somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বেলজিয়ামের ইতিহাসে আজ অবধি ঘটে যাওয়া,সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর অপরাধের তালিকায় শীর্ষে যে ক্রাই্‌ম তা ঘটানো হয়েছিল বাংলাদেশের জন্য

১৯ শে ডিসেম্বর, ২০১৩ বিকাল ৪:৫৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



১৯৭১ সালের ২৪শে সেপ্টেম্বর বেলজিয়ামের লা সোয়েরে পত্রিকায় একটি ফোন আসে-

''আমি কিন্তু পেশাদার অপরাধী নই বরং শিল্পরসিক। বয়স মাত্র বিশ, একজন এতিম। মা বেঁচে থাকলে হয়তো এই কাজটা আমি করতাম না, কিন্তু মানুষের দুর্ভোগ আমার সহ্য হয় না...'''

কথাগুলো ‘লিমবার্গের থিল’ নামে নিজেকে দাবী করা সেই বেলজিয়ান তরুণ মারিও রয়মান্সের।

১৯৭১, পুর্ব বাংলায় তখন চলছে ভয়াবহ মৃত্যু উৎসব, মৃত্যু-ধ্বংস-পলায়ন- এ যেন নিত্যদিনের চিত্র! ছেঁড়া জীর্ণ কাপড়ে কোনরকমে নিজের শরীর ঢেকে রাখা এক মায়ের কোলে একটি অপুষ্ট শিশু, চোখদুটো যেন ঠেলে বেরিয়ে আসছে! কিংবা পথের পাশে পড়ে থাকা মানুষের লাশ ছিঁড়ে খুবলে খাচ্ছে কুকুর... অথবা ভীত-সন্ত্রস্ত্র হয়ে লোকজন দ্বিগবিদিক ছুটছে জীবন বাঁচাতে... সবারই লক্ষ্য সীমান্ত পার হয়ে পার্শ্ববর্তী দেশে...

দৃশ্যগুলি মুহুর্তেই অনুভূতিকে নাড়া দিয়ে যায়! দেখে কেমন যেন ঘোরের মধ্যে চলে যান মারিও রয়ম্যান্স, মা-বাবা হারা বিশ বছরের এক বেলজিয়ান তরুণ।
টেলিভিশনের নব ঘুরাতে ঘুরাতে ফ্লেমিশ এই তরুণ জানতে পারেন জায়গাটা পূর্ব পাকিস্তান যেখানে বিছিন্নতা দমনের নামে চলছে নির্বিচারে ভয়াবহ এক গণহত্যা।

তরুণ মারিও বেশিক্ষণ আর এই দৃশ্য দেখতে পারলেন না, টিভি বন্ধ করে দিলেন কিন্তু মাথার মধ্যে টিভিতে দেখা দৃশ্যগুলো যেন ঘুরে ফিরে আসতেই থাকে, অসহায় মা-শিশু, প্রাণভয়ে ছুটতে থাকা মানুষের ছবিগুলো তার মনকে আলোড়িত করে ভীষণভাবে।

সুদূর ব্রাসেলসে বসে টিভিতে এই দৃশ্যগুলো দেখে নিজেকে আর স্থির রাখতে পারলেন না এই তরুণ। ভয়ঙ্কর এই পরিকল্পনা ফাঁদলেন।

তিনি যা করলেন বেলজিয়ামের ইতিহাসে আজ অবধি ঘটে যাওয়া সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর অপরাধের তালিকায় শীর্ষেই আছে। ২৩শে সেপ্টেম্বর ব্রাসেলসের মিউজিয়াম অব ফাইন আর্টস থেকে তিনি চুরি করলেন ১৭ দশকের শিল্পী ইয়োহান ভারমিয়ারের আঁকা ‘দ্য লাভ লেটার’ নামের মাস্টারপিসটি, যার তখনকার বাজার মূল্য ছিলো ৫ মিলিয়ন ডলারের মত।





লা সয়েরে পত্রিকার একজন সাংবাদিক ওয়াল্টার শুল্ডেনকে মারিও জানালেন- চুরি যাওয়া ‘দ্য লাভ লেটার’ নামের মাস্টারপিসটি এখন তার কাছে আছে এবং মুক্তিপণ হিসেবে দাবী করলেন ২০০ মিলিয়ন ফ্রাংক যার মূল্যমান চার মিলিয়ন ডলার।

সাথে একটি শর্ত জুড়ে দিয়েছেন, টাকাটা তাকে নয়, পাঠিয়ে দিতে হবে ক্যাথলিক দাতব্য সংস্থা কারিতাসের দপ্তরে। আর সেটা অবশ্যই ব্যয় করতে হবে পূর্ব পাকিস্তানের অসহায় শরণার্থীদের পেছনে!

সেইসাথে হুমকি দেন- মুক্তিপণ ছাড়া পেইন্টিংটা উদ্ধারের চেষ্টা করা হলে এটা চিরতরে হারিয়ে যাবে। এর ব্যত্যয় ঘটলে তিনি সেটা বিক্রি করে দেবেন ল্যাটিন আমেরিকার এক ক্রেতার কাছে। আর সেইসাথে জাদুঘরে বাকি যে ৩৯টা ভারমিয়ার আছে, সেগুলোও চুরি করবেন।

লা সয়েরের কাছে খবর পেয়ে ডাচ জাদুঘর কর্তৃপক্ষ তড়িঘড়ি করে ব্রাসেলসে আসে। পেইন্টিংটা সত্যিই আসল কিনা সেটা যাচাই করার জন্য তারা একজন বিশেষজ্ঞ দিয়ে তা পরীক্ষা করার আবেদন জানায়।

গোয়েন্দা বিভাগের এটা কোন কৌশল ভেবে রাজি হয়না মারিও ।

দু’দিন পর ‘হেট ফক’ নামের আরেকটি পত্রিকায় টেলিফোন করেন তিনি এবং সময়সীমা বেধে দিয়ে বলেন-৬ অক্টোবরের মধ্যে মুক্তিপণ বাবদ ২০০ মিলিয়ন ফ্রাঙ্ক পরিশোধ না করলে তিনি পেইন্টিংটি বিক্রি করে দেবেন বলে হুমকি দেন।

শুধু তাই নয় সেই সাথে আরও কঠিন শর্ত আরোপ করে বলেন- পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থীদের জন্য এই মুক্তিপণ পরিশোধের ঘটনাটা টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার করতে হবে। সেখানে চুক্তিপত্রে সই করার সময় ছবিটির বীমার দায়িত্বে থাকা ব্রিটিশ কোম্পানি গ্রায়েম মিলারকে উপস্থিত থাকতে হবে।

এতকিছু করেও শেষ রক্ষা হয়না মারিওর। হ্যাসেটের যে পেট্রোলপাম্প থেকে ফোন করেছিলেন মারিও তার অপারেটর ঘটনাটি শুনে ফেলেন এবং পুরষ্কারের লোভে খবর দেন পুলিশকে।কারন এই চিত্রকর্মটি উদ্ধারের জন্য সরকার ইতোমধ্যে ২০ লাখ ফ্রাংক পুরস্কার ঘোষণা করেছে ।

গাড়িতে চড়ে বেশীদূর যেতে পারেননি মারিও। ধাওয়ার মুখে আশ্রয় নেন এক গোয়ালে। লিমবার্গের রবিনহুডকে খড় দিয়ে ঢাকা অবস্থায় আবিষ্কার করে পুলিশ।

বিচারে দুই বছরের সাজাও দেওয়া হয় রয়মান্সকে।

লিমবার্গের থিলের গ্রেফতারের ও সাজা দেওয়ার খবরটি জানাজানি হলে তীব্র প্রতিবাদে ফেটে পড়ে বেলজিয়াম । বেলজিয়াম বাসী এই সহজ সরল তরুণের একটা মহৎ উদ্দেশ্যে এমন বেপরোয়া ও অভিনব উদ্যোগকে অপরাধ হিসেবে দেখায় সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন । প্রতিবাদে তরুণেরা রাস্তায় নেমে আসে।বিভিন্ন মিডিয়া- সংবাদপত্রগুলো, রেডিও-টিভি তার পাশে দাঁড়ায়।তিনি হোটেল কর্মচারী ছিলেন , তাই সারা বেলজিয়ামের হোটেলের মালিক-কর্মচারিরাও রাস্তায় নামেন মারিওর নিঃশর্ত মুক্তির দাবীতে এবং পিটিশনে সাক্ষর সংগ্রহে।

সেই সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থীদের সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে দাতব্য সংস্থাগুলো। থিল অব লিমবার্গের আড়ালে ঢাকা পড়ে যায় মারিওর আসল পরিচয়, জনতার আবেগ আর ভালবাসার কারণে প্রশাসন নরম হতে বাধ্য হয়। জনতার দাবির মুখে নতি স্বীকার করে বেলজিয়ান সরকার । বেলজিয়ামের উচ্চ আদালত থিল অব লিমবার্গের সাজার মেয়াদ ১৮ মাস কমিয়ে ছয় মাস নির্ধারণ করে।

কারাভোগ রয়মান্সের জন্য বিশাল ক্ষতি্র কারণ হয় । শরীর ভেঙে যায় তাঁর। কিন্তু কারাগারে বাস করে মানসিক আঘাত পাওয়া রয়মান্স আর নিজেকে ফিরে পাননি। ১৯৭৮ সালে খুব অল্প বয়সে তিনি পৃথিবী ছেড়ে বিদায় নেন।


সংযুক্তি - (০৪০৭২০১৫)
এই পোস্ট প্রকাশের পর সম্প্রতি জানতে পারি ,বেলজিয়াম প্রবাসী আশিক আহমেদ বাপ্পী নেটে লিমবার্গের থিল সংক্রান্ত পোস্ট পড়ে রয়ম্যান্স বিষয়ে আগ্রহী হন । তিনি অনেক কষ্টে ঠিকানা সংগ্রহ করে বেলজিয়ামের নেরেমে মারিও রয়মান্সের সমাধিতে গিয়ে, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে একটি কার্ড ও ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান । ( ছবি সংযুক্ত)

এ যেন পুরো বাংলাদেশী জাতীর পক্ষ থেকে কিঞ্চিত কৃতজ্ঞতা , জাতির বহুবছরের দেনা ইঞ্চি পরিমাণ হলেও শোধ করার প্রয়াস ।
আশিক আহমেদ বাপ্পীর জন্যও শুভ কামনা ।




সমাধির এই অংশটুকু রয়ম্যান্স পরিবারের , নাম ফলকে উপরের নাম টি মারিও রয়ম্যান্সের পিতার -



বেলজিয়াম প্রবাসী আশিক আহমেদ বাপ্পীর, জাতির বহুবছরের দেনা ইঞ্চি পরিমাণ হলেও শোধ করার প্রয়াস -

সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা জুলাই, ২০১৫ দুপুর ২:৩৫
৮১টি মন্তব্য ৮১টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান।

লিখেছেন আহা রুবন, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৫০





ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান। আমরা দিন দিন কোথায় যাচ্ছি কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। আপনার দলের লোকজন চাঁদাবাজি-দখলবাজি নিয়ে তো মহাব্যস্ত! সে পুরাতন কথা। কিন্তু নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হচ্ছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। প্রধান উপদেষ্টাকে সাবেক মন্ত্রীর স্ত্রীর খোলা চিঠি!

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:০৩




সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে মুক্তি দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে খোলা চিঠি দিয়েছেন মোশাররফ হোসেনের স্ত্রী আয়েশা সুলতানা। মঙ্গলবার (২৯... ...বাকিটুকু পড়ুন

কেমন হবে জাতীয় পার্টির মহাসমাবেশ ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৫৬


জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিক্ষুব্দ ছাত্র জনতা আগুন দিয়েছে তাতে বুড়ো গরু গুলোর মন খারাপ।বুড়ো গরু হচ্ছে তারা যারা এখনো গণমাধ্যমে ইনিয়ে বিনিয়ে স্বৈরাচারের পক্ষে কথা বলে ,ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়াতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী

লিখেছেন সামিউল ইসলাম বাবু, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১২:১৩

ফিতনার এই জামানায়,
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী খুব প্রয়োজন ..! (পর্ব- ৭৭)

সময়টা যাচ্ছে বেশ কঠিন, নানান রকম ফেতনার জালে ছেয়ে আছে পুরো পৃথিবী। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে গুনাহ মুক্ত রাখা অনেকটাই হাত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×