বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সমুদ্র তীরবর্তী নিরাপত্তা ব্যবস্থা
বাংলাদেশ প্রতিনিয়ত জাতীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থায় যে সকল বাঁধার সম্মুখীন হয় তার মধ্যে অন্যতম সমুদ্র তীরবর্তী নিরাপত্তা। বাংলাদেশের বিস্তৃত সামুদ্রিক অঞ্চল তার অর্থনীতি ও নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় বার্মার তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানের পর দেশ দুটি কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়। এই আলোচনায় বার্মা ও ভারতের সাথে সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ তুলে ধরা হয়েছে। আইনগতভাবে হাইজ্যকিং, জলদস্যুতা, অন্তর্ঘাত, যে কোনরকম শত্রুতামূলক কর্মকাণ্ড প্রতিহত করার জন্য সমুদ্র তীরবর্তী নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরী। এজন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে হয়। ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট, ইন্টেলিজেন্স গ্যাদারিং-এর পাশাপাশি কি ধরণের ঝুঁকি আসতে পারে-তা বিশ্লেষণ করা এবং মোকাবেলা করতে হয়।
বাস্তবে সমুদ্র তীরবর্তী নিরাপত্তা হচ্ছে ইন্টার ডিসিপ্লিনারি কনসেপ্ট যার সঙ্গে সামরিক বিজ্ঞান, পুলিশ বিজ্ঞান, আন্তঃ ও আন্তর্জাতিক আইন, ভূ-রাজনীতি ও ইতিহাস জড়িত। অর্থনৈতিক উন্নয়ন, ভৌগোলিক স্বাধীনতা, মানবনিরাপত্তা ও জীবনমানের সাথে সমুদ্র তীরবর্তী নিরাপত্তার গুরুত্ব জড়িত। মূলত সমুদ্র পথে অধিকাংশ বাণিজ্য হয়। শক্তিসম্পদেও চাহিদা বৃদ্ধি, ফিশারিজ ক্রাইসিস, আবহাওয়ার বিপর্যয় এবং ট্যুরিজম সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলগুলির ওপর প্রভাব রাখছে।
বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক রাষ্ট্র। সামুদ্রিক বাণিজ্য, সুদীর্ঘ উপকূলীয় অঞ্চল অনেক মানুষের জীবিকা নির্বাহের জন্য সহায়ক এবং সর্বোপরি হাইড্রোকার্বন ও মিনারেল রিসোর্স পাওয়ার নতুন সম্ভাবনা থাকায় সমুদ্র তীরবর্তী নিরাপত্তা রক্ষা করা বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশকে অন্য দেশের মত আগ্রাসন, জলদস্যু প্রভৃতি সমস্যা মোকাবেলা করতে হয়নি কিন্তু প্রতিবেশি দেশগুলির সাথে সামুদ্র সীমা নিয়ে বিরোধ রয়েছে।
বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক অঞ্চল:
যে কোন দেশের উন্নয়নের চালিকা শক্তি হল সম্পদ। বাংলাদেশ বিপুল পরিমাণ জনগোষ্ঠী সম্বলিত একটি ছোট রাষ্ট্র যার প্রায় ৭০০ কি.মি. কোস্টলাইন এবং যোগাযোগের জন্য সী-লেন আছে। তবে মিনারেল রিসোর্সে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। বাংলাদেশ এর সমুদ্র এলাকায় হাইড্রোকার্বন (প্রাকৃতিক গ্যাস ও তেল) থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। বর্তমানে পৃথিবীতে বিশুদ্ধ পানির সংকট থাকায় বাংলাদেশ সমুদ্রের পানি প্রক্রিয়াজাত করে বিশুদ্ধ পানি তৈরি করতে পারবে। দক্ষিণ এশিয়াতে বাংলাদেশ প্রথম রাষ্ট্র হিসেবে ১৯৭৪ এর জুলাই মাসে সামুদ্রিক, অর্থনৈতিক অঞ্চল সম্পর্কে সংসদে ঘোষণা দেয় যা আঞ্চলিক এবং সামুদ্রিক অঞ্চল এ্যাক্ট ১৯৭৪ নামে পরিচিত। বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা ১২ নটিক্যাল মাইল এবং ২০০ নটিক্যাল মাইল হল অর্থনৈতিক এলাকা। কিন্তু জাতিসংঘের সমুদ্র বিষয়ক সনদে স্বাক্ষর না করায় বাংলাদেশ সামুদ্রিক অঞ্চল ব্যবহার করতে পারছে না। বাংলাদেশের দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর অবস্থিত যা দেখতে আয়তাকার এবং এই আয়তাকার অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ তার সমুদ্রসীমা ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত দাবি করার অধিকার রাখে।
ভারতের সাথে দ্বন্দ্ব :
বাংলাদেশের দাবিকৃত সমুদ্রসীমার বিরুদ্ধে ভারত প্রথম থেকেই বলে আসছে। ভারত তার সামুদ্রিক অঞ্চল ঘোষণা করে ১৯৭৬ সালের ২৮ মে, যার এ্যাক্ট নং-৮০। সামুদ্রিক সীমানার দুটি দিক নিয়ে ভারতের সাথে বাংলাদেশের দ্বন্দ্ব রয়েছে। প্রথমত নিজস্ব সমুদ্রসীমার অতিরিক্ত দাবি এবং দ্বিতীয়ত দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপের মালিকানা নিয়ে দ্বন্দ্ব।
নিজস্ব সমুদ্রসীমার অতিরিক্ত দাবি:
বাংলাদেশ যখন সামুদ্রিক অঞ্চল ঘোষণা করে ভারত তখন থেকেই তা প্রতিহত করার চেষ্টা করছে এই বলে যে, এই বেজ লাইন তাদের সমুদ্রসীমার ২০ নটিক্যাল মাইল অভ্যন্তরে যা প্রায় ৪,০০০ বর্গ কি.মি.। ভারত সতর্ক হয় যখন বাংলাদেশ বিদেশি কোম্পানির সাথে স্বীয় সমুদ্রসীমায় তেল অনুসন্ধান এবং ব্যবহারের জন্য চুক্তি স্বাক্ষর করে।
বাংলাদেশের দক্ষিণে সমুদ্রসীমা এবং ভারতের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের সমুদ্রসীমা একটি কোনের সৃষ্টি করে যেখানে উভয় দেশই সমুদ্রসীমা অতিক্রমের দাবি করে। সরকারি সূত্রে জানা যায়, এ অঞ্চলে সঞ্চিত গ্যাসের পরিমাণ ১০০ ট্রিলিয়ন কিউবিক ফিট কিন্তু বেসরকারি সূত্রে যা প্রায় ২০০ ট্রিলিয়ন কিউবিক ফিট। বাংলাদেশ ১৯৭৪ সালে সামুদ্রিক ব্লক ঘোষণা করে। সুন্দরবনের কাছের ব্লকটি এশল্যান্ডকে দেওয়া হয়। ভারত এশল্যান্ড এর প্রধান কার্যালয়ে জানায়, সমুদ্রসীমা এখনও নির্ধরিত হয়নি। সুতরাং এরপরও যদি তারা তেল পেতে চায় তাদের তেল অনুসন্ধান এর অনুমতি দেওয়া হবেনা। ভারত বাংলাদেশ ঘোষিত ডি ২২ ও ডি ২৩ ব্লক নিজেদের দাবি করে এবং এ সমস্যা সমাধানে দেরি হওয়ায় এশল্যান্ড এ অঞ্চল ত্যাগ করে চলে যায়। অথচ ১৯৭৪ সালের ঘোষণানুযায়ী এটি বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা এর অন্তর্ভূক্ত। ২৪ ডিসেম্বর ২০০৮ সালে ৩টি ভারতীয় জরিপ জাহাজ মংলা বন্দর হতে বঙ্গোপসাগরের ২১০ মাইল দক্ষিণে ফেয়ারওয়ে বো হতে ১৮০ ডিগ্রিতে অবস্থান করে এবং অঞ্চলটি তাদের বলে দাবি করে। তবে বাংলাদেশ পদক্ষেপ নিলে জাহাজ ৩টি ভারতীয় সীমানায় চলে যায়।
দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপের মালিকানা নিয়ে দ্বন্দ্ব :
বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশ দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপের মালিকানা দাবি করে (ভারত একে বলে নিউমুর/ পূর্বাশা দ্বীপ)। এটি ইউ আকৃতির। সীমান্তবর্তী হাড়িয়াভাঙা নদীর মোহনায় ২১ ডিগ্রি ৩৬.০ উত্তর এবং ৮৯ ডিগ্রি ০৯.১০ দ্রাঘিমাংশ পূর্বে এর অবস্থান। ভারত দ্বীপের মালিকানা দখল করতে নৌ-জাহাজ এবং আইএনএস আন্দামান নামক ফ্রিগেট পাঠায়। বাংলাদেশ এর প্রতিকার করে এবং এ সময় দ্বীপে একটি লাইটহাউজ নির্মাণ করে। সে সময় ভারত বাংলাদেশ সমুদ্রসীমা লংঘন করে রায়মঙ্গল মোহনা অতিক্রম করে। ভারতের স্বার্থ হচ্ছে দ্বীপটি দখল করতে পারলে- এটির নিজস্ব সমুদ্রসীমা ইইজেড এবং সিএস থাকবে যা বাংলাদেশর সমুদ্রে প্রবেশ সীমাবদ্ধ করবে।
১৯৭৮ সালে উভয় দেশ সমস্যাটির সমাধানের জন্য আলোচনা করে কিন্তু মধ্য স্রোতের প্রবাহ নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। বাংলাদেশ দাবি করে, নদীটির প্রধান স্রোত দ্বীপটির পশ্চিমে প্রবাহিত হয়েছে। সেখানে ভারত দাবি করে, এটি পূর্বে প্রবাহিত হয়েছে। উভয় সীমান্তবর্তী নদী হাড়িয়াভাঙা এবং বাংলাদেশর অভ্যন্তরীণ নদী রায়মঙ্গল- মোহনায় পড়েছে। যে কারণে বাংলাদেশের দাবি ভারত পূর্বের স্রোতের সাথে বর্তমান স্রোতকে এক করে ফেলেছে। ১৯৮১ সালে সরকার দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপের ওপর ১টি শ্বেতপত্র প্রকাশ করে। বাংলাদেশ ১৯৮২ সালে উভয় দেশের একত্রে ১টি যৌথ জরিপ পরিচালনার কথা বললেও ভারত তা নাকোচ করে দেয়। সমাধান না হওয়া পর্যন্ত স্থানটি নো ম্যানস ল্যান্ড হিসেবে বিবেচিত হবে বলে ভারত সম্মত হয়। ২৮ বছর পর ২০০৮ সালের ১৫ থেকে ১৭ সেপ্টেম্বর ৩ দিন ব্যাপী সীমানা নিয়ে আলোচনা হয় কিন্ত উভয় দেশ ১৯৭৪ ও ১৯৮০ সালের মত কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়।
বার্মার সাথে দ্বন্দ্ব :
১৯৭৭ সালে বার্মা সমুদ্রসীমা ঘোষণা করে। আর বাংলাদেশর সাথে বার্মার সমস্যা মূলত সমুদ্রসীমা নিয়ে। বার্মার দাবিকৃত সমুদ্রসীমা অনুসরণ করলে বাংলাদেশ ইইজেড এবং সিএস এ অর্ধেক সমুদ্রসীমা হারাবে। ১৯৭৪ এ সমুদ্রসীমা ঘোষণা দেবার পর বাংলাদেশ বার্মার সাথে আলোচনা শুরু করে। ১৯৭৪ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত দেশ দুইটি পাঁচবার আলোচনায় বসে।
পূর্ব সীমানায় বাংলাদেশ সমুদ্রসীমা নির্ধারণ করেছে নাফ নদীকে অনুসরণ করে। ১৯৭৪ সালে এই লাইন এবং দ্বীপ এক ছিল এবং একটি মধ্যবিন্দু ছিল। ওই সময় ৮ পয়েন্ট ধরা হত এবং ৮ পয়েন্ট ছিল বার্মার অয়েস্টার রক দ্বীপে। সে সময় বার্মা এটা মেনে নেয় কিন্ত পরে বার্মা ৮ পয়েন্ট মেনে চলার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। ৮ পয়েন্ট মেনে নিলে দ্বীপটির নিজস্ব সমুদ্রাঞ্চল থাকবে। বার্মা সেন্টমার্টিন (বাংলাদেশ) হতে অয়েস্টার রক (বার্মা) পর্যন্ত সমদূরত্বের ভিত্তিতে সমুদ্রসীমার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু বাংলাদেশের মতে, সেন্টমার্টিন জনবসতিপূর্ণ এলাকা যারা সমুদ্রে জীবিকা নির্বাহ করে কিন্তু অয়েস্টার একটি পাথুরে দ্বীপ যেখানে শুধুমাত্র ১টি লাইটহাউজ রয়েছে। সুতরাং দ্বীপ দুইটির সমান গুরুত্ব থাকতে পারে না।
সম্প্রতি বার্মার তেল অনুসন্ধানে সৃষ্ট জটিলতা :
বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের জন্য বার্মার সামরিক শাসক থাইল্যান্ড ও চীনে তেল ও গ্যাস রপ্তানির ওপর নির্ভর করে। ২০০৬-০৭ সনে বার্মা গ্যাস রপ্তানি করে ১ বিলিয়ন ডলার আয় করে। দাইউ পরিচালিত কোরিয়ান এবং ভারতীয় কোম্পানি পশ্চিম বার্মার ব্লক ইজারা নেয় যা বাংলাদেশের সীমানার কাছাকাছি। এখানে দাইউ এর ৬০ শতাংশ দক্ষিণ কোরিয়ান গ্যাস কর্পোরেশন ১০ শতাংশ, ওএনজিসি ১০ শতাংশ, গেইল ১০ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। বার্মা ১৯৮৮ সাল থেকে বৈদেশিক বিনিয়োগ এর অনুমতি দিলেও ২০০৮ এর মার্চ পর্যন্ত এখানে তেল ও গ্যাস ক্ষেত্রে বিনিয়োগের পরিমাণ হয় প্রায় ২.৬৩৫ বিলিয়ন ডলার। দাইউ এবং সিএনপিসি যৌথভাবে বার্মায় অনুসন্ধানে চুক্তিবদ্ধ হয়।
৩ নভেম্বর ২০০৮, মিডিয়াতে প্রচার হয় যে ২টি নৌ জাহাজসহ বার্মা ৪টি জাহাজ সেন্টমার্টিন এর ৫০ নটিক্যাল মাইল এ তেল, গ্যাস অনুসন্ধান চালায়। বাংলাদেশের ৩টি নৌ-জাহাজ : বিএনএস আবুবকর, বিএনএস মধুমতি, বিএনএস নির্ভয় বার্মিজ জাহাজকে চ্যালেঞ্জ করে। দুইদেশের মাঝে সীমান্তেও উত্তেজনা বিরাজ করে, বাণিজ্য বন্ধ থাকে। বার্মা সীমান্তে সৈন্য জড়ো করে। বাংলাদেশ উত্তর কোরিয়াকে জানালে দাইউ অনুসন্ধান কাজ বন্ধ করে। বাংলাদেশ চীনের কাছে অনুরোধ জানায়, সমাধান না হওয়া পর্যন্ত বার্মা যেন অনুসন্ধা কাজ বন্ধ রাখে। অবশেষে ১০ নভেম্বর ২০০৮, বার্মা অনুসন্ধান কাজ বন্ধ করে।
বাংলাদেশ রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল। সুতরাং অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হওয়া ছাড়া অন্য কোন উপায় নেই। ভূ-রাজনীতি এবং ভূ-কৌশলগত অবস্থানের কারণে পুরো ব্যাপারটি জটিল আকার ধারণ করেছে। বাংলাদেশকে বার্মা এবং ভারতের সাথে আলোচনায় সফল না হলে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। কিন্তু এখানেই সমস্যা-----কারণ, এই যথাযথ ব্যবস্থা কে গ্রহণ করবে, সেটি একটি বার্নিং কোশ্চেন
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে মে, ২০০৯ দুপুর ২:৫৩