
অনেক অনেক দূর এক দেশে বাস করে এক মেয়ে। নাম তার নায়লা মালিচ।তার দেশটির নাম বসনিয়া।এক সময় যেখানে ছিল যুদ্ধ। যুদ্ধ শেষ হয়েছে অনেক আগেই। আজ আমরা যুদ্ধ নয়, নায়লার গল্পই শুনবো।
ছোট থাকতেই নায়লা খুব চুপচাপ শান্তশিষ্ট মেয়ে। তার মা-বাবা তার ছোটবেলায় ভাবতো তার বুঝি কোনো মানসিক সমস্যা আছে। কিন্তু আস্তে আস্তে বুঝতে পারে তাদের মেয়ে আসলেই অনেক শান্ত। তার কোনো কিছুর চাহিদা নেই, কোনো বায়না নেই। সর্বক্ষণ কাটে শুধু গাছ-গাছালি আর বাড়ির পাশের ছোটো টিলাগুলোতে হেঁটে বেড়িয়ে।এভাবেই বড় হয়েছে সে। নায়লার ছোট দু'টো বোন আছে। ষোড়শী বোনটার নাম আয়লা আর ছোট অষ্টমবর্ষী বোনটার আমিনা। মা,বাবা, দু'বোনকে নিয়েই নায়লার জীবন।
নায়লা মেক্যানিক্যাল ইন্জ্ঞিনিয়ারিং-এ পড়াশুনা করে। কিন্তু তার এটা ভাল লাগে না। তার ভাল লাগে ছবি আঁকতে। ক্যামেরা নিয়ে ফুল, পাখি আর প্রকৃতির ছবি তুলতে। সারাক্ষণ তার ব্যাগে থাকে একটি ছোট্ট ক্যামেরা। বাস দিয়ে ক্লাসে যাচ্ছে, জানালা দিয়ে কিছু সুন্দর দৃশ্য পড়লেই ছবি তোলা চাই তার।
ইদানিং যে নায়লার কি হয়েছে তা সে ঠিক বুঝতে পারছে না। মনে ভেতর কি যেনো একটা কাজ করছে তার। মনটা অস্থির হয়ে আছে ক'দিন ধরে। এমন আগে কখনও হয়নি। এটা শুরু হল মাহতাব নামের একটি ছেলের সাথে পরিচিত হয়ে। তার এক কাজিনের সাথে মাহতাব পড়াশুনা করতো। মাহতাব অনেক দূরদেশে থাকে।
পড়াশুনার জন্য জার্মানী এসেছিল মাহতাব। নায়লার পুরো পরিবার
বেড়াতে যায় জার্মানীতে। তখনই মাহতাবের সাথে পরিচয় নায়লার। ওর থেকে বছর পাঁচেক বড় হবে মাহতাব। কি রকম যেনো অনুভুতিহীন লাগলো তার মাহতাবকে। কিন্তু তার মনে মাহতাবের ছবিটা যেনো গেঁথে গেল। কিন্তু মাত্র তো দু'বার দেখা তাদের দু'জনের। তাও এমন কেনো লাগছে।
মাহতাব তার নিজ দেশে চলে গেছে কয়েক মাস হলো। মাঝে মাঝে নায়লা ফোন দেয় মাহতাবকে। ছেলেটা কখনই দু'মিনিটের উপর কথা বলে না। মনে হয় কোনো কিছুর উপরই ছেলেটার আগ্রহ নেই। অনলাইনে মাঝে মাঝে কথা বলতে চাইলেও কেমন যেন এড়িয়ে যায়। সে জানে মাহতাবের কারও সাথে কোনো প্রেম নেই। কিন্তু এখানে প্রেমের কথা আসছে কেনো? সেকি তাহলে মাহতাবকে ভালবেসে ফেলেছে? এটা কিভাবে হয়? তাদের দু'জনের মাঝে তো বিস্তর ব্যবধান, ভিন্ন দেশ, ভিন্ন ভাষা।
কিন্তু ভালবাসা কি ব্যবধান মানে?
ক্লাশের সবাই নায়লাকে খুব পছন্দ করে। এমন শান্ত মেয়ে খুব একটা দেখা যায় না। টিচাররাও ওকে অনেক পছন্দ করে। সেদিনও সে ক্লাশে কখন যে আনমনা হয়ে গেল, খাতায় শুধু গোলক আঁকছিল আর মাহতাবের কথা ভাবছিল।টিচার তাকে ডাক দেয়াতে ফিরে এসেছিল জগতে। নয়ত সে হারিয়ে গিয়েছিল মনের না বলা কোঠরে।
ছুটির দিনে খুব সকালে বের হয় আমিনাকে নিয়ে জমি থেকে ষ্ট্রব্যেরী তোলার জন্য। মাথা একটা কালো স্কার্ফ জড়িয়ে নেয়। আমিনা বলে তাকে নাকি ঠিক গল্পের বইয়ের রাজকুমারীর মত লাগছে। মনটা এমনিতেই ভাল, তার উপর আমিনার এমন কথায় খিলখিল করে হেসে উঠে। পাশের জমিতে কাজ করা বুড়ো লোকটা দেখে কি সুন্দর ফুলের মত একটা বাচ্চা মেয়ে আর একটি বড় মেয়ে হাসছে আর জমি থেকে ফল তুলেছে। বাতাসে হঠাৎ আমিনার মাথার হ্যাটটা উড়ে গেলে আমিনা তার পিছুপিছু দৌঁড় লাগায় আর তার পিছু নায়লা। ফুরফুরে লাগছে আজ তার অনেক। ইচ্ছে হচ্ছে পাখির মত উড়ে বেড়ায়। কারণ, কাল রাতে যে তার মাহতাব তাকে নিজের ইচ্ছেতে ফোন দিয়েছিল। ইচ্ছে হচ্ছিল কতকিছু বলার , কিন্তু খুশির আবেগে পারেনি কিছু বলতে। গলার স্বর বলতে চেয়েছিল ,ভালবাসি তোমায়। কিন্তু স্বর তার হয়েছিল পরাধীন হয়ে। মনটা জমাট বেঁধে গিয়েছিল প্রিয় মানুষের ফোন পেয়ে।
এত এত ভালবাসে সে মাহতাবকে, কিন্তু কেন জানি বলতে পারছেনা তাকে। ভয় হয়, যদি ফিরিয়ে দেয়। কখনও ভাবেনি সে এভাবে কাউকে ভালবাসবে। কত যোজন যোজন দূরে দু'জন। পথে আসতে আসতে মাঝে মাঝে গাছ গাছালীর ছবি তুলে সে। সব পাঠিয়ে দেয় মেইলে মাহতাবকে। তার ফটোগ্র্যাফী অনেক পছন্দ মাহতাবের। কখনও পাঠায় ঝরে পরা পাতার ছবি। কখনও বা ফুলের পাঁপড়ির। সেদিনও হেঁটে বাড়ি আসছিল। মাঠের মাঝে একটি প্রজাপতি মরে পড়ে ছিল। প্রজাপতিটা এত সুন্দর কিন্তু সেটা মৃত। এটা ভেবেই মনটা খারাপ হয়। হাতে নিয়ে তুলে ফেলে একটি ছবি। পরে দেখায় তার ভালবাসার মানুষকে।
খুব পছন্দ করে ছবিটা মাহতাব। মনটা ভাল হয় নায়লার। ছেলেটাকে খুব দেখতে ইচ্ছে হয় তার, খুব খুব। আসতে বলে তার দেশে। মাহতাব আশ্বাস দেয় দু' বা এক বছরের ভেতর সময় পেলেই আসবে নায়লাকে দেখতে। মনটা ব্যথায় ভরে উঠে তার। কি এমন কাজ? সে কি এখনও বোঝেনা যে নায়লা তাকে কত ভালবাসে? নাকি বুঝেও না বোঝার ভান করে? তার ভালবাসার কি কোনো মূল্যই নেই।

বারান্দায় যেয়ে ঠান্ডা বাতাসের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকে সন্ধ্যাবেলায়। চোখ থেকে অশ্রু নামতে চাইছে কিন্তু তার চোখের দু'পাতা বন্ধ করে অশ্রুকে বাঁধা দেবার জন্য। বাঁয়ের চোখটা দিয়ে একটা ফোঁটা বেয়ে বেয়ে চোখের পাঁপড়ির শেষ প্রান্তে এসে ক'সেকেন্ড ঝুলে থাকে। নায়লা চোখ বুঁজেও তা অনুভব করতে পারে। টপ করে ফোঁটাটি তার বাম গালে পড়ে।
ছোট একটি অশ্রুর ফোঁটা, কিন্ত মনে হয় তা যেন তার সর্বাঙ্গে কষ্টের আবেশ বুলিয়ে দেয়। মনটা মনের অজান্তেই ফুঁপিয়ে উঠে।
একটি চিঠি পাঠায় মাহতাবকে। জানে না কবে যাবে সেটা তার কাছে। ডিএইচএলে পাঠাতে চেয়েছিল কিন্তু অনেক খরচ এতে। বাবার কাছে চাইলে হয়ত দিত কিন্তু সে চায়নি সেটা। সারা চিঠি জুড়ে আছে শুধু তার ভালবাসার কথা। তার মনে না বলা অনেক অভিব্যক্তি নিয়ে লেখা সেই চিঠি।
এরপরও অনেকদিন কেটে গেল। মাঝে মাঝে মাহতাবের সাথে অনলাইনে কথা হয়।বুঝতে পেরেছে সে যে মাহতাবের ভেতর কোনো একটা কষ্ট কাজ করছে।কিন্তু কি সেটা তা আজো রহস্যই রয়ে গেছে।সেটা নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করলেও এড়িয়ে যায় মাহতাব।রোজ অপেক্ষায় থাকে কখন আসবে মাহতাব অনলাইনে।একদিন কথা না বললেই তার মনটা উদাশ হয়ে পড়ে। মনটা অস্থির হয়ে পড়ে ভেবে যে, তার মাহতাব ভাল আছ তো? কিন্তু বলতে পারে না সে যে পেয়েছে কি তার চিঠি।
বাড়ির পাশের টিলার মাঝে একটি বড় গাছ আছে। মাঝে মাঝে সে বসে থাকে সেখানে। আজো বসে আছে নায়লা সেখানে। মনটা আজ কেমন জানি করছে।মনে হচ্ছে সে রূপকথার কোনো এক রাজকন্যা যে কি না অপেক্ষায় আছে কখন তার রাজপুত্র এসে তাকে এই বন্দিদশা থেকে মুক্ত করে সাথে নিয়ে যাবে। মনটা ছিঁড়ে আসতে চাইছে যেনো।এমন কেনো ছেলেটা?কেনো এখনও সে বুঝতে পারে না নায়লার মন? শুধু কি সে দূরে থাকে বলেই? ভালবাসার কি কোনো সীমানা আছে? কান্না থামাতে পারছেনা আর। দু'হাত দিয়ে মুখটা ঢেকে কেঁদে উঠল পরীর মত ফুটফুটে মেয়েটা।
আর ফিসফিস করে বলছে "ভলিম তে মাহতাব, ভলিম তে" (ভালবাসি তোমাকে মাহতাব,ভালবাসি)।
আর মাহতাব কি তাকে ভালবাসে না? হয়ত ভালবাসে, হয়ত না। মনে হয় তার জীবনে সে কাউকে জড়াতে চায় না।
কিন্তু মাঝে মাঝে মনটা তারও কেমন যেন করে মেয়েটির জন্য।
কেউই তারা জানে না কি আছে ভবিষ্যতে। জানে না কি আছে লিখন তাদের ললাটে।
আসলেই কি ভালবাসার কোনো সীমারেখা আছে?
[ শুধুই গল্প। গল্প লেখার সফলভাবে ব্যর্থ প্রয়াস।]
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে জানুয়ারি, ২০১১ রাত ৮:৪৫