে একটু অস্বস্তির সাথে মাজারের সময়টা কাটালাম । সবশেষে খান জাহান আলী(রহঃ) এর মাজার জিয়ারত করে বেরিয়ে পড়লাম ।
শুটআউট এট বাগেরহাট
মাজার থেকে বেরিয়ে আমরা বাইরের দোকানগুলোতে জিনিসপত্র দেখতে লাগলাম । আমার প্রথম প্রথম এখানে টাকা খরচ করার কোন ইচ্ছা ছিল । একপর্যায়ে আমার মনে হল, খুলনা যে ঘুরে গেলাম তার কিছু সুভেনির তো রাখা উচিত । এর জন্য, ওর জন্য কিনতে কিনতে দেখি প্রায় সাড়ে তিনশো টাকার মত খরচা হয়ে গেছে । যাই হোক, এরপরে ষাট গম্বুজ মসজিদের দিকে রওয়ানা হয়ে গেলাম ।
ষাট গম্বুজ মসজিদের ওখানে গিয়ে উপলব্ধি হল এতদূর থেকে ছুটে আসা অবশেষে সার্থক হল । নামে ষাট গম্বুজ হলেও আসলে এই মসজিদের গম্বুজ হল ৮১টি, মূল গম্বুজ হল ৭৭টা, মসজিদের ভেতরে পিলারের সংখ্যাও তাই জানি । মসজিদে ঢুকেই আমি ইমাম-মুয়াজ্জিনদের নজর এড়িয়ে পিলার, প্রবেশপথ, দেয়ালের কারুকাজ ইত্যাদির ছবি তুললাম । দেখলাম বেশিরভাগ থাম ইটের আবরণ দিয়ে ঘেরা থাকলেও একটা থামে কোন ধরণের আবরণ ব্যবহার করা হয়নি । এই থাম ষাট গম্বুজ মসজিদের আদি ও আসল ডিজাইনের একটা নিদর্শন হিসেবে রাখা হয়েছে । মসজিদ থেকে বেরিয়ে ঘোড়াদীঘি দেখে বের হলাম । ও হ্যাঁ, আমরা ষাট গম্বুজ মসজিদের মিউজিয়ামও দেখেছিলাম । জাদুঘরটার সংগ্রহ বেশ ভালই । বাংলাদেশে যে এত সুন্দর সুন্দর ঐতিহাসিক মসজিদ আছে তা আবার মনে পড়ল । সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ে পড়লেও ভুলে গিয়েছিলাম । আমাদের দলের দুইজনের বাড়ি কিশোরগঞ্জ, একজনের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জ । এই দুইজায়গার বেশ কয়েকটা মসজিদের ছবি চোখে পড়ল । কিন্তু তারা আগে সেভাবে জানত না এগুলোর কথা । একারণে তাঁদের মাঝে কিছু খোঁচাখুচি হয়ে গেল ।
বিকাল সাড়ে তিনটার দিকে খুলনা শহরে পৌছালাম । পরেরদিন আমাদের খুলনা থেকে চলে যাওয়ার কথা । সেদিন রাতে আর সেভাবে বের হওয়া হয়ে উঠেনাই । রাতে হোটেল রুমে টিভি দেখে অলস সময় কাটালাম । রাতে নাস্তা করে হোটেলে এসে ঘুমিয়ে পড়লাম । তবে আমি একটা জিনিস বুঝতে পারলাম না, এত বিশাল খুলনা শহরের রাস্তা, তারপরও যানবাহন এত কম কেন? জিয়া হলের সামনে বিশাল শিববাড়ি মোড়ের রাস্তাটা অনেকাংশেই খালি থাকে ।
(বাঘ ও হরিণের ছবি বন্ধুর তোলা)
পরেরদিন সকালবেলা উঠে তৈরি হয়ে ১২টার আগেই হোটেল ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম । বাস ছাড়ার কথা হল সন্ধ্যা সাতটার সময়, তারমানে এই সাতঘণ্টা আমাদের খুলনা শহরের চিপায়-চুপায় ঘুরে কাটাতে হবে, তার ওপর আমার সেই হোঁতকা ব্যাগ আর হোঁতকা আকার ধারণ করেছে । হোটেল থেকে বের হয়ে প্রথমে গেলাম খুলনা বিভাগীয় জাদুঘরে । এই জাদুঘরটা যথেষ্ট রিচ, এমাথা থেকে ওমাথা ঘুরতে গেলে অনেক সময় লাগে । তবে এক জিনিস কয়েকবার করে রাখা আছে । নানা আমলের মুদ্রা, কোরআন শরীফ, শিল্পকর্ম, ফলক, কারুকাজ করা ইট পাথর, নানা জিনিস ছিল ।
জাদুঘর থেকে বেরিয়ে অটো দিয়ে খানজাহান আলী রোডের দিকে গেলাম । ওদিকে প্রচুর হেঁটেছি । হাঁটতে হাঁটতে খুব খারাপ লাগছিল, আর খুলনায় বোতলের পানি ছাড়া ভাল পানি পাওয়া পাওয়া মুশকিল । হেঁটে কিছুক্ষণ পর জাতিসংঘ পার্কে গিয়ে তিনমূর্তি কিছুক্ষণ বসে থাকলাম । একটু পর টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়তে লাগল । আমরা অটোতে করে দুপুরের খাবার খেতে “কেইফুং” নামে একটা রেস্টুরেন্টে গেলাম ।
রেস্টুরেন্ট থেকে বেড়িয়ে দেখি আরো চার ঘণ্টা বাকি । এ সময়টুকু কাটাতে বয়রা চলে গেলাম, সেখান থেকে মুজগুন্নীতে । যাওয়ার পথেও সে একই ব্যাপার, অনেক বড় রাস্তা কিন্তু মানুষ কম, চারপাশের অনেক জমি খালি পড়ে আছে কিন্তু বাড়িঘর সেই তুলনায় কম । যাই হোক, মুজগুন্নীতে যেই যায়গায় গিয়েছিলাম সেটা কোন এককালে শিশুপার্ক হিসেবে তৈরি করা হয়েছিল । কিন্তু কালের বিবর্তনে লুল প্রেমিক-প্রেমিকা গোষ্ঠী এই পার্ক আর শিশগু পার্ক রাখেনাই । আমি জীবনে একসাথে এত জুটি দেখিনাই । ক্যামেরা বের করে প্রকৃতির যে দুই একটা ফটো তুলব তার উপায় রাখেনাই । যাই হোক, পার্কের এক নিরাপদ জায়গায় বসে আমরা তিনজন “এলিয়েন” পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করতে লাগলাম । সময় কাটানো বলে কথা ।
বেলা পাঁচটার দিকে বের হলাম সেখান থেকে । বাকি দুজন দিনের আলোয় বাঘ দেখবে বলে চিড়িয়াখানায় যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করল । আমি নিমরাজি থাকা সত্ত্বেও গেলাম দিনের আলোয় সব দেখলাম । আমার এক বন্ধু বাঘ, হরিণের ছবি তুলল । সবশেষে ভ্যানে চড়ে শেষবারের মত খুলনা শহরের সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে শহরে চলে এলাম ।
বিয়ারটিসির বাস যখন ছেড়ে দিল তার একটু পরে খেয়াল করলাম আমি যেই সেকেন্ড হ্যান্ড মোবাইলটা নিয়ে এসেছিলাম(৩০০-৪০০টাকা দাম হবে) সেটা হারিয়ে ফেলেছি । কিন্তু বাসায় ফিরে আসার কথা ভেবে আমার এত ভালো লাগছিল যে তখন আমি এই ব্যাপার তেমন একটা পাত্তাই দেইনি । নয় ঘণ্টার জার্নির পর ভোর সাড়ে চারটার দিকে আমার প্রিয় শহর ময়মনসিং হে এসে পড়লাম । ঘরে ফেরার আনন্দ যে কি, সেটা উপলব্ধি করার জন্য হলেও মাঝে মাঝে ঘুরতে যাওয়া । এ অনুভুতি ভাষায় প্রকাশ করার মত নয় ।
এক ময়মনসিংহনিবাসীর ঢাকা-খুলনা ভ্রমণনামা-১(ঢাকা পর্ব)