স্বপ্নে দেখা এক রাজকন্যে……“কোয়েলাকান্থ” দ্য ফিস আউট অব টাইম ।
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
স্বপ্নে দেখা এক রাজকন্যে……
“কোয়েলাকান্থ” দ্য ফিস আউট অব টাইম ।
ক্রিসমাসের ঠিক দু’দিন আগের এক বিকেল। দক্ষিন আফ্রিকার কেপটাউনের উত্তর-পূবের ইষ্টলন্ডন বন্দরে এসে ভিড়লো মাছধরা ট্রলার “নেরাইন” ।ভারত মহাসাগরে মিশে যাওয়া চালুমনা নদীর মোহনায় সবেমাত্র মাছধরার কাজটি শেষ করেছে ফিরেছে সে । ডেক থেকে রাস্তায় পা রাখলেন নেরাইনের ক্যাপ্টেন হেনড্রিক গুসেন । এটা তার অনেকদিনের অভ্যেস । বন্ধু মিস ল্যাটিমারকে ডেকে এনে দেখানো, কি মাছ বা প্রানী ধরা পড়েছে তার নেরাইনের জালে । আর প্রয়োজন হলে একটি দু’টি বিরল প্রজাতির প্রানী দিয়ে দেয়া তার মিয়্যুজিয়মের জন্যে । একটি ছোট মিয়্যুজিয়ম এর কিউরেটর মিস ল্যাটিমার । কাজ কিছু নয়, সামুদ্রিক প্রানীদের নমুনা সংগ্রহ করা । হেনড্রিক গুসেন এর সাথে এজন্যেই সখ্যতা তার ।
সেদিন বত্রিশ বছরের মারজোরী কুর্টনে ল্যাটিমার খুব ব্যস্ত হয়ে আছেন একটি সরীসৃপের স্পেসিমেন মাউন্টিংয়ের কাজে । কাজে ব্যাঘাত ঘটলো হেনড্রিক গুসেন দরজা ঠেলে ঢুকে পরায় । কি জাতের মাছ ধরা পড়লো তা দেখার আমন্ত্রন গুসেন এর ।
কাজ ফেলে যাবার ইচ্ছে ছিলোনা মিস ল্যাটিমার এর । খানিকটা ভেবে নিয়ে দেখলেন, অন্ততপক্ষে নাবিক জেলেদের ক্রিসমাসের শুভেচ্ছা তো জানিয়ে আসা যায় । তাই গেলেন । সবার সাথে হাত মিলিয়ে ফিরে আসছেন, চোখ গেল মাছের স্তুপের ভেতর থেকে একটা নীলরঙা ফিন বেরিয়ে আছে দেখে । কৌতুহলে মাছের স্তুপ সরিয়ে দেখতে পেলেন পাঁচফুট লম্বা মাছটিকে । ধুসর নীল রং । রুপোলী ফুটকুড়ি দাগ তার গায়ে। কি প্রজাতির মাছ এটি বোধগম্য হলোনা মিস ল্যাটিমার এর । শুধু বুঝলেন, মাছটিকে এক্ষনি সংরক্ষন করা দরকার ।
পরে মিস ল্যাটিমার লিখেছেন, “ কিম্ভুত কিমাকার আর পাঁচফুটি মাছটি বয়ে নিতে ট্যাক্সিওয়ালার সাথে ঝগড়া করতে হলো । কারন সে এটি বইয়ে নিতে রাজী নয় আর আমার ইচ্ছে যতো দ্রুত মিয়্যুজিয়মে পৌছা যায় । হাতের কাছে যতো রেফারেন্স বই ছিলো হাতড়ে দেখলাম তা । একটি ছবির সাথে অনেকটাই মিলে গেল মাছটি । বুঝলাম কি খুজেঁ পেয়েছি আমি । হ্যা , এটা সেই মাছ যা নাকি হারিয়ে গেছে পৃথিবী থেকে প্রাগৈতিহাসিক কালে - দ্য ফিস আউট অব টাইম” ।
এই ছিলো প্রাগৈতিহাসিক মাছ “কোয়েলাকান্থ” এর আবার ফিরে আসার কাহিনী । আমার লেখা “সমুদ্রের নীচের দৈত্যপুরী”তে আমি“কোয়েলাকান্থ” এর কথা লিখেছিলাম । লিখেছিলাম মৎস্য কন্যার কথা । কেউ কেউ আবার “কোয়েলাকান্থ” সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন বিশদভাবে । সে কথা মাথায় রেখেই আবার “কোয়েলাকান্থ” এর কথায় ফিরে আসতে হলো ।
এতোবড় একটা আবিষ্কারের কাহিনী ঘটে গেল ১৯৩৮ সালের ২৩শে ডিসেম্বর । ঠিক আজকের (২৩ শে ডিসেম্বর) দিনটির সাথে মিল রেখে, যখন আমি এই লেখাটির শুরুটা লিখতে বসেছি । এর মাঝে গড়িয়ে গেছে তেহাত্তরটি বছর । গড়িয়ে গেছে কাহিনীও ।
ইষ্ট লন্ডন মিয়্যুজিয়ম এর ডিরেক্টর সরাসরি নাকচ করে দিয়েছেন মারজোরী কুর্টনে ল্যাটিমার কে । ধুর মেয়ে, এটা তো সাধারন একটা “পাহাড়ী কড মাছ”, একটি গ্রুপার । রাখো তোমার আবিষ্কার ।
ডিরেক্টর মহাশয় না মজলেও মজে আছেন যে ল্যাটিমার । কাজের টেবিলে বসেতখ্খনই ক্রুড একটি স্কেচ করে ফেললেন মাছটির । মাথার গঠন আর তিন স্তরে বিন্যস্ত লেজটির চেহারা যে মিলে যাচ্ছে লক্ষ লক্ষ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া একটি মাছের সাথে সে বিবরন সহ সেটি পাঠালেন গ্রাহামসটাউনের রোডস য়্যুনিভার্সিটির কেমেষ্ট্রির এক অধ্যাপক জে,এল.বি স্মিথের কাছে । স্মিথ তখন ক্রিসমাসের ছুটি কাটাতে বাইরে । তৎক্ষনাত জবাব মিললোনা ।
রাশিয়ান আর্মি যেদিন ঢুকে পড়লো ফিনল্যান্ডে সেদিন ইষ্টলন্ডন বন্দরে প্রস্তুত হচ্ছিলো আর একটি যুদ্ধক্ষেত্রের । দশদিন পরে ১৯৩৯ এর ৩রা জানুয়ারী ল্যাটিমার একটি কেবল পেলেন অধ্যাপক জে,এল.বি স্মিথের কাছ থেকে – “"MOST IMPORTANT PRESERVE SKELETON AND GILLS = FISH DESCRIBED." ।
ততক্ষনে মাথায় হাত দেয়ার ঘটনাটি ঘটে গেছে । স্পেসিমেনটি মাউন্ট করতে গিয়ে ল্যাটিমার মাছটির বেশ কিছু পচনশীল অংশ এরই মধ্যে ফেলে দিয়েছেন । খোঁজ… খোঁজ । নেই । মিয়্যুজিয়মের ভেতর তন্নতন্ন করে খোঁজা হলো। বাদ গেলোনা শহরের ডাষ্টবিনগুলোও । মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা, যে ছবিগুলো তোলা হয়েছিলো স্পেসিমেনটি প্রস্তুত করার সময় সেগুলোও নষ্ট হয়ে গেছে ।
নিজের কাজের বোঝা আর ক্যারিয়ারের দিকে খেয়াল রেখেও স্মিথ ভাবছিলেন কি করে, কতোখানি সময় তিনি দিতে পারবেন এরকম সম্ভাবনাময় একটি আবিষ্কারের পেছনে । তারপরেও ১৬ই ফেব্রুয়ারীর আগে তিনি আসতে পারলেন না ইষ্টলন্ডনে । মাথায় ক্রু-কাট চুল নিয়ে, পাতলা অথচ স্পোর্টিং শরীরে খাকি একটি বুশ-শার্টআর জীর্ণ একটি স্যান্ডাল পরা পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি লম্বা অধ্যাপকটি মাউন্টেড স্পেসিমেনটি দেখেই ঘোষনা করলেন, এটিই “কোয়েলাকান্থ” ,আর এই মাছটি অবশ্যই বেঁচে যাওয়া কোয়েলাকান্থ প্রজাতির একটি সদস্য । উচ্ছাসের বশে অধ্যাপক আরো বললেন, “আমি জানতাম, আমি সর্বদাই জানতাম, কোথাও না কোথাও, কোনও একদিন যে ভাবেই হোক,এরকম একটি প্রাগৈতিহাসিক প্রজাতির প্রানী আমাদের হাতে ধরা দেবেই” ।
ল্যাটিমারের পাওয়া এই মাছটিই ঘোষিত হলো এই বলে , "most important zoological find of the century" । বলা হয়ে থাকে, একটি জীবিত ডাইনোসরও এই রকম অসাধারন আবিষ্কারের কাছে বেশী বিস্ময়কর নয় ।
স্থানীয় একজন সাংবাদিককে “কোয়েলাকান্থ” এর মাত্র একটি ছবি তুলতে দেয়া হলো আর তা ছড়িয়ে গেল বিশ্বময় । রাতারাতি অধ্যাপক জে,এল.বি স্মিথ , মারজোরী কুর্টনে ল্যাটিমার আর কোয়েলাকান্থ পরিনত হলেন সেলিব্রিটিতে ।
কিন্তু প্রশ্নের আঙ্গুল ও উঠলো কম নয় । কারন অনেক প্রশ্নের জবাব মেলেনি মাছটির ইন্টারনাল অর্গানগুলো হারিয়ে ফেলার কারনে । কোয়েলাকান্থের গল্পের এখানেই শেষ নয় । স্মিথ কিন্তু বুঁদ হয়ে রইলেন এই আশার নেশা নিয়ে যে আর একটি এমোনতরো স্পেসিমেন খুজেঁ পেতেই হবে । যেখান থেকে মাছটি ধরা হয়েছে তার উপর নির্ভর করে স্মিথ ধরে নিলেন যে, মাছটি ভেসে এসেছে মোজাম্বিক স্রোতের সাথে উত্তর দিক থেকে । সাথে সাথে মাছটির ছবি সহ পুরষ্কার ঘোষনা দিয়ে পোষ্টারে ছেয়ে ফেললেন আফ্রিকার পূর্ব উপকুল । সুদুর কেনিয়া পর্য্যন্ত ছেয়ে গেল পোষ্টারে ।
হায় !
একযুগ পেরিয়ে গেল,দেখা মিললোনা মৎস্য কন্যার । রূপকথাই রয়ে গেল যেন ।
ভেবে চিন্তে স্মিথ হাতে নিলেন ভারত মহাসাগরে প্রাপ্ত সব প্রজাতির মাছেদেরই ক্যাটালগ তৈরীর মতো বিশাল এক প্রজেক্ট ।বত্তৃতা দিতে শুরু করলেন শহরে শহরে ।
এতেই ছড়িয়ে গেল এই ধারনাটি যে, “কোয়েলাকান্থ” সমুদ্র তলদেশের এক গভীর জলের প্রানী ।বিজ্ঞানীদের কল্পনাতেও এ ধারনা বাদ গেলনা । য়্যুরোপে শুরু হলো “ডীপ ওসেন” অভিযান ।কিন্তু স্মিথ অটল রইলেন এই ধারনায় যে, চেহারা-সুরত আর নীল রঙ এর কারনে এটি সত্যিকার ভাবেই গভীর জলের মাছ হতে পারেনা বরং এটি নীচু রীফ এলাকার কোনও কার্ণিভোরাস মাছ ।
জাঞ্জিবারে দেয়া এরকম একটি বত্তৃতায় আকৃষ্ট হলেন একজন ক্যাপ্টেন এরিক হান্ট । জাতিতে বৃটিশ এই লোকটি মোজাম্বিক চ্যানেলের ছোট ছোট দ্বীপগুলোতে তার নিজের জাহাজ “Nduwaro”তে চেপে ব্যবসা করেন ।বুদ্ধিতে দীপ্ত, কৌতুহলী আর সামুদ্রিক প্রানীদের বিষয়ে উৎসুক হান্ট আজব কোয়েলাকান্থের এই গল্পের প্রেমে পড়ে গেলেন । স্মিথ আর স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় এরিক হান্ট নতুন করে পুরস্কার সংক্রান্ত পোষ্টারটিতে ছেয়ে ফেললেন কমোরো আয়ল্যান্ডস । তাঞ্জানিয়া আর মাদাগাস্কার দ্বীপের মাঝামাঝি এই দ্বীপপুঞ্জটি ।
প্রথম জীবিত কোয়েলাকান্থটি ধরা পড়ার চোদ্দ বছর পরে, ১৯৫২র ডিসেম্বরের ২১ তারিখে ক্যাপ্টেন এরিক হান্ট ফিরছিলেন কমোরিয়ান আয়ল্যান্ডসের আঞ্জুয়ান দ্বীপটির মাৎসামুডু বণ্দরে । তার পথ রোধ করে দাঁড়ালো দু’জন কমোরিয়ান , একটি ভারী বস্তা তাদের কাঁধে । এদের মধ্যে একজন, আহমাদী আবদাল্লাহ , যে হাতের বড়শিতে একটি মাছ ধরেছে স্থানীয় লোকজন যাকে বলে "mame" বা "Gombessa" । এর কথাই তারা বলতে এসেছে ক্যাপ্টেন হান্টকে । এদেরকে নিয়ে এসেছে চালাক-চতুর এক স্কুলশিক্ষক, আফানে মোহামেদ । পোষ্টারে দেয়া ছবির সাথে মাছটির মিল রয়েছে দেখেই সে পুরস্কারের আশায় হান্টের কাছে এসেছে মাছটি নিয়ে । আশায় উদ্বেলিত হলেন হান্ট । এইবার বুঝি দেখা মিললো স্বপ্নের মৎস্যকন্যার । ছুটলেন,স্পেসিমেনটি রক্ষার কাজে ।ভালো কোনও প্রিজারভেটিভ পাওয়া গেলনা, অবশেষে লবনই ভরসা । তাই-ই মাখানো হলো মাছটিতে । তার নিজের জাহাজ “Nduwaro”তে তুলে চললেন ক্ষুদ্র দ্বীপ মায়োত্তির Dzaoudzi বন্দরে যেখানে মিলবে ফরমালিন । এরই মধ্যে হান্ট জেনে গেছেন, কি অপরিসীম বৈজ্ঞানিক গুরুত্ব এই আবিস্কারের কারন একটি অসতর্ক ভুলের মাশুল গুনতে হয়েছে চোদ্দটি বছর ধরে। তাই আভ্যন্তরীন অঙ্গপ্রতঙ্গ সংরক্ষনে মাছটির ভেতরে ঢুকিয়ে দিলেন ফরমালিন । তারবার্তা পাঠালেন অধ্যাপক স্মিথকে দক্ষিন আফ্রিকাতে । অপেক্ষা করতে থাকলেন স্মিথের সাড়া দেয়ার । বন্দরের কাছাকাছি পামানজী শহরে থাকা ফ্রেঞ্চ কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত ছিলেননা যে এটাই রূপকথার কোয়েলাকান্থ । তবুও যুগান্তকরী কিছু যদি একটা ঘটেই যায় তবে সেই ঘটনার সাথে নিজেদের সম্পৃক্ততা মোটেও থাকবেনা, এটা ভেবেই তারা কাছের মাদাগাস্কার দ্বীপের ফ্রেঞ্চ বৈজ্ঞানিক কর্তৃপক্ষকে তারবার্তা পাঠালেন । কোনও জবাব এলোনা কোথা থেকেও । সাড়া না পেয়ে পামানজী কর্তৃপক্ষ স্থির করলেন মাছটি তারা নিজেদের আওতায় নিয়ে নেবেন যদি অধ্যাপক স্মিথ এসে হাজির না হন । উপায় নেই দেখে হান্ট দ্বিতীয় একটি বার্তা পাঠালেন স্মিথকে যেন কোনও কালক্ষেপন না করে তিনি অচিরেই কমোরস এ হাজির হন ।
আর স্মিথ ?
এক যুগেরও বেশী সময়কাল ধরে যে আচ্ছনতাকে লালন করেছেন স্মিথ তা হয়তো বন্ধনমুক্ত হতে পারে, এই হঠাৎ প্রাপ্তিটা যদি সত্যি সত্যিই কোয়েলাকান্থ হয়ে ওঠে । তাই ভেতরে ভেতরে তার ফেনিয়ে উঠছে একটা ভীতি, যদি তা না হয় ! অস্থির হলেন তিনি । দক্ষিন আফ্রিকার প্রধানমন্ত্রী মালানের সাথে দর কষাকষি করলেন একটি উড়োজাহাজের জন্যে যা তাকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে কমোরোসে । অনুমতি মিললো মালানের । একটি ডিসি-৩ “ডাকোটা” বিমান ফ্রেঞ্চ অধিকৃত আকাশ সীমার ভেতর উড়িয়ে নিয়ে এলো তাকে তার ঈপ্সিত রাজকন্যার কাছে । ভয় ছিলো, আকাশপথে ফ্রান্সের ফাইটার বিমানগুলো তার ডাকোটাকে ইন্টারসেপ্ট করে যদি । তাহলে স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে । অবশেষে কোনও ঘটনা ছাড়াই পৌছে গেলেন তিনি ।“Nduwaro”র ডেক এ শায়িত দীর্ঘ প্রতীক্ষিত রাজকন্যাকে দেখে কেঁদে ফেললেন স্মিথ । হ্যা, এই সেই স্বপ্নের রাজকন্যা “কোয়েলাকান্থ” যাকে খুঁজে পেতে তাকে পার করতে হয়েছে চোদ্দটি বসন্ত ।
কোয়েলাকান্থ তো পাওয়া গেছেই, জানা গেছে তার আবাসস্থল । বিশ্বময় ছড়িয়ে গেল খবরটি ।
এর পর ?
পরের অধ্যায়টি বিষাদময় ।
নিজেকে প্রতারিত ভাবলেন ফ্রেঞ্চ কর্তৃপক্ষ কারন তারই অধিকৃত এলাকা থেকে তারই নাকের ডগা দিয়ে শতাব্দীর শ্রেষ্ট আবিস্কারটি করে ফেললেন একজন দক্ষিন আফ্রিকান । তাই নিষিদ্ধ করে দিলেন নন-ফ্রেঞ্চ রিসার্চারদের জন্যে “কোয়েলাকান্থ” এর এলাকা । ১৯৭০ সালে কমোরোস আয়ল্যান্ড ফ্রান্সের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ না করা পর্য্যন্ত এই নিষেধাজ্ঞা বজায় রেখেছিলেন ফ্রেঞ্চ কর্তৃপক্ষ ।
যুগান্তকরী এই আবিস্কারের সাথে যুক্তচারজনের একজন, এরিক হান্ট–যার মৃত্যু ঘটে অস্বাভাবিক ভাবে দূর্ঘটনায় । কমোরোস আর মাদাগাস্কারের মধ্যেকার গেইসার ব্যাংকের ধারালো রীফের আঘাতে তার শ্যুনার ছিন্নবিচ্ছিন্ন হলে তিনি হারিয়ে যান চিরকালের জন্যে সমুদ্রের অথৈ জলে । তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি ।
১৯৬৮সালে দীর্ঘ রোগভোগের পরে অধ্যাপক জে,এল.বি স্মিথের মৃত্যু ঘটে আত্মহত্যায় । এই দুটি অপমৃত্যুকে আবার আপনি ফারাও তুতেনখামেন এর রহস্যময় ঘটনাবলীর সাথে গুলিয়ে ফেলবেন না যেন ।
আর নাবিক ক্যাপ্টেন হেনড্রিক গুসেন ১৯৮৮ সালে, কোয়েলাকান্থ আবিস্কারের পনের বছরপূর্তির পরে পরেই ইহধাম ত্যাগ করেন ।
আর এ পর্য্যন্ত ইতিহাসে বর্নিত সর্বশ্রেষ্ট মৎস্য-কাহিনীটির কেন্দ্রীয় চরিত্র মারজোরী কুর্টনে ল্যাটিমার বেঁচে ছিলেন ৯৭ বছর, ২০০৪ সালের ১৭ই মে দিনটির শেষ আলোটুকু ইষ্ট-আয়ল্যান্ডের আকাশ থেকে মুছে যাওয়ার আগ পর্য্যন্ত ।
১৯৩৮ সাল পর্য্যন্ত যা ছিলো ৬৫ মিলিয়ন বছর আগে প্রাগৈতিহাসিক ডাইনোসরদের সাথে বিলিন হয়ে যাওয়া একটি জলজপ্রানীর ‘ফসিল’ মাত্র, তা রূপকথার রাজ্য থেকে কোন সে প্রানের টানে বাস্তব হয়ে উঠে এসেছিলো মারজোরী কুর্টনে ল্যাটিমারের স্পেসিমেন টেবিলে তা কে জানে ! আর তাই বুঝি তার বৈজ্ঞানিক নাম হয়ে গেল Latimeria chalumnae , মারজোরী কুর্টনে ল্যাটিমারের প্রতি সম্মানে । সম্প্রতি আরো যে ফসিল পাওয়া গেছে তা ৮০ মিলিয়ন বছর আগের সাক্ষ্য দেয় । কিন্তু তার আগের পুরোনো ফসিলগুলো প্রায় ৩৬০ মিলিয়ন বছর আগেও যে কোয়েলাকান্থেরা সাতরে বেড়াতো সমুদ্রে আর মিঠা পানিতে তার কথা বলে । বিজ্ঞানীরা বলেন, সেকালে কোয়েলাকান্থেরা ঝাঁক বেঁধে বেড়াতো আর তাদের ছিলো প্রায় ৯০টির মতো প্রজাতি । তাই হয়তো কমোরোসএর Latimeria chalumnaeর চেহারা সুরত প্রাপ্ত ফসিল থেকে খানিকটা ভিন্নতর । যদিও সব কোয়েলাকান্থ বিচিত্র রূপে চিত্রিত তথাপিও তাদের বিশেষ আকার আকৃতি আর বিভক্ত ফিনের কারনেই চিনে নিতে পারা যায় সহজেই। তাই বোধহয় কবি লিখে গেছেন, “একদিন চিনে নেবে তারে ।”
এতোদিন যাকে জানতাম শুধু পশ্চিম ভারত মহাসাগরের কোমোরস দ্বীপপুঞ্জের মৎস্যকন্যা, এইতো সেদিন ১৯৯৭ সালের সেপ্টেম্বরে দেখা গেল তাকে ৬ হাযার মাইল দুরের ইন্দোনেশিয়ার উত্তর সুলাউয়েসি ভূমিখন্ডের সমুদ্রে । এটি কোয়েলাকান্থের দ্বিতীয় ধরা পড়া ।
তৃতীয়টি ধরা পড়লো ১৯৯৮ সালের জুলাই মাসে । দুটোই ধরা পড়লো ইন্দোনেশিয়ার কোরাল রীফ ইকোলোজী ঘাটিয়ে দেখতে আসা ডক্টরেট এর ছাত্র Mark V. Erdmann এর জালে । ইন্দোনেশিয়ায় ধৃত কোয়েলাকান্থটিকে বর্ণনা করা হলো নতুন একটি প্রজাতি হিসাবে । ১৯৯৯সালের এপ্রিলে এর নাম দেয়া হলো “Latimeria menadoensis” । আর ঘোষনা করা হলো, সকল Latimeriaই “Endangered Species” । ঘোষনাটি এলো Convention on International Trade in Endangered Species of Wild Flora and Fauna (CITES) মাধ্যমে ।
যদিও বাইরে থেকে ইন্দোনেশিয়ায় প্রাপ্ত কোয়েলাকান্থ দু’টি পশ্চিম ভারত মহাসাগরের কোয়েলাকান্থটির মতোই দেখতে তবুও তাদের টিস্যুর ডিএনএ বিশ্লেষনে বোঝা গেল তাদের জেনেটিক পার্থক্য অনেক । বিশ্লেষকরা ধারনা দিলেন, দু’টো প্রজন্ম আলাদা হয়ে থেকে ছিলো মিলিয়ন মিলিয়ন বছর ধরে যদিও এদের বাহ্যিক আকার-আকৃতি, চাল-চলন তেমন একটা পাল্টায়নি । থিওরী অব ইভ্যালুয়েশান কি টলে গেল খানিকটা ? তর্ক আছে অনেক এ নিয়ে, সে কথা থাক ।
নাতিশীতোষ্ণমন্ডলের “টোয়ালাইট” জোনের প্রানী এরা । পায়ের মতো চারটি ডরসাল এবং পেক্টোরাল ফিন রয়েছে এদের ঠিক যেন মৎস্যকন্যা এক । ভলকানিক আয়ল্যান্ডের ঢালুতে ৫০০ থেকে ৮০০ ফুটের মধ্যে এদের বিচরন । দিনের আলোতে এদের দেখা মেলা ভার । লুকিয়ে থাকে জলের নীচের লাভার তৈরী গুহায় । রাতের বেলা শিকারের খোঁজে বেরিয়ে আসে বাইরে । আসলে এরা "passive drift feeder" ধীরে ধীরে সাঁতরায় জলের উপরিস্তরের নীচে যেখানে আছে ক্যাটেলফিস, স্কুইড, অক্টোপাস আর অন্য মাছেরা । এইসব প্রানীই এদের শিকার । সম্প্রতি দক্ষিন আফ্রিকাতে তাদের সাতরাতে দেখা গেছে ৩০০ থেকে ৩৫০ ফুট গভীরতায় । তাই এরা যে অতল জলের আহ্বান দেয় বলে এতোদিন আপনি জানতেন তা কিন্তু ভুল ।
‘কোথায় পাবো তারে?” এমোন একটি কবি কবি ভাব এতোক্ষনে জেগে উঠতেই পারে আপনার মনে !
তাহলে বলি-
“আমার স্বপ্নেদেখা রাজকন্যে থাকে
সাতসাগর আর তের নদীর পাড়ে
ময়ুরপঙ্খী ভিড়িয়ে দিয়ে সেথা
দেখে এলেম তারে…”
হ্যা, তাকে দেখতে হলে আপনাকে যেতে হবে সুদুর আফ্রিকার পূব-উপকুল আর মাদাগাস্কার দ্বীপের মাঝে ।
মযূরপঙ্খীতে নয়, যেতে হবে সাব-মার্সিবল কিছুতে চড়ে । তাকে খুঁজে পাবেন সেখানকার সমুদ্রের গভীর গিরিখাতে (deep canyons )। অতি সম্প্রতি আপনাদের মতো মৎস্যকন্যা দেখায় উৎসাহী অনেক সী-ডাইভার আর বিজ্ঞানীরা তাদেরকে দেখে এসেছেন । দেখেছেন মোজাম্বিক আর কেনিয়ার জলেও ।
আর ইন্দোনেশিয়ার জলে সাম্প্রতিক দেখা এবং ধৃত কোয়েলাকান্থের কথা তো জেনেইছেন একটু আগে । দু’দুটো সাইট সিইংযের মধ্যে ধরা পরেছে দুটোই কিন্তু সংরক্ষন করা গেছে মাত্র একটি । এর পরেও তাদের দু’দুবার জীবন্ত ঘুরে বেড়াতে দেখা গেছে ইন্দোনেশিয়ার মানাদোতুয়া দ্বীপের ২২৫ মাইল দক্ষিন-পশ্চিমে ।এর বাইরে কোথাও এদের দেখা মেলেনি আর ।
যে এলাকায় আপনার স্বপ্নে দেখা রাজকন্যে থাকে তা কিন্তু আপনারই বাড়ীর পাশে ভারত মহাসাগরের জল ।
শুধু আপনার জন্যেই কি সে প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে এখোনও ঘুরে মরছে আপনারই কাছে ???
যদি ভালোলাগে তবে দেখুন -
“সমুদ্রের নীচের দৈত্যপুরী”
Click This Link
৮টি মন্তব্য ৮টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান।
ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান। আমরা দিন দিন কোথায় যাচ্ছি কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। আপনার দলের লোকজন চাঁদাবাজি-দখলবাজি নিয়ে তো মহাব্যস্ত! সে পুরাতন কথা। কিন্তু নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হচ্ছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। প্রধান উপদেষ্টাকে সাবেক মন্ত্রীর স্ত্রীর খোলা চিঠি!
সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে মুক্তি দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে খোলা চিঠি দিয়েছেন মোশাররফ হোসেনের স্ত্রী আয়েশা সুলতানা। মঙ্গলবার (২৯... ...বাকিটুকু পড়ুন
কেমন হবে জাতীয় পার্টির মহাসমাবেশ ?
জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিক্ষুব্দ ছাত্র জনতা আগুন দিয়েছে তাতে বুড়ো গরু গুলোর মন খারাপ।বুড়ো গরু হচ্ছে তারা যারা এখনো গণমাধ্যমে ইনিয়ে বিনিয়ে স্বৈরাচারের পক্ষে কথা বলে ,ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়াতে... ...বাকিটুকু পড়ুন
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী
ফিতনার এই জামানায়,
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী খুব প্রয়োজন ..! (পর্ব- ৭৭)
সময়টা যাচ্ছে বেশ কঠিন, নানান রকম ফেতনার জালে ছেয়ে আছে পুরো পৃথিবী। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে গুনাহ মুক্ত রাখা অনেকটাই হাত... ...বাকিটুকু পড়ুন
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী খুব প্রয়োজন ..! (পর্ব- ৭৭)
সময়টা যাচ্ছে বেশ কঠিন, নানান রকম ফেতনার জালে ছেয়ে আছে পুরো পৃথিবী। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে গুনাহ মুক্ত রাখা অনেকটাই হাত... ...বাকিটুকু পড়ুন
জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা
বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন