গল্পঃ-ফেরা -এর আগের পর্ব দেখুন
প্রতিদিনের মত আজও কবরস্থান ঘেঁষা জমিটিতে নানা বয়সের লোকের সমাহার। সকাল হলেই যে যার ইচ্ছেয় আপন টানে টুপড়ি-কোদাল নিয়ে ছুটে এসে কাজে যোগ দেয়। কয়েকদিন থেকে দুপুর গড়ালে আসে সদর হাইস্কুল ও ডিগ্রী কলেজের ছাত্রদের দুটো দল।একরাম চৌধুরীর দিশায় নির্দেশিত হয়েই ছেলেগুলি বাউন্ডিলিপনা ছেড়ে পড়াশোনায় মনোনিবেশ করেছিল।চৌধুরীর দেখানো পথে ওরা উত্তোরত্তর ভাল রেজাল্টও করছে।সকাল আটটা থেকে নতুন সময়ের ক্লাস বিরতিহীন দুপুরের মধ্যেই শেষ হয়ে যায়।ক্লাস শেষেই ওরা চলে আসে। ওরা এলে শ্রমিক শ্রেণীর যে অংশটি সারাদিন খাটে তাদের গতি বেড়ে যায়। অনেকে আরামও পায়। কারণ এই শ্রমিক শ্রেণীর কেউ কেউ আবার ওদের বাবা,বড় ভাই,মা-বোন,আত্বীয় অথবা প্রতিবেশী।স্বাভাবিকই দুপুর নিংড়ানো খাবার ওদের জন্য অভাব হয় না।একান ওকান করে ওদের এই মহৎ কাজের খবর দুটো প্রতিস্ঠানের মস্তিস্কে পৌছে গেছে।তৃতীয় দিন থেকেই প্রতিষ্ঠান দুটি থেকে ওদের জন্য বাড়তি টুপড়ি-কোদাল কিনে দেওয়া হয়েছে।
স্বেচ্ছা শ্রমের এই বহরটা আরও বড়।যারা সারাদিন খাটে তাদের অনেকেই পূর্ণ পারিশ্রমিক নেয় না।কেবল বাজার খরচটা নিলেই অনেকের হয়ে যায়।কেননা দু-একটু, জমি-জমা আছে এমন লোকও শ্রমিক শেণীতে নাম লিখিয়েছে। সেখান থেকে উৎপাদিত পণ্যেই সংসার চলে। তবুও তেল, সাবান,নুন-লবন এসব নিত্য পণ্যের জন্য নূন্যতম নগদ অর্থের প্রয়োজন হয়। আবার অনেক জোতদার ঘরের ছেলেরা নিজেদের হ্যালে-কামলা নিয়ে এসে দাঁড়িয়ে থেকে দিনের প্রথম ভাগ বা মধ্যভাগটা খেটে যায়।কোন পারিশ্রমিক নেয় না। এভাবেই সকলের সমি্মলিত ঘামে শ্রমে গড়ে উঠছে দু’গ্রামের ঐক্যের বাঁধন তিলোত্তমা মূর্তি।
কাজ ও অর্থ ব্যবস্থাপনা তদারকির জন্য কমিটি গড়ে তোলা হয়েছে।কমিটির প্রধান নিজাম চৌধুরী নিজে। কিন্তু কাজ শুরুর পর দিন থেকে মাঠের কোথাও একটিবারের জন্যও তাকে দেখা যায়নি। কারণটাও অজানা।কমিটির দ্বিতীয় প্রধান একরাম চৌধুরীর বড় ছেলে এমরান চৌধুরী। কমিটির প্রাণও বটে। দুই গ্রামের কয়েকটা মসজিদের ঈমাম ও গণ্যমান্য ব্যক্তিও কমিটির সদস্য।কিন্তু এমরান ছাড়া সবাই কেমন ছায়াহীন-নীরাকার।এমরান থাকলে যেন একরাম চৌধুরীই আছে এমন দীপ্ত কর্ম উদ্দীপনায় সবাই কাজ করে।এমরান বয়সে তরুণ।তারুণ্য শিখা আর দায়িত্বের মন্ত্র সাধন ক্রমেই তাকে ন্যায় নিষ্ঠ করে তুলেছে।এ তারুণ্যের উজ্জ্বল দ্যুতিই সমাজের বাড়ন্ত কর্মস্পৃহাকে একটি বৃহৎ স্বার্থের সূতোয় সকলকে টেনে ধরেছে।যেখানে পাওনার হিসেবটা একেবারেই গৌণ।
চৌধুরী পরিবারের দানকৃত জমিটি খুব বড় নয়। সর্বমোট সাত বিঘা জমির দুটি দাগ।তবে তা রাস্তা থেকে শুরু হয়ে সোজা নেমে গিয়ে কবরস্থানের পশ্চিম আইল বরাবর চৌকোণায় শেষ হয়েছে।কবরস্থানটা উত্তর-দক্ষিণ লম্বা।এর উত্তর দিকটাতে আবার একবিঘা পরিমাপের একটি পুকুর সদৃশ ডোবা। এখানকার মাটিতেই গোটা কবরস্থানের অর্ধেকটা স্ফীতি পেয়েছে।যে কারণে দক্ষিণ দিকটা ক্ষেত সমান নীচু। আর উত্তর দিকটা বাড়ী সমান উঁচু।
প্রথম দিনটাতে জমির দক্ষিণ দিকটা থেকে মাটি কাটা শুরু হয়।কিন্তু পরের দিনটাতে কুসুমপুরের আক্কাস মিয়াসহ বাকী সব লোকের বাঁধায় তা বন্ধ হয়ে যায়।কারণটা হ’ল সাতবিঘা জমির একাংশ ডোবা হয়ে গেলে বাকীটা দু’গ্রামের মুসল্লিদের সংস্থানের জন্য কম হয়ে যায়। তার উপর মসজিদ-মাদ্রাসার প্রশ্ন আছে। কবরস্থান ও ঈদগাহের পবিত্রতার জন্য মসজিদ চাই। আর সব কিছু পবিত্র দায়িত্বে দেখভালের জন্য মাদ্রাসা চাই।
কাজে বাঁধা এলেও সমাধানে সামান্যতম দেরী হয়নি। ঐ দিন সন্ধ্যায়ই দুই গ্রামের লোকজন জমিটিতে জড়ো হয়।সিদ্ধান্ত হয় কবরস্থানের ডোবা থেকে পানি সেঁচে ফেলে দিয়ে সেখান থেকেই মাটি কাঁটা শুরু হবে। প্রথম দিনের গর্তের স্থানটি মাটি দিয়ে ভরাট করে সমানভাবে স্ফীতি করে নিতে হবে। যেমন কথা তেমন কাজ।শুকনো মৌসুম। ভোজভাজির মত রাতের মধ্যেই দু-গ্রাম থেকে চার চারটি স্যালো মেশিন সংগ্রহ হয়ে ভোর হবার আগেই ডোবার পানি তিন ধারের ক্ষেত খামারে চালান হয়ে যায়। সকাল বেলা চলে মাছ ধরার পালা।
কবরস্থানের ডোবার মাছ বর্ষায় তিন দিক থেকে পানির সাথে এসে জমা হয়। তিন দিকেই বিস্তৃর্ণ ধান ক্ষেত। বর্ষার পানিগুলো যখন আস্তে আস্তে দক্ষিণের পদ্মার দিকে নামতে থাকতে তখন ধান ক্ষেতের মাছগুলি নিরাপদ ভেবে থেকে যায় কবরস্থানের ডোবার পানিতে। পানিতে যখন টান পড়ে তার আগেই কবর কমিটির লোকেদের যত্ন হাতে কবরস্থানের গাছগুলির ছাঁটা ডালপালায় ভরে যায় ডোবা। যার বদৌলতে এতটুকুন ডোবা যেন প্রাকৃতিক মাছের অভয়ারণ্য। শৈল-টাকি,টেংরা-পুটি,কৈ-শিং-মাগুর, বোয়াল-চিতল,কাতল-মৃগেলসহ বহুরুপি মাছের আঁধার এই কবরস্থানের ডোবা। একরাম চৌধুরীর হাতে এর সদ্ব্যব্যবহারের উপায়ও বের হয়েছে।প্রতিবছর মাছ বিক্রিতেই লক্ষ ছাড়িয়ে যায়। এবারও তার ব্যত্যয় হয়নি।মাছ বিক্রির টাকায় চলে কবরস্থানের উন্নয়ন,সৌন্দর্য্য বর্ধন।বাকীটা থেকে যায় ভবিষ্যৎ সষ্ণিতির খাতায়।সেই সষ্ণিতির টাকাটাই এখন ঈদগাহ-মসজিদ-মাদ্রাসা নির্মাণে কাজে আসছে।
ঈদগাহের পশ্চিমপাশটাতেই কবরস্থান বরাবর মসজিদের কাজ ধরা হয়েছে। এবং তা জমির একেবারে নীচ থেকে পাইলিং করে। সে জন্য ওদিকটায় এখনও মাটি ভরাটের কাজ ধরা হয়নি। পিলার ও বীম রাস্তা সমান হলেই ভরাট হয়ে যাবে।বামপাশটার দক্ষিণ কোণায় মৃতের গোসল খানা সাথে মুসল্লিদের ওজুখানার ব্যবস্থা।দক্ষিণের বাকী দিকটা লম্বালম্বি মাদ্রাসার জায়গা।তবে তা আপাতত মসজিদ কেন্দ্রিক হবে। সে ক্ষেত্রে দক্ষিণ দিকটা এখনও ফাঁকা।তবে চার ধার দিয়েই দামী কাঠগাছ লাগানোর পরিকল্পনা আছে। একদিকে ইট-পাথর,বালি-সিমেন্ট-রডের ঝনঝনানি অন্য দিকে ডোবার কাঁদা মাটির ঘ্রাণ।মেটে মাটির মানুষগুলির গতরের জোর আর মনের অদম্য ইচ্ছা অনেক দূরের কাজগুলিকে মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে সবকিছু পায়ে ফেলে কত কাছে নিয়ে এসেছে।
দুপুরের তপ্ত রোদ ফুলকি দিয়ে ফুটছে।ঘামে ভেজা শ্রমিক দলের পুরোটাই বিরামহীন খাটুনির পর একটু আরাম নিতে কবরস্থানের গাছের ছায়ায় বসে পড়েছে। কবরস্থানের নীচ দিয়ে ধানক্ষেত ঘেঁষে পায়ে পায়ে আইলের রাস্তাটা টুপড়ির বাড়তি ঢিলা পড়ে একটু বেশিই প্রশস্থ হয়ে পড়েছে। জমির মালিকও কমিটির সদস্য। ফসলের এমন অনিষ্টে তাদেরও কোন চোখ রাঙানি নেই। দুপুরের বিরাম পর্বে শ্রমিকদের জন্য টিউব ওয়েলের ঠান্ডা পানির সাথে টেস্টি স্যালাইন অথবা লেবুর রসের আয়োজন নিত্যকার দৃশ্য।সাথে দু’ টুকরো বিস্কুট।আজও তার উপায় হয়েছে। এমরানের নেতৃত্বে তাহাই পরিবেশন করা হচ্ছে। অন্য দিন স্কুল-কলেজের দল দুটিই এসে পরিবেশন করে।নিজেরা আনন্দও পায়।কিন্তু আজ চারদিক থেকে জোহরের আজান ভেসে আসছে। এখনও ছেলেগুলির খবর নেই! সদরের কলেজের আজ ৫০ বছর পূর্তি উৎসব। নানা অনুষ্ঠান হবে। ওরা হয়ত ওসবেই মন এলিয়ে দিয়েছে।বিষয়টি মনে পড়তেই এমরান নিজ হাতে আজ সরবত ও বিস্কুট পরিবেশনের ভার তুলে নিয়েছে।
শরবতের পেয়ালা তখনও কাতারের মাঝ বরাবর যায়নি। এমন সময় কুসুমপুরের ভেতর থেকে একখানা জিপ গাড়ী হর্ণ দিতে দিতে রামচন্দ্রপুরের দিকে আসতে থাকে। গাড়ীটি যখন কুসুমপুর থেকে স্পষ্টে বের হয় তখনও রোদের তির্যকে প্রথমে একে আবছা আবছা মনে হয়।নতুন পিচ ঢালা রাস্তা।কেবল থানার দারোগা বাবুর গাড়ী বা দু একখানা মোটর সাইকেল ছাড়া এ রাস্তায় বড় কোন গাড়ীর সাথে গ্রামবাসী এখনও পরিচিত হয়ে উঠতে পারেনি। সে জন্য অচেনা অজানা গাড়ী দেখে কুসুমপুরের দামাল ছেলেরা পিছু নিয়েছে। ওরা গাড়ীটির সামনে। সেজন্য গাড়ীর গতি ধীর।সামনে থেকে ওদের সরানো বা সতর্ক করার জন্যই বারবার গাড়ীর হর্ণ দিতে হচ্ছে।গাড়ীর ঠিক পিছনেই স্কুল-কলেজের সেই আকাংখিত দল দুটি।সামনে পিছন থেকে গাড়ীটিকে সবাই যেন চৌকস দিয়ে নিয়ে আসছে।
কবরস্থান বরাবর হতেই গাড়ীটি থেমে গেল।ভেতর থেকে একে একে নেমে এলেন কলেজের প্রিন্সিপাল, হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও কুসুমপুর গ্রামের বড় মসজিদের ঈমাম।ততক্ষণে এমরান সরবত পরিবেশনের ভারটা অন্যের উপর ছেড়ে দিয়ে নিজেও এগিয়ে এসেছে অতিথিদের কাছে। এমরান সালাম দিয়ে সবাইকে সাদরে গ্রহণ করে।
-এমরান, তুমি এদিকে ব্যস্ত আছো তাই তোমাকে কলেজের অনুষ্ঠানে ডাকিনি।কিছু মনে করোনি তো? বলেন প্রিন্সিপাল।
-কি বলেন স্যার,এটা তো আপনাদের আর্শীবাদ।
-আমরা এসেছি চৌধুরী সাহেবের কবরটা জেয়ারত করতে।রিক্সা-ভ্যান ঠিক করেছি।দেখি ছেলেপেলে মিডিয়ার গাড়ীটিকেই পটিয়ে ফেলেছে। উঠে পড়লাম।ওরা এসেছিল কলেজের অনুষ্ঠান কভার করতে। গাড়ীতে বসে বুঝলাম ওরাও এখানে না আসলে মিস করত। এসো পরিচয় করিয়ে দিই। বলেই প্রিন্সিপাল গাড়ী থেকে নামা সাংবাদিক ও সংবাদকর্মীদের সাথে এমরানের পরিচয় করিয়ে দেয়।
ততক্ষণে মিডিয়ার গাড়ীটি থেকে বেশ কয়েকটা ক্যামেরা বের হয়ে এদিক ওদিক সেট হয়ে গেছে। কেউবা ক্যামেরা হাতে সরবত পরিবেশনের দৃশ্য নিতে থাকে।সাথে জাতীয় পত্রিকার একজন জেলা সাংবাদিক। তিনিও সদরের কলেজ থেকে ডিগ্রী নিয়েছেন।কেবল তার উদ্যোগেই মিডিয়ার এই গাড়ীটি এসেছিল কলেজের ৫০ বছর পূর্তি উৎসব কভার করতে।অনুষ্ঠানের মাঝখানে তার কানে যায় কুসুমপুর-রামচন্দ্রপুরের মানুষের স্বেচ্ছাশ্রমে নিজেদের স্বপ্ন পূরণের কাহিনী।ভদ্রলোক যখন থানা প্রতিনিধি ছিলেন তখন ”রহস্য ঘেরা নিজাম ডাকাত” নামে একখানা প্রতিবেদন লিখেছিলেন। নিজাম ডাকাতের একখানা ছবির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরে ছিলেন। আজ সেই নিজাম ডাকাতকে লোকের মাঝে পাওয়া যাবে এতো কল্পনার বাহিরে।আজকের এই ঈদগাহ-মসজিদ-মাদ্রাসার উদ্যোক্তাও সেই নিজাম ডাকাত ভাবতেই গাঁ হিমহিম করছে! একজন মানুষ খেকো রক্তপিশাচ ডাকাত কিভাবে এত রাতারাতি ভাল মানুষ হয়ে গেল টিমের সকলের মাঝে বাড়তি কৌতুহূলের। কিন্তু তা চাপা দিয়ে আসল রহস্য বের করতে সংবাদ কর্মীদের সবাই যে যার মত লোকেদের সাথে মিশে যায়।আগে চাই তথ্য।তারপর স্টুডিওতে বসে না হয় মিলানো যাবে।
অল্পক্ষণ পরেই কিছু রিক্সা-ভ্যান ও সাইকেলের একটা সারি এসে কবরস্থান বরাবর মিডিয়ার গাড়ীর পরপর দাঁড়িয়ে যায়।এগুলো থেকে একে একে নেমে আসেন কলেজ ও হাইস্কুলের বাকী শিক্ষকগণ। সবাইকে সাথে করে এমরান ঘুরে ঘুরে দেখান গোটা প্রকল্পের কাজ।এরই মাঝে ছাত্রদের দল দুটি সবার মাঝে ভাগ হয়ে ঠান্ডা পানির শরবত ও বিস্কুট বিতরণ করে। তপ্ত রোদের মাঝে ঠান্ডা পানির এই প্রাকৃতিক আয়োজন কেউ কেউ ঢকঢক করে দু’তিন গ্লাসও খেয়ে ফেলে।
-এমরান,তোমরা খুব সুন্দর আয়োজন করেছো তো। এ যেন বেহেশতি শরবত! খাওয়ার পর মনে হচ্ছে শরীর শক্তিতে ভরপুর হয়ে উঠল।তোমরা সত্যিই ধন্যবাদের যোগ্য।তোমার বাবাও এমন ছিলেন।আল্লাহ তাকে বেহেশত নসীব করুক। বলেন প্রধান শিক্ষক।প্রিন্সিপাল সাহেবও এমরানের মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে দেন।
-এমরান, তোমাদের এই মসজিদে একটু নামাজের ব্যবস্থা করা যায় না? আমার মনে হয় ঈমাম সাহেবেরও জোহরের নামাজ পড়া হয়নি। বলেই প্রিন্সিপাল জিজ্ঞাসার দৃষ্টিতে ঈমাম সাহেবের দিকে তাকান।
-সকাল থেকে তো আপনার সাথেই আছি।আপনি না পড়লে আমি কিভাবে পড়লাম,স্যার?
-তো ব্যবস্থা করেন না।এই বেহেস্তি ময়দানে কয়েক রাকাত নামাজ পড়ে যাই।
-কিন্তু স্যার, এত রোদ!
-তোমার বাবা এমরানের সাথে এভাবে কত জায়গায় নামাজ পড়েছি।আজ তার কবর জিয়ারত করতে এসে নামাজ না পড়ে যাব?
কেউ আর কোন কথা বাড়ায় না।এমরান ছাত্রদেরকে ডেকে সবাইকে টিউবওয়েলের ঠান্ডা পানিতে ওজু করার বন্দোবস্ত করে দিয়ে আক্কাছ মিয়াকে সাথে করে নিজের মোটর সাইকেল নিয়ে ছোটে কুসুমপুর বড় মসজিদের দিকে।খবরটি ইতিমধ্যেই মোবাইলে পৌছে গেছে মসজিদের মুসল্লিদের কানে।ওখানেও ওজুর আয়োজন চলছিল।শুনেই কয়েকজন মুসল্লি মিলে তাড়াতারি কয়েকখানা খেঁজুরের পাটি ও লম্বা চটের বিছানা ও ওজুর বদনা নিয়ে ভ্যানে চড়ে রওনা দিয়েছে।পথেই দেখা।কিন্তু ভূল করে ত্রিফলটি আনা হয়নি। এমরান আবার ছোটে ত্রিফল আনতে।ত্রিফল নিয়ে ফিরে দেখে মসজিদের সামনে উম্মোক্ত জমিনে নামাজের বিছানায় সবাই বসে পড়েছে।ত্রিফল দেখে সবাই হাতে হাতে টাঙিয়ে নিতে সাহায্য করে। সামনেই মসজিদের পিলারের উদোম রড।কেবল পিছনে কয়েকটি খুটি পুঁতে মহুর্তে তা ছায়া উদ্যাণে পরিণত হয়ে গেল।ঈমামের ইশারায় আক্কাছ মিয়া জোহরের আযানটাও দিয়ে দিয়েছে।কিন্তু ওজুর পর্ব এখনও শেষ হয়নি। কেননা শ্রমিক শ্রেণীর অধিকাংশই শরীক হতে কাতার বেঁধে ওজু করছে।বেশ কয়েকটা কাপড়ের জায়নামাজও চলে এসেছে।তার সামনেরটিতে ঈমাম সাহেব যখন ঈমামতিতে দাঁড়ালেন পিছনে পাঁচ পাঁচটি কাতার হয়ে গেছে।
এদিকে যখন নামাজের আয়োজন চলছে ওদিকে তখন মিডিয়া টিমের সর্ব কনিষ্ট সদস্য সুশীলের মনে অন্য পরিকল্পনা খেলা করছে।সুশীল বরাবরই একটু বেশি কৌতুহুল,সেই সাথে দূরন্ত সাহসী।গড়নে পাতলা ছিপছিপে।অনায়াসেই হাইস্কুলের ছাত্র বলে চালিয়ে দেয়া যায়।পরণের ড্রেস দেখে যে কেউ কিন্ডার গার্ডেনের ছাত্র বলে মেনে নেবে।সাথে সবসময় থাকে SAMSUNG এর নতুন W200 Waterproof Pocket Camera. জামার বুক পকেটে রেখেই যে কারও অলক্ষ্যে মহুর্তে অনেকগুলি ছবি ভিডিও নিয়ে নেয়া যায়।
যে মানুষটিকে নিয়ে টিমে এত আলোচনা সে মানুষটি ঈদগাহ-কবরস্থানের কোথাও নেই।এমন নিশ্চিত খবর সুশীল কেন টিমের সবাই জেনে গেছে।সুশীল রামচন্দ্রপুর গ্রামের স্কুল পড়ুয়া ছেলেদের খুঁজতে থাকে। বেশি খুঁজতে হ’ল না। নিজেদেরই গাড়ীর সামনে কয়েকটি হাইস্কুল পড়ুয়া ছেলে সাইকেল ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।সুশীল ওদের সাথে ভাব জমিয়ে ফেলে।
-আচ্ছা ভাই,এখান থেকে পদ্মা কতদূর?
-আপনী কোন্থেকে এসেছেন?
-আমি সদর কলেজের নতুন ছাত্র।স্যারদের সাথে এসেছি।শুনলাম কাছেই পদ্মা।দেখতে খুব ইচ্ছে করছে।
-যাবেন আমাদের সাথে?
-কিন্তু সে তো অনেক দূর। ঐ যে গ্রাম,এরপর মাঠ, তারপর পদ্মা।এত দূর থেকে ফিরবেন কিভাবে? বলে আরেকজন।
-কেন রিক্সা পাওয়া যাবে না।
-হুঁ,বাজার থেকে পাওয়া যাবে।
-এখন আপনারা কেউ নিয়ে নিন। ফেরার পথে রিক্সায়ই আসব।
-ওকে, উঠে পড়ুন।
-না,না আমার ভাল অভ্যেস আছে।আপনি পিছনে বসুন। আমি চালিয়ে যাচ্ছি।
ছেলেটা কথা না বাড়িয়ে ব্যাগ হাতে নেমে দাঁড়ায়।সুশীল চালানো শুরু করলে দুদিকে দুপা ছড়িয়ে ছেলেটি চলন্ত সাইকেলের পিছনে উঠে পড়ে।সুশীলও পাকা চালক। কেউ উঠল সাইকেলকে বুঝতেই দিল না। দেখে পিছনের সাইকেল দুটির তাচ্ছিল্য ভাব কেটে গেল।
-আপনী কি সাইকেল চালিয়েই কলেজ করেন?
-কথনও কখনও।তবে পায়ে হেঁটেই বেশি হয়।সাইকেলের চেয়ে পায়ে হাঁটলে শরীর মন দুইই ভাল থাকে।
-আমার আব্বাও তাই বলে।কিন্তু আমাদের গ্রাম থেকে স্কুল তো অনেক দূর।তাই সাইকেলই ভরসা।
-দূরের জিনিসের প্রতি আকর্ষণ,মহব্বত বেশি থাকে।স্কুল গ্রামে হলে অতটা হ’ত না।জ্ঞানের জিনিস দূরে থাকলে মেধা প্রখর হয়।সহজলভ্য হলে আলোস্য ভর করে।
-Extrim!আপনী সত্যি বলেছেন।কষ্ট করে যেটা পড়ি সেটাই বেশি মনে থাকে।আর সহজে যেটা বুঝি তা আবার সহজে ভূলেও যাই।
-প্রকৃতির এটাই নিয়ম।
-আপনার সাথে এত কথা হচ্ছে।নামটিই তো জানা হ’ল না।
-আমি সুশীল।সুশীল দেবনাথ।
-আমি রাজু।রাজু আহম্মেদ।
-Nice to meet you.
-I am also proud of you.
এর পর অনেকক্ষণ কারও কোন কথা নেই।নতুন পাকা রাস্তা কেবলি সামনে টানছে।ঝকঝকে মশৃণ রাস্তায় সুশীলের মনেই হচ্ছে না সে সাইকেল চালাচ্ছে। প্রথম বাড়ীটি অতিক্রম করতেই মনে হ’ল রামচন্দ্রপুর গ্রামে ঢুকে পড়েছে।
-এটাই আপনাদের গ্রাম?
-হুঁ,সামনে আমাদের বাড়ী।
-ওয়্যাও কি সুন্দর গ্রাম।
-রাজু, চললাম আবার কালকে কেখা হবে।বিদায় অতিথি বন্ধু।কথাগুলি বলে পিছনের সাইকেল দুটি বামের মেঠো রাস্তায় ঢুকে গেল।সুশীল যখন সাইকেলের ব্রেক কষল ওরা ততক্ষণে বাড়ীগুলোর আড়ালে মিলিয়ে গেছে।
মাঠ মাড়িয়ে রাস্তাটি তীরের মত সোজা রামচন্দ্রপুর ঢুকে পড়েছে।বামের কাঁচা রাস্তাটি নেমে যেতেই পাকা রাস্তাটি কিঞ্চিৎ ডানে বাঁক নিয়ে আবার সোজা ছুটেছে। কিছুটা দূরেই একটা মোড়ের মত। এখানে রাস্তাটিও বেশ চওড়া।ডানপাশটাতে একটা মসজিদের মিনার গাছপালার উপর দিয়েই দেখা যাচ্ছে। মসজিদের পেটটা রাস্তার দিকে বাড়ানো।পেটের ধার ঘেঁষে একটা টোন দোকান।খোলা কিন্তু দোকানে কেউ নেই।রাজু এইখানটাতেই সাইকেল দাঁড় করতে বলে।
-এটাই আপনাদের বাড়ী?
-হুঁ দোকানটাও আমাদের। কিন্তু আমাকে আর আপনী করে বলবেন না। আপনী কলেজ আর আমি স্কুলের ছাত্র।
-আচ্ছা হবে।কিন্তু দোকানে লোক কই?
-আব্বা ঈদ মাঠে মাটি কাটে। আর মা দোকান খুলে রেখেছে। আশেপাশেই হয়ত কোথাও আছে।কারও কিছু লাগলে মাকে ডেকে আনবে।
-কেউ যদি না বলে কিছু নিয়ে নেয়, ধরবে কেমনে?
-এই চৌধুরী বাড়ীর মুখ থেকে? বলেই রাজু হো-হো করে হেঁসে ওঠে।
-চৌধুরী বাড়ী! কোন দিকে?
-ঐতো ওপাড়।
সুশীল একরাশ আশ্চর্যে্য রাস্তার ওপাশে তাকায়। সুন্দর কারুকার্যে রাস্তার সামনে একটা গেট।রাস্তার ধার ঘেঁষে বিশাল বিশাল কাঠ গাছ পিছনের দ্বি-তলা বাড়ীটিকে আড়াল করে রেখেছে। নিজের অজান্তেই সুশীল রাস্তা পার হয়ে বাড়ীটির সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।পিছনে পিছনে রাজুও।কিন্তু তার মধ্যে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। চোখে মুখে ততোধিক আশ্চর্য্য নিয়ে কেবলি অতিথিকে অনুসরণ করছে।
- ওয়্যাও! এখানে দেখার মত এত সুন্দর একটা বাড়ী আছে কারও কাছে কখনও তো শুনিনি।
-হুঁ,এটা কেবল বাড়ী নয়,আমাদের ভরসা।সামনে যে ঈদের মাঠের কাজ চলছে সব উনাদের দান।গ্রাম পেরিয়ে দক্ষিণের মাঠের পুরোটাই এই চৌধুরী বাড়ীর।ইনারা খুব ভাল,দয়ালু।
-বাড়ীতে লোকজন থাকে না?
-ওমা! তো কোথায় থাকবে? সবাই আছে।বাড়ীর পিছনে বিশাল বড় পুকুর। ডান দিকটায় যে ঘন গাছগাছালি দেখছেন ওটা ওনাদের বাগানবাড়ী। ওর ভেতর দিয়ে পিছনের পুকুরপাড়ে যাওয়া যায়।
-বাড়ীর ভেতরে ঢুকলে কেউ কিছু বলবে?
-যাইবেন? আমার সাথে আসেন।কেউ কিছু বলবে না।
গেটের পকেটটা ভেজানোই ছিল।ধাক্কা দিতেই খুলে যায়। মাথা নীচু করে দুজনে ভেতরে ঢুকে যায়।সামনের দিকটা ফুটবল মাঠের মত বিশাল উঠান।বিল্ডিংটা অর্ধাচন্দ্রাকার ঘোরানো।দু’মাথাই সামনের রাস্তা পর্যন্ত চলে এসেছে।কেবল মাঝখানে পেটের মধ্যে উঠান।উপরে ও নীচে অর্ধাচন্দ্রাকার দুটি ঘোর বারান্দা। বারান্দা থেকে নামতেই বাহারী ঢঙে সাজানো থোকায় থোকায় নানাজাতের ফুলগাছ।
চারিদিকে পরিপাটি করে সাজানো অথচ কোন জনমানুষের চিহ্ন নেই।উঠান মাড়িয়ে দুজন বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়।বারান্দা থেকেই একটা পেঁচানো সিঁড়ি উপরে উঠে গেছে।কিন্তু এর ধাপগুলি দুদিকেই বিছানো।অর্থাৎ দুদিক থেকেই সিঁড়িতে উঠা যায়। আগে রাজু পিছনে সুশীল।সিঁড়ির কাছাকাছি হতেই রাজু মুখে আঙুল চেপে থেমে যায়।
সিঁড়ি গোড়ার পশ্চাৎ দিকটা সামান্য বেদীর মতন উঁচু।এখানে সুন্দর অলংকার খচিত ছোট্র একটি খাট পাতা।তাতেই সুন্দর সুশ্রী মুখে চাপ দাড়ি গায়ে সাদা ধবধবে পাঞ্জাবী পরিহিত চল্লিশ পেরুনো একজন ভদ্রলোক শুয়ে আছেন। বুকের উপর বাংলা তরজমা করা একখানা কোরআন শরীফ। পাতাগুলি দু’দিকে ভাগ করা।বোঝাই যাচ্ছে পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছেন।
-লোকটি কে? অস্ফুটে বলে সুশীল।
-ছোট দাদা।অস্ফুটে উত্তর দেয় রাজু।
-নাম কি?
-নিজাম চৌধুরী।
নাম শুনে সুশীলের মনে আনন্দের ঢেউ খেলে যায়।কিন্তু রাজুকে বুঝতে দেয় না।মহুর্তে পকেট থেকে ক্যামেরাটা বের করে বিভিন্ন এ্যাংগেল থেকে কয়েকটা ছবি তুলে নেয়।রাজু কিছু বোঝার আগেই ঘটনাটা ঘটে যায়।
-কি করছেন কি? উনি কাউকে ছবি তুলতে দেন না।ভয়ার্ত কন্ঠে অস্ফুটে বলে রাজু।
-Sorry, ভূল হয়ে গেছে।
-তাড়াতাড়ি ক্যামেরা লুকিয়ে ফেলুন।
-Ok.
-রাজু কি কাউকে খুঁজছো? ভূত দেখার মত চমকে ওঠে দু’জন। রাজুর অনেকটা কেঁদে ফেলার মত অবস্থা। কারণ কন্ঠটা তার পরিচিত।কিন্তু সামনে-পিছনে,উপরে-নীচে কন্ঠটির ছায়াটি পর্যন্ত নেই।সুশীল কাঁধ চাপড়ে রাজুকে অভয় দেয়।রাজু কাঁধেই সুশীলের হাতটি চেপে ধরে।তার হাত থরথর করে কাঁপছে।
-ধুর বোকা ছেলে।চাপা গলায় কিন্তু অনেকটা ধমকের সুরেই কথাটা বলে সুনীল।ফিরে তাকিয়ে অনেকটা ধাতস্ত হয় রাজু।ততক্ষণে ছায়ামূর্তিটি এসে সামনে দাঁড়িয়েছে।এখন দু’জনেই স্বাভাবিক।
-আস্সালামু আলাইকুম, Uncle.
-বলছিলাম, কাউকে খুঁজছিলে? জামার বোতাম লাগাতে লাগাতে বলে নিজাম চৌধুরীর মেঝ ছেলে ওয়ারেছ। দ্বিতীয় তলার বারান্দা থেকে প্রথম বারের কথাটি ছেড়ে দিয়েই সে পিছনের সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করেছে। এজন্য রাজু-সুশীল কন্ঠের উৎস খুঁজে পায়নি।
-হ্যাঁ,মানে, মা এসেছে কিনা দেখতে এসেছিলাম।
-দোকানে নাই বুঝি? তাহলে দেখ পিছনে থাকতে পারে।কিন্তু এটি কে?
-আমার বন্ধু।একই সাথে পড়ি। সুশীল আরেকটা সালাম দেয়।
-ওকে,তোমরা দাঁড়াও আমি খবর পাঠাচ্ছি।কিছু মাছ ধরা হয়েছে।তোমার মা বোধ হয় ওখানেই থাকতে পারে।
-না-না-না Uncle. আমি খুঁজে দেখছি।
-ওরি, কোথাও বেরুচ্ছিস? ততক্ষণে নিজাম চৌধুরীও উঠে বসেছেন। জামার হাতাটা গোছাতে গোছাতে ওয়ারেছ পিতার খাটের দিকে এগোয়।একমাত্র মেয়ে লামিয়া কোন্থেকে দৌড়ে এসে গলা জড়িয়ে ধরে পিতার কোলে বসে পড়ে।রাজু সুশীল এই ফাঁকে হনহন করে গেটের বাইরে দৌড়ে বাঁচে।
-বাবা,শুনলাম মিডিয়ার লোকজন নাকী ঈদ মাঠে নেমেছে।বলেনত ঘুরে আসি।
-ওরা আজ মসজিদের সামনে নামাজও পড়েছে।
-বলেন কি,বাবা?
-ঈমাম সাহেব বলছিল, আর আমি গা জ্বালা নিয়ে শুনছিলাম।
-বাবা, এভাবে বলতে নেই। বলেছি না আমি তোমাকে এ ক্ষতি পুষিয়ে দিব।ওটা তুমি বিনিয়োগ করেছো!
-হ্যারে, আগে বললে তো আমি তোকে ওখানে একখানা কারখানা করে দিতুম।
-কেন,আমাদের জমি কি আর নেই নাকী?
-ওগুলো তো পদ্মা খেয়ে ফেলছে। আজ করবি কাল গিলে খাবে।
-বাবা,তুমিই তো আমাদের কারখানা। তুমি বেঁচে থাকলে সব হয়ে যাবে। আমি তোমার সংসার সোনায় মুড়িয়ে দিব। তোমার নামে থানা আদালত সব থরথর করে কাঁপে। তুমি হচ্ছ আদমান চৌধুরীর সন্তান। লোকে বলে তোমার মধ্যে আদমান চৌধুরীর তেজ। এখন আমাদের হাতে একরাম চৌধুরীর সম্মান। আমি তোমাকে দুইয়ের মিলন ঘটিয়ে দিচ্ছি। তুমি এভাবে বলো না, জেঠি মা শুনতে পারলে মন খারাপ করবে।লোকের কানে গেলে ছিছি করবে। তুমি দেখে নিয়ো, জ্যাঠার শোকে ব্লাকমেইল করে আমাদের যারা ঠকিয়েছে আমি ঠিকই তাদের শিক্ষা দিব। আদমান চৌধুরীর সম্পত্তিতে তাল চাটলে জিহ্বা হারাতে হয়। ওদের প্রাণ হারাতে হবে। কথাগুলি হয় অত্যন্ত অনুচ্চ শব্দে। ওয়ারেছ কন্ঠটাকে বারবার কেটে নিয়ে খাটো করে আর এদিক ওদিক তাকায় যাতে বাড়ীর অন্য কানে কথাগুলি না যায়। শিশু লামিয়া কেবলি ফ্যাল ফ্যাল করে একবার বাবা আরেকবার ভাইয়ের মুখের দিকে অব্যক্ত চোখে তাকিয়ে থাকে।
-এতবড় সম্পত্তির বাজার মূল্য কত জানিস? আর এমরানের পেটে এত বিদ্যে মাথায় এই বুদ্ধিটুকু আসল না!
-ওকে জ্যাঠার সরলতা পেয়ে বসেছে।কিছুদিন পরে ঠিক হয়ে যাবে। রাস্তায় একটা গাড়ীর শব্দে থেমে যায় ওয়ারেছ। কান খাড়া করে তাকায় দু’জন। একসময় মনে হয় বাড়ীর গেটেই পার্ক করল গাড়ীটি। নিজাম চৌধুরী ওয়ারেছকে দেখতে বলে লামিয়াকে কোলে নিয়ে ভেতরে ঢুকে যায়।ওয়ারেছ এগোয় গেটের দিকে।
গেট দিয়ে ঢোকে এমরান। ওয়ারেছকে সামনে পেয়েই সালাম দেয়।
-কি দাদা ভাই,গেটে গাড়ী মনে হয়?
-হ্যাঁ,ভাইজান।প্রিন্সিপাল স্যার আর হেড স্যার এসেছেন।আমতা আমতা গলায় বলে এমরান।
-হ্যাঁ, তো বাইরে কেন? গেট খুলে দাও।গাড়ী ভেতরে ঢুকুক।তুমি না……
-জি ভাইজান।বলেই এমরান হুক উঠিয়ে গেটের দু’পাল্লা দু’দিকে খুলে দেয়।ততক্ষণে প্রধান শিক্ষক মহোদয় গাড়ী থেকে নেমে দাঁড়িয়েছেন।গেট খুলতে দেখে আবার গাড়ীতে বসে পড়েন। গাড়ী যখন ওয়ারেছকে অতিক্রম করে তখন সে মাথা নূইয়ে অতিথিদের সালাম দেয়।আবার জায়গা মত দাঁড়াতেই দৌড়ে গিয়ে গাড়ীর দরজা খুলে বিনয় ভরে অতিথিদের নামতে সাহায্য করে।ওয়ারেছের এই বিনয় পর্বে আগত সবাই অবিভূত হয়ে পড়ে।
-আমরা এসেছিলাম একরামের কবরটা জেয়ারত করতে। আজ কলেজের ৫০ বছর পূর্তিও ছিল। অনুষ্ঠানে মিডিয়ার গাড়ীটি এসেছিল।তোমার বাবার ঐ মহৎ কাজের কথা শুনে ওরা কিছু্তেই না এসে ছাড়ছিল না। কি আর করবে? ভাল কাজের কথা কি আর চেপে থাকে? রাষ্ট্র হয়ে দিগন্তে ছড়িয়ে পড়ে। চৌধুরী সাহেবের পায়ের ধূলো নিয়ে এই পূণ্যি কাজের ধন্যবাদটা জানিয়ে যাই। নইলে যে আরও দেরী হয়ে যাবে।
-এভাবে বলছেন স্যার? আপনারা হলেন সম্মানীয় ব্যক্তি। আপনাদের পায়ের ধূলি চৌধুরী বাড়ীর কাছে খুবই সম্মানের।এটা আমাদের পরম পাওয়া। আমি আপনাদের আনতেই যাচ্ছিলাম।
-বেঁচে থাক বাবা। তা চৌধুরী সাহেব আছেন তো?
-হ্যাঁ, আব্বা নামাজ পড়ে এসে হয়ত গা এলিয়ে দিয়েছেন।আপনারা বৈঠকখানায় বসেন আমি আব্বাকে ডেকে দিচ্ছি।
-আচ্ছা, একটু দেখ তো বাবা। চৌধুরীর সাথে কথা বলে প্রাণটা জুড়িয়ে যাই।
জাতীয় পত্রিকার জেলা প্রতিনিধি গৌতম সরকার।দূর্বোধ্যতার প্রতি বরাবরই তার আকর্ষণ।মিডিয়ার লোকদের সাথে ঈদগাহ মাঠ ও কবর জিয়ারতের একটা সচিত্র প্রতিবেদন তৈরীর যাবতীয় উপকরণ পেয়ে গেছেন। এমন লোকালয়ে এই স্বতস্ফূর্ত আলেখ্যে সে অবিভূত। একটা মামূলী অনুষ্ঠান কভার করতে এসে আরেক কাব্যের সন্ধ্যান! অত্যন্ত যত্নে সে অবলোকন করছে এই গাও গেরামের মানুষদের সহজ-সরল অভিব্যক্তি,স্বতস্ফূর্ত উম্মাদনা। কিন্তু সেই উম্মাদনার পিছনে যে শক্তিটি ছায়া হয়ে কাজ করছে তাকে নিয়ে কিছু না লিখলে যে পাঠকের কাছে প্রশ্ন থেকে যাবে। এক অজানা সমীকরণ নিয়ে এই বাড়ীতে আসা।কেননা শক্তির পেছনে আছে একটা নিষিদ্ধ জীবনের ইতিহাস। তার মোহপাশ চিড়ে সে কতটুকু স্বাভাবিকতায় স্থিতি নিয়েছে তা হয়ত দুদন্ড আলোচনায় কিঞ্চিৎ বোঝা যাবে। কিন্তু দৃষ্টির বহিরাঙ্গন যথেষ্টই সমৃদ্ধ।যেখানে দ্বন্দের কোন অবকাশ নেই। নইলে দু দুটো প্রতিষ্ঠানের দু’দুজন পন্ডিত ব্যক্তি এই ভর দুপুরে তাকে সঙ্গ দিত না। একরাশ উৎসাহ পবিত্র ভক্তির আরাধ্যতায় নূইয়ে পড়ছে।সেখানে নেই কোন সন্দেহ,কোন প্রশ্ন।
সুশীল ফোনটা Silent করেই চৌধুরী বাড়ীতে ঢুকেছিল। কিন্তু বের হয়ে তার অভিজ্ঞতা টিমের কারও কারও সাথে শেয়ার করে নিয়েছে।কথাটা গৌতম সরকারের কানেও পৌছেছে। সেজন্য গাড়ীতে টিমের সব লোকের আসা হয়নি। কেউ কেউ রিক্সায় চড়ে নদীর ধারে গিয়েছে।সেখানে সুশীলও আছে।
এদিকে বাড়ীর পিছন আঙিনায় চলছে মহা আয়োজন। পিছনের পুকুর থেকে আজ কোন প্রয়োজনে কিছু বড় মাছ ধরা হয়েছে। ওয়ারেছ অতিথিদেরকে বৈঠকখানায় চালান করে দিয়েই নিজে সোজা ছুটে গিয়েছে পিছনের আঙিনায়।সেখানে বাড়ীর জন্য দুপুরের রান্না প্রায় শেষ হয়ে এসেছিল।কিন্তু এই ভর দুপুরে বাড়ী বইয়ে আসা সন্মানকে ওয়ারেছ খালি মুখে ফেরত দিতে চায় না।কথাটা জানান দিতেই অন্দর মহলে অনেকটা উৎসবের ধূম পড়ে গেল।
-স্যার, আব্বা বলছিলেন আজ দুপুরের খানাটা আপনাদের সাথে খাবেন।আম্মা,জেঠিমা সবাই বলছেন। আমাদেরকে নিরাশ করবেন না। দরজায় দাঁড়িয়ে বিনয়ের সাথে কথাগুলি বলে ফেলল ওয়ারেছ।
-সে কি! তোমার বাবার সাথে দুটো কথা বলেই উঠতে চাচ্ছিলাম।
-কোন দিন আমাদের এ সৌভাগ্য হয়নি।খোদার ইশারায় আজ যখন আপনাদের পদধূলি পেয়েছি তখন ছোট্র এইটুকু খেদমত করতে দিন, স্যার।
-আমরা ছাড়াও লোক তো আরও আছে। বলেই প্রিন্সিপাল গৌতম সরকারের মুখের দিকে তাকায়।
-এমরানের কাছে শুনে ধারণা পেয়েছি। বেশি না স্যার, কয়েকটা মাছ ভাতের আয়োজন। সাংবাদিক ভাইদের সবাইকে সাথে করেই খাব।
-ভালই হয়। কিন্তু আপনাদেরকে বাড়তি ঝামেলায় ফেলে দিলাম। বলে গৌতম সরকার।
-ভাইজান,অতিথি হ’ল খোদার আর্শীবাদ। সেবা করার সৌভাগ্য সবার হয় না। একে ঝামেলা বলছেন কেন? কর্তব্য। ঠিক এই মহূর্তে এমরান প্লেটে প্লেটে কিছু পেয়ারা ও মিষ্টি নিয়ে রুমে ঢুকল।ওয়ারেছ তা সুন্দরভাবে পরিবেশন করার কথা বলে আবার উধাও হয়ে যায়।
-এই হ’ল আমাদের চৌধুরী বাড়ী। গৌতম সরকারের দিকে তৃপ্তির সুরে কথাটি ছেড়ে একখানা পেয়ারা তুলে নেয় প্রধান শিক্ষক।
-আস্সালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লা।নাস্তা পর্ব শেষের দিকে।এমন সময় ধীর পায়ে রুমে প্রবেশ করতে করতে সালাম দেয় নিজাম চৌধুরী। গায়ে আলখেল্লা ঢিলেঢালা সাদা জোব্বা।মুখে কালো চাপ দাঁড়ি ।মাথায় পাগড়ী নেই কিন্তু একখানা গোল টুপিতে চুল বাদে পুরো মাথার শুভ্রতা পবিত্রতা চাদরে ঢেকে দিয়েছে।বাম হাতে ধরা একখানা ধর্মীয় পস্তুক। আতরের ঘ্রাণে মহুর্তে পুরো রুম ভরে ওঠে। সাদা পোষাকে স্বর্গীয় দূতের মতই প্রবেশ।ঘটনার আকস্মিকতায় রুমের সবাই উঠে দাঁড়িয়েছে। একে অন্যের দিকে তাকাচ্ছে।
-স্যার, কাকা। এমরান বলে।
-ওহ! তাই বল। চিনতে পারিনি। বলে প্রিন্সিপাল।
-নামাজ পড়ে এসে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, স্যার।বসিয়ে রেখেছিলাম বলে বেয়াদবি নিবেন না।
-না দেখা করে যেতে ইচ্ছে হচ্ছিল না।তাই ঠিটু ধরে বসে আছি।
-কি যে বলেন স্যার, সে তো আমার পরম পাওয়া। মেয়েটা বুকের মধ্যেই ছিল।চোখ না বুঝে কিছুতেই ছাড়ছিল না।একমাত্র মেয়ে কিনা তাই।
-তোমার মসজিদে জোহরের নামাজ পড়লাম।
-কোথায় ঈদমাঠে ! ঐ রোদের মধ্যে?
-হ্যাঁ,কি যে সুন্দর লাগছিল! এমরান সব ব্যবস্থা করে দিয়েছিল।
-ওদিকটা খুব একটা যেতে পারি না।ছেলেপেলেগুলো কেমন করে যে সব চালাচ্ছে!
-আসলে আব্বাকে আমরাই ওদিকে যেতে দিতে চাইনে। ওখানে গেলেই আব্বা কেমন যেন হয়ে যায়। বাড়ীতে এসে জ্যাঠার রুমে গিয়ে মনমড়া হয়ে বসে থাকে। রুমে ঢুকতে ঢুকতে কথাগুলো কেড়ে নিয়ে বলে ওয়ারেছ।
-তা হ’লে তো চলবে না, নিজাম। তোমাকে আরও শক্ত হতে হবে। এমরান বেঁচে আছে আমাদের সবার মাঝে। তুমি যা করেছ এখন বাকী কাজটা আমাদের। বলে প্রধান শিক্ষক।
-কি আর করলাম! এতটুকুন জমি। একসাথে মাঠ-মাদ্রাসা আবার মসজিদ।আর কিছুটা জমি হলে মাদ্রাসার জায়গা হ’ত। কিন্তু আমাদের তো ওখানে আর জায়গা নেই।
-সে তোমাকে ভাবতে হবে না। আপাতত মসজিদ আর মাঠটা হয়ে যাক।মাদ্রাসার ব্যাপারটা নিয়ে কবরস্থানের সামনের জমিটা নিয়ে কথা হচ্ছে।মাষ্টারের ভাই খুব শিঘ্রই গ্রামে আসছে।কি মাস্টার কথা তো?
-হ্যাঁ ভাইজান কথা দিয়েছেন। এখন চৌধুরীর সাথে কথা বলাটা বাকী।
-জমি তোমার ভাইয়ের।চৌধুরীর সাথে কথা বলার কি আছে?
-আমরা জমি চৌধুরীর হাতেই দিব। তারপর এই বরকতের হাত দিয়ে যে কাজে লাগবে আমরা তাতেই খুশি।
-তো হয়ে গেল।
-ভাইয়ের সাথে এভাবেই কথা। চৌধুরী আমাদের ঐক্যের প্রতীক। চৌধুরীর ঐ পবিত্র মুখে মসজিদ-মাদ্রাসা-ঈদগাহের কথা বের হয়েছে।আমরা সেই মুখের অসন্মান করব না। আমরা নাম মাত্র মুল্যে চৌধুরীর নামে লিখে দিব।ব্যস চৌধুরীর জমিতেই মাদাসা গড়ে উঠবে।চৌধুরী বাড়ীতে দাঁড়িয়ে এ আমার মৌখিক দলিল।শেষের কথাগুলি আবেগে আড়ষ্টতায় মাস্টারের মুখে জড়িয়ে যায়।ততক্ষণে নিজাম চৌধুরীর চোখেও পানি চিকচিক করছে।দৌড়ে গিয়ে মাথা নীচু করে মাস্টার প্রিন্সিপালের পায়ে পড়ে সালাম করে।দু’জন আদর মেখে চৌধুরীর নীচু মাথায় হাত বুলিয়ে আর্শীবাদ করে। রুমে দাঁড়িয়ে বাকী সব সদস্য বোবা চোখে কেবলি এ দৃশ্যের যবনিকাপাত দেখে।ওয়ারেছ অত্যন্ত্য যত্নে পিতাকে এই ধর্মীয় পোষাক পড়িয়ে হাতে একখানা ধর্মীয় পুস্তক ধরিয়ে দিয়ে যে আবেগের মঞ্চস্থ করেছিল এক্ষণে তা এই প্রাকৃতিক মিশ্রণে পরিপূর্ণতা নিল।অজানা ভয়ে ওয়ারেছের হিসেবটা যেন ক্ষণিক হোঁচট খেল।
(চলবে)