একমাত্র বউয়ের রোদ ঝলমলে মুখটাতে আজ কালো মেঘের ঘনঘটা। ঝড়-বৃষ্টি শুরু হবার আগে চারপাশ যেমন নি:স্তব্ধ হয়ে যায় তেমনি। তবে আশার কথা হচ্ছে রাগ আর অভিমানের মিশেলে দারুণ এক সৌন্দর্য খেলা করছে তার চেহারার বারান্দায়। অফিস থেকে ফিরতে ফিরতে শিয়ালেরা কাজে বেরুনোর মত রাত নেমেছে মফস্বলের এই শহরটাতে। ছেলেটা ঘুমিয়ে আছে বলে ড্রিম লাইট ঠেলে আলো জ্বালাতে তাড়া দিলাম না। আমাদের মধ্যকার কথোপকথনও আর লম্বা করলাম না। পাছে ছেলেটা জেগে বাবা বাবা বলে গলায় ঝুলে পড়বে এক্ষুণি। ছেলেটার এই এক অভ্যাস। হাজার ঘুমে থাকলেও বাবার কন্ঠের স্বরটা কানে যাওয়া মাত্রই উঠে বসে। কোলে না নিয়ে আর উপায় নেই। দুহাত উচু করে এমন দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকাবে তাতে আমার জান দিতে আসা মালাকুল মউতের মনেও করুনার উদয় হবে। সেও বলবে, থাক! বরং আরেকটু অপেক্ষা করি। বাবা-ছেলেতে খুনসুটি লম্বা হোক আরেকটু।
অভিমানের জোয়ার খুব কষ্টে চেপে রেখেছে বউটি। আমার অমনুযোগিতা সেই অভিমানের জোয়ারে আলোড়ন সৃষ্টি করছে তা আমি এই ড্রিম লাইটের আলোতেও ঢের বুঝতে পারছি। আর উপেক্ষা করলে অভিমান আর উপেক্ষার তেজস্ক্রিয় বিক্রিয়া হবার সম্ভাবনা যে প্রবল তা আমার প্রত্যুৎপন্নমতি মন ঢের বুঝতে পারছে। ৪ নম্বর বিপদ সংকেত টের পেয়ে আমি তরী ভিড়ালাম উপকূলের কাছাকাছি। বউও এবার আশ্রয় খুজে নিলো আমার চওড়া বুকটাতে। আমি আর অপেক্ষা করতে পারলাম না। অভিমানের উৎপত্তি স্থলের খোঁজে নেমে পড়লাম। ভূমিকম্পের উৎপত্তি স্থল যত দূরে হবে ততই এর ক্ষতির সম্ভাবনা কম। এক্ষেত্রে অভিমানের সাথে ভূমিকম্পের বেশ মিল লক্ষ্য করা যায়। এই সব টুকিটাকি ভূগোল বিশারদ না হলে সংসার ধর্মে মওলানা হওয়া যায় না। আমি অবশ্য মওলানা হতে পারি নি। খাদেম কেবল। মওলানা হবার ইচ্ছা আমার নেই। কেন নেই সে কথা আরেকদিন বলা যাবে। আজ বউয়ের মন খারাপের পদার্থ-রসায়ন উদঘাটন করা যাক।
একটা মেয়ের সাথে বেশ বন্ধুত্ব আমার বউয়ের। মেয়েটা অবশ্য এই দেশের না। চাইনিজ মেয়ে। চ্যাং চ্যুং করে কি সব বলে ওরা আমি কিচ্ছু বুঝি না। বউ দেখি খুব হাসে ও সব ইলু বিলু চ্যং চুং শুনে। আমি মাঝে মাঝে তাল দেই সেই রসবোধে। তবে কখনো কখনো সঠিক সময়ে হেসে উঠতে না পারলে বিপদ হয়ে যায়। মেয়েটা চাইনিজ বলে ওর ভাষা ইংলিশ সফটওয়্যার দিয়ে কনভার্ট করে বুঝে নেয় বউটি । অল্প সময়ের পরিচয়ে বউটা চাইনিজ মেয়েকে বেশ ভালো বন্ধু বানিয়ে ফেলেছে। এর আগেও এক বান্ধবী ছিলো। সেও চাইনিজ। তার সাথে ওর ব্রেকাপ হয়ে গেছে। ব্রেকাপের কারন আমি জানি কিন্তু এখন বলতে চাচ্ছি না। বর্তমানের বন্ধুর ঘটনার সারসংক্ষেপ শুনতে হবে আগে। ঘটনার সামারি যা শুনলাম তা শুনে আমি হাসবো না কাঁধবো বুঝতে পারছি না। আমি শুধু স্বান্তনা দিয়ে গেলাম।
ঘটনা বলতে শুরু করলো বউ। চাইনিজ মেয়েটার একটা ছেলে বন্ধু আছে। ছেলে বন্ধুকে দেখে বউয়ের খুব একটা সুবিধার মনে হয়নি বলে আগে থেকেই মেয়েটাকে বারণ করেছিলো ছেলেটার কাছে না যেতে। ছেলেটার আগে একটা প্রেম ছিলো। আগের প্রেমিকা চলে গেছে ছ্যাকা দিয়ে। তাই আমার বউয়ের বান্ধবীর কাছ থেকে সহানুভূতি নিচ্ছে। ছেলেটা আর বউয়ের বান্ধবী ক্লাসমেট। সেই ভগ্ন হৃদয়ের মলম লাগাতে লাগাতে একদিন ওদের মাঝে প্রেম হয়ে যায়। বেশ চলছিল ওদের প্রেম। বউও আশা করছিলো ওদের শুভ পরিনয় হোক সহজ সরল মেয়েটি ছেলেটাকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করে। এভাবে প্রেম চলতে চলতে হঠাৎ একদিন সেই প্রাক্তন প্রেমিকা ফিরে আসে। প্রাক্তন তার ভুল স্বীকার করে। ছেলেটাও ওই মেয়ের প্রতি এতোটাই দূর্বল ছিলো যে আগের সবকিছু ভুলে আবার প্রাক্তনকে বর্তমানের চাইতেও বেশি সময় দেই। আস্তে আস্তে বর্তমান প্রাক্তন হয়ে যায় আর প্রাক্তনকে নিয়ে ঘর বাঁধার স্বপ্নে মশগুল ছেলেটি। তবুও ছেলেটিকে অবিশ্বাস করে না বউয়ের বান্ধবী। আগের মতোই ছেলেটিতে ভালোবাসে। ওকে সহযোগিতা করে বিভিন্ন বিষয়ে। এই সব রঙ্গ লিলা দেখে বান্ধবীর প্রতি চরম নাখোশ আমার বউ। নাখোশ হবেই বা না কেন! আমি বউয়ের স্থলাভিষিক্ত হলে আমিও এমন করতাম। আরেকটি ঘটনাতো চরম ভাবে আমার বউকে বিধ্বস্ত করেছে। সেই ঘটনার কারনেই আজ বউয়ের মনটা খারাপ। গত কয়েকদিন আগে চায়নাতে একটা ডান্স কম্পিটিশনে বউয়ের বান্ধবী একটা আবেদন জমা দেয়। আবেদনটি পাঠায় ঐ কথিত প্রেমিকের মাধ্যমেই। এদিকে ফিরে আসা আগের প্রেমিকাও আবেদন জমা দিবে। ছেলেটি জানে যদি বর্তমানের প্রেমিকা প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় তাহলে প্রাক্তন মানে ফিরে আসা প্রেমিকা ডান্স কম্পিটিশনে টিকবে না। তাই আর বর্তমান প্রেমিকার আবেদন জমা দেয় না। মেয়েটি এই ঘটনা বুঝতে পারে যখন তখন আর আবেদনের সময় নেই। ছেলেটিকে আবেদন না জমা দেয়ার কারন জিজ্ঞেস করলে সাত-পাঁচ একটা বুঝ দেয়। মেয়েটা মেনেও নেই সেই বুঝ। তবুও অবিশ্বাস করে না ছেলেটিকে। আমার বউ শত বুঝানোর পরও ঐ ছেলের পিঁছেই ঘুরে মেয়েটি। অনেক বকাঝকাও করেছে মেয়েটিকে। তবুও কাজ হয় নি। সেই ছেলে ছাড়া নাকি ও বাঁচবেই না। এই সব ঘটনা চোখের সামনে দেখে কি আর মন মেজাজ ঠিক রাখা যায় বলেন! তাইতো আজ বউয়ের মন খারাপ।
এখন আপনারা প্রশ্ন করতে পারেন আমার বউ এত কিছু জানলো কি করে? আসলে এই ঘটনাগুলো ঘটেছে বউয়ের চোখের সামনেই। ওর স্মার্ট ফোনে। ঘটনা হইলো গিয়ে আমার বউ ইদানিং চাইনিজ রুমান্টিক ড্রামা দেখা শুরু করেছে। আর এই ড্রামার এক নায়িকার এমন প্রতারণার স্বীকার হওয়া কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না ও। এখন আপনারাই বলুন কি বলে স্বান্তনা দিবো বউকে?