ট্রেনের দরজা সামনে দাঁড়িয়ে দেখছি সামনের পার হওয়া মাঠ, ঘাট,নদী-নালা, সবুজ ক্ষেত। চলন্ত ট্রেনের শব্দের সাথে তাল মিলিয়ে যেন হচ্ছে দৃশ্যের পরিবর্তন। চোখের পাতার একটি পলকেই যেন হারিয়ে ফেলি কোনো এক গ্রাম, কোনো এক কিশোরের ছুটে চলা। হারিয়ে চলে যায় মন ট্রেনের ছুটে চলার ছন্দের স্পন্দনে, শুধু রিক্ত নয়নে তাকিয়ে রয়ে যাই বাইরের চলন্ত দৃশ্যে। চোখে ভেসে উঠে ঠিক এমনই অতীতের কিছু দৃশ্য, ট্রেনের গতির মত হয়ে উঠে সেই অতীত চলন্ত। একের পর এক ভেসে উঠে এক শুভ্র আকাশ, কোনো এক মুগ্ধ বিকেল, অথবা কোনো এক স্নিগ্ধতায় ভরপুর সন্ধ্যা। সেই চলন্ত অতীতের স্থির হয়ে পড়ে এক জোড়া নীল নয়ন।
নীলনয়না দৃষ্টিনীলে
মুগ্ধসময় অবাকবিধুর
এইতো সেদিন;
শূন্য এখন চোখের কোণে
রঙবিনাশী, তোর কি তাতে?
ভালই আছিস!
জোৎস্নাপ্রহর একাই কাটে
গল্পবিহীন, তুই কাছে নেই
থাকবি কেন?
তুই যে বিলীন আকাশতারায়
মেঘনটবর তাড়িয়ে বেড়াস
ভুলেই গেছিস!
আবার ফিরে আসি আমি, ফিরে আসি বাস্তবতা নামক এক অদৃশ্য দুঃস্বপ্নের। বসে থাকি এক পলক চেয়ে বাহিরের দিকে। হাতের ডায়রিতে লিখবার অপচেষ্টা করে যাই। লেখা বের হয়না, কলম চলতে চায় না। চোখ চেয়ে থাকে শুধুই বাহিরে, মনে করে দিতে চায় কোনো এক শব্দ। জানালার ঠান্ডা বাতাস এসে ঘোলাটে করে দেয়, নাহ চোখ নয়, ঘোলাটে করে দেয় স্মৃতি। সবকিছু বিলিন হয়ে যায়, শুধু সেই স্মৃতিতে ভেসে উঠে একটি মুখ, দু'টি হাত, প্রথম দু'হাতের স্পর্শ, রিনিঝিনি এক শব্দ! ট্রেনের এই জানালার পাশের অবস্থান যেন আমায় মনে করিয়ে দেয় বারান্দার কথা। যেখানে পাতার পর পাতা আমি লিখে চলে যাই।
বারান্দাভোর ঝুলচেয়ারে
একলাবিষাদ তোকেই ভাবি
তুই কি বুঝিস?
দৃষ্টিগহীন দূরপলাতক
তোকেই খোঁজে শূন্যব্রজে
তুই কি জানিস?
ডাইরিপাতায় তোর ছোঁয়াটা
শব্দপ্রবণ হাতের চুড়ি
রেখেই গেছিস;
হাঁটতে পথে লীনখেয়ালে
লেকের ধারে শেষ বিকেলে
আমায় খুঁজিস?
ক্লান্ত কোনো বেলায়, ক্লান্ত এই শহরে চলে আসি আমি।
আবারও আসি ক্ষণিকের এই জগতে। ছুটে চলা দেখে যাই সবার, ব্যস্ত সবাই জীবন যুদ্ধে। আমি হয়তো এই জীবন যুদ্ধের যোদ্ধা। হৃদস্পন্দন চলতে থাকে শারীরিক ভাষায়, কিন্তু সত্যিকার অর্থে কোনো স্পন্দন থাকেনা। সবার মাঝে সংগোপনে হেঁটে চলে যাই রাস্তার পাশ দিয়ে। পথশিশুর ক্লান্ত হাতে ফুল বিক্রি দেখি জ্যামে পড়া কোনো গাড়ীর নিকট। কখনও বা হয় বেচা, কখনও বা নয়। ফুল বিক্রির টাকা যখন হাতে গুঁজে রাখে, মুখের হাসিটা তাদের গোপন রাখতে পারেনা। কত অনাবিল সেই হাসি। তুমি কি জানতে, এমনই এক পথশিশুর নিকট হতে প্রথম তোমার জন্য ফুল নিয়েছিলাম। আমি সেই কফির দোকানে ছুটে চলেছিলাম, আমার হাসিটি কি তখন এই পথশিশুর চেয়ে অনাবিল ছিল? আমি হেসেছিলাম তোমায় দেখে মনের আনন্দে, কিন্তু সেই শিশুটি হেসেছিল তার একবেলা খাবার পয়সা জুটেছিল দেখে। আমার থেকেও পবিত্র ছিল তার সেই হাসিটি।
কফির ফিউম একাই দেখি
উলটো চেয়ার ফাঁকাই থাকে
জিতেই গেছিস;
আলতো দূরে হাতের ছোঁয়া
নাইবা পেলাম, কি আসে যায়!
স্নিগ্ধ থাকিস।
পথ হারিয়ে পথেই ঘুরি
পথের শিশুর মুখসরলে
তোকেই খুঁজি;
প্রশ্নচোখে হাঁটছি আজও
কোন অভিমান? কেনই গেলি?
কি ভেবেছিস?
ফুটপাতের পাশে এক শিশুর বাসি ভাত খাওয়া দেখি। মুঠো ভরে খাচ্ছে, প্রাণ জুড়িয়ে বসে দেখছে তার মা। ভাত না চিবিয়ে গোগ্রাসে গিলে যাচ্ছে, এই দৃশ্যটি কেন আমার বুকে আঘাত করলো? আমার কষ্ট অনেক সস্তা এই শিশুটির ভাতের চেয়ে। বিধাতা আরও দিক কষ্ট আমায়, অজস্র কষ্ট দিক। কিন্তু এই শিশুটি যেন আর না থাকে অভুক্ত। মানিব্যাগের সব অর্থ দিয়ে আসি তার মায়ের হাতে। তার অবাক দু'চোখ আমায় টানেনা। টানে আমার শিশুটির ভাতমাথা মুখ। সেই মুখে প্রশান্তির এক ছায়া। হয়তো এই আধাপেট খেয়েই সে শান্তি।
বৃষ্টির মাঝে কবরস্থানের জানাযা ঘরে ঠাঁই নেই। অনেকের মাঝে আছে এক মা এবং তার ছোট্ট শিশু। শিশুটির কথাগুলোর দিকে খেয়াল করি, তার হাতের দিকে তাকিয়ে থাকি। কিছু ফুল তার হাতের মুঠোয় ধরা, আরেকটি হাত মায়ের হাতে। এখানে সবাই এসেছে সবার প্রিয়জনের নিকট। যেখানে আছে শুধুই মাটির সাড়ে তিন হাতের সৌধ। শিশুটি এসেছে তার বাবার কাছে দেখা করতে, বাবার সেই মাটির সাড়ে তিন হাত ঘরে ফুল দিতে। এই দেবশিশুটির কি এমন দোষ ছিল বিধাতা? কি দোষ ছিল তার মায়ের? শিশুটির একের পর এক প্রশ্নের জবাব শুধু দিচ্ছিল অল্প কিছু কথায়। মায়ের চোখ যেন দূর কোনো এক অতীতে চলে গিয়েছিল। অন্যদিকে মন নিয়ে যাই, বৃষ্টির ঝড়ে পড়া দেখি সামনের মাটিতে। আজ ভিজেছে এই মাটির বুক, ভিজছে এই জানাযা ঘরে ঠাঁই নেয়া কিছু মানুষের মন।
খেয়ালী তুই ঝুম বরষায়
হাত বাড়িয়ে তোর জানালায়
দাঁড়িয়ে থাকিস?
অশ্রুচোঁয়া বৃষ্টিফোটায়
তোকেই দেখি;
তাই বলে কি পড়ছে মনে!
একটুও না,
ভুল ভেবেছিস।
বৃষ্টি কমে আসছে, দিন শেষের আগমনী বার্তা এসে পড়েছে।
হেঁটে যাই আমি ধীর পায়ে এক মাটির সৌধের দিকে। অনেক, অনেকদিন পর আসা এখানে। পা জোড়া অচল হয়ে পড়ছে, আর কাছে যেতে পারিনা। দূর থেকে দেখে দাঁড়িয়ে যাই, গাছে হেলান দিয়ে চেয়ে থাকি এক দৃষ্টিতে। কেউ যেন অভিমান করে আছে আমার সাথে। অপেক্ষায় ছিল যেন আমার, চেয়ে থাকি আমি সেই শূণ্য জায়গাটিতে। চুপচাপ চারিধার, চুপচাপ এই বাতাস, আকাশ সব। সূর্য বিদায়ে যেন আমরা সবাই ব্যথিত। এমন সব বিদায়েই কি আমরা বিষন্ন হই? আরও কাছে যেতে চাই, তবু পারিনা। একটু করে মনকে বোঝাই, মন শুধু টেনে ধরে। অনেক দূরে গিয়েছিলাম সব ছেড়ে, তবু এলাম ফিরে। স্মৃতিরই কাছে, অতীতের কাছে, ভালবাসার কাছে। তোমার পাশেই বসে থাকি, আলতো হাতে বুলাই জমে থাকা আগাছাতে। এখানে নেই তুমি, তাও অনেক মমতায় হাতটি রাখি মাটিতে। বৃষ্টি ভেজা মাটি আমার হাত আরও নরম করে দেয়। মন করে দেয় অশ্রুমাখা, কাঁচের টুকরোর মত ভেঙ্গে যায় সেই মন। শ্বাস হয়ে পড়ে বদ্ধ।
সুদূরদেশে হারিয়েই যেতাম
বুক পকেটের নিচেই দেখি
তোর কবিতা;
তোর কবরে ফুল ফুটেছে
একটু পাশে বসতে দিবি?
কাঁদবো আমি? তাই দিবি না?
কাঁদবো না আর, দেখিসরে তুই?
অশ্রু চোখে? ও কিছু না।
কি যে হল চোখদু'টোতে!
যখন তখন ঝাপসা হবে।
কাঁদবো কেন? তুই কে আমার?
রাখবো মনে? বয়েই গেছে!
তুই রেখেছিস?
আযান পড়ে, সাথে বেলাও পড়ে।
আমি ফিরি, চোখ চলে যায় সেই শিশুটির দিকে। ফুলের পাঁপড়ি ছিড়ে বাবার কবরে ছড়িয়ে দিতে থাকে। তার মা এক পলকে তাকিয়ে থাকে সেই অতীতের মানুষটির মাটির ঘরের দিকে। ধর্মে আছে, কবরেতে ফুল দেয়া নিষেধ। সৃষ্টিকর্তা, যদি এই ফুল দেয়া পাপ হয়ে থাকে সেই শিশুটির পাপ যেন আমার নামে লেখা হয়। এমন পাপে আমার সন্তুষ্টি, এমন পাপে আমি পরিশুদ্ধ হতে চাই।
বেলা মিলিয়ে যায়, অন্ধকারে মিলিয়ে যায় রিক্ততার সেই অশ্রুরেখা............
***************************************************
লেখাতে ব্যবহৃত কবিতাটি উপহার দিয়েছে বন্ধু ত্রাতুল
***************************************************