ভিকারুননিসা স্কুলের অরিত্রী অধিকারী নামের যে মেয়েটি আত্নহত্যা করে চুপি চুপি চলে গেছে না ফেরার দেশে, সেই মেয়েটির বয়স ছিলো মাত্র ১৫ বছর! কোন পরিস্থিতে পড়ে তার এই নিজেকে সরিয়ে নেয়ার পথ বেছে নেয়া? কিশোরী এই মেয়েটি তার স্কুলেরই শিক্ষক কর্তৃক বাবা-মাকে করা অপমানের বোঝা মাথায় নিয়ে মারা গেছে।
আপনার সুইসাইডাল থটস আসে না, গ্রেট। আপনি ইমোশোনালি অনেক স্ট্রং, ওয়ান্ডারফুল। আই রিস্পেক্ট ইয়োর ইমোশনাল স্ট্যাবিলিটি। সমস্যাটা কি জানেন, সমাজের প্রত্যেকটা মানুষ আপনার ক্লোন কপি না। তাদের সবার চিন্তার খোরাক আলাদা, মেন্টাল স্ট্রেংথের লেভেল আলাদা। আপনি আপনার এই সুইসাইডাল থটস চেক দিতে পারলেও তারা হয়তো পারেনা। প্রত্যেকটা মানুষের লাইফে স্ট্রাগল আছে, সেই স্ট্রাগল গুলো একটা অন্যটার থেকে আলাদা।
আমরা সবাই ইমোশনালি একই রকম না। প্রত্যেকের ইমোশনাল রিস্পন্স একেক রকম। সবাই একই ঘটনায় একইভাবে রিয়্যাক্ট করিনা তো, তাইনা? কখনো ভেবেছেন ক্যানো? যাদের নিজেদের জীবনে কখনো ডিপ্রেশন আসেনি, তাদের বুঝতে পারার কথা নয় তীব্রতম ডিপ্রেশন কতটা ভয়ংকর একটা জিনিস। মনের সকল জোর এটা দূর্বল করে দেয়। আর ওদের বয়সটাও তো দেখতে হবে। টিন এজ, জীবনের সবচেয়ে ইমোশনালি ভালনারেবল বছরগুলো। এই বয়সের কিশোর কিশোরীদের কখন মনের গতি প্রকৃতি ক্যামন থাকবে তা খোদ মনোবিজ্ঞানীরাই এখনো বের করতে পারেন নি, অথচ আমরা বের করে ফেলেছি- অর্থাৎ আমাদের ভাবনায় যা আসছে তা চাপিয়ে দিয়ে জাস্টিফাই করতে চাচ্ছি! ওহ স্যরি ভুলে গিয়েছিলাম, আমরা এই ফেসবুক বিজ্ঞানীরাতো যেকোন মনোবিজ্ঞানী, ডাক্তার, সমাজবিজ্ঞানী বা এরোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারদের থেকেও বেশি নলেজ রাখি। কখনো ভেবে দেখেছেন মেয়েটা সুইসাইড করার ঠিক আগের মূহুর্তে কী করছিলো? কী ভাবছিলো? কতগুলো প্রশ্নের জবাব নিজের কাছে খুঁজে না পেয়ে না ফেরার দেশে পারি জমিয়েছে সে? এই অবস্থায় পড়লে আপনি নিজে কী করতেন কখনো ভেবে দেখেছেন? আমরা সবাই জাজমেন্টাল কিন্তু জাজমেন্ট করার প্রথম শর্তটাই আমরা ওভারলুক করছি। টু জাজ সামওয়ান, অ্যাট ফার্স্ট ইউ হ্যাভ টু বি ইন দেয়ার শু'জ, ইউ হ্যাভ টু থিঙ্ক ফ্রম দ্যাট পার্সন'স স্ট্যান্ডপয়েন্ট।
আর যারা বলছেন মেয়েটা স্কুলে ফোন নিয়ে গেছে, নকল করেছে তো তাকে আর তার বাবা মাকে অপমান করে কি দোষ করেছে- মেয়েটা আসলেই নকল করছিলো কিনা সেই বিতর্ক তুলে রেখে বলতে চাই, ইউ গাইজ বিলং টু দ্য সেইম ক্যাটেগরি অফ পিপল হু সে দ্যাট, "মেয়ের জামাকাপড় ঠিক নাই, এমন মেয়েকে রেপ করবে না তো কি করবে।"
আমি আমার বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। একমাত্র সন্তানদের কিছু স্যাক্রিফাইস করতে হয়। নিজের ইচ্ছেগুলোকে চাপা দিয়ে বাবা-মার দেখানো পথে চলতে হয়। আমার ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম ছিলোনা। আমার বাবা কথায় শেমিং করাটা প্রেফার করতেন মার দেয়া থেকে। কিন্তু আমি কথা সহ্য করতে পারতাম না। ছোটবেলা থেকেই আত্নসম্মানবোধ প্রখর ছিলো বলেই হয়ত পারতাম না। সেসব কারণে বাবার সাথে আমার দুরত্ব ক্রমেই বেড়েছিলো একটা বয়সে। আমার টিন এজ বয়সের লেখা গুলো যদি কেউ পড়েন, দেখবেন কী পরিমাণ ডার্ক, কী পরিমাণ ক্ষোভ লেখাগুলোয়। আমি আমার নিজের ভেতর গড়ে ওঠা ক্ষোভ, ডিপ্রেশন গুলোকে লেখায় চ্যানেল করতে পেরেছিলাম। অবশ্য এই ক্ষেত্রে মা ছিলো বলেই পেরেছিলাম। মা ছিলো আমার একমাত্র শ্রোতা, আমার মেন্টর, আমার বন্ধু। যাইহোক, সবাই এই ভাবে অন্যভাবে ক্ষোভ, রাগ, অভিমান গুলোকে প্রশমিত করতে পারেনা। পারেনা বলেই আত্নহুনণের চিন্তা আসে, অথবা ভেতরে গজিয়ে ওঠে দুর্বার প্রতিশোধ স্পৃহা। এগুলোকে না কন্ট্রোল করা গেলে দুটোই মারাত্নক হয়ে উঠতে পারে ধীরে ধীরে। পর্যাপ্ত পরিমাণ অ্যাটেনশন না দিলে আপনার সন্তানের ক্ষেত্রেও এমনটি হতে পারে। তখন আপনার অ্যাকশন কী হবে?
দু একজন বাদে অনেক মনোরোগ বিশেষজ্ঞও নিজেদের পেশেন্টকে মনোবৈকল্যের রোগী ভেবে নিতেই বেশি পছন্দ করেন, সুস্থ একজন পাজলড মানুষও যে তাদের কাছে কাউন্সেলিং এর জন্যে আসতে পারে, এটা মনে হয় তারা ভাবতেই পারেন না। আমার নিজেরই অভিজ্ঞতা আছে। তখন পড়ি ভার্সিটির থার্ড সেমিস্টারে। নিজের শহর ছেড়ে ঢাকায় এসেছি পড়তে, কিন্তু পড়ালেখায় কোনভাবেই মনোযোগ বসাতে পারছিনা। সেকেন্ড সেমিস্টারের রেজাল্ট ভয়াবহ বাজে হয়েছে। ভাবলাম একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেই। নাম লিখব না এখানে, শুধু বলবো তিনি পাবনা মানসিক হাসপাতালের প্রাক্তন প্রধান ছিলেন, আর সেই সময়ে রাজশাহীর সবচেয়ে নামকরা সাইক্রিয়াট্রিস্ট। উনি আমাকে সাকুল্যে ৫ মিনিট দেখলেন আর কথা শুনলেন। খসখস করে একটা ওষুধ লিখে দিলেন। বের হয়ে দেখি ডায়াগ্নোজ করেছেন ADHD অর্থাৎ অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপারঅ্যাক্ডটিভিটি ডিসঅর্ডার। চাইলে গুগল করে দেখে নিতে পারেন ক্যামনতর অসুখ এটা। যাহোক ওই ক্যাপসুল খাওয়া শুরু করলাম, আমার অ্যালার্জিক রিয়্যাকশন হলো। চুল পড়ে যেতে লাগলো। মাঝেমাঝেই মাথার ভেতর ক্যামন যেন লাগতো। চুল কামিয়ে ফেলে বাসায় যেয়ে বসে থাকলাম। এক সেমিস্টার ড্রপ গেল। পরবর্তীতে আরেকজন ডাক্তারকে দেখালে উনি ভীষণরকম ক্ষেপে গেলেন পূর্বোক্ত সেই সাইক্রিয়াট্রিস্টের ওপর। রিয়াকশন রিভার্স করার জন্যে দুটো মেডিকেশন দিলেন, আর বললেন আমার কোন সমস্যাই নেই। এডিএইচডি নিয়ে আমি যেন মোটেই মাথা না ঘামাই।
মেন্টাল হেলথ বাংলাদেশে চুড়ান্তভাবে অবহেলিত একটা টপিক। এর কোন গুরুত্ব আমাদের বাবা-মার কাছে ছিলোনা। শিক্ষকদের কাছেও না। ক্লাসরুমে প্রহার করার শুধু শারীরিক ব্যাথাই নয়, যে হিউমিলিয়েশন, ট্রমা সহ্য করতে হচ্ছে ক্লাসমেট দের সামনে, এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব যে মনোবৈকল্যেও রুপ নিতে পারে, তা আমরা কখনো ভাবিনি। খুবই স্বস্তির একটা ব্যপার যে ক্লাসরুম থেকে এই প্রহারের ব্যপারটা উঠে গিয়েছে বললেই চলে। শুধু প্রহার না, বড় ভাই বা দুষ্ট ক্লাসমেটদের কাছে বুলিং এর শিকার হয়নি এমন কজন আছে? আমি নিজেই মোটাসোটা ছিলাম বলে স্কুলে কলেজে অসংখ্যবার বডি শেমিং এর শিকার হয়েছি। বাইরের দেশ গুলোতে যখন এই বুলিং বন্ধে হাজার হাজার মুভমেন্ট হয়েছে, হচ্ছে, তখন আমরা পড়ে আছি একটি কিশোরী মেয়ের আত্নহত্যা নকল করেছে বলে জাস্টিফিকেশনের খাতা খুলে! এভাবেই চলবে? আমরা পাইনি বলে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মও পাবেনা, এই জাস্টিফিকেশনেই আটকে থাকবো আমরা? এই দায় কেউই এড়াতে পারেনা। না স্কুল, না শিক্ষক, না বাবা মা। কতটা ডিপলি ডিস্টার্বড হলে ১৪-১৫ বছরের একটা কিশোর-কিশোরী আত্নহণনের পথ বেছে নিতে দ্বিধা করেনা, তা অনুধাবণ করতে গেলে আমাদের কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যেতে হয়! এই শিক্ষাব্যবস্থা নিয়েও কথা বলা উচিত। যে শিক্ষকরা নকলের প্রমাণ না পেয়েই শুধু মোবাইল ফোন সাথে রাখার কারনে একজন শিক্ষার্থীকে টিসি দিতে পারেন, যারা এই কারনে শিক্ষার্থী ও তার বাবা-মা কে তার সামনেই অপমান করতে পারে্ন, তারা আর যাই হোন, "শিক্ষক" নামের যোগ্য হতে পারেন না। যে শিক্ষাব্যবস্থায় বাবা-মা, পরিবার, শিক্ষক, সমাজ সবাই মিলে শিক্ষার্থীদের এটা মনে করতে বাধ্য করে যে জিপিএ ফাইভ পাওয়াই শিক্ষাজীবনের একমাত্র লক্ষ্য, না পেলে কর্মজীবনের সব পথ বন্ধ, যে শিক্ষাব্যবস্থা চরম চাপের মুখে একজন শিক্ষার্থীকে বাবা মার অপমানের বোঝা নিয়ে পৃথিবী ছাড়তে বাধ্য করে, সেই শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তনের প্রয়োজন আছে।
অরিত্রী এই কিশোর বয়সে ঝরে পড়ার বিচার চাইবোনা। বিচার হয়না এদেশে, সেই আশাও করিনা। আমার এই লেখার একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে চিন্তার খোরাক যোগানো। চিন্তা করতে শিখুন। দেহের সুস্থতা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, মনের সুস্থতাও এক চিমটি কম নয় তার থেকে। কাল আপনার ফুটফুটে সন্তানের জীবনে এমন দিন না নেমে আসুক। আমরা ভাবতে শিখি, আমরা নিজেদের যায়গা থেকে প্রতিবাদী হতে শিখি। আমাদের মধ্যে থেকেই কিন্তু একেকজন নীতি নির্ধারক, একেকজন শিক্ষক, আর সেই মন থেকেই কিন্তু মানুষ।
আমরা মানুষ হতে শিখি!
ছবিসত্ত্বঃ আর্টস বাই র্যাটস
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ বিকাল ৩:৫৬