১৮৭৯ সালে জার্মানির উলম শহরে জন্মগ্রহন করলেও বিজ্ঞানী আইনস্টাইন বেড়ে উঠেন মিউনিখ শহরে।ভবিষ্যতে তিনি যে বিখ্যাত একজন পদার্থবিদ হবেন তার আভাষ কিন্তু ছোটবেলায় পাওয়া যায়নি। এটা বোধহয় প্রায় সবাই জানে যে তিন বছর বয়স পর্যন্ত তাঁর মুখে কথা ফুটেনি।১৮৯০ এর দশকে আইনস্টাইনের বাবার ইলেক্ট্রিক ব্যবসায় লস হলে তাদের পরিবার মিলান শহরে চলে আসে।কিশোর আইনস্টাইন পড়াশুনার জন্য চলে যান সুইজারল্যান্ড।কিন্তু প্রথমবারের চেষ্টাতে কলেজ এন্ট্রান্স(প্রবেশিকা) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে তিনি ব্যর্থ হন।১৮৯৬ সালে তিনি জার্মান নাগরিকত্ব ছেড়ে দেন যাতে মিলিটারিতে যোগদান করা না লাগে। এরপর জুরিখ পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটে চার বছরের একটি কোর্সে ভর্তি হন।এটি ছিলো স্কুলের বিজ্ঞান বিষয়ক শিক্ষক তৈরি করার উদ্দেশ্যে প্রণয়িত একটি কোর্স।এই কোর্সে আইনস্টাইন ছিলেন মোটামুটি মানের একজন ছাত্র।
১৯০০ সালে স্নাতক পাশ করার কয়েকমাসের মধ্যেই তিনি জার্নালে নিজের গবেষণাপত্র প্রকাশ করা শুরু করেন। তাঁর প্রথম গবেষণাপত্রটি ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের ‘কোয়ান্টাম থিউরি’র সাথে একই সংখ্যায় প্রকাশিত হয়।১৯০২ সাল থেকে ১৯০৪ সালের মাঝে তিনি কতগুলো গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন যেগুলো কানেকটিকাটের বিজ্ঞানী জে উইলার্ড গিবসের ‘পরিসংখ্যানগত বলবিদ্যার মৌলিক নীতি’কে সমর্থন করে এবং বুঝায় যে বিজ্ঞানী গিবসের কাজ ফেলনা ছিলোনা।
একই সময়ে আইনস্টাইন তাঁর এক হাঙ্গেরিয়ান ছাত্রী মিলেভা মারিকের প্রেমে পড়েন। বিয়ের আগেই তাদের একটি কণ্যাসন্তান জন্ম নেয় এবং বাচ্চাটিকে দত্তক দিয়ে দেয়া হয়।আইনস্টাইন তাঁর মেয়েকে দেখার সুযোগ পাননি।এর দুই বছর পর তারা দুজনে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এই সময়ের মধ্যে ১৯০২ সালে আইনস্টাইন সুইস প্যাটেন্ট অফিসে চাকরি নেন এবং পরবর্তী সাত বছর এই চাকরিতেই কাটিয়ে দেন। আইনস্টাইন তাঁর এই কাজ বেশ উপভোগ করতেন।যদিও এই কাজ যথেষ্ট চ্যালেঞ্জিং ছিলো তবুও তা পদার্থবিজ্ঞানের প্রতি তাঁর ভালোবাসাকে বিন্দুমাত্র কমাতে পারেনি।বরং বলা চলে ১৯০৫ সালে তাঁর দেয়া বিখ্যাত বিশেষ আপেক্ষিকতার তত্ত্বের পটভূমি এই প্যাটেন্ট অফিসের কাজে থাকতেই রচিত হয়েছিলো।
তাঁর গতিশীল বস্তুর তড়িৎগতিবিদ্যা সম্পর্কিত গবেষণাপত্রটিকে এযাবতকালের সবচেয়ে অসাধারণ গবেষণাপত্র ধরা হয়।এর উপস্থাপনা ভঙ্গি কিংবা ভিতরের তথ্যাবলী দুটোই ছিলো অন্যান্য গবেষণাপত্র থেকে ভিন্ন।এতে কোন পাদটিকা,উদ্ধৃতি কিংবা পূর্ববর্তী কোন গবেষণাপত্রের উল্লেখ ছিলোনা। ছিলোনা তেমন কোন গাণিতিক ব্যাখ্যা।তবে তাঁর প্যাটেন্ট অফিসের একজন সহকর্মী, মিচেল বেসো’র সহায়তার কথা বলা হয়েছিলো।সি পি স্নো এ প্রসঙ্গে বলেছেন,“আইনস্টাইন কারো সহায়তা ছাড়াই শুদ্ধ চিন্তার পরিপ্রেক্ষিতে একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন।অন্য কারো মতামত না শুনেই তিনি বিশাল এক পরিসরের চিন্তা ভাবনা একাই করে ফেলেছিলেন’’।
এই গবেষণাপত্রে তাঁর ভুবন বিখ্যাত E=mc2 সমীকরণটি ছিলোনা।তবে এর কয়েক মাস পরেই তিনি এটি প্রকাশ করেন।স্কুলে পড়ে আসা বিদ্যা দিয়ে আমরা জানি যে এখানে E মানে শক্তি,m মানে বস্তুর ভর এবং c দ্বারা আলোর বেগকে বুঝানো হয়েছে।সহজভাবে বলতে গেলে বলা যায় যে এই সমীকরণ বলছে যে বস্তুর ভর এবং শক্তি একটা ভারসাম্য অবস্থায় থাকে। মূলত প্রতিটা জিনিসই দুইটা রূপে থাকে। একটা হলো শক্তি আর অন্যটা বস্তু।শক্তি হলো মুক্ত হয়ে যাওয়া বস্তু। আর বস্তু হলো যা শক্তিতে রূপান্তরের অপেক্ষায় আছে। যেহেতু আলোর বেগের বর্গ ( আলো বেগ প্রতি সেকেন্ডে প্রায় তিন লক্ষ কিলোমিটার) একটা বিশাল সংখ্যা সেহেতু বলা যায় প্রতিটা বস্তুতেই একটা বিশাল পরিমাণ শক্তি মজুদ আছে।একজন পরিনত মানুষের শরীরে প্রায় 7 x 10^18 জুল পরিমাণ শক্তি রয়েছে যা ত্রিশটা বড় আকারের হাইড্রোজন বোমার শক্তির সমান।আসলে প্রতিটা বস্তুতেই শক্তি সঞ্চিত আছে। আমরা শুধু তা ব্যবহার করার সঠিক উপায় এখনো জানতে পারিনি। এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি শক্তি উৎপন্ন করতে পারে এমন জিনিস হলো ইউরেনিয়াম বোমা।এটি এর মূল শক্তির মাত্র এক শতাংশেরও কম শক্তি উৎপন্ন করে।আমরা আরো একটু চতুর হতে পারলে এর পুরোটাই শক্তিতে পরিনত করতে পারতাম।
অন্যান্য আরো অনেক তত্ত্বের মধ্যে আইনস্টাইনের এই থিউরি তরঙ্গের প্রকৃতি সম্পর্কেও ধারণা দেয়।কিভাবে একটি ইউরেনিয়াম পিন্ড বরফের মতো গলে না গিয়ে উচ্চ শক্তি উৎপন্ন করতে পারে তার ব্যাখ্যাও পাওয়া যায়।এই সমীকরণের কল্যাণে আমরা জানতে পেরেছি যে আলোর বেগ সবসময় একই থাকে অর্থাৎ ধ্রুব। কোন কিছুই আলোকে অতিক্রম করতে পারেনা।সাথে সাথে আলোকবাহী ইথারের প্রকৃতি এবং এর অনস্তিত্বের কথাও জানা যায়। এর মাধ্যমে আমরা এই মহাবিশ্বের স্বরূপ সম্পর্কেও জানতে পারি।কিভাবে নক্ষত্র গুলো বিলিয়ন বছর ধরে জ্বলছে কিন্তু নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছেনা তাও আমরা এর মাধ্যমেই জানতে পেরেছি।আইনস্টাইনের এই তত্ত্বের মাধ্যমে আমাদের নিকট এক নতুন মহাবিশ্বের দুয়ার খুলে দিয়েছেন।
নিয়ম অনুসারেই পদার্থবিদরা একজন প্যাটেন্ট অফিসের কেরানির প্রকাশিত গবেষণাপত্রের দিকে তেমন কোন লক্ষপাত করেন নি।যার কারনে আইনস্টাইনের এই বিখ্যাত আবিষ্কার খুব কম সাড়া ফেলে প্রথমদিকে।মহাবিশ্বের অল্পকিছু রহস্যের সমাধান করার পর আইনস্টাইন ইউনিভার্সিটির লেকচারার পদে যোগদানের জন্য আবেদন করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে প্রত্যাখ্যাত হন। এরপর স্কুল শিক্ষক হিসেবে আবেদন করলে সেখানেও অমনোনীত হন। শেষমেশ তিনি আগের সেই ছাপোষা তৃতীয় শ্রেণীর কেরানী পদে ফিরে যান।কিন্তু চিন্তা-ভাবনা করা থামান নি। মহাবিশ্বের রহস্য উদঘাটনের কাজের শেষ তিনি এখনো করে উঠতে পারেন নি।
কবি পল ভালেরি আইনস্টাইনকে জিগ্যেস করেছিলেন তিনি তার আইডিয়া গুলো কোন নোটবুকে লিখে রাখেন কিনা।জবাবে স্মিত হেসে আইনস্টাইন বলেছিলেন,‘তার প্রয়োজন হবেনা। তেমন কোন আইডিয়া আমার মাথায় নেই’।
কিন্তু আসলে এর পরে আইনস্টাইনের মাথায় যে চিন্তা ভাবনা এসেছিলো তা ছিলো জগতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং সাড়া জাগানো এক আইডিয়া যা আমাদের চেনা জগতের খোলনলচে বদলে দিয়েছিলো। কোথাও কোথাও বলা হয় যে, ১৯০৭ সালের দিকে আইনস্টাইন একজন শ্রমিককে ছাদ থেকে পড়ে যেতে দেখেন এবং তখন থেকেই অভিকর্ষ নিয়ে চিন্তা ভাবনা শুরু করেন। তাঁর নিজের মতো, চেয়ারে বসে থাকার সময়ে তিনি অভিকর্ষের সমস্যা নিয়ে অবগত হন।
আইনস্টাইনের এই আইডিয়া অভিকর্ষের সমস্যা সমাধানের পথে প্রথম পদক্ষেপ বলা চলে।এমনিতেও আইনস্টাইনের মাথায় এটা ছিলো যে তাঁর বিশেষ আপেক্ষিকতার তত্ত্বে কিছু একটা ছিলোনা।আর তা ছিলো অভিকর্ষ।‘আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্ব’ সম্পর্কে বিশেষ ব্যাপার হলো এটি অভিকর্ষের প্রভাবে চলন্ত বস্তু নিয়ে কাজ করে। কিন্তু যদি কোন বস্তু অভিকর্ষের বাইরে থেকে গতিশীল হয়(যেমন-আলো) তখন কি ঘটবে !!এই প্রশ্নটিই পরবর্তী এক দশক ধরে তাঁর চিন্তাভাবনা জুড়ে ছিলো এবং অবশেষে ১৯১৭ সালের শুরুতে তিনি প্রকাশ করেন তাঁর ‘সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্ত্ব’ শিরোনামে বিখ্যাত গবেষণাপত্র।
১৯০৫ সালে দেয়া ‘আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্ব’ বেশ গভীর এবং গুরুত্বপূর্ণ হলেও সি পি স্নো এর মতে,''আইনস্টাইন যদি এই বিশেষ তত্ত্ব না দিতেন তবে পরের পাঁচ বছরের মধ্যে কেউ না কেউ তা ঠিকই প্রকাশ করতেন।কিন্তু আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্বের ব্যাপার আলাদা।আইনস্টাইন এই তত্ত্ব না দিলে আমাদের হয়তো এখনো এর জন্য অপেক্ষা করতে হতো''।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:২৮