ধামরাই গিয়েছিলাম সেদিন। কুমার পাড়ায় ছবি তুলতে। আগে কখনো কুমার পাড়ায় যাওয়া হয় নাই। তাই ওদের জীবন যাপন সম্পর্কে কোনো ধারনা ছিল না। তিন ঘন্টা আসলে খুব কম সময় ছিল ওদের জীবন যাপনের আসল স্মরূপ তুলে আনার জন্য। ওখানে পা রাখার পর থেকেই শুধু চারদিক থেকে শুনলাম নাই নাই আর নাই। নানা অজুহাতে অনেকেই হাজার বার টাকা চাইল আমাদের সবার কাছে। কি নিদারুন দু:খ কষ্টের মধ্য দিয়ে যে ওরা দিন কাটায় সেটা কাছ থেকে না দেখলে বোঝা যাবে না। প্রতিদিন সেই ভোর থেকে শুরু করে একাগ্র চিত্তে কাজ করে যাওয়া, একটার পর একটা যুগের সমাপ্তি ঘটে, নতুন যুগ শুরু হয়। কিন্ত বদলায় না ঐ পাড়ায় জন্ম নেয়া শিশুটার একদিন ঠিকই জন্মের জন্য নিজের ভাগ্যকে দোষারোপ করা।
ওদের কাজের স্টাইল খুবই আর্টিস্টিক। এত দারুন শিল্প নিজের চোখে দেখিনি বহুদিন। ওদের প্রায় সবাই নিজের কাজে ভালোই দক্ষ। খুব অল্প সময়ে দ্রুত গতিতে বানিয়ে ফেলছে একের পর এক দুর্দান্ত সব মাটির পাত্র। সবচেয়ে নজর কেড়েছে হুইল, যেটার নাম দিয়েছি আমি জীবনের চাকা। একদলা কাদামাটি থেকে শৈল্পিক হাতের পরশে হুইলের গতিতে গড়ে উঠছে শিল্প। বর্ণনা করে বোঝানো যাবে না। ছবিব্লগের কথা বলে বক বক করেই যাচ্ছি। তার চেয়ে আসুন বরং দেখি জীবনের চাকা।
এই সিরিজটার নাম হতে পারে হ্যান্ড অফ এন আর্টিস্ট অথবা হুইল অফ ফরটুন। পাঠকের হাতেই ছেড়ে দিলাম। এবার না হয় স্বয়ং আর্টিস্টের কিছু মুভমেন্ট দেখে ফেলি।
এত গেল আর্ট। এবার জীবন দর্শনের কথা বলি। খুব মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করেছি আমি। আমাদের সাধারন সমাজ ব্যবস্থাটা এমন যে একটা মেয়ের জীবন আর একটা ছেলের জীবনযাপনে প্রায় আকাশ পাতাল তফাৎ। কুমার পাড়ার একটা মেয়ের জীবন আমাদের সমাজের অন্য মেয়েদের চেয়েও সম্ভবত অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং। এদের শুরুটা হয় আর দশটা শিশুর মতন। পৃথিবী আলোকিত করে।
জন্ম নেয়া নতুন একটা শিশুর ভুবন ভোলানো হাসি হয়তো সেরকম আনন্দের নয় এখানে। তাই আস্তে আস্তে সে বেড়ে উঠে অযত্ন আর অবহেলায়। ঠিক মতন পৃথিবী বুঝে উঠার আগেই সে বুঝে যায় সে একটা মেয়ে। তার অনেক দায়িত্ব।
ঘর সংসার সামলানো হচ্ছে এদের কাজের বাইরের কাজ। তাই এরা অল্প বয়স থেকেই হাত লাগায় জীবকার কাজে।
এক সময় তার দেহে নারীত্ব। বিয়ে করে সংসারী হয় সে। তবে সুখী কিনা তা বলা খুব মুশকিল।
জীবন চলতে থাকে একি গতিতে। একদিকে রান্নাঘর, আরেক দিকে জীবিকা।
নারীত্বের পূর্ণতা হয়ে ঘর আলো করে আসে সন্তান। বেড়ে যায় দায়িত্ব। তবে সে সামলে নেয় আপন ক্ষমতায়। সহজাত নারীর সে ক্ষমতা। আমরা শুধু অবাক হয়ে ভাবি। কি অদ্ভুত।
একসময় এভাবেই সময় ফুরিয়ে আসে বার্ধক্য। কিন্ত জীবিকা তখনো তাদের পিছু ছাড়ে না।
এই জীবন চক্রের কি নাম দেব খুঁজে পাচ্ছি না। পারলে কেউ একটা যুতসই নাম দিয়ে সাহায্য করুন। আমরা এখানে বসে হয়তো অনেক উহ আহ করতে পারবো। চায়ের কাপে হয়তো উঠে যাবে অনেক ঝড়। এই আমি কতটা স্বার্থপরের মতন হিটের নেশায় বুঁদ হয়ে কতটা সময় দিলাম এই ব্লগ লেখার পেছনে। তিন ঘন্টার ছবি তোলা, কিংবা এসব নিয়ে সাময়িক মন খারাপ। তারপর সব ভুলে যাব। কিন্ত পাইকারি বাজারে একটা মাটির পাত্রের দাম এক পয়সাও বাড়বে না। পাইকারি ক্রেতারা পানির দরে কিনে নেবে এই শিল্প। আর তাতে সামান্য ব্লক বসিয়ে চড়া দামে বাজারে সেটা বিক্রি হবে। তাতে অনিশ্চিত ভবিষ্যত মাথায় নিয়ে জন্ম নেয়া ওই মিষ্টি আলোয় মিষ্টি হাসি মাখা শিশুটার ভবিষ্যতের কোনো পরিবর্তন হবে না। ওরা সারা জীবন নাই নাই আর টাকা টাকা চিৎকার করেই যাবে। আর হয়তো একদিন সব ছেড়ে ছুড়ে ভুলে যাবে এই শিল্প। শিল্পের কোনো মূল্য নেই যদি পেটে ক্ষুধা থাকে। আমাদের ক্ষনিকের মুগ্ধতায় ওদের পেট ভরে না। আর আমরা নিতান্তই স্বার্থপর মানুষ। নিজের তাগিদে নিজের ক্ষুধা মিটিয়েই খালাস। জীবনের চাকা , এর ব্যাসার্ধটা পরিধির সব বিন্দুতে মনে হয় সমান নয়। তাই এর গতি স্বাভাবিক নয়। বড় বেশি অস্বাভাবিক।