আমাদের দেশে বর্তমানে যেসব সামাজিক সমস্যা প্রকট আকার ধারন করেছে তার মাঝে ধর্ষন অন্যতম। ধর্ষনের শিকার হয়ে অসংখ্য নারী বেছে নিয়েছে আত্বহত্যার পথ। ধর্ষনের শিকার প্রতিটি নারীই সামাজিক ভাবে হয় লাঞ্চিত। বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই ধর্ষণের ফলে নারীকেই দোষারুপ করা হয়। নারীর জীবন ধ্বংশ হয়ে গেলেও পুরুষের তেমন কোন সাস্তি হয়না। বরঞ্চ পুরুষটি বিভিন্ন উপায়ে নিজের এই কৃতকর্ম ধামাচাপা দিতে চেষ্টা করে এবং এ ক্ষেত্রে সে সফলও হয়। ধর্ষণ প্রবণতা মুলত এক ধরনের মানসিক ব্যাধি। অসুস্থ মানসিকতার লোকজনই ধর্ষনকে বেছে নেই। বর্তমান আধুনিক সমাজ ব্যবস্থা ও ডিজিটাল প্রবণতায় যারা নারীকে যোগ্য সম্মান দিতে প্রস্তুত নয় তারাই মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে ধর্ষনের মতো অপরাধের আশ্রয় নেয়। নিচে বর্তমান সমাজের কিছু চিত্র তুলে ধরলাম যাতে হয়ত পরিস্কার হবে কিভাবে মানুষ অসুস্থ মানসিকতার অধিকারী হয়।
১. আমার এক সহকর্মীর স্মার্ট-ফোন ব্যবহার করার সখ। কিছুদিন আগে তাকে একটি স্মার্ট-ফোন কিনে দিই তারপর ইন্টারনেট চালু করে গুগল প্লে স্টোর থেকে কিছু এপ্লিকেশন ডাউনলোড দিতে চাচ্ছিলাম। গুগল প্লে স্টোর এ ঢুকে ইন্টারনেইনমেন্ট পেজে ঢুকতেই আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম এই পেজে যেসব এপ্লিকেশনগুলো জনপ্রিয় তালিকায় রয়েছে তার বেশির ভাগই অশ্লীল।
জনপ্রিয় হয়ে উঠা এসব স্মার্টফোনগুলো বেশী ব্যবহার করছে ১৮ না পেরেনো তরুণ দল। যাদের বয়সটুকুই নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি আগ্রহী করে তুলে। যখন তারা এসব এপস দেখে তখনই ডাউনলোড করে এসব অরুচিকর এপস এর জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে তুলে। এবং এসব এপস ব্যবহার করে নিজের মনকে কলুষিত করে তুলে।
২. কিছুদিন আগে খিলক্ষেত এলাকায় ফুটপাতে উপর সিডি ও ডিভিডি ক্যাসেটের পরসা সাজিয়ে বসা দোকান থেকে আমার ভাগ্নেদের জন্য কার্টুন ছবির ডিভিডি ক্যাসেট বাছাই করছিলাম। কিছুক্ষন পর সেখানে এক ক্রেতা আসল। ক্রেতা সাথে ডিভিডি ক্যাসেট বিক্রেতার কথোপকথনে বোঝা গেল তিনি নিয়মিত এখান থেকে ক্যাসেট খরিদ করেন। তাদের কথোপকথনের এক পর্যায়ে বিক্রেতা বলল “বাংলা দিমু নাকি ইংলিশ”। আমি তখনও বুঝিনি তারা কিসের কথা বলছে। ক্রেতা ইংলিশ জিনিস নিতে চাইলেন। তারপর বিক্রেতা তার দোকানের নিচ থেকে কিছু ক্যাসেট বের করল। ক্যাসেটগুলোর মোড়কের দিকে আমার দৃষ্টি পরতেই আমি বুঝতে পারি তারা বাংলা অথবা ইংলিশ বলে কি বুঝাতে চেয়েছিল। ওরা অশ্লীল ডিভিডি ক্রয় বিক্রয় করছিলো। আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম বিক্রেতার বয়স ১৫ বছরের বেশী হবেনা। এই অল্প বয়সী একটি ছেলে কিভাবে এসব ক্যাসেট সংগ্রহ করল তা ভেবে আমি অবাক হই আর প্রকাশ্যে এসব ক্যাসেট বিক্রি হচ্ছে অথচ আমাদের আইন প্রনয়নকারী সংস্থাগুলো কোথায়?
৩. বিমানবন্দর বাসষ্ট্যান্ডে বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। সেখানে হঠাৎ আমার নজর গেল ফুটপাতে সাজিয়ে রাখা বইয়ের দোকানের দিকে। বইয়ের দোকান দেখলেই আমার একটি অভ্যাস হলো সেখানে কি কি বই আছে তার খোঁজ নেওয়া ও পছন্দ হলে কিছু বই কিনে নেওয়া। দোকানটিতে সাজিয়ে রাখা ছিল বিভিন্ন বই, ম্যাগাজিন ও দৈনিক পত্রিকা। এগুলোর দিকে নজর দিতে দিতেই আমার চোখ আটকে যায় মোড়কে অশ্লীল ছবি ও রগরগে বর্ণনা সম্বলিত কতিপয় বই ও ম্যাগাজিনের দিকে। সবার সামনেই এগুলো বিক্রি হচ্ছে অথচ কেউ দেখেও যেন দেখছেনা।
৪. অনলাইনে যে কোন কিছু খোঁজে বের করার জন্য সবচেয়ে জনপ্রিয় সাইট হলো গুগল। কোন কিছু খোঁজার প্রয়োজন হলেই সকলেই প্রথমে গুগলের সরানপন্ন হয়। তবে দুঃখজনক হলেও কতিপয় অসুস্থ মানসিকতার লোকজন গুগলকেও অশ্লীল করে তুলেছে। বাংলায় বিশেষ কয়েকটি অক্ষর আছে যেগুলো গুগলে লেখলেই তাদের সাজেশন বক্সে যে সকল সাজেশনগুলো ভেসে উঠে সেগুলোর দিকে কোন সুস্থ লোকের নজর দিলেও ঘৃণা বোদ করবে।
৫. বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে ফেসবুক সবার অন্তরে ঠায় করে নিয়েছে। ফেসবুকের কল্যাণে এখন পারস্পারিক সান্নিধ্য বৃদ্ধি পেয়েছে। বৃদ্ধি পেয়েছে আত্নীয়তার বন্ধন। এখন যেকোন কাজেই ফেসবুককে ব্যবহার করা যায়। ফেসবুকের মাধ্যমে ভালো কাজ যেমন করা যায় তেমনই খারাপ কাজও করা যায়। সুস্থ মানুষের পাশাপাশি বিকৃত মানসিকতার অনেকেই ফেসবুক ব্যাবহার করে যারা ফেসবুকে অশ্লীল ছবি পোষ্ট করে, অশ্লীল পেজ বানিয়ে তা শেয়ার করে। তাতে কেউ লাইক দিলে তা ঐ ব্যাক্তির বন্ধুমহলের সকলের হোম পেজেই ছড়িয়ে পরে।
৬. জনসাধারন অনলাইনের দিকে ঝুকতে শুরু করেছে দেখে কতিপয় অসাধু ব্যক্তিও জনগনের এই ঝুককে কাজে লাগাতে অনলাইনে বিভিন্ন ওয়েবসাইট বা অনলাইন পত্রিকা খুলে বসেছে। আর কতিপয় অনলাইন পত্রিকা তাদের হিট বাড়ানোর জন্য অশ্লীল ছবি ও অশ্লীল সংবাদ পোষ্ট করে থাকে। এসব পোষ্ট আবার ফেসবুকেও শেয়ার করে পাঠকদের আকৃষ্ট করা হয় যেন হিট বেড়ে যায়। আর অনলাইনে যত বেশী হিট হবে ব্যবসা তত বেশী হবে। তাই এ সুযোগ ঐসব অসাধু ব্যবসায়ীরা হারাতে চাবে কেন?
পরিশেষঃ
পরিসংখ্যানে দেখা গেছে এসব অশ্লীল পোষ্ট, অশ্লীল বই ও অশ্লীল ক্যাসেটের ক্রেতা ও পাঠক তরুন সমাজ। সরকার বা আমরা ধর্ষণের বিরুদ্ধে যত কথাই বলি না কেন সমাজ থেকে ধর্ষণ কমাতে হলে তরুণদের হাত থেকে এসব অরুচিকর অশ্লীল জিনিসগুলো সরিয়ে নিতে হবে। যারা বলেন নারীদের পোশাকই ধর্ষণের অন্যতম কারণ আমি তাদের সাথে একমত নই। নারীদের পোষাক কখনোই ধর্ষণের অন্যতম কারণ নয়, ধর্ষণের অন্যতম কারণ হলো নষ্ট ও কুরুচিপূর্ণ মানসিকতা।
গত বছর ২৮শে ফেব্রোয়ারী পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১২ পাস করা হয়। এই আইনানুযায়ী পর্নোগ্রাফি উত্পাদন, সংরক্ষণ, বাজারজাতকরণ, বহন, সরবরাহ, ক্রয়-বিক্রয় ও প্রদর্শন বেআইনী ও নিষিদ্ধ। এই নিষিদ্ধ কর্ম সম্পাদনের জন্য শাস্তির বিবিধ বিধান রাখা হয়েছে। এ আইনের অধীনে সংঘটিত অপরাধ আমলযোগ্য এবং অজামিনযোগ্য হবে। কিন্তু আমাদের কাছে কেবল আইনই আছে কিন্তু আইন প্রয়োগকারী যথাযোগ্য প্রতিনিধি নেই। রাস্তায় প্রকাশ্য স্থানে পর্নোগ্রাফি আইনের আওতায় নিষিদ্ধ বই, ক্যাসেট বিক্রি ও প্রদর্শন হয় অথচ কাউকেই আইনের আওতায় আনা হয় না।
আমাদের সমাজ থেকে ধর্ষণ নামক ব্যাধি দুর করতে হলে সবার আগে আমাদের মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে। নারীকে তার যোগ্য সম্মান প্রদর্শন করতে হবে। আমাদের সন্তান ও ছোট ছোট ভাই বোনদের এসব ব্যাপার নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করে তাদের সঠিক ও ভুল পথ চিনিয়ে দিতে হবে। আমরা যে ডিজিটাল যুগের স্বপ্ন দেখছি তা যেন সুস্থ ধারার হয় সেদিকে আমাদের নজর রাখতে হবে।