
বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান
বিদ্যুৎ সমস্যার জন্য দেশের মানুষের যে কি পরিমাণ কষ্ট হচ্ছে তার কোনো বর্ণনা করার ভাষা নেই। এই অবস্থায় দেশের গ্যাস সম্পদও শেষের দিকে।
১. বিদ্যুৎ সমস্যার দীর্ঘমেয়াদে সবচেয়ে গ্রহনযোগ্য সমাধান হচ্ছে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। এক হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বসানোর জন্য যদি ১১ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়। তবে এ ধরনের দুই থেকে তিনটা পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বসানোর জন্য এখনই উদ্যোগ নেয়া উচিত। এ ধরনের বড় প্রকল্পের পেছনে খরচ কখনোই একসাথে দিতে হয় না। প্রতি বছরের বাজেট থেকে দুই হাজার কোটি টাকা করে দিলে এ খরচের ভার খুব সহজেই মেটানো যায়। আমরা সামরিক সহ আরো কয়েকটা খাতে এর কয়েক গুণ বেশী টাকা প্রতি বছর খরচ করি। আর একবার স্থাপন করতে পারলে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে উৎপাদিত বিদ্যুতের দাম কিন্তু কমই থাকে।
রাজনীতিবিদদের বোকামির কারণে অতীতে ইন্টারনেট সাবমেরিন কেবলের সংযোগ বিনা পয়সাতে পাওয়ার সুযোগ পেয়েও আমরা হারিয়েছিলাম। তখন যুক্তি দেয়া হয়েছিলো ইন্টারনেট সংযোগ থাকলে আমাদের দেশের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে (তার অনেক বছর পরে কয়েক মিলিয়ন ডলার দিয়ে এই সংযোগ নেয়া হয়েছে)। ফলে আমাদের দেশ হারিয়েছে সফটওয়্যার শিল্পের উন্নয়ন সম্ভাবনা। অন্যদিকে পাশ্ববর্তী দেশ সে সুযোগ নিয়ে সফটওয়্যার শিল্পে ব্যাপক উন্নতি করেছে। এখন কোনোভাবেই সেই ক্ষতি পূরণ হবে না। রাজনীতিবিদদের এমন বোকামি আমরা আর দেখতে চাই না।
২. দেশের যে দুইটা বড় কয়লা ক্ষেত্র আছে সেগুলোর কাছাকাছি দ্রুত আরো কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য বাজেট বরাদ্দ করতে হবে।
৩. নবায়নযোগ্য শক্তি যেমন, সৌরবিদ্যুৎ, বায়ু বিদ্যুৎ, পানি বিদ্যুৎ ইত্যাদির প্রসার বাড়ানোর জন্য আরো আর্থিক বরাদ্দ প্রয়োজন।
৪. বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী এনার্জি সেভিং বাল্ব উৎসাহিত (সম্ভব হলে বাধ্যতামূলক) করতে হবে।
পারমাণবিক বনাম সৌরশক্তি
রিনিউয়েবল এনার্জি ব্যবহার বাড়ানো উচিত। বিশেষ করে সৌরশক্তির ব্যবহার বহুগুণে বাড়ানো উচিত। আমাদের দেশের গৃহস্থালী ব্যবহারের জন্য এটা খুবই কাজের হবে। কিন্তু শিল্প কারখানার জন্য এই উৎপাদন কতোখানি কাজের হবে তা নিঃসন্দেহে প্রশ্ন সাপেক্ষ।
জাপান:
জাপানে নতুন বাড়িগুলোর ৭০% সৌর প্যানেল সমৃদ্ধ। কিন্তু তা দিয়ে বাড়িগুলির আংশিক বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণ হয়। সৌরশক্তি দিয়ে জাপানের বিদ্যুতের অতি সামান্য অংশই পূরণ হয়। ২০০৮ সালে জাপানে ৫৫টি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ৪৯ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে। আর সৌর প্যানেল থেকে উৎপাদন হয়েছে মাত্র ২ হাজার মেগাওয়াট (প্রায়)।
ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন
অন্যদিকে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন একটু ভিন্ন পদ্ধতি নিয়েছে। তারা বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোকেই টার্গেট বেধে দিয়েছে যে, তাদের মোট উৎপাদনের ১০% নবায়নযোগ্য শক্তি (সৌর, বায়ু, পানি) থেকে উৎপাদন করতে হবে।
এখন কথা হলো, একটা দেশের কতোখানি চাহিদা সৌরশক্তি দিয়ে পূরণ করা সম্ভব? জার্মানি এক্ষেত্রে পৃথিবীর অন্যতম শীর্ষ নির্মাতা ও ব্যবহারকারী। পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক সৌরবিদ্যুৎ এ দেশেই উৎপাদন হয়। তথ্য অনুযায়ী তারা ২০৫০ সাল নাগাদ তাদের মোট বিদ্যুতের ২৫% সৌরশক্তি দিয়ে পূরণ করার পরিকল্পনা করেছে। তাই একথা মানতেই হবে যে, সৌরশক্তি দিয়ে দেশের সম্পূর্ণ বিদ্যুৎ চাহিদা মেটানোর সময় এখনো আসেনি।
পারমাণবিক বিদ্যুতের বর্তমান ব্যবহার
পৃথিবীর উন্নত-অনুন্নত বহু দেশ পারমাণবিক বিদ্যুৎ দিয়ে তাদের চাহিদা মেটাচ্ছে।
স্বল্প উন্নত দেশগুলোর মধ্যে, চীন, তাইওয়ান, ভারত (ভারতে ১৭ টি প্ল্যান্ট), ব্রাজিল, মেক্সিকো, লিথুয়ানিয়া, আর্জেন্টিনা, পাকিস্তান, ইরান স্বাচ্ছন্দে পারমাণবিক বিদ্যুৎ ব্যবহার করছে। ভারতীয়দের চেয়ে আমাদের বুদ্ধি কোনো অংশে কম নয়।
যেসব দেশ নতুন পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের ঘোষণা দিয়েছে তার মধ্যে জর্ডান, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, আরব আমিরাত ও নাইজেরিয়া উল্লেখযোগ্য।
পারমাণবিক জ্বালানী:
পারমাণবিক জ্বালানী দেশেই মজুত আছে (তবে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কঠিন কাজ হলেও অসম্ভব নয়)
সাধারণত যে কোম্পানির সাথে পারমাণবিক চুল্লি নির্মাণের চুক্তি করা হয় তারাই দীর্ঘমেয়াদী জ্বালানী সরবরাহ করে।
আমাদের মতো দেশের কাছে এ প্রযুক্তি বিক্রি করবে কিনা
ইতিমধ্যেই রাশিয়া, দঃকোরিয়া সহ বহু দেশ প্রস্তাব নিয়ে এসেছে। তারা তৈরি করবে ও জ্বালানী সরবরাহ করবে।
পারমাণবিক নিরাপত্তা
পারমাণবিক নিরাপত্তা অবশ্যই নিশ্চিত করে তারপর উৎপাদন করতে হবে। একথা মানতেই হবে যে, জাপানিদের নিজেদের দেশের নিরাপত্তার প্রতি মায়া আমাদের চেয়ে কম না। পারমাণবিক বোমার তারা সবচেয়ে বড় শিকার। তার পরেও তারা তাদের দেশে ৫৫ টা পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বসিয়েছে। দুর্ঘটনার ভয়ে বাদ দেয় নাই। চেরনোবিল দুর্ঘটনার পর রাশিয়া বা থ্রি মাইল আইল্যান্ড দুর্ঘটনার পর আমেরিকা এ শক্তির ব্যবহার বন্ধ করে নাই।
পৃথিবীর বহু দেশ পারমাণবিক বিদ্যুৎ দিয়ে তাদের চাহিদা মেটায়। শুধু তা-ই নয়, শত শত সাবমেরিন ও পারমাণবিক শক্তিচালিত সামরিক জাহাজ এ শক্তি দিয়েই চলে। তারা কখনো দুর্ঘটনার ভয়ে উৎপাদন বন্ধ রাখেনি। আমাদের দেশের এই চরম সঙ্কটে দুর্ঘটনার ভয়ে পারমাণবিক শক্তি উৎপাদন থেকে পিছিয়ে গেলে চলবে না।
ছোট বিদ্যুৎ কেন্দ্র বনাম বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্র
ছোট ছোট বিদুৎ কেন্দ্র সব সময় এফিশিয়েন্ট হয় না (রিনিউয়েবল বাদে)। অর্থাৎ এক ঘনফুট গ্যাস থেকে বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্র যে পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে ছোট বিদ্যুৎ কেন্দ্র তার চেয়ে অনেক কম উৎপাদন করবে।
-------------------------------------------------------
বাজেটের প্রধান মাপকাঠি হওয়া উচিত কর্মসংস্থান
-------------------------------------------------------
পশ্চিমা বিশ্বের মন্দার মধ্যে আমাদের সামনে আসছে বহু মিলিয়ন মানুষের কথা, যাদের চাকরি চলে গেছে। কতো মানুষের চাকরি আছে, কতো মানুষের গেছে, কিভাবে তাদের জন্য ব্যবস্থা করা যায়, এসব ব্যাপার তাদের অর্থনীতিবিদদের অন্যতম প্রধান মাথা ব্যথা। কিন্তু আমাদের দেশে কর্মসংস্থান বিষয়ে তেমন কোনো আলোচনা দেখি না। আমার মতে কর্মসংস্থানই হওয়া উচিত আমাদের বাজেটের প্র্রধান লক্ষ্য। আর এ লক্ষ্যকে সামনে রেখেই সরকারের অন্যান্য খাতকে তৈরি করা উচিত। কারণ দারিদ্র্য বিমোচনের নামে টাকার অপচয়ের কোনো দরকার নেই।

কর্মসংস্থানের মাধ্যমে দরিদ্র্য মানুষকে কাজের ব্যবস্থা করে দিতে পারলে তারা নিজেরাই নিজেদের দারিদ্র্য বিমোচন করবে। কারো সাহায্যে এটা হয় না। কর্মসংস্থানের মাধ্যমে অর্থনিতির গতি সঞ্চার হয়। যে শ্রমিক ১০০ টাকা বেতন পাবেন সে কিন্তু টাকাটা গোপনে লুকিয়ে রাখবে না। বাজারে গিয়ে টাকাটা খরচ করে ফেলবে। সেই খরচের টাকাটা আবার অন্য মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে। ফলে অর্থনীতি সচল থাকে।
অন্যদিকে বেকার মানুষ মানেই দেশের অপরাধ সহ নানান সামাজিক সমস্যা বৃদ্ধি। তাই দেশের বাজেটের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত কর্মসংস্থান, কর্মসংস্থান ও কর্মসংস্থান।
-------------------------------------------------------
শিল্প উন্নয়ন
-------------------------------------------------------
১. দেশীয় ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প-কারখানার বিকাশ অতি গুরুত্বপূর্ণ। আমার জানা মতে, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের মাধ্যমে ব্রিটেনের বেসরকারি খাতের ৫৯.২% কর্মসংস্থান হয়ে থাকে অন্যদিকে বাংলাদেশের মাত্র ২৩% কর্মসংস্থান এ খাতের মাধ্যমে হয় (সূত্র: ইউকে ন্যাশনাল স্ট্যাটিসটিকস ও বাংলাদেশের পরিকল্পনা কমিশন)। তাই সরকারের উচিত অযথা ও হয়রানিমূলক নানা ধরনের ট্যাক্সের বোঝা থেকে এ খাতকে মুক্ত রাখা ও উৎসাহমূলক নানা ধরনের ব্যবস্থা দিয়ে দেশের কর্মসংস্থান বৃদ্ধি ও অর্থনীতি গতিশীল করা।
২. শুল্ক কাঠামো শিল্প সহায়ক করা। দেশীয় শিল্পকে নানা ধরনের ট্যাক্স ও হয়রানি থেকে মুক্ত রাখার ব্যবস্থা।
3. তৈরি পণ্য আমদানি শুল্ক বাড়ানো আর সেগুলোর জন্য উপকরণ, কাচামাল ও যন্ত্রপাতি আমদানি শুল্ক কমানো। এর ফলে দেশীয় শিল্পগুলো উৎসাহিত হবে।
যে সুযোগগুলো আমরা প্রতিনিয়ত হারাই:
কয়েক বছর আগে আমরা দেশের শিল্পের উন্নয়নের বিশাল এক সুযোগ হারিয়েছি। ঢাকা শহর থেকে পুরনো স্কুটারগুলো উঠিয়ে দিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে বহু সিএনজি স্কুটার আমদানি করা হলো। সে সময় যদি সরকার তৈরি সিএনজি স্কুটার আমদানি করার উৎসাহ না দিয়ে শুধু সিএনজির যন্ত্রপাতি আমদানি শুল্ক কমিয়ে দিতো তাহলে বেশ কয়েকটা দেশীয় শিল্প যন্ত্রপাতি আমদানি করে সিএনজি সংযোজন/তৈরি করা শুরু করতো। পরে আস্তে আস্তে তারা নিজস্ব প্রয়োজনে দেশীয় উপকরণ ব্যবহার শুরু করতো। সংযোজন কাজ করতে গিয়ে দেশীয় ইঞ্জিনিয়ারদের কারিগরী জ্ঞান বৃদ্ধি পেত। যে জ্ঞান দিয়ে তারা পরবর্তীতে নিজেরাই সিএনজি তৈরি করতে পারতো।

এগুলো এমন কোনো আহামরি প্রযুক্তি না যে দেশে উৎপাদন করা যাবে না। বরং দেশে তৈরি করা হলে কর্মসংস্থান হতো বহু মানুষের। দেশী কয়েকটা শিল্পও দাড়িয়ে যেতো। সরাসরি তৈরি পণ্য আমদানি করার চেয়ে যন্ত্রপাতি আমদানি করায় উৎসাহ দেয়াটা এজন্য অনেক ভাল। এটা একটা উদাহরণ মাত্র। এ ধরনের আরো বহু সুযোগ আমরা প্রতিনিয়ত হারাই।
৪. শেয়ার বাজারের সম্পৃক্ততা আরো বাড়াতে হবে।
-------------------------------------------------------
অবকাঠামো
অবকাঠামো এ দেশের জন্য সবচেয়ে বড় একটা চ্যালেঞ্জ। এ কারণে এ খাতে বরাদ্দ রাখতেই হবে। বিশেষ করে সেতু নির্মাণ, নৌপথ, রেলপথ ও মহাসড়কগুলোর বৃদ্ধি, বন্দর উন্নয়ন ও ফাইবার অপটিকের মতো ইন্টারনেট অবকাঠামো নির্মাণ অতি জরুরী।
-------------------------------------------------------
শিক্ষা
শিক্ষা খাত হওয়া উচিত সবচেয়ে বেশী বাজেট বরাদ্দের খাত। অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার পাশাপাশি উচ্চ শিক্ষার জন্যও পর্যাপ্ত বরাদ্দ রাখা উচিত।
-------------------------------------------------------
বিদেশী লোন চাইনা
-------------------------------------------------------
আইএমএফ অর্থনীতিকে গতিশীল করার জন্য কিংবা সঙ্কট থেকে উত্তরণ করার জন্য শর্তসাপেক্ষে লোন দেয়। কিন্তু তাদের অযাচিত ও অবাস্তব শর্ত পূরণ করতে গিয়ে অর্থনীতির বারটা বেজে যায়। এছাড়াও এ লোনগুলোর অধিকাংশই তাদের শর্ত অনুযায়ী বিদেশী কনসালটেন্টদের ফি হিসেবে দিয়ে দিতে হয়। ফলে আসল অর্থ দেশের খুব কমই কাজে লাগে।

বিগত আমলে কয়েকজন অর্থমন্ত্রী ইন্টারন্যাশনাল মনিটরি ফান্ড বা আইএমএফের লোন নেয়ার জন্য ব্যাপক তৎপর ছিলেন। সাইফুর রহমান আইএমএফের প্রায় সব শর্ত পূরণ করার পরেও আইএমএফের ঋণের শেষের দিকের কিস্তিগুলো আনতে পারেন নাই। তাই মন্ত্রীত্ব কালের শেষের দিকে তাকে প্রকাশ্যেই আইএমএফের প্রতি বিষেদগার করতে দেখা যেত। এসব ঝামেলা থেকে বাঁচার সবচেয়ে ভাল পদ্ধতি হচ্ছে তাদের কাছ থেকে লোন নেয়ার কোনো চেষ্টাই না করা।
-------------------------------------------------------
আমরাও পারি
আমরা খুব বোকা, উন্নত প্রযু্ক্তি বানাতে পারি না, ব্যবহার করতে পারি না নীতি নির্ধারকদের ইত্যাদি ধরনের ধারণা বাদ দেয়াই সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ। দৃঢ়কণ্ঠে বলতে হবে আমরাও পারি।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা মে, ২০০৯ রাত ১২:১২