ট্রাকে ভ্রমনের অভিজ্ঞতার সাথে অন্য কোন বাহনের অভিজ্ঞতা তুলনীয় নয়।
পড়াশোনার উদ্দেশ্যে ঢাকায় চলে আসার পর হুট হাট করে চট্টগ্রাম চলে যেতাম। ঢাকায় মন টিকছে না কিংবা হঠাৎ মনে হল, 'যাই চিটাগাং', ব্যস সায়েদাবাদ গিয়ে গাড়িতে উঠে পরলাম। একদিন বিকেলের দিকে এমনটি মনে হওয়ায় আমি আর নেজাম চলে গেলাম সায়েদাবাদ এবং দেখলাম নাইটকোচ ছাড়া এই মুহূর্তে চট্টগ্রামগামী কোন বাস নেই। রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করার কোন মানে হয় না, ফেনীর মহিপালগামী একটা লোকাল বাসে উঠে পড়লাম। মহীপালে যখন নামলাম তখন বাজে রাত দশটা এবং সরাসরি চট্টগ্রাম যাবে এমন কোন বাস নেই। লোকাল বাসের জন্য অপেক্ষা করছি এমন সময় একটি ট্রাক 'চট্টগ্রাম-চট্টগ্রাম' বলে হাক দিচ্ছে দেখে উঠে পড়লাম। সে এক অবিস্মরনীয় অভিজ্ঞতা। মজবুত গাড়ি, কোন ভয়ডর লাগে না ভেতরে বসলে। সবচে ইন্টারেস্টিং হল ড্রাইভারের সিট। মনে হচ্ছে সেটি একটি স্প্রিং এর উপর তৈরী। ড্রাইভার একবার সামনে একবার পেছনে, একবার ডানে একবার বামে - এভাবে দুলছে। আমরাও দুলছিলাম, কিন্তু ড্রাইভারের মত নয়। সাড়ে বারোটায় জিইসি'র মোড়ে নামিয়ে দিয়েছিল সেই ট্রাক।
লাউয়াছড়ার জঙ্গল থেকে ফেরার সময় আমাদের এই একই সমস্যায় পড়তে হল। গাড়ি নেই। বৃষ্টি, দুএকটা সিএনজি অটো দেখতে পাওয়া যাচ্ছে, সেগুলো রিজার্ভ। দুএকটা গাড়িও দেখা যাচ্ছে, সেগুলোও। দাড়িয়ে আছি, মাধবকুন্ড যাবার পরিকল্পনা বাতিল করা ছাড়া উপায় নেই, কারণ শ্রীমঙ্গল থেকে ওদিকে কোন বাস বা অন্য গাড়ি যেতে দেখছি না। অপেক্ষা করছি। হঠাৎই একটা সাদা পিকআপ দেখা গেল। শ্রীমঙ্গলের দিকে যাচ্ছে। 'নিয়ে যাবেন?' 'কয়জন?' 'পাচ' - ড্রাই্ভার মাথা কাত করে হ্যা জানিয়ে দরজা খুলতে চাইল, কিন্তু আমরা পাচজনই পেছনে চড়ে বসলাম। জঙ্গলের মাঝ দিয়ে দুর্দান্ত গতিতে ছুটে যাচ্ছে গাড়ি, বৃষ্টি হচ্ছে ঝিরঝির, আমাদের গায়ের নীল পলিথিন উড়ে ছুটে পালিয়ে যেতে চাচ্ছে, বৃষ্টির ছাট প্রচন্ড গতিতে আমাদের মুখে আঘাত করছে বলে আমরা চোখ বন্ধ করে আছি কিন্তু দাতগুলো বের করে হাসতে হাসতে একহাতে গাড়ির বডি অন্য হাতে পলিথিন আকড়ে ধরে ছুটে চললাম শ্রীমঙ্গলের দিকে। বালকরা মোবাইলের ক্যামেরায় ছবি তুলতে লাগল - এই অভিজ্ঞতা মোবাইলে যদি বন্দি নাই করা যায় তবে এত দামী মোবাইল কেন?
বালকের তোলা ছবি
দুই কিলো আগে থাকতেই আমরা নেমে পড়লাম গাড়ি থেকে। চা বাগান। বাংলাদেশ চা গবেষনা ইন্সটিটিউট (বিটিআরআই)। যে সময়ে চা বাগানে এসেছি সেটা সঠিক সময় নয়। বাগানে কোন কুলি নেই, কামিন নেই। এখন চা পাতা গজাচ্ছে, পাতা তোলা হবে আরও কয়েকমাস পর থেকে। তাই বাগান একদম ফাকা। আমরা একদম ভেতরে চলে এলাম। বিটিআরআই এর অফিসের গেটে কয়েকজন ভদ্রলোক দাড়িয়ে ছিলেন। একজন এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন, 'পাতা লাগবে? এক নাম্বারটা দেবো।' এই ধরনের আহবানে আমি সবসময়ই নির্লিপ্ত। একা থাকি, এই চা পাতা নিয়ে কাউকে দেবো সে সুযোগও নেই। বালকরা তাদের পরিবারের সাথে থাকে, চিন্তা ভাবনা করছে কিনবে কি কিনবে না - এমন সময়ই দেয়ালের গায়ে সাইনবোর্ডটা চোখে পড়ল - 'এখানে চা পাতা বিক্রয় করা হয় না। চা পাতা কিনে প্রতারিত হবেন না' (একটু এদিক সেদিক হতে পারে, ছবি নেই)। এই কথার পর আর দাড়ানো চলে না। আমরা আরও ভেতরে গেলাম।
তৈরী হচ্ছে সেতু। শীতকালে এর উপর দিয়ে গাড়ি যাবে, বর্ষাকালে নিচ দিয়ে যাবে খরশ্রোতা কাদামাখা ঘোলাটে পানির ঢল
চা বাগানের ছবি না দেয়াটা ঠিক হবে কি?
চা বাগানের রাস্তায়
চা বাগানের এক দিকে থাকে বাংলোগুলো, সেখানে কর্মকর্তারা থাকেন তাদের পরিবার নিয়ে। এই বাংলোগুলোর ডিজাইন প্রায় সব জায়গায়ই একরকম। সম্ভবত বৃটিশ আমলে এইভাবে বাংলোগুলো তৈরী করা হত। এই চা বাগান আর বাংলোগুলো দেখলে মনে হয় অনেক চেনা। কারণ কি? সমরেশ মজুমদারের বই 'উত্তরাধিকার'। অনিমেষ/অনি ডুয়ার্সে এই ধরনের চা বাগানে বড় হয়েছিল, তার হিরো ছিল দাদু। কুলি কামিনদের বস্তি আর চা বাগানের বাবুদের বাংলো - ডুয়ার্স আর শ্রীমঙ্গলে বোধহয় কোন পার্থক্য নেই। কল্পনায় আকা ছবির সাথে এই ছবির বড্ড বেশী মিল। বাংলাদেশী কোন্ লেখক চা বাগান নিয়ে এত বিস্তারিত লিখেছেন?
জনপ্রতি দুই টাকা দিয়ে বাসে করে ফিরলাম শ্রীমঙ্গলে।
শ্রীমঙ্গলে হোটেলে খেতে বসে দেখা গেল গরু পাওয়া যায় না। দু:খজনক, খুবই দু:খজনক। কেন? এখানে নাকি প্রায় সিক্সটি পার্সেন্ট হিন্দু। তাই গরু তেমন চলে না। গরু পেতে হলে একটু নিম্নমানের হোটেলে যেতে হবে। বিশেষ করে সাতকড়া দিয়ে রান্না করা গরু সেইসব হোটেলের জনপ্রিয় খাবার। আমাদের খাওয়া হল না সেই সুস্বাদু (শোনা কথা) গরুর মাংস।
শ্রীমঙ্গলের বেশ পরিচিত চিড়িয়াখানার নাম হল শীতেষ বাবুর মিনি জু। তার পুরো নাম শীতেষ রঞ্জন দে। ভদ্রলোক সম্ভবত শিকারী ছিলেন। ভালুকের থাবায় তার এক চোখ নেই। চিড়িয়াখানায় ঢোকার অনুমতি ছিল না, বৃষ্টিতে কাদা হয়ে আছে। অনুরোধে খুলে দেয়া হল। নানা প্রজাতির প্রানী, প্রায় সবই ঢাকা চিড়িয়াখানায় পাওয়া যায়। যা পাওয়া যাবে না সেরকম একটা হল সোনালী বাঘ (ছবি তুলি নাই)। আরেকটার নাম ভুলে গেছি। ঢাকা চিড়িয়াখানার থেকে এখানে জানোয়ার দর্শনের অভিজ্ঞতা একটু ভিন্ন। ঢাকায় চিড়িয়াখানার খাচার বাইরে একটা বাউন্ডারি থাকে নিরাপত্তার জন্য। এখানে সেটা নেই। ফলে মনে হয় না খাচায় দেখছি। বেশ উৎফুল্ল ভঙ্গিতে ভাল্লুকটা ঘুরে বেড়াচ্ছিল বলে তার ছবি তুলতে গেলাম। হাত খাচার বাইরেই ছিল, কিন্তু ভাল্লুকটা থাবা বাড়িয়ে দিল হঠাৎ। ধক্ করে উঠেছিল কলিজা! ছবিটাও নড়ে গেল।
হাত কেপে যাওয়ায় ছবি ঝাপসা হয়ে গেল
সিলেট বলেন আর শ্রীমঙ্গল - দুই থেকে সাত রং চায়ের কথা শুনতে শুনতে মাথা নষ্ট হয়ে যাবে। কুমিল্লার সব মাতৃভান্ডারই যেমন অরিজিনাল, এখানেরও সব চা'ই অরিজিনাল। তবে শ্রীমঙ্গলে নীলকন্ঠ (ঠিক আছে তো??) বলে একটা দোকান আছে, যেটায় প্রথম এই চা বানানো হয়েছিল, সেটা রিকশাওয়ালারা বেশ ভালো চিনে। বিকেলে গেলাম সেখানে। নানান রং এর চা পাওয়া যাচ্ছে। এক রঙ এর চা আছে তিন ধরনের তার একটা আবার পানির রং এর। আমি দুধের মালাই চা'য়ের অর্ডার দিলাম। বাকীরা এক এক রকমের চা। এবং সবাই মিলে একটা সাত রং এর চা। রং হিসেবে দাম। প্রতি রং দশ টাকা। প্রায় বিশ মিনিট অপেক্ষা করার পর চা এসে গেল। খাবো কি - ছবি তুলতেই ব্যস্ত হয়ে পড়লাম সবাই।
সাত রং এর চা
আমার ছুটি ফুরোলো। বালকরা থাকবে আরও একদিন, মাধবকুন্ড যাবে, পরীকুন্ড যাবে। আমার বস ছুটি দিল না। গোলামের আবার ভ্রমণ! রাত সাড়ে বারোটার টিকিট কেটে ফেললাম। তারপর সবাই মিলে হাটতে হাটতে রাধানাথ সিনেমাহলে। সেখানে চলছে ' জীবনে তুমি মরনে তুমি '। বালকরা কখনো সিনেমাহলে এফডিসি-র বাংলা সিনেমা দেখে নি। ঢাকায় বসে দেখবে সে সাহসও নেই। সুতরাং শ্রীমঙ্গল অনেক ভালো জায়গা। আমরা রাত নয়টার শো'র দর্শক হয়ে গেলাম।
শ্রীমঙ্গল ভ্রমন শুরু করেছিলাম ভারতের সাথে বাংলাদেশ একত্রিত হয়ে গেলে কি হবে সেই কথা নিয়ে। এরকম চিন্তা সুস্থ্য মানুষের লক্ষণ নয়, হতাশাগ্রস্থ মানুষ এরকম চিন্তা করতে পারে। আমি হতাশাগ্রস্থ নই, আলোচনার স্বার্থে সকল যুক্তি প্রদর্শন করেছিলাম। ভারতের সাথে মিশে যাওয়ার চিন্তা আমাদের করতে হয় না, যদি আমরা আমাদের রিসোর্সগুলোর সঠিক ব্যবহার করতে পারতাম। রিসোর্স বলতে শুধু মাটিতে-পানিতে প্রাপ্ত প্রাকৃতিক জিনিসগুলোই শুধু নয়, এই চৌদ্দ কোটি মানুষের মাথায় যে রিসোর্স তার ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না কোনভাবেই। নিজেদেরকে উন্নত না করেই আমরা উন্নত দেশগুলোর আচরনকে লালন করা শুরু করেছি। ঘটনাপ্রবাহ স্বাভাবিক-ই। সরকারের কিছু ভূমিকাকেও অস্বীকার করা যাবে না, কিন্তু এই আমরা যদি পাল্টে ফেলতে পারি, তবে সরকার করবে কি? চাই না ভারতের অংশ হতে, আমার বাংলাদেশ নিয়েই আমি থাকবো, তবে তার আগে বাংলাদেশকে থাকার মত একটি দেশ হিসেবেও তৈরী করে নেব।
চা কেমন হয়েছিল সেটা বর্ণনা না করে এই পোস্ট শেষ করা ঠিক হবে না।
আমি: (মালাই চা) পুরানা পল্টনে ওভারব্রিজের নিচের চা এর থেকে একশগুন ভালো।
বালকেরা (সাত রং এর চা) : প্রথম কালারটা নোংরা পানি, দ্বিতীয় কালারটা ড্রেনের পানি ... (আমি আর শুনতে চাই নি)
বাস চলতে শুরু করলো। গুড বাই শ্রীমঙ্গল, গুড বাই মৌলভীবাজার। মাধবকুন্ড, পরীকুন্ড দেখার জন্য হলেও আরেকবার আসবো। সেবারও একাকী আসবো না ইনশাল্লাহ।
===========
দারাশিকো'র বঙ্গভ্রমণ
দারাশিকো'র ব্লগ
ফ্যান পেজ