সম্প্রতি লন্ডনে এক ধনী আরব দোষী প্রমাণিত হয়েছে তার কর্মচারীকে লন্ডনের এক হোটেলে নির্যাতন করে মেরে ফেলার কারণে। সিসি ক্যামেরার ফুটেজে সে নির্যাতনের অংশবিশেষ বিবিসিতেও দেখানো হয়েছে। খুন করার সময় ধনী ওই আরবের হয়তো খেয়াল ছিল না যে সে তখন আরবের বাইরে আছে। আরব দেশে হলে এই ঘটনার বিচার তো দূরে থাক আত্মীয় স্বজন লাশটা পেলেও নিজেদের ভাগ্যবান বলে মনে করতেন।
দুবাই ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে ইউরোপের পথে যাত্রা বিরতির সময় দুজন ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা আলাপ করতে করতে জিজ্ঞাসা করলেন আপনি কোন দেশের নাগরিক? বাংলাদেশ- কথাটা শুনেই তাদের মুখের ভাব পাল্টে গেল। কারণ বুঝতে আমার একটুও দেরী হলো না। বাংলাদেশের মানুষজনকে এরা একটু নিচু দৃষ্টিতেই দেখে। আরব দেশগুলোর নিম্ন বেতনের চাকরিগুলোই বাংলাদেশের মানুষজন করে। এগুলোর মধ্যে আছে সবচেয়ে নিকৃষ্ট কাজ- গৃহকর্মী।
সম্প্রতি বাংলাদেশের সাথে সৌদি আরবের এক চুক্তি সম্পাদন হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ থেকে তারা বহু মানুষ নিবে। পদের মধ্যে রয়েছে বাগানের মালি, ক্লিনার, ড্রাইভার এবং নারী গৃহকর্মী (বা কাজের মেয়ে)। এর সংখ্যা হতে পারে প্রতি মাসে ১০ হাজার পর্যন্ত। এসব পদের মধ্যে বাস্তবতার কারণে একমাত্র বিরোধীতার পদটি হচ্ছে, গৃহকর্মী বা কাজের মেয়ে।
বাড়ির কাজের মেয়ে পদটাই মানুষের জন্য অবমাননাকর। আর তা যদি হয় সৌদি আরবে তাহলে পদটা হয়ে দাড়ায় ভয়ঙ্কর ঝুঁকিপূর্ণ। বিদেশী বিভিন্ন পত্রিকার পাতায় প্রায়ই আরবদের বিদেশী কাজের মেয়ে নির্যাতনের খবর পা্ওয়া যায়। আর ইন্টারনেটে এ বিষয়ে সার্চ দিলে যে খবরগুলো আসে তা দেখলে রিতিমতো আতঙ্কে শিউরে উঠতে হয়। আরবে নারী গৃহকর্মীদের মধ্যে নির্যাতিত হবার হার অনেক বেশী। এ নির্যাতনের মধ্যে রয়েছে ধর্ষণ, মারধর, বৈদ্যুতিক শক, বন্দী করে রাখা এবং বেতন না দেয়া। এসব সহ্য করতে না পেরে অনেকে বেছে নেয় আত্মহত্যার পথ। অন্যদিকে নির্যাতিত হবার পরে বিচার চা্ওয়ার মতো পরিস্থিতি আরবে নেই। বাংলাদেশের যেসব নারীদের সেখানে পাঠানো হবে তাদের অনেকে একেবারেই নিরক্ষর। বাংলাদেশের দূতাবাসের তুলনায় অন্য কয়েকটি দেশের দূতাবাস তাদের নাগরিকদের রক্ষায় অনেক সচেষ্ট হলেও তারা তাদের নাগরিকদের নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা করতে পারেনি। এক্ষেত্রে আমাদের দূর্বল দূতাবাসের পক্ষে যে তা সম্ভব হবেনা তা বলাই বাহুল্য।
গত বছরের আগস্টে সৌদি আরব থেকে নির্যাতিত হয়ে ফেরত আসা শ্রীলঙ্কার এক মহিলার এক্সরে রিপোর্টে হাত, পা ও মাথার ভেতর থেকে ২৪টি পেরেক ও সুচ পা্ওয়া যায়। এর মধ্যে একটা পেরেক পাওয়া যায় তার চোখের উপর বিদ্ধ অবস্থায়। অন্যগুলো ছিল হাত ও পায়ের ভেতর।
পেরেকগুলো আড়াই থেকে পাঁচ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা আর সুচগুলো প্রায় আড়াই সেন্টিমিটার লম্বা। নির্যাতনের শিকার আরিওয়াথি সাংবাদিকদের জানান, "তারা আমাকে কখনো বিশ্রামও করতে দিতোনা। ভারী জিনিস বহন করতে অক্ষম হওয়ায় তারা পেরেকগুলো গরম করে আমার দেহে ঢুকিয়ে দেয়। বাড়ির পুরুষটা সেগুলো গরম করে এবং মহিলাটা সেগুলো আমার দেহে ঢুকিয়ে দেয়।" তবে সৌদি আরবে থাকতে তিনি অভিযোগ করেননি কারণ, অভিযোগ করলে তারা যদি তাকে দেশে আসতে না দেয়। এ ঘটনার জন্য শ্রীলঙ্কা সরকার সৌদি সরকারের কাছে প্রতিবাদ জানায়।
নির্যাতনের ভয়াবহ এ ধরনের চিত্র আরবের দেশে বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। আল আরাবিয়া নিউজের মতে আরবে নির্যাতিত নারী গৃহকর্মীর সংখ্যা ৩০ লাখ! আরবের নব্য ধনীরা কাজের মানুষকে অতীতের দাস প্রথার সময়কার দাসীদের মতো করেই দেখে।
প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম বৃহৎ শক্তি। এ মুহূর্তে প্রবাসীরা অর্থ পাঠানো বন্ধ করে দিলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা সরবরাহে ঘাটতি সৃষ্টি হবে এবং দেশের আমদানীর অর্থ শোধ করা সম্ভব হবে না। ফলে দেশের অর্থনীতি ব্যালেন্স অফ পেমেন্ট সঙ্কটে পতিত হবে বলে সরকারের ধারণা।
বাস্তবে অত্যন্ত বিপদের মধ্যে ঠেলে দেয়া এই মেয়েদের থেকে কি পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা পা্ওয়া যাবে তার বাস্তবসম্মত হিসাব সরকারের আছে কিনা জানা নেই। বলা হচ্ছে তাদের বেতন হবে মাসে মাত্র ১২ হাজার টাকা। উল্লেখ্য পৃথিবীর অনেক দেশেই আইন অনুযায়ী একজন অদক্ষ শ্রমিকের মাত্র দুই দিনের সর্বনিম্ন বেতনই আরবের প্রস্তাবিত ওই ১২ হাজার টাকার থেকে বেশী।
মাসে ১২ হাজার টাকার হিসেব করার সময় সরকারের অবশ্যই হিসেব করা উচিত যে বিদেশে যেতে একজন শ্রমিকের দালাল, রিক্রুটিং এজেন্ট, পাসপোর্ট তৈরি, ভিসা প্রাপ্তি, যাতায়াত প্রভৃতিতে বহু খরচ হয়ে যায়। এর মধ্যে অনেকেই মেয়েই বাস্তবে তাদের পরিশ্রমলব্ধ পা্ওনা টাকা পাবেনা, নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে কোনো রকমে জান নিয়ে ফেরত আসবে। দেশে ফেরত আসার পর অনেকের চিকিৎসার নিতেই উপার্জনের এ টাকা শেষ হয়ে যাবে। এসব খরচ করার পর ১২ হাজার টাকা থেকে কয় টাকা ভুক্তভোগীর হাতে থাকবে কিংবা কোনো টাকা থাকবে কিনা তা অবশ্যই হিসেব করা প্রয়োজন রয়েছে।
নারী গৃহকর্মীদের বিদেশ যা্ওয়ায় কোনো খরচ করা হবেনা বলেই জানানো হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, বিদেশ যা্ওয়ার সময় নানা অজুহাতে রিক্রুটিং এজেন্টরা প্রত্যেকের কাছ থেকে ৪ লাখ টাকা পর্যন্ত নিয়ে নেয়। গরীব কর্মীরা ধার-দেনা করে কিংবা ভিটা-মাটি বিক্রি করে এ টাকা জোগাড় করে। ফলে বিদেশ থেকে তারা চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে আসতে চাইলেও আসতে পারে না। দেশে আসলে ঋণ কিভাবে শোধ হবে এ চিন্তাতেই নির্যাতন সহ্য করে তাদের বিদেশে থেকে যেতে হয় লম্বা সময়।
পরিসংঋখ্যানে জানা যায়, বিদেশ যাওয়া নারী শ্রমিকদের মধ্যে ১৪ শতাংশ সম্পূর্ণরুপে সর্বশান্ত হয়ে ফিরে আসে। রিক্রুটিং এজেন্ট সহ বহু ধরনের খরচ তাদের পানিতে যায়। তাদের মধ্যে ৩৫ শতাংশের আর্থিকভাবে কোনো লাভ হয় না ক্ষতিও হয় না। কোনোক্রমে বিদেশ যা্ওয়ার টাকাটা উঠে আসলেই তারা দেশে ফিরে আসে। অর্থাৎ তাদের জীবনের মূল্যবান সময় ও শ্রম তারা বিদেশে নষ্ট করে। সব মিলিয়ে বিদেশে পাঠানো নারী শ্রমিকের ৪৯ শতাংশেরই প্রত্যাশা পূরণ হয় না।
বাংলাদেশে নারী শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নেই এমনটা মনে করা ভুল। গার্মেন্টসের রপ্তানি প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে এর সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে কর্মসংস্থান। চট্টগ্রাম অঞ্চলের গার্মেন্টস ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন, সে এলাকায় সারা বছর কর্মী সঙ্কট লেগেই আছে। মাঝে মাঝে মাইকিং করেও তারা দক্ষ কর্মী পায়না। আর কিছুদিন গার্মেন্টসে কাজ করার পর দক্ষ হয়ে উঠলে আরবের প্রস্তাবিত ১২ হাজার টাকার থেকে বেতন খুব একটা কম হবে না। উপরন্তু এখানে চাকরি পাওয়ার জন্য পাসপোর্ট, দালাল, বৈদেশিক রিক্রুটিং এজেন্ট, বিমান ভাড়া ইত্যাদি বাবদ খরচ নেই। ফলে চাকরির নেয়ার জন্য ঋণের দায়ে সর্বশান্ত হতে হবে না।
আসুন দেখি বাংলাদেশ থেকে বেশী বেশী গৃহকর্মী নেয়ার আরবদের উদ্যোগের পিছনে কারণটা কি? অতীতে আরবের দেশগুলো মূলত ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, শ্রীলঙ্কা, ইথিওপিয়া ও ভারত থেকে কাজের মানুষ নিতে পারতো। যেসব দেশে এসব মেয়েরা কাজ করে তার মধ্যে রয়েছে, সউদি আরব, কুয়েত, জর্ডান ও লেবানন।
এসব কর্মীদের নির্যাতন, মৃত্যু, কম বেতন দেয়া ইত্যাদি কারণে সরবরাহকারী দেশগুলো বর্তমানে আরবের দেশগুলো থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। তাই তারা সস্তায় নতুন মেয়ের সন্ধানে এসেছে বাংলাদেশে। যদি বিদেশে এভাবে মেয়েদের পাঠানো বন্ধ না হয় তাহলে আর কিছুদিনের মধ্যেই আরবের ৩০ লক্ষ নির্যাতিত গৃহকর্মীর সংখ্যা আরো বড় হবে। বিদেশের মাটিতে আমাদের দেশের মেয়েদের এ অবমাননা ও নির্যাতন আমরা চাইনা।
অন্যথায় আমরা বাধ্য হবো আরবদের নতুন নতুন পদ্ধতির নির্যাতনে মৃত মেয়েদের লাশ দেখতে। বেঁচে যা্ওয়া বহু নারীকে নির্যাতনের ভয়াবহ স্মৃতি বহন করতে হবে, অনেকে পঙ্গু হয়ে যাবে, যন্ত্রণা বয়ে বেড়াবে সারা জীবন।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে এপ্রিল, ২০১১ সকাল ৮:৪৯