অবিকল সেই আবহ
এখন থেকে ৪২ বছর আগে হুবহু এইরকম একটি পরিস্থিতি নেমে এসেছিল ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এই বাংলাদেশজুড়ে। তখন এই মুসলমানিত্ব যাচাইয়ের পরীক্ষক ছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আর তাদের সহযোগী জামায়াতি রাজাকাররা। আর এখন পরীক্ষক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে হেফাজতে ইসলামের আবরণে কওমী মোল্লা বাহিনী। এবারও সহযোগী হিসেবে আছে সেই জামায়াতি রাজাকাররা, বিপুল অর্থের ভাণ্ডারসহ। এরা খুব মনোযোগ সহকারে জনে জনে মুসলমানিত্বের পরীক্ষা নিচ্ছে। যেন ওই পরীক্ষায় পাশ করলেই কেবল কেউ মুসলমান হতে পারবে, নইলে কাফের। মানসিক রোগী মাহমুদুর রহমানের আমার দ্বেষের ওপর ভর করে তারা দুদিন পর পর হুক্কা-হুয়া রব তুলে এলান পেশ করছে- 'এই লোক নাস্তিক', 'ওই লোক কাফের', 'অমুকের কল্লা লাগবে', 'তমুকের ফাঁসি চাই'। মহানবী নিজে কাউকে কাফের সাব্যস্ত না করার জন্য সাবধান করে দিয়েছেন তার অনুসারীদের। তবু এখনকার বাংলাদেশে নাস্তিকের কল্লা যেন সবচেয়ে সস্তা। যেন চাইলেই এক কোপে নিয়ে ফেলা যায়। যেন নাস্তিকের কল্লা নিলেই ইসলামকে পরিপূর্ণ শান্তির ধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা যাবে! ১৯৭১ সালে ঠিক এমনিভাবেই মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে ধর্মবিরোধিতার অভিযোগ তোলা হয়েছিল। চার দশক পর ওই একই ধর্মব্যবসায়ীরা সেই তরুণদের বিরুদ্ধে ধর্মবিরোধিতার অভিযোগ তুলে যাচ্ছে, যারা তাদের মুখোশ উন্মোচন করে দিচ্ছিল শ্রেফ কি-বোর্ড চালিয়ে।
নাস্তিকতায় কার কী এসে যায়!
গুগলে সার্চ করলেই দেখা যায়, কথায়-লেখায়-ছবিতে ইসলামকে চরম অপমান করা হয়েছে- এমন ওয়েবসাইটের সংখ্যা বিশ্বে হাজার হাজার। হেফাজতে ইসলামের কি সাধ্য আছে, এদের কোনো একটির কেশাগ্র স্পর্শ করার? বিশ্বে নাস্তিক আছে কোটি কোটি। হেফাজতে ইসলামের কি সাধ্য আছে, এদের কারো দিকে আঙ্গুলখানি শুধু তোলার? অথবা নাস্তিকের একটি গুগল একাউন্ট কিংবা একটি ফেসবুক একাউন্ট বন্ধ করার আবদারটুকু তুলে দেখুক তো! গুগল-ফেসবুকের যা কড়া নীতি, তাতে হয়তো এহেন অনুরোধকারীদের ভার্চুয়াল বলাৎকারই করে দেবে, সে আলেম হোক আর জালেম হোক। হেফাজতের ভণ্ড মোল্লাগুলো নিজেরাও সেটি জানে ভালোই।
আমি নিজে মুসলিম, যদিও ধর্মপরায়ণতা কিংবা ধর্মহীনতা কোনোটিতেই আমার উৎসাহ নেই। এটি একান্তই আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। এটি নিয়ে কারো নাক গলানোর সুযোগ নেই। কোনো ভণ্ড আল্লামা, হেফাজতে কি নেজারতে ইসলামের কাছে নিজের মুসলমানিত্বের পরিচয় দিতে ইচ্ছুক নই। তবু যেটুকু জ্ঞান আমার, তাতে জানি বিশেষ কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর অবমাননায় ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার মতো ধর্ম ইসলাম নয়। যদি সেটিই হতো, তাহলে এতো হাজার বছর পরও ইসলাম টিকে থাকতো না। প্রতি ৫০ হাজার ব্লগারের মধ্যে একজন হয়তো ধর্ম নিয়ে টানাহেঁচড়া করেন, তাতে কি বাকি সব ব্লগারই ধর্মবিরোধী নাস্তিক হয়ে যান? আর ইসলামের হেফাজতকারী তো স্বয়ং আল্লাহ, কোথাকার কোন্ মৌলোভী শফী, সবচেয়ে নিম্নমানের ব্লগারটিও যার চেয়ে বিদ্যাবুদ্ধিতে অগ্রসর, সেই লোক কিংবা তার সাঙ্গপাঙ্গ কিভাবে ইসলামের হেফাজতকারী হতে পারেন? এ কি ইসলামেরই অপমান নয়?
বড়ো আকারে দেখার জন্য ক্লিক করুন এখানে
ইসলামের নয়, জামায়াতের হেফাজত
প্রকৃতপক্ষে এটা এখন কারোরই অজানা নয়- এসবই হল ভেক। ধর্মকে বর্ম বানিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার থেকে মানুষের চোখ অন্যদিকে ফিরিয়ে নেওয়ার অপচেষ্টা। সেজন্য হেফাজতে ইসলাম নেতার ফোনালাপও শোনা লাগে না। দিনের আলোর মতোই স্পষ্ট যে, গণজাগরণ মঞ্চকে ঠেকানোর জন্যই কেবল হেফাজতে ইসলামের সাইনবোর্ডে আশ্রয় নেওয়া এই বর্বর মোল্লাগুলোকে লেলিয়ে দিয়েছে জামায়াতিরা। দিনে দিনে অনেক কাহিনীই এখন জানা যাচ্ছে। অথচ জামায়াত নেতা রফিকুল ইসলাম খান ও শফিকুল ইসলাম মাসুদ যখন হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে নিজামীর সঙ্গে তুলনা করে বক্তব্য দেন, তখন এই হেফাজতে ইসলাম স্বাভাবিকভাবেই গর্তে ঘাপটি মেরে ছিল। তখন আবার তাদের ঈমান তেমন একটা ক্ষতিগ্রস্থ হয়নি!
ইতিহাসের এমনই মিল! একাত্তরে এই মোল্লারাই ইসলাম গেল, ইসলাম গেল রব তুলে প্রাণপণ চেষ্টা করেছে মুক্তিকামী মানুষকে ঠেকানোর। তাতে কাজ হয়নি। ভণ্ড মোল্লার মুখে লাথি দিয়ে মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল যুদ্ধে। সেই মানুষের কজনই বা ছিল হিন্দু? ৩০ লাখ শহীদের মধ্যে ১০ কি ২০ ভাগ হয়তো হিন্দু ছিল। বাকি সকলেই কি মুসলমান ছিল না? তবু ওই খানকির পোলাদের কাছে মুসলমানিত্বের পরীক্ষা দিতে হবে!
এই হেফাজতের নেতারা যে আজই জামায়াতের স্বার্থ রক্ষা করছে তা নয়, একাত্তরেও তারা ওই কাজটিই করেছে নিষ্ঠার সঙ্গে। বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের নেতারা আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ করেছেন, ঢাকার লালবাগ, চট্টগ্রামের হাটহাজারী ও পটিয়া মাদ্রাসা, ফটিকছড়ির বাবুননগর মাদ্রাসা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জামেয়া ইউনুছিয়াসহ উল্লেখযোগ্য কওমি মাদ্রাসাগুলো একাত্তরে মুজাহিদ বাহিনীর ক্যাম্প ছিল। এসব মাদ্রাসার ওহাবী ও খারিজি মৌলভিরা একাত্তর সালে ফতোয়া দিয়েছিলেন, অমুসলিমদের সম্পত্তি গণিমতের মাল।
হেফাজতে ইসলামের আমির শাহ আহমদ শফী একাত্তরে মুজাহিদ বাহিনী গঠন করে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের সহায়তা করেন বলে দাবি করেছে বাংলাদেশ সম্মিলিত ইসলামী জোট। জোটের সভাপতি হাফেজ মাওলানা জিয়াউল হাসান বলেন, "হেফাজতের নেতা আহমদ শফী একাত্তরে পাকিস্তানকে রক্ষার জন্য মুজাহিদ বাহিনী গঠন করে পাকিস্তানি সেনা আর রাজাকারদের সব কাজে সহযোগিতা করেন।"
অথর্ব আওয়ামী লীগ, গণবিরোধী বিএনপি
'নাস্তিক ব্লগার' 'নাস্তিক ব্লগার' রব তুলে মোল্লারা রীতিমতো কাবু করে ফেলেছে সরকারকে। সেই চাপে সরকার দুদিন পর পর মাথাভারি কমিটি আর সাইরেন বাজিয়ে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি জারি করে যাচ্ছে। মোল্লাদের আনুগত্য অর্জনের জন্য এমন কোনো চেষ্টা নেই, যা এই সরকার করছে না। অবস্থা দেখে মনে হয়, আওয়ামী লীগ সরকার দুধকলা দিয়ে আলখেল্লাধারী এই কালো সাপগুলোকে পোষার নিয়ত করেছে। এমনকি হেফাজতের উত্থানের জন্য সরকারই অনেকাংশে দায়ী বলে অনেকেরই বিশ্বাস। মোল্লাদের চাপের মুখে যৌক্তিক কোনো কারণ ছাড়াই শ্রেফ 'সন্দেহের বশে' নির্বিচারে ব্লগারদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, তাদের ওপর নির্যাতনও চালানো হয়েছে বলে আমরা জেনেছি। নিরীহ ব্লগারের কি-বোর্ডের ভয়েই যখন এই অবস্থা, অথর্ব এই সরকারের কাছে আমরা আর কী আশা করতে পারি?
অন্যদিকে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি জামায়াতে-হেফাজতে ইসলামীর অশুভ তৎপরতার প্রতি সমর্থন জানিয়ে যাচ্ছে অনুগত ভৃত্যের মতো। বরাবরই বিএনপির অভিযোগ থাকে, সরকার দেশকে নৈরাজ্য ও গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। অথচ এই বিএনপিই জামায়াত-শিবিরের সহিংস তৎপরতায় প্রত্যক্ষভাবে ইন্ধন যুগিয়ে যাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের একজন সেক্টর কমান্ডারের গড়া এই দলটি নিজেকে মুক্তিযোদ্ধাদের দল হিসেবে দাবি করে। অথচ এই দলটিই যুদ্ধাপরাধীদের পাশে নিয়ে যুদ্ধাপরাধের বিচার বন্ধের আহবান জানায়। বিএনপির অবস্থান এখন পুরোপুরিই গণবিরোধী।
উপড়ে ফেলতে হবে বিষদাঁত
জামায়াত-শিবিরের ধারাবাহিক ত্রাস ও তাণ্ডব, যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে মরিয়া হেফাজতে ইসলামের বিষবাষ্প আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে একাত্তরে তাদের চেহারা কেমন ছিল। জামায়াত-শিবির তো বটেই, হেফাজতে ইসলামের নেতারাও সেই সময় বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে দেশজুড়ে ইতিহাসের ভয়াবহতম নৃশংস ঘটনাগুলোই ঘটিয়েছিল। জামায়াত-শিবির বরাবরই আছে সেই একাত্তরের সেই চিরচেনা চেহারায়। হেফাজতের ভন্ড মোল্লাগুলো এতোদিন ঘাপটি মেরে ছিল কওমি মাদ্রাসার আড়ালে। চার দশক পর তারা ফিরেছে সেই আগের চেহারায় - 'নাস্তিক ব্লগার' দমনের নাম দিয়ে একাত্তরের নরপশু যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষার মিশন নিয়ে। জামায়াত-শিবির যত বেশি জনসমর্থন হারাচ্ছে, তাদের তাণ্ডবও ততোই বীভত্স হতে শুরু করেছে। ধর্ম তাদের শেষ অস্ত্র, হেফাজতকে সামনে রেখে সেই অস্ত্রের ব্যবহার অবশেষে তারা শুরু করেছে। হেফাজতে ইসলাম যে ১৩টি মধ্যযুগীয় দাবি তুলেছে, সেগুলো বাস্তবায়ন হওয়ার আগে বিবেকবান যে কোনো মানুষের মরে যাওয়াই ভালো।
চার দশক ধরে অনেক ঘাত-প্রতিঘাত সয়ে টিকে থাকা এই বাংলাদেশ আফগানিস্তান হতে পারে না, পাকিস্তান হতে পারে না, ধর্মান্ধ মোল্লাদের অধিকারে যেতে পারে না। এদের বিষদাঁত উপড়ে ফেলতে হবে। নইলে বিষধর এই সাপের হাত থেকে কেউই রেহাই পাবে না, হুজুরদের কাছে আনুগত্য প্রকাশে মরিয়া হয়ে ওঠা আওয়ামী লীগও নয়। এদের প্রতিহত করা এখন সময়ের দাবি। আমি নিশ্চিত, এই ধর্মব্যবসায়ীরা একাত্তরের মতোই হারবে আবার। নভোযান জুনো বৃহস্পতির কক্ষপথে যাক কিংবা না যাক, মঙ্গল থেকে কিওরিসিটি ফিরুক কিংবা না ফিরুক - ধর্মব্যবসায়ীদের হারাতেই হবে।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই এপ্রিল, ২০১৩ সন্ধ্যা ৬:১০