যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে আমি কিছু বলবো না আমার এই লেখা সম্পূর্ণই অন্য এক পয়েন্টে। ইদানীং বেশ শোর উঠছে যে আমাদের ট্রাইবুন্যাল হচ্ছে এই ট্রাইবুনাল কি যথাযথ কিনা। আসুন দেখি আইন কি বলে বিভিন্ন দেশে কিভাবে বিচার হয়েছে বা হচ্ছে। ট্রাইবুনালই বা কিভাবে হচ্ছে বা কারা করছে।
শুরুতেই ন্যুরেম্বার্গ ট্রায়ালের কথা না বললেই নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর নাজীদের বিচারের জন্য গঠন হয় এই ট্রাইবুন্যাল এবং বিচার কার্য্য এখনো চলছে। যার প্রমান ৬২ বছর পর একজন নাজীকে খুজে পাওয়ার পর তার শাস্তি হলো এই তো কিছুদিন আগে। এই ন্যুরেম্বার্গ ট্রায়ালে জাজ কারা ছিলেন বা কোন দেশী ছিলেন? ইংল্যান্ড থেকে দুইজন, ফ্রান্স থেকে দুইজন, আমেরিকা থেকে দুইজন এবং তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে দুই জন নিয়ে তৈরী করা হয় বিচারক প্যানেল।
এখানে লক্ষ্য করুন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহন কারী ১৫ এর অধিক (মিত্র বাহিনী) দেশের মধ্যে শুধু মাত্র চারটি দেশের থেকে বিচারক প্যানেল তৈরী হয়। আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট হচ্ছে বিচারের জায়গাটি ছিলো ন্যুরেমবার্গ। ন্যুরেম্বার্গকে বেছে নেওয়ার পিছনে দুইটি কারনের মধ্যে একটি ছিল, এই জায়গালেই নাজীদের জন্মস্থান হিসাব করা হয় এবং এখান থেকেই তাদের বাৎসরিক র্যানলী পরিচালনা হত। মূলত এটাকে হিসাব করা হয়েছে এই বিচার নাজীবাহিনীর রূপক মৃত্যু ঘটাবে। অর্থাৎ, যেখানকার পাপের শাস্তি সেখানেই দেওয়া। এই বিচার করতে কিন্তু তাদের কোথায় যেতে হয়নি। সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রথমে বার্লিনে চাইলেও পরে ন্যুরেম্বার্গকে এই কারনে মেনে নেয়। অথচ সুপার পাওয়ার হিসাবে কিন্তু এদের যে কেউ দাবী করতে পারত বিচার তাদের দেশেই হোক তা কিন্তু হয়নি। বিচার হয়েছে অপরাধের কেন্দ্রবিন্দুতেই।
আরো একটা উদাহারন দেই। “মাই লাই ম্যাসাকার” ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় ইউএস আর্মীর এক গনহত্যার দগদগে দাগ। ১৯৬৮ সালের ১৬ই মার্চ ইউএস আর্মী দক্ষিন ভিয়েতনামে ৩৪৭ – ৫০৪ জন নিরস্ত্র বেসামরিক মানুষ হত্যা, ধর্ষণ এবং অত্যাচার করে । মজার ব্যাপার হচ্ছে এই হত্যাকান্ডের বিচার কিন্তু আমেরিকাই করেছিলো। এটাই মূল কথা। এই কারনে কিন্তু ভিয়েতনামের চিৎকার করতে হয়নি। বিচার চাইতে হয়নি। এক সৈন্যের চিঠির মাধ্যমে জানাজানির পর আমেরিকাই এর বিচার কার্যক্রম শুরু করে। মেজর জেনারেল স্যামুয়েল ডাব্লিউ কোস্টার সহ ১৪ জন অফিসার সহ মোট ২৬ জনকে নভেম্বর ২৭ ১৯৭০ সালে কোর্ট মাশাল করে।
ক্যাপ্টেন ম্যাডিনা হত্যার অনুমতি দেওয়াতে তার যাবজ্জীবন কারাদন্ড হয় এবং সেকেন্ড লেফট্যানেন্ট উইলিয়াম ক্যালি সেই আদেশ কার্যকর করায় তাকেও একি শাস্তি দেওয়া হয়। দুঃখজনক হচ্ছে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের হস্তক্ষেপে ক্যাপ্টেন ম্যাডিনাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। এই ঘটনা টেনে আনার মূল কারন হচ্ছে এইটাই বলা যে বিচার করতে সদিচ্ছার প্রয়োজন। কোন কোর্টে হচ্ছে সেটা রেলেভেন্ট না। বিচার সুষ্ঠ হওয়ার জন্যে সদিচ্ছা দরকার আর সবার সহযোগীতা। তাহলেই বিচার কি কোর্টমার্শালে হচ্ছে নাকি রমনায় জনতার আদালতে নাকি ইন্ট্যারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট বা নিজের দেশেই যে কোন কোর্টে সেটা নিয়ে মাথা ঘামানো লাগবে না। অনস্থা আনতে হবে না।
সবচেয়ে বড় প্রশ্ন আসছে আমাদের জুরিসডিকশনবা আইনগত অধিকার নিয়ে । আইনগত অধিকার খর্ব হচ্ছে কিনা দেখা আগে আমরা আগে জানবো এই ব্যাপারে আন্তর্জাতিক আইন কি বলে।
প্রথমেই বলে নেওয়া ভালো যে কোন দেশের সম্পুর্ণ অধিকার আছে যে কোন ক্রিমিনাল ল’য়ের ব্যাপারে যে কোন সিদ্ধান্ত নেওয়ার বা শাস্তি দেওয়ার যদি কোন নাগরিক কোন নির্দিষ্ট কোন আইন ভঙ্গ করে, এই ক্ষেত্রে যেটি যদ্ধাপরাধ। প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইন আইনগত অধিকারের ক্ষেত্রে পাচটি মৌলিক নীতি স্বীকার করে যেগুলো যুদ্ধাপরাধের বিচারের সময় ব্যাবহার যোগ্যঃ ১। টেরিটোরিয়াল , ২। ন্যাশনালিটি ৩। প্যাসিভ ন্যাশনালিটি ৪। প্রোটেক্টিভ ৫। ইউনিভার্সালিটি।
টেরিটোরিয়ালঃ এটি খুব সম্ভবত সবচেয়ে বেশি গ্রহন যোগ্য ও ব্যাবহৃত নীতি। এসে বলা হয়েছে, যে কোন দেশ এর সীমানার ভিতর সংগঠিত যে কোন অপরাধ বিচারের ও রায় কার্যকরের আইনগত অধিকার রাখে। অর্থাৎ আমাদের দেশের ভিতর সংগঠিত যে কোন অপরাধ বিচার ও রায় কার্যকর আমরাই করতে পারি। এই জন্যে আমাদের আন্তর্জাতিক কোন সংস্থার দারস্থ হতে হবে না। এই খানে আরো একটা কথা বলে রাখা ভালো, নিজের সীমানার ভিতর এই ধরনের ব্যাপারে যে কোন পদক্ষেপ নেওয়ার অধিকার একটি রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের একটি বড় চিহ্ন। অর্থাৎ কেউ যদি এই ব্যাপারে আমাদের দেশের কোন সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপ করে বা করার চেষ্টা করে তবে তা আমাদের সার্বভৌমত্বকে খর্ব করে। যারা আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ চেয়ে গলা ফাটাচ্ছেন তাদের কাছে আমার প্রশ্ন রইলো “ আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ কি আমাদের সার্বভৌমত্ব খর্ব করে না? আর কেউ যখন সার্বভৌমত্ব খর্ব করে বা করার চেষ্টা করে তখন কি তাকে রাষ্ট্রদ্রোহী বলাটা খুব একটা ভুল?”
দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধরনের নীতি মূলত জাতীয়তার উপর ভিত্তি করে। ধরা যাক ক একটি রাষ্ট্র আর অপরাধী ক রাষ্ট্রের নাগরিক, রাষ্ট্রের সম্পূর্ণ অধিকার আছে তার নাগরিককে তার করা যে কোন অপরাধের জন্যে কোর্টে আনার। প্যাসিভ ন্যাশনালিটিতে বলা হচ্ছে, যদি ক রাষ্ট্রের কোন নাগরিকের বিরুদ্ধে কোন যুদ্ধাপরাধ হয়ে থাকে তবে যে যদি ক রাষ্ট্রের হেফাজতে আসে তবে ক রাষ্ট্র তাকে নিজের এক্তিয়ারভুক্ত ক্ষমতায় তার বিচারের অধিকার রাখে।
অর্থাৎ, যেহেতু যুদ্ধাপরাধীরা আমাদের দেশের নাগরিক, অন্তত পাসপোর্টধারী ভোটাধিকার আছে তাই তাদের নাগরিক না বলে পারছি না, তাই তাদের করা যে কোন যুদ্ধাপরাধের বিচার আমরা দেশে বসেই করতে পারি। শুধু তাই নয় যদি সে অন্য দেশের নাগরিকও হয় এবং আমাদের কাস্টডিতে আসে তবে আমাদের দেশের নাগরিকের বিরুদ্ধে তার করা যে কোন যুদ্ধাপরাধের বিচারও আমরা দেশে বসেই করতে পারবো। আমাদের তার দেশকেও জানাতে হবে না। এই ব্যাপারে Permanent Court of International Justice (বর্তমানে International Court of Justice) জাজ মুর বলেন, এটা এখন সার্বজনীন ভাবে স্বীকৃত যে কোন দেশের সীমানার ভিতর সংগঠিত যে কোন অপরাধের বিচারের করতে পারে যেহেতু অপরাধ হওয়ার সময় অপরাধী সেখানে হাজির ছিলো। এবং এই কারনে আন্তর্জাতিক আইন এই বিচারকে রদ ও করবে না। (S. S. “Lotus”, (France vs Turkey), Permanent Court of International Justice, Ser. A, No. 9. (19271927); Hudson World Court Reports 20 (1935)) তার মানে হচ্ছে পাকিস্তানের কোন যুদ্ধাপরাধী যদি আমাদের হাতে ধরা পড়ে আমরা আমাদের আইন অনুযায়ী তাকে বিচার করতে পারবো।
যেখানে আন্তর্জাতিক আইন আমাদের হাত খুলে দিচ্ছে অন্যদেশের কেউ ধরা পড়লেও আমরা তার বিচার করতে পারব সেখানে আমাদের দেশের নাগরিকদের দ্বারা সংগঠিত আমাদের নাগরিকদের বিরুদ্ধে আমাদের দেশে সংগঠিত কোন কিছুর বিচার করতে পারবো না!!!! আরো একবার ভেবে দেখার অনুরোধ রইলো।
চতুর্থত, বলা হচ্ছে কোন দেশে যদি এমন কোন অপরাধ সংগঠিত হয় যা সে দেশের প্রধান কোন অধিকার খর্ব করে যেমন এর জনসংখ্যার বড় একটা অংশ যদি নির্বাসিত হয় তবে সেই দেশ সেই অপরাধ ও অপরাধীকে নিজস্ব আইনের আওতায় এনে বিচার করতে পারবে। মুক্তিযুদ্ধের সময় কত হাজার হাজার মানুষ নির্যাতন ও নির্বাসনের স্বীকার হয়েছে তা বলে শেষ করা যাবে না। হিন্দু সম্প্রদায় ছিলো নিজভূমে নির্বাসিত। এককোটির বেশি মানুষকে স্মরনার্থীর জীবন যাপন করতে হয়েছে। লক্ষ লক্ষ মানুষকে সম্পুর্ন নয় মাস পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে পশুর মত। এই সব অপরাধ যারা করেছে তাদের বিচার আমরা আমাদের কোর্টেই করতে পারি ।
সর্বশেষ নীতি যে কোন দেশকে যে কোন অপরাধ সংগঠনকারীকে জাতীয়তা, স্থান ইত্যাদি নির্বিশেষে শাস্তি দেওয়ার অধিকার দেয় । ঐতিহ্যগত ভাবে এই আইন সর্ব প্রথম ব্যাবহার হয় জলদস্যুদের শাস্তি দিতে। দ্বিতীয় বিশযুদ্ধের পরে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্রে এই নীতির সবচেয়ে ভালো ব্যাবহার লক্ষ্য করা যায়। যেমন একটি অস্ট্রেলীয়ান মিলিটারি কমিশন জাভায় সংগঠিত চাইনিজ ও ইন্ডিয়ানদের বিরুদ্ধে জাপানিজদের দ্বারা সংগঠিত যুদ্ধাপরাধের বিচার করেছে । এমনকি জার্মানীতে বসে আমেরিকা এক জার্মানের দ্বারা রাশিয়ান ও চেক নাগরিকের বিরুদ্ধে সংগঠিত অপরাধের বিচার করেছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে এই অপরাধ সংগঠিত হয়েছিল আমেরিকা মিত্রবাহিনীতে যোগ দানের আগে।(United States v Remmele, 1515 LAW Report 44 (1949) ).
সুতরাং আমরা যদি আমাদের দেশে বসে আমাদের দেশে হওয়া কোন অপরাধের বিচার আমাদের কোর্টে করতে চাই আমরা করতে পারি । এই ব্যাপারে আন্তর্জাতিক আইন পরিস্কার ভাবেই অধিকার দিয়ে দিচ্ছে।
পরের পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১২ সকাল ১১:১৬