একা একা হেটে বেড়াচ্ছি। অবশ্যই ধানমন্ডির অলিতে গলিতে না। হেটে বেড়াচ্ছিলাম গ্রামের পথে। একটা আইলের উওর দিয়ে মাঠ পাড়ি দিচ্ছিলাম। মনে আছে শীতকাল। কুয়াশাচ্ছন্ন সবকিছু। আর কনকনে ঠান্ডা। আকাশে ঝাপসা মেঘ আর চাঁদের কিঞ্চিৎ আলোও ছিল। কিন্তু আমার রাস্তা একেবারে স্বচ্ছ। কোথায় কোন দিকে যাচ্ছি তা আমার জানা। অনেকবার এই পথ দিয়ে দিনের বেলায় যাওয়া আসা করেছি।
আইলের দু'পাশে ধানক্ষেত। খালি। পুরো খা খা করছে। কোথাও কোন লোকজন নেই। আসেপাশে কমপক্ষে কয়েক মাইল অন্ধকার। অথচ আমার রাস্তা স্পষ্ট। এমনি একসময় সামনে আকস্মিক একটা পরিচিত লোকের ডাক শুনে আঁতকে উঠলাম। আমাদের বাড়ির কেয়ার টেকার। এতরাতে তার এখানে থাকার কথা না। আমারও না। এইজন্যই তো ভয়। আমি শহুরে নান্দনিক হতাশা দূর করার জন্য নাহয় রাতে সবার অজান্তে বেড়িয়েছি। তাতে কার কী? এখানে হারানো অত সোজা না। আর সবথেকে বড় কথা এইখানে এই নির্জনতায় ছিনতাইকারীর কোন ভয় নেই।
যাহোক ডাক পেয়ে কাছে যাচ্ছি। লোকটার আবছা দেহ আমার চোখে পড়েছে তখন। এগিয়ে যেতেও লোকটা স্পষ্ট হয়ে এলো। তার হাত পা মুখ সব কিছুই দেখতে লাগলাম। তখনই আমার রক্ত হিম হবার পালা। এ আমাদের কেয়ার টেকার নয়। এই গ্রামের এক পাগল। সারারাত জেগে থাকে। যদিও কোনদিন কারও ক্ষতি করেছে বলে শুনি নাই। কিন্তু লোকটির ইতিহাস ভাল না। তার দুই ছেলেকে কুপিয়ে হত্যা করেছে বলে লোকে বলাবলি করে। তারপর থেকে সে পাগল।
আমি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। এমন সময় লোকটি বলল, "ভয় নাই, আপনাকে মারবো না বা ধরবো না, আমার একটা কাজ করে দিতে হবে"।
লোকটার কথা অনেক সাবলীল। আমি অনায়াসে বলতে পারতাম আমার বাড়ি যেতে হবে, কিন্তু বাঁধ সাধলো লোকটার হাতে চমকে ওঠা রামদা।
বললাম," কী করতে হবে চাচা বলেন"?
-পুকুর দেখা যাইতেছে না?
-জ্বি
-ওখানে নেমে আমাকে দুইটা শাপলা তুলে দেবে বাবা?
-আমি যে সাতার জানি না।
লোকটা আমার দিকে তাকালো যদিও চাদ অনেক আবছা বুঝতে পারলাম সবই। লোকটা একটা লম্বা দির্ঘশ্বাস ফেলে পুকুরে ফুটে থাকা শাপলার দিয়ে অসহায় ভাবে চেয়ে বলল, "আমার রাতে খাওয়ার কিছু নাই"।
তখন আমার বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠে। আমাদের নান্দনিক হতাশার যুগে এ সমস্ত কথা বজ্রপাতের মত মনে হয়। আমাদের যে একটা হৃদয় আছে তা আমরা ভুলে যাই। তখন মনে পড়ে।
আমি আস্তে করে পুকুরের পাড়ে গেলাম। তারপর সিড়ি বেয়ে নেমে পড়লাম পুকুরের পানির আরও কাছে। লোকটা আমাকে বলল, "থাক, তোমার ঠান্ডা লাগবে"।
আমার গায়ে তখন দুইখানা সোয়েটার জাড়ানো। আর পায়ে একখানে উলের স্লিপিং প্যান্ট। আর লোকটার গায়ে কিছু নেই। শুধু একটা লুঙ্গি তাও ছেড়া ক্ষতবিক্ষত। আমি সোয়েটার দু'টো খুলে বললাম, "দাঁড়ান আমি এনে দিচ্ছি"।
ঠান্ডা পানিতে পা রাখতেই সারা শরীর শীতে কুকড়ে উঠে। চোখ খুলি, কিছুক্ষণ চিন্তা করি, তারপর লেপটা ভালো ভাবে টেনে নিয়ে ওপাশ করে চোখ বন্ধ করে আরেকটা স্বপ্নের জন্য অধীর অপেক্ষা করছি। আর গায়ে তখন দুইটা সোয়েটার, একটা উলের প্যান্ট আর লেপ! অনেক ঠান্ডা!
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই আগস্ট, ২০০৮ রাত ১১:৫১