দিন – ৪ ও ৫ (১০-০৩-২০১৩ ও ১১-০৩-২০১৩)
ভারতে আমাদের প্রথম সকাল। ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে রেস্টুরেন্টে গেলাম নাস্তা করতে। নাস্তা সেরে হোটেল রুমে ফিরে গেলাম। ব্যাগ গুছিয়ে দিল্লীর উদ্দেশ্যে রওনা দিতে বের হলাম। আমাদের ট্রেন ছিল ১১:৩০টায়। কিন্ত আমরা ৯:০০টায় স্টেশনে চলে যায়। কারণ আমরা যেহেতু নতুন সেহেতু সিট খোঁজার একটা ব্যাপার ছিল। আমি, ফখরুল আর নকিব পড়লাম সোহেল স্যারের সাথে একই কম্পার্টমেন্টে। আমরা এতে মহা খুশি! সময় কাটানোর জন্য আমরা স্টেশনে কার্ড খেলা শুরু করলাম। আমার প্রথম কার্ড খেলাও তখনই। আগে কখনো কার্ড খেলিনি। সোহেল স্যারই আমার গুরু। তাছাড়া কৃতজ্ঞ থাকব রবিন স্যার, সাইফুল ভাই, নাহিদ ভাই আর ফখরুলের কাছেও। নাহিদ ভাইয়ের সাথে পরিচয়ই তো কার্ড খেলা নিয়ে। নাহিদ ভাই আমাদের চাইতে এক বছরের সিনিয়র ছিলেন। কিন্তু পুরো সফরেই কখনো মনে হয়নি তিনি আমাদের সিনিয়র। কত মজার স্মৃতি আছে তার সাথে। কার্ড খেলতে খেলতে স্টেশনে ঘোষণা দেওয়া হল ট্রেন আসবে ১২:৩০টায়। অপেক্ষা আরো এক ঘন্টা বাড়ল। কার্ড খেলা দেখে রপ্ত করতে করতেই আবার ঘোষণা আসল ট্রেন আসবে ০৩:৩০টায়। এই ঘোষণা শোনার পর মেজাজ এমন খারাপ হয়েছিল যে কি করব বুঝতে পারছিলাম না। এরকম দেরি করার জন্য আমরা বাংলাদেশের রেলপথকে গালি দিই। ভারতেরও যে একই অবস্থা!
একটু পর বুঝতে পারলাম এই ঘোষণাটা আমাদের জন্য শাপেবর হয়ে এসেছে। মহানন্দ পার্ক দেখার এই সুযোগ আর মিস করা চলে না। সোহেল স্যারকে বলে রওনা দিলাম মহানন্দ পার্কের উদ্দেশ্যে। আমরা ৬জন ছিলাম। তাই অটো ট্যাক্সি নিয়েই গেলাম। ট্যাক্সি থেকে নেমে কিছু পথ হেঁটে যেতে হয়। রাস্তাটা মহানন্দ নদীর পাশ দিয়েই। এই নদীর অবস্থা আমাদের বুড়িগঙ্গার চাইতেও খারাপ। খুব বাঝে গন্ধ উঠে আসে নদী থেকে। মহানন্দ পার্কে পৌছালাম। সবাই মহানন্দ পার্ক বললেও এই পার্কের নাম আসলে সূর্য্য সেন পার্ক। অনেক সুন্দর একটি পার্ক। দেখেই বুঝা যায় পার্কের সবকিছুর অনেক যত্ন নেয় ওরা। পার্কে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে আবারো ফিরে গেলাম শিলিগুড়ি জাংশনে।
দুপুরের খাবার চলে এসেছে। স্টেশনে বসেই খেতে হবে। কাগজের প্লেট দেওয়া হল সবাইকে। অনভিজ্ঞদের জন্য এই প্লেটে ভাত খাওয়া কষ্টের কাজ। খাওয়া শেষ করে সবাই অপেক্ষা করছে ট্রেন কখন আসবে। এমন সময় ঘোষণা এল ট্রেন আসবে ৪:১৫টায়। তখন এই তো আর কিছুক্ষণ বলে বলে নিজেদের সান্তনা দেওয়া ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না। সময় কাটানোর জন্য সোহেল স্যারকে নিয়ে একটা গানের আসর বসল। তাছাড়া মজার অনেক ঘটনাই ঘটেছিল স্টেশনে। বেশিরভাগই আব্বাসকে ঘিরে। আব্বাস 'র' কে 'ল' এর মত উচ্চারণ করে। বিপত্তি ঘটে সেখানেই। সে রবিন স্যারকে ডাকত লবিন স্যার। রবিন স্যারও তার নাম দিয়েছিলেন ফাদারস। আব্বা ইংরেজি ফাদার এবং আব্বাসের 'স' টা ফাদারের পাশে যুক্ত করে নাম দিয়েছিলেন ফাদারস। মজা করতে করতে আব্বাস এক পর্যায়ে বলে বসে,
“স্যার লেল গালিতে না গিয়ে বাসে গেলে আরো ভাল হতো।“
দেখতে দেখতে ঘড়িতে ৪:০০টা বাজল। আমরা প্রস্তুত হয়ে গেলাম। স্টেশন থেকে আবারো ঘোষণা! না, এবার খারাপ কোন ঘোষণা নয়। ট্রেন আসছে আগের নির্ধারিত সময়েই।
একটু পর চলে আসল দিল্লীগামী ট্রেন মহানন্দ এক্সপ্রেস। তাড়াতাড়ি করে উঠে পড়লাম। সিট খুঁজতে আমাদের তেমন কষ্ট হয়নি। বগিতে উঠেই প্রথম কম্পার্টমেন্টে আমাদের সিট পড়েছিল। একেকটা গ্রুপ একেক কম্পার্টমেন্টে। অন্য যাত্রীদের অনুরোধ করে অনেকেই সিট পরিবর্তন করেছে। ভারতের রেলগুলো স্লিপার সিটসহ। তিনতলা বিশিষ্ট স্লিপার সিট। আমাদের কম্পার্টমেন্টে সমস্যা ছিল আমাদের নিচের দুইটা সিটই অন্য ২জন যাত্রীর। তারপরও তেমন একটা অসুবিধাই পড়তে হয়নি। আমাদের কম্পার্টমেন্টে সোহেল স্যার থাকায় মজা বেশি হয়েছে। সবাই ঘুরতে আসত এই কম্পার্টমেন্টে।
আমি কখনো প্লেয়িং কার্ড খেলিইনি বা খেলার চেষ্টাও করিনি। এই সফরের আগেই ফখরুলের কাছ থেকে কল ব্রিজ শিখেছিলাম। আর ভারতে গিয়ে শিখলাম টুয়েন্টি নাইন। শিক্ষকের নাম তো আগেই বলেছি। স্যার আর আমি মিলে নাহিদ ভাই আর সাইফুল ভাইকে দুইবার হারিয়েছিলাম। ৩৩ ঘন্টার ট্রেন জার্নিতে সময় কাটানোর জন্য কার্ডের চাইতে বড় ঔষধ আর নেই। অনেক হাসি ঠাট্রার মাধ্যমে সময় কাটাচ্ছিলাম আমরা। ট্রেনেই আব্বাসের বড় ভাই আব্বাসকে ফোন করেছিল। সম্ভবত আব্বাসকে জিজ্ঞেস করেছিল সে কোথায় কোথায় যাবে।
তো আব্বাস উত্তর দিল, “আঁরা দিল্লীত্তুন শ্যামলী (আসলে হবে সিমলা) যাইয়্যুম, এত্তুন মনালি যাইয়্যুম (মানালি)।
তার শ্যামলী, মনালি শুনে আমার হাসি আর চাপিয়ে রাখতে পারলাম না। এরপর থেকে তার নামই হয়ে গেল শ্যামলী।
ভারতের ট্রেনের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে হিজড়া। প্রায় প্রতিটা স্টেশনেই ট্রেনে হিজড়া উঠেছিল। আমাদের কামড়া থেকে আমরা দিয়েছিলাম ৯৫ রুপি। হিজড়া নিয়ে মজার ঘটনা অনেক। হাসিব স্যার তো হিজড়া আসলে মূর্তি হয়ে যেত। একবার তো ভয়ে গরম চায়ের মধ্যেই আঙ্গুল চুবিয়ে দিয়ে বসে ছিলেন। হিজড়াদের হাতে সবচেয়ে নির্যাতিত হয়েছিল স্থায়ী ক্যাম্পাসের সানি। একবার নয় তিন তিনবার সে নির্যাতনের শিকার হয়েছে। আমরা যখন তাকে জিজ্ঞেস করলাম, কেমন লাগল?
সে উত্তর দিল, “আঁই হইদি আঁই স্টুডেন্ট, টিঁইয়া ন দি, ইতাল্লায় আদর গরি দিইয়ি দে।“
এই ঘটনার পর সানিকে নিয়ে একটা গানও লিখে নাহিদ। লিখে বললে ভুল হবে, হিন্দী একটি বিজ্ঞাপনের নকল বলাই শ্রেয়। গানটা ছিল এমন,
“হ্যালো সানি সানি...পয়সা দে দে দে...হ্যালো সানি সানি...“
এবার আসি আব্বাসের ঘটনায়। সে তো হিজড়া দেখে স্যারদের কম্পার্টমেন্টে পালিয়ে গিয়েছিল। হিজরাটাও তার পালিয়ে যাওয়া খেয়াল করেছিল। হিজড়া ট্রেন থেকে নেমে গিয়েছে ভেবে আব্বাস যখন তার কম্পার্টমেন্টে ফেরত আসছিল হিজড়াটা তাকে দেখে ফেলে। হিজড়াটা তাকে ডেকে একটা সিটে বসায়। হিজড়াটা হিন্দীতে টাকা দিতে বলেছিল। আব্বাস টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানায়। তারপর হিজড়াটা যখন কাপড় তুলতে যাচ্ছিল আব্বাস চিৎকার করে বলে, “আঁই দির দির।“
সাইফুল্লাহ ভাইয়ের সাথেও ঘটে মজার একটি ঘটনা। তবে সেটি হিজড়া সম্পর্কিত নয়। একটি স্টেশনে দাঁড়িয়েছিল আমাদের ট্রেনটি। আমরা সবাই কথা বলছিলাম। হঠাৎ ছোট একটি মেয়ে জানালা দিয়ে এসে সাইফুল্লাহ ভাইকে বলে,
“হে দাড়িওয়ালা ভাই! পেহলে চুম্মা লে লে, ফিরসে পয়সা দে দে।“
এই কথা শুনে আমরা তো হাসতে হাসতেই শেষ। পুরো জার্নিতে অনেকেরই প্রিয় ডায়লগ ছিল এটা।
৪র্থ আর ৫ম দিন এভাবেই কেটে গেল। মজার মজার সব ঘটনা ঘটেছিল ট্রেনে। তবে কিছুটা বিরক্তও হচ্ছিলাম। বার বার স্টেশনে দাঁড়ায় ট্রেনটা। আর চলার গতির কথা নাই বা বললাম। মালবাহী ট্রেনও এই ট্রেনের চাইতে জোরে চলে। তাছাড়া এক রাতে এক মহিলার ব্যাগ চুরি হয়ে গিয়েছিল। তার সেই কি কান্নাকাটি! মাঝরাতে তার এমন কান্ডে সত্যিই বেশ বিরক্ত হয়েছিলাম। পরেরদিন সকালে দিল্লী পৌছাবো এই আশা নিয়েই সবাই ঘুমাতে গেলাম।