[ছয়]
রাত প্রায় সাড়ে বারোটা। রায়হান সাহেবের আজ একদমই ঘুম আসছে না। এক রকমের ব্যর্থতা আর নিজের উপর চাপা ক্ষোভ তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। কারণটা আর কিছু না। তিনিও যে বাবা হিসেবে মেয়েকে কখনই প্রয়োজনীয় সময়টুকু দিতে পারেন নি। এসব ভাবতে ভাবতেই ধীর পায়ে মেয়ের রুমের দিকে এগিয়ে গেলেন।
- কি ব্যাপার আম্মু? তুমি যে এখনো ঘুমাও নি!
- ঘুম না আসলে আমি কি করব শুনি?
- ওমা সে কি! বেশি রাত জাগলে শরীর খারাপ করবে না? বোকা মেয়ে!
- করুক গিয়ে। তাতে কার কি?
- ওরে বাবা! আচ্ছা আমি স্যরি তো। বুড়ো মানুষের উপর বেশিক্ষণ রাগ করে থাকতে নেই কিন্তু।
- উহু বুড়ো মানুষ মেয়েকে কখনো বকা দেয় না। উল্টো এত্তগুলা আদর করে।
- হা হা হা পাগলী মেয়ে আমার।
- হয়েছে হয়েছে এখন আর আদর দেখিয়ে নিজেকে বুড়ো প্রমান করতে হবে না।
আর হাসি আটকাতে না পেরে এবার বাবা মেয়ে দুজনেই উচ্চস্বরে হেসে উঠল। চলে আসার সময় দরজার সামনে থেকেই কি মনে করে যেন রায়হান সাহেব আবারো পিছু ফিরে তাকালেন।
- আচ্ছা আমার লক্ষ্মী মায়ের এবার মনে হয় কোন গিফট লাগবে না তাই না!!
- লাগবে না মানেনেনেনে!!!!
- ওহ তাই? আমি তো আরও ভেবেছিলাম লাগবে না। আচ্ছা তাহলে কাল সকাল সকাল রেডি থেকো কেমন? তোমাকে নিয়ে এক জায়গায় ঘুরতে যাব।
- সত্যি??? এইতো আমার গুড বয় আব্বু। ওকে বাবা গুড নাইট।
- হুম। গুড নাইট।
[সাত]
সকাল সকাল নাস্তা সেরেই বাবা মেয়ে রওয়ানা হল। নাহ আজকে বিএমডব্লিউ/ মার্সিডিজ কোনটাই সাথে না বরং গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা রিক্সাটাতেই গিয়ে চড়ে বসলেন রায়হান সাহেব। এতে আদ্রিতা যার পর নাই অবাক কিন্তু এবার কিছুই না বলে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে একটা মিচকা হাসি দিল। পথে একবার রিক্সা থামিয়ে রায়হান সাহেব কি যেন কিনলেন তবে আদ্রিতার সেদিকে কোন খেয়াল নেই।
- আরে আরে আব্বু তুমি এটা কোথায় রিক্সা থামালে?
- বলতো এটা কোথায় আমরা??
- কোথায় আবার কারওয়ান বাজার বস্তিতে! ছিঃ কি পচা গন্ধ!!
- ছি মা এইভাবে বলে না। আমার পিছন পিছন আসো তো।
- হু আসছি। কিন্তু তুমি কাজটা ঠিক করলে না এটা। আগে জানলে আমি জীবনেও আসতাম না এখানে।
নাকে হাত দিয়ে রায়হান সাহেবের পিছু পিছু হাঁটছে আদ্রিতা। ইশ কি অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ! ভাবতেই তার বমি আসছে। কিন্তু পরক্ষনেই মাথার ভিতরে প্রশ্নেরা এসে ভিড় করতে শুরু করল। ভেতরকার আদ্রিতা যেন এবার জেগে উঠল। আচ্ছা আদ্রিতা বলতে পার, একটু ভারি বৃষ্টি হলে এখানকার মানুষগুলো কিভাবে দিনাতিপাত করে? কিভাবে ৮ ফুট বাই ১০ ফুটের ছোট্ট ঝুপড়ি ঘরে একই পরিবারের পাঁচ থেকে সাত জন মানুষ বাস করে? অথবা এইযে বিভিন্ন বয়সের বাচ্চাগুলো দেখছ তারা কি আদৌ কোন স্কুলে যায়? আচ্ছা স্কুলের কথা বাদই দিলাম বলতো তারা এত ম্যালনিউট্রিশনে কেন ভুগছে?? এরকম হাজারটা প্রশ্ন আদ্রিতার নিঃশ্বাসকে ক্রমেই দীর্ঘায়িত করে তুলছে।
এগুলো ভাবার মাঝেই হঠাত অবাক হয়ে সে নিজেকে আবিষ্কার করে পাতলা নীল পলিথিনে ঘেরা ওইরকম একটি ঝুপড়িতে। হ্যাঁ ঠিক ঐ পলিথিনগুলো... যেগুলো আমরা সচরাচর রিক্সার পর্দা হিসেবে ব্যবহার হতে দেখি! সামনেই তার বাবার পাশে এক বৃদ্ধা দাঁড়িয়ে। আদ্রিতা আরও অবাক হয়ে লক্ষ্য করল তার বাবা ঐ বৃদ্ধা মহিলাটিকে মা মা বলতে বলতে পা ছুঁয়ে সালাম করছে!! সে কি বলবে ঠিক বুঝতে পারছে না। তার কিছু বুঝে উঠার আগেই রায়হান সাহেব বলে উঠলেন,
- আম্মু তোমার দিদাকে সালাম কর তো।
- আদ্রিতা সালাম করতে যাবে তখনই উনি তাকে থামিয়ে দিয়ে, থাক থাক... মায়া তুমি বাইচ্চা থাক।
- (রায়হান সাহেব হাতে কিছু একটার প্যাকেট দিয়ে) মা এটা ভিতরে রাখেন। আর আপনি একদম ব্যস্ত হবেন না যেন।
- কি যে কয় পোলায়। আমার নাতিন এই পয়লা আমার বাড়িত আয়সে আর আমি তারে কিচ্চু খাওয়ামু না??
বলতে বলতে দ্রুত পায়ে হেঁটে গেলেন। সাথে সাথেই শুরু হল আদ্রিতার জিজ্ঞাসা। 'আচ্ছা বাবা উনি কে? তুমি না বলেছিলে দিদা অনেক আগেই চলে গেছেন' উত্তরে রায়হান সাহেব... ঠিক কোথা থেকে শুরু করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। কিন্তু এটাই যে সঠিক সময়! আজ মেয়েকে তার সব কিছু খুলে বলতেই হবে।
...আসলে মা জানতো, জন্মসুত্রে মা তো মা ই। উনার কোন তুলনা হয় না। কিন্তু জন্ম দেয়া ছাড়াও কেউ কেউ মা হতে পারেন। মহান সৃষ্টিকর্তা উনাদেরকে সেই বিশেষ সম্মান দিয়েই দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন। তোমাকে একদিন বলেছিলাম না, আমাদের প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর দুধমা ছিলেন শ্রদ্ধেয় মা হালিমা? যিনি নবী কারিম (সাঃ) কে সেই ছোটকাল থেকে মায়ের আদর ভালবাসা দিয়ে বড় করেছেন।
এবার আসি আমার ঘটনায়। আমি তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি। এই বস্তির পাশের রেললাইন পার হয়েই আমাকে স্কুলে যেতে হত। বাসার কাছে তাই হেঁটেই বন্ধুদের সাথে যাওয়া আসা করতাম। একদিন আমাদের ম্যাথ টিচার বাঘা বাচ্চু স্যারের কাছে মার খেয়ে অনেক মন খারাপ করে একা একা বাড়ি ফিরছিলাম। বিশ্বাস কর আম্মু... সেদিন আমার কি হয়েছিল আমি জানি না। কি মনে করে রেললাইন ধরে হাঁটা শুরু করে দিলাম। কখন যে পিছন থেকে ট্রেন আসছিল সেদিকে আমার কোন খেয়ালই ছিল না। একদম শেষ মুহূর্তে কেউ একজন আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল। আমি ছিটকে কয়েক হাত দূরে গিয়ে পড়লাম। সাথে সাথেই অনেক মানুষজন জমা হয়ে গেল। আমি একটু স্থির হওয়ার পর লক্ষ্য করলাম ওইপাশে একজন মহিলা পড়ে কাতরাচ্ছেন। খুব বাজেভাবে আহত হয়েছিলেন। একটি পা কেটে ফেলে দিতে হয়েছিল। উনি আর কেউ নন, আজকের এই মহিলাটি। তোমার দাদাজানই সব ট্রিটমেন্ট করিয়েছিলেন। একটি কৃত্রিম পা ও লাগানো হয়েছিল। তুমি নিশ্চই খেয়াল করেছ উনি একটু খুঁড়িয়ে হাঁটছিলেন। সেদিনের পর থেকেই আমি উনাকে মা ডাকি আর একটু সময় পেলেই উনার কাছে ছুটে আসি। কিন্তু জান আম্মু আমার মনের ভিতর সব সময় একটা কষ্ট আর তোমার দাদাজানের উপর এক রকম চাপা অভিমান কাজ করে। সেদিন অনেক রিকুয়েস্ট করেছিলাম যেন উনাকে আমাদের বাসায় নিয়ে আসে। অনেক কেঁদেছিলাম ও। কিন্তু জানি না ঠিক কি কারনে তোমার দাদাজানকে কোন ভাবেই রাজি করাতে পারলাম না! তারপর স্টাব্লিশ হয়ে বিয়ে করলাম... তোমার দাদাজান চলে গেলেন... তুমিও আস্তে আস্তে বড় হতে শুরু করলে তখন সবকিছু অন্যরকম হয়ে গেল। জানো তোমার মাকে আজও আমি এর কিছুই বলিনি। দেশের বাইরে ভিন্ন কালচারে বড় হয়েছে বিষয়টা ঠিক কিভাবে নিবে বুঝতে পারিনি। আর তুমিও যেভাবে বেড়ে উঠছিলে তাতে কখনই তোমাদের সাথে শেয়ার করার মত ভরসাটুকু আমি পাইনি। তোমরা জান আমি প্রতিদিন জগিং এ বের হই। কিন্তু আমি আসলে ছুটে আসি আমার এই মায়ের কাছে। যার জন্য আমি আজও বেঁচে আছি... প্রতিদিন উনার মুখখানা না দেখে আমি কিছুই মুখে দেই না। বলতে বলতেই খেয়াল করলেন আদ্রিতা ফুঁপিয়ে কাঁদছে!
- আরে আম্মু তুমি কাঁদছ কেন??
- তুমি আমার সাথে একদম কথা বলবে না।
- দেখ দেখি পাগলী মেয়ের কান্ড!
- আমি কি এতই পচা মেয়ে হয়ে গেছি যে তুমি আমাকে এতদিন এর কিছুই বললে না!
- আরে বোকা মেয়ে তুমি পচা হতে যাবে কেন হুম? তুমি তো আমার লক্ষ্মী আম্মু। কাঁদে না মা। আচ্ছা এইযে বাবা সরি বলছে।
- তুমিও তো কাঁদছ! দেখি এদিকে আস চোখ মুছে দেই।
বাবা মেয়ের কথার মাঝেই একটা বাটিতে এতোগুলা লাড্ডু আর চিঁড়ার নাড়ু নিয়ে প্রবেশ করলেন সেই মহীয়সী নারী। রায়হান সাহেব এগিয়ে এসে হাত ধরে উনাকে চৌকিতে বসালেন। মা নিজের হাতে তার ছেলেকে মুখে তুলে খাইয়ে দিচ্ছেন।
- কি দাদি... খালি তোমার ছেলেকেই খাওয়াবে? আমাকে দিবে না?? আচ্ছা আমি রাগ করছি!
- পাগল মাইয়া কি কয়? নে নে জলদি হা কর...
- শোন দাদি, তোমার ঘটি বাটি সব এক্ষনি ব্যাগে ভর (খেতে খেতে আদ্রিতা)
- কেন রে মায়া??
- কোন কথা বলবা না। আমি তোমারে নিতে আসছি।
- কই যামু আমি... আমি এই বাড়ি ছাইড়া কোথাও যাইতে পারুম নারে মায়া। আমার মেলা কাম।
- আমি অতশত বুঝি না। আচ্ছা যাও আজকের জন্য তোমাকে মাফ করলাম। তোমার সব কাজ শেষ করে সব গুছিয়ে রাখ। আমি কাল শুক্রবার এসেই তোমাকে নিয়ে যাব।
- এইবার দেখব কিভাবে না এসে থাকেন। পড়েছেন আসল বাঘিনীর পাল্লায় (হাসতে হাসতে রায়হান সাহেব)
- হুহ দেখতে হবে না আমি কার মেয়ে??? বাবার মেয়ে আদ্রিতা হি হি হি। তাইনা বাবা?
- হা হা হা হয়েছে হয়েছে। চল মা এইবার উঠা যাক। তোমার দাদির সাথে তো কাল দেখা হচ্ছেই।
সারারাত ঘুম হয়নি আদ্রিতার। এক রকম উত্তেজনা আর দাদিকে নিয়ে হাজারো প্ল্যানে তার মাথা খারাপ হয়ে যাবার অবস্থা। এদিকে রায়হান সাহেবের অনেকদিন পর খুব ভাল একটা ঘুম হয়েছে। আহ... শেষবার কবে এরকম ঘুমিয়েছিলেন ঠিক মনে করতে পারছেন না। কিন্তু আদ্রিতা আর ঘুমাতে দিল কই? সকাল সকাল বাবাকে ঘুম থেকে টেনে তুলে দাদির কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে আগে থেকেই সবকিছু ঠিকঠাক করে রাখতে। আর সে কিছুক্ষনের মধ্যেই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। প্রথমে যাবে বসুন্ধরা সিটিতে। সেখান থেকে দাদির জন্য তার পছন্দের কয়েক সেট কাপড় কিনে সোজা চলে যাবে কারওয়ান বাজার। ব্যাপারটা ভাবতেই আনন্দে তার চোখমুখ কেমন চিকচিক করছে। কিন্তু বাবা মেয়ের কেউই সঠিক জানে না আজও তাদের মা কিংবা দাদিকে খুব কাছের করে পাওয়া হবে কিনা। কারণ ঐ শ্রেণীর স্পেশাল মানুষগুলো কেবল হৃদয় মন উজার করে দিতেই জানে বিনিময়ে বেশি কিছু পাবার প্রত্যাশা রাখে না...
অবশেষে শেষ করলাম। যারা সাথে ছিলেন তাদের প্রতি অনেক অনেক কৃতজ্ঞ। আশা রাখি সব সময় এভাবে করেই পাশে পাব। শেষটায় বলে রাখি এটা ছিল আমার শততম পোস্ট। কিন্তু আমি নিতান্তই এক নাদান লেখক। এরকম আরও পাঁচশো পোস্ট লিখলেও আমি হয়ত কোন স্ট্যান্ডার্ড লেখকের কাতারেও পরব না। তাই ঘটা করে কিছু লিখার সাহস করলাম না। শুধু এটুকুই বলব সবাই আমার জন্য দোয়া করবেন।
যারা আগের দুইটি পর্ব পড়তে ইচ্ছুক তাদের জন্য লিঙ্ক দিয়ে দিব। এই মুহূর্তে সামুর সার্ভারে প্রব্লেম থাকায় লিঙ্ক এড করতে পারছি না। আপনারা চাইলে আমার হোমপেইজে গিয়ে সহজেই পেতে পারেন।