চায়ের দোকানটা রাস্তা থেকে একটু উচুতে ,বৃদ্ধ ভদ্রলোকের উঠতে কষ্ট হচ্ছিলো । তিনি আমাকে বললেন বাবা, আমার হাতটা একটু ধরবে ? আমার এক হাতে চায়ের কাপ আর অন্য হাতে জ্বলন্ত সিগারেট । চায়ের কাপটা পাশে রেখে সিগারেটটা ফেলে দিয়ে উনাকে ধরে ধরে বেঞ্চিতে বসালাম । তিনি আমার দিকে তাকিয়ে কৃতজ্ঞতার হাসি দিলেন
আমি দোকানের বিল মিটিয়ে দিয়ে বের হয়ে এলাম । কিছুক্ষন উধভ্রান্তের মতো রাস্তায় এলোমেলো হাটলাম । আমার চোখ থেকে অনেকদিন হলো কোন নোনাজল নির্গত হয় না সেদিন মনে হয় হয়েছিলো ।ভাগ্যভাল নিয়ন আলোয় কেউ লক্ষ্য করেনি ,লক্ষ্য করলে বিরাট লজ্জায় পরতাম ।
অনেকদিন আপনাকে ভুলে ছিলাম । অথবা ইচ্ছে করেই মনে করার চেষ্টা করি না । ইদানিং কেন জানি নিজের অজান্তেই আপনার কথা মনে পড়ে ।পনেরো বছর ,খুব কম সময় না । মানুষের মন খুব বিচিত্র । আপনাকে নিয়ে অনেক উদ্ভট চিন্তা ভাবনা করি মাঝে মাঝে ।
আপনার সাথে এখন আমার সম্পর্ক কেমন হতো,কিভাবে কথা বলতাম আপনার সাথে এইসব ।সম্পর্ক কি খুব সহজ সরল হতো নাকি চিরায়িত বাবা ছেলের অম্লমধুর সম্পর্কের মতন হতো? ।আপনি কি আমাকে খুব বকাবকি করতেন নাকি কিছুই বলতেন না ।
সেদিন আমার একফ্রেন্ড বলছিলো ,তার কক্সবাজার যাবার ব্যাপারে তার বাবার সাথে আজ তার বোঝাপরা আছে, বলেই তার বাবাকে ফোন দিলো ।ফোন দিয়ে বোঝাপরা সারলো ।
আমার রুমমেট মাঝে মাঝে তার বাবার সাথে খুব রাগারগি করে ফোন রেখে দিয়ে নিজেই অনেক্ষন ছটফট করে । বার বার বলে রাগের মাথায় উল্টাপালটা কথা বলে ফেলেছি এখন নিজের কাছেই খারাপ লাগছে বলে তার মাকে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করে , বাবা কি ঘুমিয়ে গেছেন?
আমার এক বন্ধুকে তার বাবা প্রতিদিন ফজরের নামাজের সময় ফোন দিয়ে জাগিয়ে দেন নামাজ পড়ার জন্য ।আমি নিশ্চিত আপনিও এরকম করতেন কিন্তু সুযোগ পেলেন না ।
আমি জানি না আপনি কি করতেন এটা জেনে যে, আপনার ছেলে ফজরের আজান দেয়ার পর ঘুমাতে যায় এখন !?
খুব কষ্ট লাগে এটা ভেবে যে ,আপনার সাথে আমার তেমন কোন স্মৃতি নেই ।আপনার এই অপদার্থ ছেলেটা আপনার মৃত্যুবার্ষিকি কবে ,এটা জানারও প্রয়োজন মনে করে না ।
কিছু আবছা স্মৃতি এখনো মনে পড়ে । আপনার সাদা পাঞ্জাবি ,সাদা টুপি এখনো মনে আছে আর হ্যা আপনার ব্যাক ব্রাশ করা ঘন চুল ।আমিও মাঝে মাঝে ব্যাকব্রাশ করে চুল আচড়াই । আপনি চোখে সুরমা দিতেন ,এটাও মনে আছে এখনও । আমি কিছুদিন যাবৎ ধরে বিভিন্ন জায়গায় সুরমা খুজেছি পাইনি ।
প্রতি সন্ধ্যায় মাগরিবের আজানের পর আপনি জায়নামাজে নামাজ পড়ে বসে বসে জিগির করতেন ,এর মধ্যেই আম্মা চা নাস্তা দিতেন । একেবারে এশার নামাজ শেষ করে আপনি জায়নামাজ ছেড়ে উঠতেন ,আবছা আবছা মনে আছে এখনো ।
হাসপাতালের কথাও আমার মনে আছে । আপনি খেতে পারতেন না দেখে আপনার নাকের ভিতর দিয়ে নল জাতীয় কিছু একটা ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছিলো ,যেটার মাধ্যমে আপনাকে খাবার খাওয়ানো হতো ।একদিন আমাকে বলেছিলেন জীবনে কখনো সিগারেট ধরবি না ,ধরলে আমার মত তোরও একিই অবস্থা হবে ।নাকের ভিতর এরকম নল ঢুকিয়ে খাবার গেলানো হবে । হাস্পাতালের বেডে বসে আমাকে অনেক কথাই বলতেন প্রতিদিন । কথা শেষ করে বলতেন , তুই তো বড় হলে এর কিছুই মনে রাখবি না। তোকে এসব বলে লাভ নাই। মাকেও বলতেন ,তোর পাকনা ছেলের এগুলা কিছুই মনে থাকবে না বড় হলে ।
আপনার ধারনা ঠিকই , আপনার কোন কথাই আমি মনে রাখিনি ,কিছু কথা রাখতে পারিনি ।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে মে, ২০১৬ রাত ২:৩২