এ বি এম খালেক মজুমদার, পিতা-আব্দুল মজিদ মজুমদার, গ্রাম-দোহাটা, হাজিগঞ্জ, কুমিল্লা। একাত্তরের ঘৃণিত এক পিশাচের নাম। বুদ্ধিজীবি হত্যাকান্ডের মুলহোতাদের একজন এই আলবদর। ১৬ই ডিসেম্বরের পর মুক্তিসেনারা এই দালালের বাসায় অভিযান চালিয়ে বুদ্ধিজীবিদের নামের তালিকা সম্বলিত একটা ডাইরি খুজে পান যার অনেকগুলা নামের পাশে লাল কালিতে ক্রস চিহ্ন দেয়া ছিল তাদের সবাই নিখোজ ছিলেন ঐ সময়ে পরবর্তীতে তাদের হত্যা করা হয়েছে মর্মে নিশ্চিত হওয়া গেছে। অথচ স্বজনেরা আজও প্রতিক্ষায় আছেন তাদের। "এখনও গভীর রাতে দরজায় টকটক শব্দ হলে ছুটে আসেন মা! ডেকে বলেন গেটটা খুল বাবা, দেখ তোর বাবা বোধ হয় এলো।বাবা আর আসেন না। মা জানেন বাবা আর আসবে না তারপরও মানতে পারে না তিনি।বৈধব্যের সাদা শাড়ী তাই পড়েননি হয়তো। কতটা কষ্ট বুকে নিয়ে আমাদের প্রতিদিন এসব দেখে যাওয়া!" শহীদ আজাদের মায়ের কথা মনে পড়ে যায়। ছেলের ফিরে আসার প্রতিক্ষায় মৃত্যুদিন পর্যন্ত অপেক্ষায় ছিলেন তিনি। আগষ্টের ঐ দিনে শেষবারের মতো শহীদ আজাদের জন্য ভাত নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। হায় আজাদ! তার আগেই হারিয়ে গেছে। সে দুঃখে আজাদের মা আর জীবনে কখনো ভাত খান নি। আহা!
আসুন আজ জেনে নেই এই ঘাতকের কৃতকর্মের কিছুটা। দেশমাতৃকার মুক্তির চুড়ান্ত সংগ্রামে কতটা রক্ত আর অশ্রু ঝরিয়েছিল সে। তাতে হয়ত আপনার চোখ ঝাপসা হয়ে আসবে, ঘৃনায় কুচকে যাবে চোখ, শক্ত হয়ে উঠবে মুষ্টিবদ্ধ হাত। মনে হবে ইস যদি একটা রাইফেল পেতাম ছুটে গিয়ে এখনই হত্যা করতাম এই নরপশুটিকে, যে আমার দেশের ৮০ ভাগ মানুষের ধর্ম ইসলামকে টুপি দাড়ী সহকারে বিক্রি করে দিন যাপন করছে। প্রায়ই এমন লাগে আমার। তখন উঠে গিয়ে মুখে পানির ঝাপটা দিই। তারপর প্রতিজ্ঞায় দীপ্ত হই, না আমি তো এর মত পিশাচ নই! কোন পিশাচের রক্তও আমার দেহে বহমান নয়। আমার স্বজনের রক্তে স্বাধীন এ দেশে আমি এই খুনীর বিচার চাই। কোন সহমর্মিতা যেন এ ঘাতকের জন্যে না থাকে। কেবল ঘৃনা প্রাপ্য এর।
---------------------------------------------------------------------
১৯৭১ সালের নভেম্বরের মাঝামাঝিই বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা তৈরি করেছিল আলবদর বাহিনী। এর সদস্যরা বাড়ি বাড়ি চিঠি দিয়ে আগাম ঘোষণা দিয়েছিল মৃত্যুর। তার পর বুদ্ধিজীবীদের একে একে বাড়ি থেকে বের করে আনা হয়েছিল হাত-চোখ বেঁধে।
একাত্তরে আলবদর বাহিনীর সুপরিকল্পিত বুদ্ধিজীবী হত্যার নানা তথ্য উঠে এসেছে প্রামাণ্যচিত্র 'আলবদর : এ কিলিং স্কোয়াড অব পাকিস্তান আর্মি, ১৯৭১ '-এ। উপস্থাপন করা হয়েছে হত্যাযজ্ঞের অকাট্য দলিল। নেওয়া হয়েছে শহীদ বুদ্ধিজীবীর স্বজনদের একান্ত সাক্ষাৎকার।
ছবিতে বলা হয়, আলবদর বাহিনী বুদ্ধিজীবী হত্যার নীল নকশা তৈরি করে একাত্তরের নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে। অবশ্য হত্যাকাণ্ড শুরু হয় অনেক আগেই। এর সুস্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায় ২৩ সেপ্টেম্বরের দৈনিক সংগ্রামে নিজামীর বক্তব্যেই। বুদ্ধিজীবীদের হত্যার প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত দিয়ে তিনি বলেন, 'যারা ইসলামকে ভালোবাসে শুধুমাত্র তারাই পাকিস্তানকে ভালোবাসে। এবারের উদ্ঘাটিত এ সত্যটি যাতে আমাদের রাজনৈতিক বুদ্ধিজীবীরা ভুলে যেতে না পারে সে জন্য সর্বাত্বক প্রচেষ্টা চালাতে হবে।'
বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত বদর বাহিনীর আরো পাঁচ সদস্যের নাম উঠে এসেছে এই প্রামান্যচিত্রটিতে। এদের মধ্যে একজনই হত্যা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত পাঁচ শিক্ষককে। আলবদরের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জেনারেল রাও ফরমান আলীর নোটবুকের একটি পাতায় পাওয়া গেছে ২০ বুদ্ধিজীবীর নাম। সেই তালিকার সবাইকেই হত্যা করা হয়েছে নির্মমভাবে।
এতে এ সংক্রান্ত কিছু দলিলপত্রও উপস্থাপন করা হয়। বলা হয়, ২৩ নভেম্বর '৭১ পাকিস্তান সরকার জরুরি অবস্থা জারি করলে এ বাহিনী তাদের কিলিং মিশনে নেমে পড়ে। এরা ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত বুদ্ধিজীবীদের ঘর থেকে তুলে নিয়ে প্রথমে অমানুষিক অত্যাচার ও পরে হত্যা করে। পুরো অপারেশনে সরাসরি হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার জন্য আলবদরের কমান্ডার এ বি এম খালেক মজুমদার, অপারেশন ইনচার্জ চৌধুরী মুঈনুদ্দীন, হাই কমান্ড সদস্য ও বুদ্ধিজীবী হত্যার প্রধান এক্সিকিউটর আশরাফুজ্জামান খান, সদস্য আবদুল খালেক ও শওকত ইমরানের নামে সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে। এই সময়ে দুটি ঘটনা পুরো ঢাকা শহরে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল। প্রথমত, একটি জিপে জনসভা করা এবং স্বাধীনতাকামী মানুষকে হুমকি দেওয়া, অপরটি ছিল একটি চিঠি যা বেশ কয়েকজন বুদ্ধিজীবীকে দেওয়া হয়। এসব চিঠিতে বুদ্ধিজীবীদের মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত থাকতে বলা হয়।
আলবদর ঘাতকরা এমনি একটি চিঠি দিয়েছিল তৎকালীন দৈনিক ইত্তেফাকের বার্তা সম্পাদক সিরাজুদ্দিন হোসেনকে। পরে ১০ ডিসেম্বর রাত ৩টায় তাঁর বাড়িওয়ালাকে বন্দুক ধরে বাসায় ঢুকে গামছা দিয়ে চোখ বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁকে। এই শহীদ বুদ্ধিজীবীর সন্তান সাংবাদিক শাহীন রেজা নূর বলেন, 'রাইফেলের নলের মুখে সেই যে ধরে নিয়ে গেল, সেই থেকে বাবাকে পাইনি। মিরপুর বা রায়েরবাজারের বধ্যভূমিতেও লাশ খুঁজে পাওয়া যায়নি।'
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর নোটবুক থেকে একটি পাতা ধারণ করা হয়েছে প্রামাণ্যচিত্রে। তাতে মোট ২০ বুদ্ধিজীবীর নাম লেখা রয়েছে। এর মধ্যে ১১ জনই ১৪ ডিসেম্বরের মধ্যেই অপহৃত ও শহীদ হয়েছেন। বাকিরা হয়েছেন পরে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী ছিলেন তাঁদের মধ্যে একজন। তাঁর লাশও খুঁজে পাননি স্বজনরা। শহীদ মুনীর চৌধুরীর ছোট ভাই শমসের চৌধুরী বলেন, 'ওরা ভেতরে ঢুকে বেশ সমীহের সঙ্গেই ভাইকে বলল যে আপনাকে আমাদের সঙ্গে একটু ধানমন্ডি থানায় যেতে হবে। বড় ভাই একটু পেছনে হটে বলল, তোমাদের কথায় তো আমি যেতে পারি না। এ সময় একটি ছেলে ঘুরে এসে বন্দুকটা ওনার পিঠে ধরল। বলল, স্যার চলুন। বড় গেটের সঙ্গে একটা আয়রন গেট খোলা থাকে। সে গেট দিয়ে ভাই চলে যাচ্ছে। সে দৃশ্যটা আমার আজো মনে আছে। যাওয়ার সময় বলল, যাইরে ভাই। আমি বললাম, যা। এই তো। আজো গেল। তার দেহ পাওয়া যায়নি। সে কোথায় আছে, কেমন আছে আমার ভাই, জানি না
রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে একটার পর একটা লাশ খুঁজেও স্বামী শহীদুল্লাহ কায়সারের লাশটি খুঁজে পাননি স্ত্রী পান্না কায়সার। কিন্তু স্বামীকে নিতে আসা ঘাতকদের দলে থাকা এ বি এম খালেক মজমুদারকে চিনে ফেলেছিলেন তিনি। সে ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, 'যখন ওকে (শহীদুল্লাহ কায়সার) অন্ধকার ঘর থেকে টান দিয়ে আমার সঙ্গে বারান্দায় নিয়ে এলো, পেছন থেকে ওর হাতটা ধরে আমিও বারান্দায় গেলাম। গিয়ে তাড়াতাড়ি সুইচটা অন করে দিলাম। সব আলো হয়ে গেল। সবার মুখে মুখোস। আমার ননদ পাশ থেকে দৌড়ে এলো। ও তখন সন্তানসম্ভবা। উপায়ান্তর না পেয়ে একজনের মুখের কাপড়টা টান দিয়ে খুলে ফেলল। সে-ই ছিল খালেক মজুমদার (এ বি এম খালেক মজুমদার)।'
ভোরের কাগজ এ নিয়ে বেশ আগে একটা রিপোর্ট করেছিল,
ইখতিয়ার উদ্দিন : একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের অন্যতম এ বি এম খালেক মজুমদার মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে স্বাধীনতাবিরোধী সাম্প্রদায়িক দল জামাতে ইসলামীর ঢাকা শহর শাখার দপ্তর সম্পাদক ছিলেন। ছিলেন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ঘনিষ্ঠ সহচর। শহীদ সাংবাদিক শহীদুল্লাহ কায়সারের অপহরণকারী হিসেবে অভিযুক্ত হয়েছিলেন এই জল্লাদের দোসর। এই অভিযোগে সাজাও হয়েছিল তার। পরে পঁচাত্তরের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর খালাস পেয়ে যান। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর পালিয়েছিলেন এ বি এম খালেক মজুমদার। [sb]একাত্তরের ২৩ ডিসেম্বর রামপুরার টেলিভিশন কেন্দ্রের কাছাকাছি একটি গোপন আস্তানা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে ছোট কাটারার গেরিলা বাহিনী। তখন জহির রায়হান বেঁচে আছেন। তার উদ্যোগ ও নেতৃত্বে সে সময় কাজ করছে বুদ্ধিজীবী হত্যার তদন্ত কমিটি। তাই খালেক মজুমদারকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হয় শহীদুল্লাহ কায়সারের বাসায়। তার সামনে ডেকে আনা হয় শহীদুল্লাহ কায়সারের স্ত্রী পান্না কায়সারকে। পান্না কায়সারের জবানিতে :
‘ঃ লোকটাকে দেখেই আমি ঝাঁপিয়ে পড়েছি তার ওপর। লোকটার গায়ের শার্টটা ধরে পাগলের মতো টানতে টানতে চিৎকার করে বললাম, হ্যাঁ! এ পিশাচটাই সেদিন ওকে (শহীদুল্লাহ কায়সার) ধরে নিয়ে গিয়েছিল। চিনতে আমার একটুও ভুল হয়নি। তারপর আমি মেঝেতে পড়ে গেলাম।’
খালেক মজুমদারকে শনাক্ত করেছিলেন শহীদুল্লাহ কায়সারের বোন সাহানাও। শহীদুল্লাহ কায়সারকে ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় সাহানা তার সঙ্গে ধস্তাধস্তি করার এক পর্যায়ে খালেক মজুমদারের কালো কাপড়ের মুখোশ খুলে গিয়েছিল। তাই সাহানাও মনে রাখতে পেরেছিলেন তার চেহারা। সেদিন তাকে আইনের হাতে তুলে দেওয়া হয়।
খালেক মজুমদারকে বিচারের সম্মুখীন করা হয়েছিল। আদালতে আবারো শহীদুল্লাহ কায়সারের স্ত্রী, বোন, ভাইয়েরা তাকে শনাক্ত করেন। বিচারে শহীদুল্লাহ কায়সারকে অপহরণ করার দায়ে তার শাস্তি হয় ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড। তারপর ৭৫-এ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে ঘটে যায় রাজনৈতিক পট পরিবর্তন। ক্ষমতায় আসেন জিয়াউর রহমান। ১৯৭৬ সালের ২৯ এপ্রিল হাইকোর্টের এক রায়ে খালেক মজুমদারকে ‘শহীদুল্লাহ কায়সারের অপহরণ মামলার অভিযোগ’ থেকে বেকসুর খালাস দেওয়া হয় বলে জানা যায়।
বুদ্ধিজীবি হত্যার মুল পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নকারীদের অন্যতম খালেক মজুমদার। তার নেতৃত্বেই আলবদর বাহিনীর কিলিং স্কোয়াড তুলে এনেছে একের পর দেশ মাতৃকার সেরা সন্তানদের। শুধু সিরাজউদ্দিন হোসেন, ডঃ মুনীর চৌধুরী, শহীদুল্লাহ কায়সার ই নয় অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহমদ, ড. আবুল খায়ের, এস এম এ রাশীদুল হাসান (ঢাবির ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক), ড. ফয়জুল মহি, ড. সেরাজুল হক খান, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য, ডা. মোহাম্মদ মোর্তজা কে (প্রধান চিকিৎসক, ঢাবি) অপহরন ও হত্যার সাথে এই ঘাতক সরাসরি জড়িত ছিল।
দেশ স্বাধীনের মাত্র দুদিন আগে এই ঘাতকের নেতৃত্বাধীন আলবদর কিলিং স্কোয়াড কেবল ঢাকাতেই কমপক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০ শিক্ষক, পাঁচ প্রখ্যাত সাংবাদিক, দুই সাহিত্যিক ও ২৬ চিকিৎসককে হত্যা করেছে।
চল্লিশ বছর ধরে এ সকল হত্যাকান্ডের বিচারের অপেক্ষায় আছে জাতি। আজ সে সময় সমাগত। চল্লিশ বছর ধরে প্রিয়জনের রক্ত আর অশ্রুর ভারে যে ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছি আমরা তার থেকে কিছুটা হলেও মুক্তির অপেক্ষায় রইলাম।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জুলাই, ২০১০ রাত ১২:১৭