পৈত্রিকসূত্রেই রিয়াজ সাহেব অঢেল সম্পত্তির মালিক। দেশের শীর্ষ ধনীদের মাঝে একজন এই ৪৫ বছর বয়সী রিয়াজ।
বিভিন্ন দিকেই তার ব্যবসা-বানিজ্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। গত দু'বছর হলো বিদেশী এক কোম্পানীর সাথে যৌথভাবে দেশে মোবাইল কোম্পানী খুলেছেন। প্রথম প্রথম বেশ লোকসানের মুখ দেখলেও এখন দেশের অন্য ৩টি মোবাইল কোম্পানীর সাথে বেশ আজ টেক্কা দিয়েই চলেছেন। রিয়াজের ব্যবসায়ী কৌশল, ক্ষমতার চাতুর্যতায় তার কোম্পানী আজ দেশের শীর্ষ ৫ ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানের মাঝে একটি। অন্যসব ব্যবসাতে কেন যেন ইদানিং আর আগের মত মন বসছেনা রিয়াজ সাহেবের। মোবাইল ব্যবসাতে এত মজা এটা তিনি আগে বুঝতে পারেননি। প্রথম বেশ খরচ হলেও এখন হু হু করে টাকা আসছে। যদিও একটা বড় অংশ দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে, তবু যা দেশে থাকছে সেটাও অতুলনীয়। ৩-৪ জন সংসদ সদস্য তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু হবার সুবাদে আয়করের ব্যাপার-স্যাপার, বা অবৈধভাবে বৈদেশিক কল করবার সুবিধা পেতে রিয়াজ সাহেবের কোনো সমস্যা হয় না। শুধু লাভই লাভ। কেন যে আরও আগে এই ব্যবসাতে আসেননি মাঝে মাঝে ভাবলে তার বেশ আফসোস হয়।
ক'দিন আগে কিছু পত্রিকা বেশ সরগরম করে দিয়েছিল তার কোম্পানীর নামে। শীর্ষ এক পত্রিকার সহকারি সম্পাদককে ডেকে দ্বি-পাক্ষিক চুক্তি(!) অনুসারে ব্যাপারটার সুরাহা করে ফেলে রিয়াজ। তাদের কোম্পানীর বেশিরভাগ বিজ্ঞাপন এখন থেকে সেই পত্রিকাতেই যাবে, আর বিনিময়ে পাবলিকের মাথায় এই মোবাইল কোম্পানীর সব সুযোগ-সুবিধা মাথায় ঢুকাতে হবে। এখন তো নতুন এক ব্যবসার দুয়ার হচ্ছে এসএমএস। সেই সুযোগটাকে পুঁজি করেই এগিয়ে চলেছেন রিয়াজ সাহেব। এখন কোথায় নেই এসএমএস? সকাল বেলার গান শোনা থেকে শুরু করে রাতের ঘুম পাড়াবার গানটাও এসএমএসের মাধ্যমে পেয়ে যাচ্ছে দেশের মানুষগুলো। নিত্যদিনের সর্বক্ষেত্রে ছড়িয়ে আছে এই এসএমএস। এটাকে আরও ছড়িয়ে দিতে হবে, ভাবেন রিয়াজ সাহেব।
সেদিনই বিখ্যাত এক স্কুলের শিক্ষক প্রচন্ড অসুস্থ হয়ে পড়েন। চিকিৎসার জন্য ৩ লাখ টাকা দরকার। রিয়াজ সাহেবের সেই ঘনিষ্ঠ পত্রিকা ছাপিয়ে দিল এক জ্বালাময়ী রিপোর্ট আর সাথে সেই শিক্ষককে সাহায্য করবার পদ্ধতি। 'অমুক নাম্বারে' “HELP”লিখে পাঠিয়ে দিন, প্রতি এসএমএসের জন্য ৫ টাকা চার্জ প্রযোজ্য। শুধুমাত্র রিয়াজ সাহেবের কোম্পানীতে এই এসএমএস পাঠানো যাবে বিধায় যারাই পত্রিকা পড়েছে তারাই অকাতরে এসএমএস পাঠানো শুরু করলো। এত বেশি টাকা জমা হবে সেটা রিয়াজ সাহেব ভাবতেও পারেননি। বুঝে গেলেন ব্যবসার (!) পলিসি। এরপর থেকে কোনো অসুস্থ কারও পাশে রিয়াজ সাহেবের কোম্পানী তড়িৎ ছুটে যান সাহায্যের (!) জন্য। পত্রিকায় বড় বড় ছবির সাথে রিপোর্ট থাকে যে, আজ এই কোম্পানী না থাকলে দেশ কোথায় যে যেত। এসএমএস বাণিজ্যের একটা অংশ পেয়ে সেই পত্রিকাটিও যেন হয়ে উঠে রিয়াজ সাহেবের ডানহাত। সাথে আরও জুটে যায় টিভি চ্যানেল, কিছু ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ফার্ম। রিয়াজের টাকার মধুর লোভে তার হয়ে লিখতে শুরু করে দেয় বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীরা (!)। তাদের কলমে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠে রিয়াজের 'বি-টেল'। নিজের কোম্পানীর নাম 'বি-টেল' রেখেছে সে, মানে 'বকবক টেলিকম'। দেশের মানুষের মোবাইলে এত কথা বলা দেখেই তার এই অনুপ্রেরণা।
টিভি'র রিয়েলিটি শো গুলোতে তো টিকেই আছে এই বিভিন্ন কোম্পানীর এসএমএসের মাধ্যমে। একটি চ্যানেলের ছোট শিশুদের রিয়েলিটি শো'র সহকারী প্রতিষ্ঠান এবং একমাত্র বিজ্ঞাপনদাতা হলো বি-টেল। টিভিতে ৩০ মিনিটের সেই শো-তে গান চলে ১০ মিনিট, ১০ মিনিট বিজ্ঞাপন এবং বাকি ১০ মিনিট হচ্ছে উপস্থাপিকা দিয়ে বিভিন্ন প্রতিযোগীকে ভোট দেবার এসএমএস বিজ্ঞাপন। প্রতিদিনই হাজারে হাজারে এসএমএম আসছে, আর রিয়াজ সাহেবের মুখের হাসি আরও বড় হচ্ছে। কোনো কোনো প্রতিযোগী যদি অনেক কষ্ট করে আসে, তাহলে তো চ্যানেলের সাথে সাথে রিয়াজ সাহেবেরও মহা সৌভাগ্য। চ্যানেলের বাড়ে টিআরপি আর বি-টেলের এসএমএস। এক প্রতিযোগী ঠিকমত খেতে পারতো না দেখে তো টিভিতে বিজ্ঞাপনই দেয়া হলো যে, “ছোট্ট এই শিশুটিকে যদি দু'বেলা ভাত খেতে দেখতে চান, তাহলে আপনার বি-টেল নাম্বার দিয়ে এসএমএস করে দিন এই নাম্বারে” । ব্যস, আর কি লাগে? জনগণের আবেগকে পুঁজি করে ব্যবসা করবার মত আর কিছুতে কি আছে?
হঠাৎ খুব অসুস্থ হয়ে গেলেন রিয়াজ সাহেব। ডাক্তার শুধু বিশ্রামে থাকতে বললেন ক'দিন। তাই রিয়াজ সাহেব ক'দিন শুয়ে বসেই কাটাচ্ছেন। ছোট সংসার তার, বৃদ্ধ মা, স্ত্রী আর সদ্য কৈশরে পা দেয়া স্কুল পড়ুয়া কন্যা। সব মিলিয়ে সুখি মানুষই বলা চলে তাকে। এমনই এক দুপুরে হঠাৎ তার মোবাইলে ফোন এলো।
- বাবা? মেয়ের কন্ঠ শুনতে পেলো রিয়াজ সাহেব।
- হ্যারে মা।
- বাবা, আজ না টিফিনের সময় স্কুলের সামনের আমি ফাস্টফুডের দোকানে যাচ্ছিলাম, তখন তিনটা বখাটে ছেলে না আমার আর আমার বান্ধবীকে টিজিং করছিল। এত খারাপ লাগছে বাবা, তাই এসেই তোমাকে জানালাম। ছেলেগুলো আগেও না এমন করেছিল অনেকের সাথে কিন্তু কেউ কিছু বলেনা।
- এত্ত বড় সাহস! টিচারকে জানিয়েছো? রিয়াজ সাহেব বেশ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন।
- না বাবা, তুমি কিছু করো বাবা, তোমার তো অনেক ক্ষমতা।
- কোনো চিন্তা করিস না মা। ক্লাশ শেষ হলে তুই বাসায় চলে আসিস। আমি দেখছি যা করার। একদম মন খারাপ করবিনা।
রিয়াজ সাহেব সাথে সাথে তার পুলিশ কমিশনার বন্ধুকে ফোন দেয়, কিন্তু কোনো সারা শব্দ নেই। সাথে সাথে ফোন ডিরেক্টরী বের করে মেয়ের স্কুলের এলাকার পুলিশ থানাতে ফোন দিতেই সেখান থেকে জানানো হলো এসএমএসের মাধ্যমে সমস্যা জানাতে। নতুন আইন করা হয়েছে এটা, অন্য কোনো উপায় নেই। বিরক্তির সাথে এসএমএস নাম্বার নিয়ে সেখানে এসএমএস করতেই ফিরতি এসএমএসে জানানো হল, “আপনার আবেদনটি যথাযথভাবে গৃহীত হয়েছে, এবার এটির প্রক্রিয়া পুরোপুরি করতে চাইলে হ্যা লিখে এই নাম্বারে দিন, আর না করতে চাইলে না লিখুন।” রাগে মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে রিয়াজ সাহেবের। এটা কোন ধরনের পদ্ধতি হলো? কোন আহাম্মক এই আইন তৈরী করলো? বিকেলে মেয়ে বাসায় আসবার পর বেশ শান্তি অনুভব করলেন অসুস্থ রিয়াজ সাহেব।
মনে পরে গেল কিছু দিন আগের কথা, যখন কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী একত্রে তার কাছে এসেছিলেন ইভটিজিং-এর ক্যাম্পেইনের জন্য অল্পকিছু ডোনেটের জন্য। কিন্তু তিনি সেটা বুঝিয়ে দিয়েছেন এভাবে যে, তাদের কর্মকান্ডে উনি খুশিমনে সাহায্য করতে চান কিন্তু তার বৈদেশিক পার্টনার হয়তো এর জন্য জবাবদিহি করবে। এরকম খোঁড়া যুক্তি দিয়ে উনি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। ধুর! আজ এগুলো কেন ভাবছেন উনি?
বৃদ্ধ মা দেশের সব থেকে দামী হাসপাতালে শুয়ে আছেন।
রিয়াজ সাহেবের সেক্রেটারী জানালো কোনো ডাক্তারই অপারেশনের জন্য রাজি নয়। কারণটা কি? কারণ হলো হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ২০ লক্ষ এসএমএস চান জনগণের কাছ থেকে তার মায়ের অপারেশনের জন্য। এর কম হলে তারা অপারেশন করতে পারবেনা, এটা তাদের মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি। রিয়াজ সাহেব হুংকার দিয়ে উঠলেন, জানালেন তার মা'কে দেশের বাইরে নিয়ে চিকিৎসা করাবেন। সেক্রেটারী জানালেন সেটাও সম্ভব নয়, তার মতো ভিআইপিকে এবং তার পরিবারের কাউকে দেশের বাইরে যাওয়া এখন আর সহজ নয়। যেই দেশেই যেতে চাইবে সেই দেশের সরকারের কাছে কয়েক লক্ষ এসএমএস জমা করে তারপর আবেদন করতে হবে। সেক্রেটারী জানতে চাইলো সে পত্রিকা বা টিভি বিজ্ঞাপন দিবে কিনা এসএমএস ভিক্ষা চেয়ে। রিয়াজ সাহেব চিৎকার করে উঠলেন। এসব কি হচ্ছে, কেন এই ধরনের নিয়ম-নীতি করা হচ্ছে? সাধারনভাবে কি কিছু করা সম্ভব নয়?
টিভিতে বিজ্ঞাপন চলছে, আর রিয়াজ সাহেব ক্লান্ত নয়নে দেখছেন। সুন্দর এক মডেল বেশ অত্যাধুনিক উচ্চারনে বলে চলেছেন, “প্রিয় দর্শকবৃন্দ, রিয়াজ সাহেবের মায়ের চিকিৎসার জন্য বাঁচাও মা লিখে এসএমএস করুন এই নাম্বারে, মনে রাখবেন, সর্বোচ্চ এসএমএস যিনি পাঠাবেন তিনি পাবেন ….......”
হঠাৎ জেগে উঠলেন রিয়াজ সাহেব।
শরীর দিয়ে ঘাম ছুটছে তার। বিছানার পাশের টেবিলে রাখা গ্লাসের পানিটুকু শেষ করলেন এক ঢোকে। এতক্ষন স্বপ্ন দেখছিলেন তিনি। যাক, বাঁচা গেলো। বেশ শান্তি লাগছে এখন, কি সব আজেবাজে জিনিস যে দেখছিলেন। মুখ ধুয়ে বারান্দায় দাঁড়ালেন। কাল আবার এক সুন্দরী প্রতিযোগীতার বিচারক হিসেবে তার উপস্থিত থাকতে হবে পাঁচতারা হোটেলে। তাই বেশিক্ষন জেগে থাকা চলবে না আবার। হঠাৎ একটি এসএমএস আসে মোবাইলে, টেবিল হতে নিতেই দেখে তার সেক্রেটারীর এসএমএস। শহরের বাইরে সন্ধ্যায় নাকি এক বাস দূর্ঘটনায় ২০ কি ২৫ কিশোর মারা গিয়েছে। আগামীকাল সেখানে উপস্থিত হয়ে কিছু শোক বাণী দিয়ে তাদের মা-বাবাকে অল্প কিছু টাকা ধরিয়ে দিলেই ভাল একটা খবর নাকি হবে। যাবার কোনো ইচ্ছেই নেই রিয়াজ সাহেবের। সুন্দরী প্রতিযোগীতা এবং প্রতিযোগীদের জন্য ভোটের এসএমএস তাকে টাকা এনে দেয়, মৃত কোথাকার কোন কিশোর বাচ্চারা সেটা আনবেনা।
ওহ না! বাচ্চাগুলোর মা-বাবাকে সাহায্যের জন্য তো এসএমএস চাওয়া যেতে পারে জনগণের কাছ থেকে। এই সুযোগটা ছাড়া উচিত হবে না। ঘুমাবার আগে সেক্রেটারীকে ফোন দিয়ে জানাতে হবে ব্যাপারটা, রিয়াজ সাহেবের বিবেক সেটাই চিন্তা করলো।
[ কাল্পনিক গল্প ]
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জুলাই, ২০১১ ভোর ৬:১৬