১ এপ্রিল মঙ্গলবার রাত ১১টার দিকে সামহোয়্যারইনের ব্লগার রাসেল পারভেজকে নিজ বাসা থেকে ধরে নিয়ে গেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) একটি টিম। একাধিক মাধ্যমে তার স্ত্রী এই খবরের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। ব্লগার মশিউর রহমান বিপ্লবেরও একই হাল হয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। প্রায় একই সময় থেকে আরেকজন ব্লগার সুব্রত শুভকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানাচ্ছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের ছাত্র শুভকে তার হলের সামনে থেকে একটি গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে গেছেন ৫-৬ জন অপরিচিত ব্যাক্তি।
আপডেট ১ : আমারব্লগ কি বাংলাদেশে ব্লকড?
১ এপ্রিল দুপুরের পর থেকে বাংলাদেশের বেশ কিছু ইন্টারনেট নেটওয়ার্ক থেকে আমারব্লগ ডট কম দেখা যাচ্ছে না। যদিও প্রক্সি সাইটগুলো থেকে ব্লগটি ঠিকই দেখা যাচ্ছে। এ থেকে ধারণা করা হচ্ছে, সরকার ওই ব্লগটি ব্লক করে দিয়েছে, যে কারণে বাংলাদেশ থেকে আর খোলা যাচ্ছে না। আমারব্লগের এডমিন সুশান্ত দাশগুপ্ত তার ফেসবুক টাইমলাইনে জানিয়েছেন, তারা এখনও বিটিআরসি কিংবা তথ্য ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় কিংবা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয় থেকে কোনো অফিসিয়াল চিঠি পাননি। তিনি বলেন, "আদৌ বাংলাদেশ সরকার আমারব্লগ ব্লক করেছে কিনা অথবা করলেও ঠিক কী কারণে করা হয়েছে সেটিও আমাদের জানা নেই।"
===
স্মরণাতীতকালে এমন দুঃসময় আর এমন মহাদুর্যোগ আর আসেনি, বাংলা ব্লগমণ্ডল এখন যার মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। ব্লগার—এই মুহূর্তের বাংলাদেশে সবচেয়ে আলোচিত চরিত্র, সবচেয়ে দুর্ভাগাও। সরকারি হিসেবেই সংখ্যায় তারা প্রায় আড়াই লাখ। তবু এই মুহূর্তে তাদের মতো নিঃসঙ্গ কেউ নেই, তাদের পাশেও কেউ নেই। মোল্লারা তাদের ফাঁসি চেয়ে মিছিল করে, ধারালো ছোরায় জঙ্গিরা দেয় আরো শান। মৌলবাদিদের মুখপত্রগুলো আগেই প্রকাশ্য যুদ্ধ ঘোষণা করেছে ব্লগারদের বিরুদ্ধে। ব্লগের লেখা বিচার করার জন্য পুলিশ-আমলা নিয়ে ৯ সদস্যের কমিটি পর্যন্ত গঠন করা হয়েছে খোদ প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ উৎসাহে। সংসদীয় কমিটিগুলো প্রতিনিয়ত ক্ষোভ ঝাড়ছে ব্লগের বিরুদ্ধে। পত্রিকার পাতায় ব্লগারদের নিয়ে দু কলম লেখার সময় হয় না কোনো বুদ্ধিজীবীর। তুচ্ছ ঘটনায় কতো বিবৃতিজীবীর দেখা মেলে, কিন্তু ব্লগের বিরুদ্ধে ক্রমাগত অপপ্রচার সবাই দেখেও না দেখার ভান করে থাকেন। মূলধারার কোনো গণমাধ্যম ব্লগবিরোধী নয় ঠিক, কিন্তু ব্লগারদের পাশে তারাও নেই। ক্রমাগত অপপ্রচারে সাধারণ মানুষের কাছে ব্লগার মানেই যেন নাস্তিকের আড্ডাখানা। ছোট এই যে বাংলা ব্লগমণ্ডল, সেখানেও দলাদলি আর নোংরামির ছড়াছড়ি। দুর্দিনে কে কাকে বাঁশ দিয়ে বিটিআরসি কিংবা সরকারের আস্থাভাজন হয়ে উঠবেন—সেই প্রতিযোগিতায় মেতে উঠতে দেখছি কাউকে কাউকে। এমনকি যে গণজাগরণ মঞ্চ গড়ে উঠেছিল কেবলই ব্লগারদের হাত ধরে, সেই মঞ্চও এখন আর ব্লগারদের পাশে নেই। ব্লগাররা আজ প্রকৃত অর্থেই একা—নিঃসঙ্গ।
ব্লগমণ্ডলের ইতিহাসে অভূতপূর্ব দুর্ঘটনা
গত ২২ মার্চ ঘটলো বাংলা ব্লগমণ্ডলের ইতিহাসে অভূতপূর্ব এক ঘটনা। সেদিন বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থার (বিটিআরসি) পক্ষ থেকে সরকারি নির্দেশে ব্লগের বিভিন্ন অ্যাকাউন্টের লেখা পর্যবেক্ষণ করার বিষয়ে সামহোয়্যারইন ব্লগসহ কয়েকটি ব্লগের অ্যাডমিনকে ইমেইল করা হয়। তাতে নির্দেশ দেওয়া হয়, ব্লগ অ্যাকাউন্টগুলোর লেখায় ধর্মবিরোধী মন্তব্য পাওয়া গেলে সেগুলো বন্ধ করে দেওয়ার জন্য। এছাড়াও অ্যাকাউন্ট ব্যবহারকারী সম্পর্কে ব্যক্তিগত বিস্তারিত তথ্য (আইপি এড্রেস, লোকেশন, ইমেইল, মোবাইল নম্বর এবং ব্যক্তিগত নাম) পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বিটিআরসির কাছে পাঠানোর নির্দেশও দেয়া হয়।
তখনই ধরা পড়লো এক ব্লগ-রাজাকার
বিটিআরসির চাপে সব ব্লগই মোটামুটি কাবু হয়েছে। সামহোয়্যারইনে জানা নিজেও সাম্প্রতিক কিছু ব্যানের ব্যাপারে রাখঢাক করেননি। এক পোস্টে নিজে সেটি স্পষ্ট করেই বলেছেন কাকে কী কারণে ব্যান করা হয়েছে। বাংলাদেশের এমন কোনো ঐতিহাসিক ঘটনা নেই, যেখানে স্বজাতির মধ্যেই বিশ্বাসঘাতক ছিল না। ব্লগও তার ব্যতিক্রম নয়, এখানেও আছে ব্লগ-রাজাকার। নিষ্ঠার সঙ্গে সেই ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন আমার ব্লগের অ্যাডমিন যুবলীগ নেতা সুশান্ত দাশগুপ্ত। আচমকা বিপ্লবীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে পুরো ছাত্রলীগ স্টাইলে সেখানকার ব্লগারদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে বসেছেন তিনি। ২২ মার্চ "আমার ব্লগ বিটিআর সির সকল অপনির্দেশনা আজ থেকে প্রত্যাখান করছে" শীর্ষক দীর্ঘ বিপ্লবী গীত গেয়ে প্রায় চে গুয়েভারা হয়েই যাচ্ছিল। কিন্তু মাত্র দুদিন পর সুশান্ত বাবুর থলের বেড়াল বের করে দিয়ে বোমাটা ফাটালো অনলাইন সংবাদ সংস্থা 'বাংলামেইল'। 'বিটিআরসির নির্দেশে আপত্তিকর পোস্ট মুছে দিচ্ছে আমারব্লগ' শিরোনামের সেই প্রতিবেদন থেকে আমরা জানতে পারলাম, বিটিআরসির নির্দেশ যেদিন এসেছে, সেই ২২ মার্চেই আমার ব্লগের অ্যাডমিন সুশান্ত দাশগুপ্ত বিটিআরসিকে মেইল দিয়ে 'সর্বাত্মক সহযোগিতা' প্রদানের কথা জানিয়ে দেন। সেই ইমেইলে তিনি amarblog.com/blogger/bnp ও amarblog.com/blogger/dinosaur ব্লগের সব পোস্ট মুছে দেয়ার কথা জানান। amarblog.com/blogs/arifuk ব্লগের পোস্ট মুছে দেয়ার কাজ চলছে জানিয়ে কোন্ পোস্টের আর্কাইভ কপি বিটিআরসির প্রয়োজন তাও জানাতে বিনীত অনুরোধ জানান সুশান্ত। বাংলামেইল বিটিআরসিকে পাঠানো সুশান্ত বাবুর ইমেইলের স্ক্রিনশটও প্রকাশ করে ওই প্রতিবেদনের সঙ্গে। এদিকে এমন খবরও পাওয়া যাচ্ছে যে, আওয়ামী লীগ বিরোধী কয়েকজন ব্লগারের আইপিসহ যাবতীয় তথ্য আমারব্লগ কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যে বিটিআরসির হাতে তুলে দিয়েছে বা দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
এই চোগলখুরি এখানেই শেষ হতে পারতো। কিন্তু না, গত ২৪ মার্চ ইনিয়ে-বিনিয়ে আবার সেই বিপ্লবী গীত, আবার সেই ভাঙা রেকর্ড আমারব্লগের পাতায় বাজলো- 'আমার ব্লগ বিটিআরসির সকল অপনির্দেশনা আজ থেকে প্রত্যাখান করছে! আন্তর্জালে বাংলা ব্লগ বাক স্বাধীনতা রক্ষায় আমরা বদ্ধপরিকর এবং তার জন্য যে কোন প্রকার আত্মত্যাগ স্বীকার করতে রাজী আছি...।' ঘটনা এখানেও শেষ হতে পারতো। কিন্তু না, সুশান্ত দাশগুপ্ত এই পর্যায়ে ইমেইলের স্ক্রিনশট থেকে শুরু করে পুরো ব্যাপারটিই বানোয়াট বলে দাবি করলেন। এমনকি বাংলামেইলকে ওই প্রতিবেদনটি মুছে ফেলার জন্যও জোরাজুরি শুরু করেন। কিন্তু বাংলামেইল আরো একধাপ এগিয়ে সুশান্তের দাবিই যে পুরোপুরি মিথ্যা এবং প্রতারণামূলক সেটি প্রমাণ করে দিল তার প্রতিবেদকের বক্তব্যে।
যে পথ ধরে ব্লগের ওপর নেমে আসছে সরকারি নিয়ন্ত্রণ
গত বুধবার সচিবালয়ে প্রধানমন্ত্রীর গঠিত কমিটির বৈঠকে জানানো হয়, ওইদিন থেকেই দু ধরনের অভিযোগ কেন্দ্র বা তথ্য কেন্দ্র খোলা হচ্ছে। অনলাইনে এবং সরাসরি ব্যক্তি পর্যায়ে অভিযোগ করার ক্ষেত্রে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে অভিযোগ কেন্দ্র বা তথ্য কেন্দ্র চালু করা হবে। কমিটির সভাপতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মাইনউদ্দিন খন্দকার বলেন, “ব্লগে যে কেউ লিখতে পারেন, তবে প্রকাশ করে ব্লগ কর্তৃপক্ষ। এক্ষেত্রে যারা ব্লগ পরিচালনা করেন বা ব্লগ সাইটের মালিক তাদের সঙ্গে বৈঠক করা হবে।” আগামী ৩১ মার্চ এ কমিটি ইসলামী চিন্তাবিদ ও আলেমদের সঙ্গে বৈঠক করবে, এর পরপরই ব্লগ কর্তৃপক্ষ বা পরিচালনাকারীদের সঙ্গে বৈঠক হবে বলে জানান তিনি।
মাইনউদ্দিন খন্দকার বলেন, ব্লগে আপত্তিকর মন্তব্যকারীদের কোনো ছাড় দেয়া হবে না। বৈঠকে উপস্থিত কমিটির সদস্যরা বলেন, মডারেশন ছাড়া লেখা প্রকাশ করা কোনো ভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। সব কিছুই নিয়ম-নীতির মধ্যে থাকা উচিত। কমিটির সদস্য আইন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব আবু আহমেদ জমাদার বলেন, “প্রচলিত আইন অনুযায়ী দোষী প্রমাণিত হলে আপত্তিকর মন্তব্যকারীদের এক কোটি টাকা জরিমানা এবং ১০ বছর কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।” প্রয়োজনে আপত্তিকর মন্তব্যকারী ব্লগার ও ফেসবুক ব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে সরকার সন্ত্রাস বিরোধী আইন ও বিশেষ ক্ষমতা আইনেও বিচার করতে পারে বলে জানান আবু আহমেদ জমাদার। ইন্টারনট ব্যবহারকারী কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য পাওয়ার এখতিয়ার রয়েছে এবং সেই তথ্য চাহিদা অনুযায়ী প্রদানে বাধ্যবাধকতাও রয়েছে বলে জানান আবু আহমেদ জমাদার।
কমিটির সদস্য তথ্য-প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ মোস্তফা জব্বার সভায় সরকারের দুর্বলতার কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘‘ব্লগ বা নিউজ পোর্টালের জন্য কোনো নীতিমালা নেই। তবে প্রতিকারের জন্য ১৯৭৩ সালের ছাপাখানা আইন রয়েছে। যাদের রয়েছে দায়বদ্ধতা। ব্লগে লেখার দায়িত্ব লেখকের ব্যক্তিগত হলেও প্রকাশকের দায়িত্ব সামগ্রিক।’’ তিনি বলেন, 'ব্লগ পরিচালনাকারীদের খতিয়ান নেওয়া উচিত।' সভায় একই সঙ্গে দেশের ৪৮টি ব্লগ তদারক করতে বিটিআরসিকে অনুরোধ করা হয়েছে।
বাকি যে লাখো ব্লগার, তাদের দোষ কী?
যে খবর আমরা ভেতর থেকে পাচ্ছি, তাতে প্রমাণ মিলছে ব্লগ নিয়ে সরকারি তৎপরতার লক্ষণ ভালো নয়।
স্পষ্টভাবেই সরকার হাঁটছে ব্লগ নিয়ন্ত্রণের পথে। এই আশঙ্কা আমরা আগেই প্রকাশ করেছিলাম, সরকার যখন অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালা তৈরির উদ্যোগ নিয়েছিল। আমরা তখনই বলেছিলাম, অনলাইন নিয়ে সরকারের এই ঘাঁটাঘাটির মূল টার্গেট হবে ব্লগ। সেই আশঙ্কা আজ সত্যি বলে প্রমাণিত হয়েছে। মৌলবাদিদের মতো সরকারেরও অজুহাত ওই একটিই- নাস্তিক ব্লগার! অথচ পুরো বাংলা ব্লগমণ্ডলে 'নাস্তিক ব্লগার' ১০-১৫ জনও হয়তো পাওয়া যাবে না। নাস্তিক ব্লগারদের নিয়ে খোদ আমার দেশই তাদের প্রতিবেদনে মাত্র তিন কি চারজনের কর্মকান্ডের হদিস দিতে পেরেছে। তাহলে বাকি যে লাখো ব্লগার, তাদের দোষ কী? প্রায় প্রতিটি কমিউনিটি ব্লগের নীতিমালাতেই আপত্তিকর লেখা কিংবা মন্তব্যের জন্য সুনির্দিষ্ট বিধি আছে। এই নীতিমালা জোরদার করলেই যথেষ্ট। এর মধ্যে বিটিআরসি কিংবা সরকারের নাক গলানোর কিছুই নেই।
কেন ব্লগ কর্তৃপক্ষগুলোকে বসতে হবে আমলাপ্রধান সরকারি কমিটির সঙ্গে? কেন সরকার ছড়ি ঘোরাবে ব্লগের ওপর? বিটিআরসি কেন নজরদারি করবে ৪৮টি ব্লগের ওপর? ব্লগের সঙ্গে সম্পর্কহীন কতিপয় আমলার কী অধিকার কিংবা যোগ্যতা আছে এটা বলার- 'মডারেশন ছাড়া লেখা প্রকাশ করা কোনো ভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। সব কিছুই নিয়ম-নীতির মধ্যে থাকা উচিত।' কেন মোস্তফা জব্বারের মতো সুবিধাবাদি লোক ব্লগের জন্য কুখ্যাত ছাপাখানা আইন প্রয়োগের জন্য দালালি করবেন?
গুগলে সার্চ করলেই দেখা যায়, কথায়-লেখায়-ছবিতে ইসলামকে চরম অপমান করা হয়েছে—এমন ওয়েবসাইটের সংখ্যা বিশ্বে হাজার হাজার। সরকারের কি সাধ্য আছে, এদের কোনো একটির কেশাগ্র স্পর্শ করার? বিশ্বে নাস্তিক আছে কোটি কোটি। সরকারের কি সাধ্য আছে, এদের কারো দিকে আঙ্গুলখানি শুধু তোলার? অথবা নাস্তিকের একটি গুগল একাউন্ট কিংবা একটি ফেসবুক একাউন্ট বন্ধ করার আবদারটুকু তুলে দেখুক তো সরকার! গুগল-ফেসবুকের যা কড়া নীতি, তাতে হয়তো এহেন অনুরোধকারীদের ভার্চুয়াল বলাৎকারই করে দেবে। মাত্র কিছুদিন আগেই আমরা জেনেছি, বিটিআরসির এরকম অনুরোধে ফেসবুক উল্টো কড়া মেইল দিয়ে জানতে চেয়েছে, একাউন্ট বন্ধের এই মামার বাড়ির আবদারের হেতু কী?
ব্লগকে শেকল পরানোর ছল
এক নাস্তিক আসিফ মহিউদ্দিনের ব্লগ বাতিলে যারা বগল বাজাচ্ছে, তারা জানে না, এই একই পরিণতি তাদের নিজেদেরও হতে পারে। সময়ের অপেক্ষা কেবল। আসিফের প্রতি আমার বিশেষ কোনো পক্ষপাত নেই, বরং কারণে-অকারণে ইসলাম ধর্ম নিয়ে তার কটুক্তি করার স্বভাবটা আমার অপছন্দ বরাবরই। কিন্তু এ নিয়ে দ্বিমত প্রকাশের কোনো উপায় নেই যে, সরকারি চাপে আসিফের ব্লগ ব্যান একটি গুরুত্বপূর্ণ সংকেত। এই সংকেত জানিয়ে দিচ্ছে, ব্লগের ওপর যে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পথে এগিয়ে যাচ্ছে সরকার, তা থেকে ডান-বাম-মধ্যপন্থী-উদারপন্থী কেউই রেহাই পাবে না। কেউই না।
ব্লগারদের চাপে, ব্লগারদের অভিযোগে যদি আসিফের ব্লগ ব্যান করা হতো, বলার কিছুই ছিল না। কিন্তু এই ব্যান হয়েছে সরকারের চাপে, এই ব্যান হয়েছে মৌলবাদিদের চাপে। সামহোয়্যারইন কর্তৃপক্ষ লেখার কারণে নয়, তাকে স্পষ্টতই নিষিদ্ধ করেছে সরকারের চাপে। ব্লগার হিসেবে এই অপমান, এই গ্লানি আমাদের সবার।
আশঙ্কার কথা এই যে, চোর দরজার সিটকিনি খোলার পথটি জেনে গেছে, সুতরাং সে বার বার ওই ঘরে ঢোকার চেষ্টা করবেই। বিটিআরসির তরফে সরকার ইতিমধ্যে বুঝে গেছে, চোখ রাঙিয়ে ব্লগকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। সুতরাং আজ ও আগামীতে আওয়ামী লীগ হোক কিংবা বিএনপি, যারাই সরকারে থাকুক, তারা কারণে-অকারণে ব্লগের ওপর ছড়ি ঘোরানোর চেষ্টা করবে- এটা খুব স্বাভাবিক। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে বিএনপিমনস্ক ব্লগার আর বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে আওয়ামী লীগ সমর্থক ব্লগারদের নাড়িনক্ষত্র জানা খুব কঠিন কোনো কাজ আর হবে না। অনলাইনে ভিন্নমতাবলম্বী যে কারো কন্ঠ চেপে ধরা, জেলে পোরা, জরিমানা করা ক্ষমতাসীনদের পক্ষে এখন খুবই সহজ হয়ে গেল।
এই যুদ্ধ সামহোয়্যারইনের একার যুদ্ধ
আগে-পরে ছোটখাটো আরো ব্লগের নাম সরকারি গোণায় এলেও মূল টার্গেট সামহোয়্যারইনই। ফলে বাক-স্বাধীনতা রক্ষার এই লড়াইয়ে সামহোয়্যারইন এবং তার ব্লগারদের দায়িত্বই সবচেয়ে বেশি। সামহোয়্যারইন যদি সরকারের চোখ রাঙানিতে পিছু হটে, সত্যিকারের যে নির্ভয় ব্লগিং, তার অপমৃত্যুও তখনই ঘটবে। মুক্তমত প্রকাশের ক্ষেত্র হিসেবে যে সামহোয়্যারইনের জন্য আমরা গর্ব বোধ করি, সেটি ধুলোয় মিশে যাবে। ছয় ছয়টি বছর ধরে তিল তিল করে একটি স্বাধীন বাংলা ব্লগের যে স্বপ্ন দেখে আসছিলাম আমরা, অকপটে সত্য বলার যে খোলা জানালার স্বপ্ন দেখে আসছিলাম, সেই স্বপ্নটুকু ধুলিসাৎ হয়ে যাবে নিমেষেই। এইটুকু বিশ্বাস এখনো রাখতে চাই, বাংলা ব্লগের এই দুঃসময়ে সামহোয়্যারইন কর্তৃপক্ষ তার ব্লগারদের পাশে থাকবে, পাশে দাঁড়াবে। যতো বৈঠকই হোক না কেন, যতো চাপই আসুক না কেন চোখে চোখ রেখে সরকারি পেয়াদাকে নিশ্চয়ই তারা বলে দেবেন, ব্লগের জন্য কোনো সরকারি নীতিমালা, কোনো কালো আইন আমরা চাই না। তারা স্পষ্টভাবে বলে দেবেন, ব্লগারদের আইপি তো দূরের, ব্যক্তিগত কোনো তথ্যই সরকারি সংস্থা বা অন্য কারো কাছে হস্তান্তর করা হবে না কখনোই। ব্লগারদের পক্ষ থেকে এই কথাও আশা করি তারা জানিয়ে দেবেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে গঠিত কমিটি এবং টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থার (বিটিআরসি) সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড আন্তর্জাতিক ব্যক্তিগত গোপনীয়তা আইনের পুরোপুরি লঙ্ঘন। কে না জানেন, এই বাংলাদেশে স্বাধীনভাবে কথা বলার প্রথম জানালাটি আরিল ও জানা নিজ হাতেই খুলে দিয়েছিলেন। আমি নিশ্চিত, সেই স্বাধীনতা ক্ষতিগ্রস্থ হোক সেটি নিশ্চয়ই তারা চাইবেন না।
প্রিয় ব্লগার...
নিশ্চিত জেনে রাখুন, কেউই আপনার পাশে দাঁড়াবে না। ব্লগারমাত্রেই নিঃসঙ্গ—একা। তাতে ক্ষতি কিছু নেই, যে শেরপা ঝঞ্ঝাবিক্ষুদ্ধ এভারেস্টের শিখরে ওঠে অসীম সাহসে, সেও নিঃসঙ্গই থাকে। নিজের লড়াই এখানে নিজেকেই করতে হবে। আসুন ব্লগে সরকারের নগ্ন হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াই। নইলে-
উত্তর পুরুষে ভীরু কাপুরুষের উপমা হবো
এরকম দুঃসময়ে যদি মিছিলে না যাই...
ব্যাকআপ কপি