পুতুলের মতো সাজানো হয়েছে বাড়িটাকে আজ। বাহারি ফুল, রঙিন কাপড় ও কাগজের সমাহার পুরো বাড়ি জুড়ে।তার উপর রং বেরংয়ের মরিচা বাতি গুলো প্রজ্জলিত হচ্ছে সারা বাড়িময়। তারা এদিক ওদিক ছুটোছুটি করছে বিরামহীন চঞ্চলতা নিয়ে।আমার মনের ভাবনা গুলিও যেন এই মরিচা বাতিদের সাথে খেলা করার ব্যার্থ প্রয়াস চালাচ্ছে। কিন্তু হয়তো কুলিয়ে উঠতে পারছেনা। এক নিদারুণ জড়তা জমেছে আমার মনের ভাবনা গুলোতে। বলা যায় কেউ একজন অসীম জড়তা নিয়ে আটকে রয়েছে এই হৃদয়ে। যে জড়তা কখনো ছুটবার নয়। হয়তো ইচ্ছে করেই পুষে চলেছি তাদের এক অজানা মায়ায়।
আজ আমার বাসর রাত। বর হিসেবে এখন বাসর রাত পালন করার কথা থাকলেও নিজের রুমে যাওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা করছে না আমার।নতুন বউকে খাটের উপর বসিয়ে রেখেই বারান্দায় এসে সিগারেটের পর সিগারেট টানছি। জ্বলন্ত সিগারেটের কুন্ডলীতে ভষ্মীভূত করতে চাইছি অতীত কষ্ট ও দুঃস্মৃতি গুলিকে। কিন্তু তার বদলে সেই কুন্ডলীতেই প্রতিভাত হচ্ছে নিজের সোনালী ভবিষ্যতের অগ্নিদাগ্ধ রূপ।
কিছুটা জোর করেই বিয়েটা করানো হয়েছে আমাকে। একে তো বাবার আদেশ তার উপরে মায়ের অশ্রুসিক্ত নয়নের আবদার,
"দেখ ঈষাম,তুই ই আমাদের একমাত্র সন্তান। নিজের জীবনটা এভাবে নষ্ট করিস না। তোর যদি কিছু হয় তাহলে এই বুড়ো বাবা মায়ের কি হবে এইটা একটু ভেবে দেখ! এবার একটা বিয়ে কর বাবা। নিজের জীবনটাকে গুছিয়ে নে!"
তাদের বারবার এমন প্রস্তাব উপেক্ষা করতে না পেরেই বিয়েটা করা। মায়ের মতে আমার নতুন বউ নাকি খুবই রূপসী এবং সুশীল পরিবারের মেয়ে। কিন্তু তাতে আমার কি!! আমার কিছু যায় আসেনা। এখন পর্যন্ত মেয়েটির ছবিও দেখিনি। দেখার কোন ইচ্ছাও নেই!! বিয়ে যেহেতু বাবা-মায়ের কথায় করছি তাই তাদের পছন্দ হলেই হলো। আর যার সাথে কখনো আমার হৃদয়ের সম্পর্ক হবার নয় তাকে দেখেই বা কি লাভ!!
বারান্ডায় প্রচন্ড বাতাস হচ্ছে। হঠাত্ বাতাসে ভেসে হাড়িয়ে যেতে ইচ্ছে করছে ৫ বছর পূর্বের সেই ভার্সিটি জীবনে। বারবার মনের দৃশ্যপটে ঊকি দিচ্ছে সেই আবেগঘন দিনের স্মৃতি গুলি। যেদিন প্রথমবার দেখা হয়েছিল তার সাথে।
ক্যাফেটেরিয়ার এক কোণায় একলা টেবিলে কফির মগ হাতে নিয়ে বসে ছিল মেয়েটি। লাল জামা এবং খোলা চুলে তাকে ঠিক এক ডানা কাঁটা পরীর মতো লাগছিল। সেদিন জীবনে প্রথম কোন মেয়েকে দেখে হৃদয়ের স্পন্দন গতিটা হঠাত্ করে বেড়ে গিয়েছিল আমার। মনে হয়েছিল এই অপ্সরীর জন্যেই আমার পৃথিবীতে আসা। তাকে ছাড়া এই জীবন অচল, নিছক অর্থহীন।
কিছুদিনের মাঝেই আমার এক বন্ধুর কল্যানেই পরিচয় হয় তার সাথে।তার ডিপার্টমেন্টের ছাত্রী ছিল মেয়েটি। সেদিনই আমি প্রথম জানতে পেরেছিলাম তার নাম।
'নীরা'
এই নামটি যেন আমার হৃদয়ে গেঁথে গিয়েছিল চিরদিনের জন্য।
সেদিনের পর প্রতিদিনই দেখা হতো আমাদের। আমাদের সম্পর্কটা এক সময় আপনি থেকে তুমি গড়িয়ে তুই এ রুপান্তরিত হয়। একে অপরকে ছাড়া একটি মুহূর্ত ও থাকতে পারতাম না আমরা। আমাদের বন্ধুত্ব সারা ভার্সিটি জুড়ে ঈর্ষার কারন হয়ে দাড়িয়েছিল। কিন্তু সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করার সময় কোথায় আমাদের। আমরা আমাদের বন্ধুত্বটা ঠিকই বহাল রেখেছিলাম ভার্সিটির শেষ দিনটি পর্যন্ত।
নীরাকে প্রথম দেখার মুহূর্ত থেকেই তার উপর দুর্বল হয়ে পরেছিলাম আমি। তাকে বন্ধু থেকে কিছুটা বেশিই ভাবতাম সব সময়। যতক্ষণ তার সাথে থাকতাম এক ধরণের অজানা ভাল লাগা কাজ করতো আমার মাঝে। তার প্রতিটি কথা, প্রতিটি কাজ মন্ত্র মুগ্ধের মতো শুধু চেয়ে চেয়ে দেখতাম আমি। এক
অটুট বাঁধনে আটকা পড়েছিলাম এই মেয়েটিকে ঘিরে। হয়তো একেই বলে ভালবাসার বাঁধন।
নীরাকে হৃদয় ঊজার করে ভালবাসলেও মুখ ফোঁটে কখনো বলা হয়নি তাকে নিজের হৃদয়ের অনুভূতি গুলি। অনেক ভয় হতো। ভালবাসার প্রকাশ করতে গিয়ে যদি পরিশেষে এই বন্ধুত্বটাও হাড়াতে হয়!! এই ভেবে সর্বদাই এক পা এগিয়ে দুই পা পিছিয়ে যেতাম।
আমাদের ভার্সিটি জীবনের পরেও মাঝে মাঝে দেখা করতাম আমরা। তেমনি একদিন নীরার ফোন আসে দেখা করার জন্যে। ফোনে বলেছিল একটা খুশির সংবাদ দিবে আমাকে।
ভাবলাম এইটাই সুযোগ তাকে আমার হৃদয়ে গোপন করে রাখা না বলা ভালবাসার কথাটি বলে দেয়ার।তার প্রিয় এক মুঠো লাল গোলাপ নিয়ে গেলাম সেদিন বুক ভরা প্রত্যাশা নিয়ে।এই প্রত্যাশা ভালবাসার,ভালবাসার মানুষটিকে একান্তভাবে কাছে পাবার।
কিন্তু তার দেয়া বিয়ের কার্ডটি হাতে নিয়ে আর ভালবাসার কথাটি বলা হলো না আমার। কিছুদিন পরেই তার বিয়ে আর এটিই ছিল তার বলা সেই খুশির সংবাদ। যা খুশির বদলে দুঃখের বিষ মাখা এক সূচালো তীর হয়ে বিঁধেছিল আমার হৃদয়ের ঠিক মাঝখানটায়। যে লাল গোলাপ নিয়ে নিজের ভালবাসার ফুল ফোটাতে চেয়েছিলাম সেই লাল গোলাপ দিয়েই তার নতুন জীবনের শুভেচ্ছা প্রদান করে ফিরে আসলাম। এটাই ছিল আমাদের শেষ দেখা। আমার প্রথম এবং একমাত্র ভালবাসার করুণ পরিসমাপ্তি।বারান্দায় বসে থাকতে আর ভাল লাগছে না। চোখ জোড়া ঝাপসা হয়ে আসছে। হাতের শেষ সিগারেটটা শেষ করেই রুমের ভেতরে যাই আমি। মাথার ঘুমটা না উঠিয়েই খাটের উপর জড়সড় হয়ে হয়ে ঘুমিয়ে পরেছে আমার নতুন বউ। অনেকক্ষণ দাড়িয়ে দাড়িয়ে তার দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকি। মেয়েটার জন্যে একটু করুনার জন্ম নেয় মনের কোণে। একটা মেয়ে বিয়ের প্রথম রাতটির জন্যে কতো শত আবেগমাখা স্বপ্ন বুনে রাখে মনের ভেতর বছরের পর বছর জুরে। এই মেয়েটিও হয়তো তার ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু আমি এক নিমিষেই ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছি তার সকল রঙ্গিন স্বপ্ন। নিজের কাছেই এখন নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে খুব।
নিঃশব্দে খাটের কাছে যাই আমি। তার গায়ের উপর কাঁথা জড়িয়ে দিয়ে নিজের বালিশটা নিয়ে সোফায় এসে ঘুমিয়ে পড়ি সাথে সাথেই।
চোখ কচলাতে কচলাতে ঘুম ভাঙ্গে আমার। হাত ঘড়িটাতে চোখ পড়তেই দেখি ১০.১৫ মি.। কখনো এতো দেড়ী করে ঘুম থেকে উঠিনা আমি।হয়তো কাল অনেক রাত করে ঘুমানোর ফল এইটা। সোফার সামনে টেবিলে এক মগ গরম কফি রাখা। তার পাশে আমাদের বিয়ের কার্ড। ডান হাতে কফির মগ হাতে নিয়ে বাম হাতে কার্ডটি খুলি আমি।
কনের নামের জায়গায় লিখা-
"সাদিয়া মেহজাবিন নদী"
নামটা অনেকটা হৃদয়ে গেঁথে যায় আমার। মনে হলো যেন তিনটি সুন্দর নামকে একত্রিত করে একটি নাম বানানো হয়েছে।
এরই মাঝে মাথায় ঘোমটা দিয়েই ঘরে প্রবেশ করে নদী। সোফাতে বসেই তার দিকে চোখ তুলি। কিন্তু সেই চোখ আর সরাতে পারি নি কিছুতেই। এতো স্নিগ্ধ এবং কোমল চেহারার মেয়ে আমি হয়তো জীবনে প্রথম দেখলাম।তার কাজল টানা চোখ গুলি ঝিলের জলের
মতো স্বচ্ছ। যেন এখনই টুপ করে ডুব দিয়ে সাতার কাঁটা যাবে। তার উপর পড়নের লাল শাড়িটা তার সৌন্দর্যটা বাড়িয়ে দিয়েছিল শতগুণে।
ভেবেছিলাম কাল রাতের কথা নিশ্চই জিজ্ঞেস করবে আমাকে। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে ঐ ব্যাপারে একটা প্রশ্ন ও করেনি সে।
এভাবেই কাটছিলো আমার দিন গুলি। সকালে ঘুম থেকে উঠেই অফিসে চলে যেতাম এবং ফিরতাম অনেক রাত করে।নদীর সাথে খুবই কম সময় কাঁটাতাম আমি।তার স্নিগ্ধতা ও সৌন্দর্য্য আমাকে আকৃষ্ট করতো প্রতিনিয়ত। কিন্তু এক ধরনের বাঁধা কাজ করতো আমাদের মাঝে। যে বাঁধার কারণে সব আকর্ষণ ছিন্ন করে দিতো আমার। দূরে ঠেলে দিতো তার কাছ থেকে যোজন যোজন পথ।
নদীকে আমি ভালবাসা দিতে না পারলেও তার পক্ষ থেকে কখনো কোন আক্ষেপই শুনিনি,, ছিলোনা কোন আবদারও। আমার ঐ দূরত্ব ও নির্লিপ্ততাকে গ্রহণ করে সংসার করে চলেছিলো সে অনায়াসেই। হয়তো মেয়েদের একটা আলাদা শক্তি থাকে। যা দিয়ে তারা নিরঙ্কুশভাবে ভালবাসা বিলিয়ে যেতে পারে কোন প্রকার প্রতিদানের আশা ছাড়াই।
প্রায় চার মাসের মতো হয়ে গেলো আমাদের বিয়ের। মায়ের কথায় নদীকে তার বাবার বাড়ীতে নিয়ে চললাম আমি। বিয়ের পর এই প্রথম আমি তাকে নিয়ে বেড় হই।
ঢাকার ব্যাস্ত রাস্তা দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছিলাম আমি এবং আমার পাশে নিশ্চুপ মেয়ে হয়ে বসে আছে নদী। গাড়ির জানালা দিয়ে প্রবেশ করা বাতাসে তার খোলা চুলগুলি বারবার সরে আসছিলো আমার দিকে। আড় চোখে আমি তার দিকে তাকাচ্ছিলাম এবং মুগ্ধ হচ্ছিলাম তার সৌন্দর্য্যে। এরই মাঝে সিগনাল পরে রাস্তায়। গাড়ি থামিয়ে তার দিকে তাকাই আমি। বাইরে ফুলের দোকানের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেয়েটি।
সেদিকে তাকাতেই দেখলাম অনেক গুলো লাল গোলাপ সাজিয়ে রাখা হয়েছে পুরো দোকান জুড়ে। হয়তো মন চাইছে সেই গোলাপ গুলিকে ছুঁয়ে দেখতে,তাদের স্নিগ্ধতার পরশ নিতে। কিন্তু আমি জানি মুখ ফুঁটে আমাকে কখনোই কিছু বলবে না এই মেয়েটা। নিজের সব চাওয়া পাওয়া গুলোকে নিজের মাঝেই বন্ধি করে রাখে সে। কিন্তু যখনি আমি নিজের থেকে কিছু একটা দেই তখন বাচ্চাদের মতো উচ্ছাসিত হয়ে উঠে। চোখে মুখে ফুঁটে উঠে প্রাপ্তির অনাবিল আনন্দ রেখা।
হঠাত্ কি যেন হলো আমার। এক দৌড়ে চলে গেলাম রাস্তার বিপরীত পাশে ফুলের দোকানটায়। খুব জলদি এক মুঠো লাল গোলাপ হাতে নিয়েই পা বাড়ালাম গাড়ির দিকে।এরই মাঝে সিগনাল ভাঙ্গলো রাস্তার। গাড়ির কাছাকাছি চলে আসতেই হঠাত্ সো সো শব্দ করে একটি বাস চলে গেলো ঠিক চোখের কয়েক ইঞ্চি সামনে দিয়ে। কিছু বোঝে উঠার আগেই এক চিত্কার দিয়ে নদী এসে ঝাপিয়ে পড়লো বুকে। তার চোখের পানিতে ভিজতে শুরু করলো আমার সাদা শার্ট। নিজের অজান্তেই দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলাম নদীকে। মনে হলো যেনো মৃত্যুকে ফাঁকি দিয়ে সদ্য জয় করে নিলাম এক নতুন জীবন। ভালবাসাময় নতুন জীবন.....