আপনার মনে এই প্রশ্নটি অবশ্যয় এসেছে যে, যেখানে একদিকে স্যামসাং, অ্যাপেল, এইচটিসি ইত্যাদি কোম্পানির ফোন গুলোর দাম দিন দিন বেড়েই চলেছে সেখানে অন্য দিকে Chinese Phone নির্ভর কোম্পানি গুলো যেমনঃ সিম্ফনি, ওয়াল্টন, ওয়ান+ ইত্যাদি একই ফিচার সমৃদ্ধ ফোন অর্ধেক বা তার চেয়ে কম দামে পাওয়া যাচ্ছে। তো আপনার মনে সন্দেহ আসতেই পারে যে, এ Chinese Phone হ্যাই কেয়া চীজ? Chinese Phone গুলো এত সস্তা কেনো হয়? এটা কেনা কি মোটেও ঠিক হবে? এর যন্ত্রপাতি কি আসল হবে না নকল? আমার মনে হয় আপনার মনে এই ধরনের হাজারটা প্রশ্ন টিং টিং করে নোটিফিকেশন দেয়। যাই হোক এখনই আপনার মন এর নোটিফিকেশন বার ওপেন করুন আর সব রিমুভ করে দিন। কেনোনা এই টিউনটি পড়ার পরে আর কোনো সন্দেহ থাকবে না।
বন্ধুরা দেখুন যেসব বড় কোম্পানি গুলো আছে যেমনঃ স্যামসাং, অ্যাপেল, এইচটিসি, এল জি ইত্যাদি এবং যেসব ছোট কোম্পানি গুলো আছে যেমনঃ সিম্ফনি, ওয়াল্টন, ওয়ান+ ইত্যাদি এদের ভেতর মোট ৪ টি প্রধান বিষয়ের পার্থক্য আছে। সেগুলো হলোঃ
১/গবেষণা এবং উন্নয়ন (Research & Development)
২/বাজারকরণ (Marketing)
৩/আয়তন (Size)
৪/কৌশল (Strategy)
গবেষণা এবং উন্নয়ন (Research & Development)
তো চলুন সর্ব প্রথম কথা বলি গবেষণা এবং উন্নয়ন বা Research & Development নিয়ে। দেখুন স্যামসাং, অ্যাপেল, এইচটিসি, এল জি ইত্যাদি কোম্পানি গুলো গবেষণা এবং উন্নয়ন ক্ষাতে প্রতি বছর কোটি কোটি ডলার খরচ করে থাকে। তারা নতুন প্রযুক্তি উদ্ভবন করতে চায় এবং উন্নয়ন করতে চায়। এবং এর জন্য কোটি কোটি ডলার খরচ করে থাকে। আপনি হয়তো ইন্টারনেট এ দেখে থাকবেন যে আইফোন তৈরি করতে মাত্র ৳২০,০০০্ খরচ হয়েছে অথবা স্যামসাং এস ৬ তৈরি করতে ৳১৫,০০০ খরচ হয়েছে। আসলে বিষয় গুলো সত্য। কিন্তু সেই খরচ কিন্তু শুধু যন্ত্রপাতির। এখন ঐ ফোনটি বানাতে গিয়ে সেই কোম্পানিটি কত গবেষণা করেছে বা বছর ধরে কতো কষ্ট করেছে সে বিষয়টি কিন্তু আপনি ভেবে দেখেন না। তো গবেষণা ও উন্নয়ন বা Research & Development এর উপর বড় বড় কোম্পানি গুলো যে পরিমান খরচ করে ছোট কোম্পানি গুলো সে খরচ কখনই করে না। বলতে গেলে Chinese Phone নির্ভর কোম্পানি গুলোর গবেষণা ও উন্নয়ন এর পেছনের খরচ না এর বরাবর।
দেখুন স্যামসাং বা অ্যাপেল সব সময় নতুন প্রযুক্তি সমন্বিত ফোন তৈরি করার চেষ্টা করে। তারা ডিসপ্লে এর উপর খরচ করে, সফটওয়্যার এর উপর খরচ করে, প্রসেসর এর উপর খরচ করে। আসলে এই খরচ গুলো লুকায়িত থাকে। তাই একজন সাধারন ব্যবহারকারির কাছে মনে হতে পারে যে কোম্পানি বড় হওয়ার জন্য বেশি দামে ফোন বিক্রি করছে, অথবা তারা বেশি মুনাফা কামানোর চেষ্টা করছে।
অন্য দিকে ভেবে দেখুন Chinese Phone নির্ভর কোম্পানি গুলোর গবেষণা ও উন্নয়ন বলে কিছুই করে না। তারা শুধু বাজার এর প্রাপ্ত যন্ত্রপাতি কেনে নিয়ে যায়, তারপর নিজের ডিজাইন এ বসিয়ে বাজারকরন করে। তাদের শুধু ডিজাইন নিজের হয়, কখনও কখনও আবার তাও হয় না নিজের। এখন আপনি নিজেই চিন্তা করুন, Chinese Phone গুলো কেনো এত সস্তা হয়?
বাজারকরণ (Marketing)
এখন চলুন কথা বলি বাজারকরণ বা Marketing নিয়ে। আপনি অবশ্যয় খেয়াল করে থাকবেন যে বড় কোম্পানি গুলো তাদের ফোন বাজারে ছাড়ার পর তারা কি পরিমানে বাজারকরণ বা Marketing করে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক টিভি চ্যানেল, আন্তর্জাতিক পত্র পত্রিকা, ইন্টারনেট ইত্যাদিতে বিজ্ঞাপন এ ভরিয়ে দেয় তারা। কিন্তু Chinese Phone নির্ভর কোম্পানি গুলো এই বিষয়টি কখনই করে না। তাদের বিজ্ঞাপন আপনি কখনই আন্তর্জাতিক ভাবে দেখতে পাবেন না। তারা খুব বেশি হলে তাদের নিজের ওয়েবসাইট কিংবা স্থানীয় পত্র পত্রিকাই বিজ্ঞাপন দিয়ে থাকে।
বড় কোম্পানি গুলো যেমনঃ স্যামসাং বা অ্যাপেল বাজারকরণ এর জন্য যে পরিমান খরচ করে থাকে তা প্রায় তাদের ফোন তৈরি করার দাম এর প্রায় ২০%-৩০% এর সমান হয়ে থাকে। যেখানে Chinese Phone নির্ভর কোম্পানি গুলো সেই খরচ দিয়ে তাদের ফোন তৈরি করে থাকে।
আকার ও আয়তন (Size)
দেখুন Marketing এর পরে যে বিষয়টি তৃতীয় নাম্বার এ আসে তা হলো সাইজ। যদি অ্যাপেল এর কথা বলি তবে এর যে প্রধান কর্মকর্তা তার নাম হলো টিম কুক। এখন অ্যাপেল টিম কুক এর পেছনে এক বছরে যতো টাকা খরচ করে থাকে, তা সিম্ফনি বা ওয়াল্টন এর মতো কোম্পানি গুলোর বাৎসরিক লেনদেন এর সমান। অ্যাপেল বা স্যামসাং, এই কোম্পানি গুলো এত বৃহৎ আকারের যে এদের সারা দুনিয়াতে অফিস আছে। এবং প্রচুর কর্মকর্তাগন তাদের সাথে কাজ করেন। তার ফলে এই সকল বৃহৎ কোম্পানি সমূহর প্রচুর খরচ হয়ে থাকে।
Chinese Phone নির্ভর কোম্পানি গুলোর লেনদেন এতো বৃহৎ আকারে হয়ে থাকে না। তাছাড়া তাদের অনেক বড় বড় অফিস বা কারখানা ও থাকে না। সেখানে তারা তাদের ফোন গুলোকে অনেক সস্তা দাম এ বিক্রি করতে পারে। যেখানে অ্যাপেল বা স্যামসাং যদি সস্তা দাম এ বিক্রি করতে চায়, তবে মুনাফা তো অনেক পরের কথা তাদের অফিস ই চলবে না হয়তো ঠিক মতো।
কৌশল (Strategy)
চতুর্থ এবং শেষ বিষয়টি হলো কৌশল বা Strategy। দেখুন অ্যাপেল এর কথা বলুন কিংবা স্যামসাং, এরা একদম প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি। আজ যদি অ্যাপেল বা স্যামসাং তাদের ফোন এর দাম ৩ গুন ও বাড়িয়ে দেয় তবে তাতে কিচ্ছু যায় আসবে না। মানুষ তাদের ফোন কিনবে এবং ব্যবহার করবে। কেনোনা তারা মানুষের ভরসা জিতে নিয়েছে। অন্য দিকে যদি চাইনিজ ফোন কোম্পানির কথা বলি, তবে তারা হয়তো বাজারে একেবারেই নতুন বা তারা চাচ্ছেন যে তাদের ফোন মানুষ ব্যবহার করে দেখুক। বা তারা বাজারে তাদের এক ভিন্ন পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্য সস্তা দামে ফোন বিক্রি করে থাকে।
এখন মনে করুন লাভা কিংবা সিম্ফনি যদি ৫০ হাজার বা ৬০ হাজার টাকার ফোন তৈরি করে বিক্রি করতে চায় তবে আপনি কি তা কিনবেন? কেনার আগে প্রথমেই বলবেন, “হুমহ…… ৫০ হাজার টাকা দিয়ে খেয়ে কাজ নেই সিম্ফনি কিনবো, স্যামসাং মরে গেছে নাকি?” আচ্ছা মেনে নিলাম যে সিম্ফনি আমাদের দেশে অনেক বছর ধরে আছে, অনেক সার্ভিস সেন্টার আছে তাদের। তারপর ও ভাববেন, ফোনটা ভালো হবে তো? ধুর, স্যামসাং নিলেই বুঝি ভালো করবো। তো আপনার এই সব মনের কথা ভেবেই চাইনিজ ফোন কোম্পানিরা সস্তা দামে ফোন বিক্রি করে। যেন মনের ভেতর কোনো এঁরর নোটিফিকেশন দেওয়ার আগেই আপনি ফোনটি কেনে ফেলেন।
অন্য দিকে বড় বড় মোবাইল ফোন নির্মাতা কোম্পানিরা এই কৌশল অবলম্বন করে না। কারন তারা ইতিমধ্যে বড় ব্র্যান্ড এবং মানুষ তাদের বিশ্বাস করে।
চাইনিজ ফোন গুলোর গুনগত মানঃ
এতক্ষণ এ আপনি নিশ্চয় বুঝে গেছেন যে চাইনিজ ফোন এর দামের পার্থক্য কেনো হয়। এখন আপনার মনে যেটি প্রশ্ন থাকে তা হলো এর গুনগত মান নিয়ে। এই বিষয়টি নিয়ে অনেক সহজ করে বোঝাতে চাই আপনাকে। দেখুন চাইনিজ ফোন গুলোর দাম কম হলেও গুনগত মান এর দিক থেকে কোনো পার্থক্য থাকে না। আপনি এইচটিসি বা স্যামসাং এর কথা বলুন আর সিম্ফনি বা ওয়াল্টন এর, এরা কিন্তু কেউই OEM নয়। মানে Original equipment manufacturer (প্রকৃত যন্ত্রাংশ তৈরিকারী) নয়। যেমন ধরুন এই ফোন গুলোতে যে মেমোরি লাগানো থাকে তা হয় স্যামসাং বা অন্য কোম্পানির, যে প্রসেসর থাকে তা হয় মিডিয়াটেক বা কোয়ালকম এর, অথবা যে ক্যামেরা থাকে তা হবে সনি বা অন্য কোনো কোম্পানির। তো এই সকল ফোন কোম্পানি গুলোয় একই স্থান থেকে যন্ত্রাংশ কেনে। এমনটা কিন্তু নয় যে স্যামসাং বা এইচটিসি দামী যন্ত্র কেনে আর সিম্ফনি বা ওয়াল্টন কম দামী যন্ত্রাংশ কেনে। তো বাস্তবিক দিক থেকে দেখতে গেলে গুনগত এর দিক থেকে তেমন কোনো পার্থক্য দেখতে পাওয়া যায় না। এটা কখনোয় ভাববেন না যে চাইনিজ ফোন এর গুনগত মান খারাপ হবে। আপনি অনায়াসে চাইনিজ ফোন কিনতে পারেন এবং ব্যবহার করতে পারেন। তবে চাইনিজ ফোন এ কিছু কিছু অসুবিধা হতে পারে। তা নিয়ে নিচে আলোচনা করছি।
চাইনিজ ফোন এর অসুবিধা সমূহঃ
অনেক সময় দেখা যায় আপনি যে চাইনিজ ফোন টি কিনেছেন তার প্রস্তুতকারি কোম্পানি একেবারেই নতুন হওয়াতে কেনার পর সার্ভিস পেতে আপনার অসুবিধা হতে পারে। সার্ভিস নিতে আপনাকে বড় কোনো শহর এ যেতে হতে পারে। আরেকটি সমস্যা হতে পারে তা হলো অনেক সময় ফোন এর অপারেটিং সিস্টেম এবং হার্ডওয়্যার সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় না। মনে করুন আপনি ৬-৭ হাজার টাকা দিয়ে ১ জিবি RAM এর একটি ফোন কিনলেন যেটা Android ললিপপ অপারেটিং সিস্টেম দিয়ে চলে। এখন ১ জিবি RAM হওয়ার কারনে আপনার ফোনটি ল্যাগ করতে পারে। তাছাড়া GPU (Graphics processing unit) ভালো না হলে গেম খেলে মজা পাবেন না ইত্যাদি। তাছাড়া অন্য কোনো সমস্যা নাই। আপনি চাইনিজ ফোন কিনেও ভালো ভাবে ব্যবহার করতে পারবেন।
উপসংহারঃ
তো আশা করি এতখনে বুঝে গেছেন যে Chinese Phone গুলো কেনো এত সস্তা হয় এবং Chinese Phone আপনার কেনা উচিৎ কি না। তবুও আপনার যদি কোনো প্রশ্ন থাকে বা কোনো মতামত থাকে এই বিষয়টির উপরে তবে নিচে কমেন্ট করে আমাদের জানাতে পারেন।
পূর্বে প্রকাশিতঃ বাংলা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ব্লগ
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই এপ্রিল, ২০১৬ রাত ৯:০৪