রাত্রী সাড়ে ৯টা গ্রামের ভাষায় অনেক রাত।খেটে খাওয়া মানুষেরা কেউ ঘুমিয়েছে, কারও ঘুমের আয়োজন চলছে। ঠিক এমনি সময় পাড়ার মসজিদের মাইক বেজে উঠে একরাম চৌধুরীর মৃত্যু সংবাদ ঘোষণা করল। সুস্থ সবল মানুষ। বৈঠক খানায় পরিবারের অন্যান্য সবার সাথে বসে দরকারী কথা বলছিলেন। কথা বলতে বলতে বুকে ব্যথা,ক্রমেই বেশি।তাড়াতাড়ি থানা সদরের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।এর বেশি সময় দেননি।
রামচন্দ্রপুর চৌধুরী বাড়ীর বড় ছেলে একরাম চৌধুরী। আশপাশের আট-দশটি গ্রামের সবার কাছে শ্রদ্ধার পাত্র। সদরের কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে গ্রামেই একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুল খুলে দিনটা সেখানেই কাটাতেন। আর সন্ধ্যে পরে যতটুকু পারতেন বাজারের দোকানে বসে মানুষকে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা সেবা দিতেন। বৈঠক শেষে আজও বসতে চেয়েছিলেন।
সদরের শিক্ষিত সমাজের সাথে চৌধুরী পরিবারের যে সম্পর্ক তা কেবল একরাম চৌধুরীর মাধ্যমেই সম্ভব হয়েছে। দূর গ্রাম ও থানা সদরের সাথে স্থল যোগাযোগের একমাত্র রাস্তা যেটিতে ইট-সুরকির আচ্ছাদন পড়েছে তাও তারই অবদান। কৃতজ্ঞতায় গ্রামের লোক ও ভদ্রসমাজ তাকে দেখলেই নূইয়ে পড়ে।
এলাকায় চৌধুরী পরিবারের একটা কুখ্যাতি আছে। একরাম চৌধুরীর পিতা আদমান চৌধুরীর ভয়ে বলা চলে বাঘে মহিষে একঘাটে জল খেত। এলাকায় হেন কোন অপরাধ নেই তার দ্বারা হয়নি। জোর জুলুম হত্যা গুম ছিল তার নেশা।
রামচন্দ্রপুর বৃটিশ আমল থেকেই খাতা কলমে দূর্গম।বিশাল মাঠের একপাশে চরের মতই অবস্থান।এখনও দূরের গ্রামগুলি,পদ্মা,সংযুক্ত যমুনা ও তৎসংলগ্ন নদীগুলোতে যত ডাকাতি সবই এ গ্রাম থেকে হয়। মৎস্য আহরণের আড়ালে গ্রামের একটি অংশের পেশা হল ডাকাতি। আর চৌধুরী বাড়ীর নিজাম চৌধুরীর পৃষ্টপোষকতায় এখন চলছে সব। মানুষ মারা তার কাছে পিঁপড়ে মারার সমতুল্য। আশপাশের দশ গ্রামের মানুষতো বটেই খোদ থানা কোন মামলা নিতে গেলেও ভয়ে জবুথবু হয়ে পড়ে।নিজাম ডাকাত বললে বনের হরিণও দৌড়ে আশ্রয় খোঁজে।
চোধুরী বাড়ীর সম্মুখ ভাগটা ফুটবল মাঠের মত বিশাল উঠান। সকাল ১০টায় এখানেই জানাজার স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে।কয়েক গজ দূরে রাস্তার পাশেই পাড়ার মসজিদ। সকাল সাড়ে ৯টায়ই উঠান মুসল্লিতে কানায় কানায় পূরণ হয়ে গেল।মৃতের খাটিয়া ঈমামের সামনে আনলে সবাই সাঁড় বেঁধে দাঁড়িয়ে যায়।
ঈমামের অনুমতি নিয়ে মৃতের বড় ছেলে সবার কাছে পিতার ভূল-ক্রুটির ক্ষমা চেয়ে নেন।পাশে নিজাম চৌধুরী কেবল নিবিস্ট মনে তাকিয়ে আছে সমাগত মুসল্লির দিকে। কত মানুষকে নিজ হাতে মেরে পিছন ফিরে দেখেননি। কোন মানুষের জানাজায় এত মানুষ হয় তাও ভাবেননি,দেখাতো দূরের কথা। জন্মদাতা পিতারও এই স্থানে জানাজা হয়েছিল।কাতার হয়েছিল বড়জোড় তিনটে। কাউকে কাউকে তাগাদা দিয়ে বাড়ী থেকে ডেকে আনতে হয়েছিল।এসব ভাবতেই বড় ভাইয়ের প্রতি পবিত্র শ্রদ্ধায় নিজাম চৌধুরীর মস্তক নত হয়ে এল।
রামচন্দ্রপুর থেকে বেরিয়ে ইট-সুরকির রাস্তাটি একটি বিশাল মাঠ পেরিয়ে কুসুমপুরের ভেতর দিয়ে গিয়ে আরেকটি মাঠ মাড়িয়ে সদরে মিশেছে। রামচন্দ্রপুর-কুসুমপুর মাঠের ঠিক মাঝখানে রাস্তার বামপার্শ্বে কবরস্থান। মালিকানা দু’গ্রামের সমান সমান। এখানেই একরাম চৌধুরী চিরদিনের জন্য শায়িত হবেন।
জানাজা পর্ব শেষে লাশ কবরস্থানে আনার পথেই দেখা গেল কুসুমপুরের দিক থেকে অগণিত লোক রামচন্দ্রপুরের দিকে আসছে। একরাম চৌধুরীর লাশ আসছে জেনে সবাই কবরস্থান বরাবর রাস্তায় দাঁড়িয়ে গেলেন।কাছাকাছি আসতেই সমুস্বরে আরেকবার জানাজা পড়ানোর অনুরোধ ধ্বনিত হতে লাগল।
কবরস্থানের ঠিক বামপাশটায় রাস্তা ঘেঁষে চৌধুরী পরিবারেরই একটা পতিত জমি। ঈমাম সাহেবের সাথে পরামর্শ করে এখানেই আরেকবার জানাজা পড়ানো হবে বলে স্থির হ’ল। সবার সাথে পরামর্শ মতে দুই গ্রামের বাদ পড়া জানাজাচ্ছুক সকলেই যাতে দ্বিতীয় জানাজায় শরিক হতে পারে এজন্য বেলা ১২টা সময় নির্ধারণ হল। দু’গ্রামের সব মসজিদের মাইকে মাইকে বারংবার ঘোষণা আর মুখে মুখে শুনে অনেকটা কৌতূহলবশত মানুষে মানুষে কবরস্থান লোকারণ্য হয়ে গেল।
চারিদিকে দিগন্ত বিস্তৃত ফসলের ক্ষেত।এর একপাশে রাস্তা রেখে
মাঝখানে কবরস্থানটি। কয়েক বছর আগেও বাঁশ, ছোন বনে দিনের বেলায়ও কেমন আলো আঁধারী হয়ে থাকত। এখন কেবল বাঁশ আছে। ছোন বন কেটে মাঝখান দিয়ে একটা রাস্তা টেনে তার দু’পাশটাতে নানাজাতের ফুলের চারা লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। কবরস্থানের এ পাশটাতে দাঁড়ালে ওপাশটা স্পষ্ট দেখা যায়। জায়গায় জায়গায় স্থাপিত সোডিয়াম লাইটের পোস্টগুলিও জানান দিচ্ছে রাতের পরিবেশটা কেমন থাকে। এটাও একরাম চৌধুরীর অবদান।
নিজাম চৌধুরীও ভাইয়ের লাশের সাথে এসেছেন। পিতার সাথেও এসেছিলেন। কিন্তু তখন অসংখ্য লতাগুল্মে আচ্ছাদিত ছোট ছোট গাছ,বাঁশ,ছোন বন আর সাথে চারপাশের ধানক্ষেতে ঘেরা এই শয়নক্ষেত্রটিকে প্রকৃতই যমের ঘর বলে মনে হয়েছিল। কেবলি মনে হয়েছে-“ক্রোধে পিষ্ট নরগুলির নির্বাসনের উপযুক্ত স্থান বটে।”
সময় আছে জেনে নিজাম চৌধুরী কবরস্থানের উপরে উঠে যায়। জায়গায় জায়গায় জমায়িত লোক পিতা-মাতা বা আত্বীয়-স্বজনের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে দোয়া দরুদ পড়ছে। সাথের লোকজন আরও উপরে উত্তর দিকটাতে আঙুল দেখিয়ে বললেন ঐখানটাতেই একরাম চৌধুরীর কবর খোড়া হয়েছে।লোকগুলিকে সাথে করেই নিজাম চৌধুরী কবরটির কাছে গেলেন।
উত্তর পাশের জামগাছটির নীচেই কবরটি খোড়া হয়েছে। বেলা তেঁতে গেছে অনেকক্ষণ আগেই। গুমোট ভ্যাপসা গরমের মধ্যেও স্থানটিতে ঝিরিঝিরি বাতাসে যেন স্বর্গীয় একটা আবেশ বয়ে যাচ্ছে। কবরের পাশে তখনও খুন্তি কোদাল। নীচে চারপাশে পাড় কাটা ঝকঝকে নতুন কবর।এখানেই শায়িত হবেন বড় ভাই একরাম চৌধুরী। যে কিনা গতকালও একসাথে বসে কথা বলেছেন। শরীরের কোথাও কাটাছেঁড়ার চিহ্ন নেই। নিজাম চৌধুরী নিজেও একজন মানুষরুপি আজরাইল। মৃত্যুর সময় কতজনের কত কাকুতি মিনতি কাতরুক্তি রক্ত জখম দেখেছেন। প্রিয় মানুষটির মৃত্যুতে এসবের লেশমাত্র নেই। তবে কোন ঘাতকের আঘাতে এই নিঃশব্দে প্রয়াণ! এই নিরব নিঃশব্দ অক্ষত বিয়োগের কে সেই মহাশক্তি ? ডানপাশে শান বাঁধা আরেকটি কবর। মাথার দিকে নাম ফলকে লেখা মরহুম আদমান চৌধুরী। যার হাতে তার অপরাধ সাম্রাজ্যের হাতেখড়ি।সেই গুরুমহের কবরের ঠিক মাঝ বরাবর একটি বাঁশের ঝোঁপ গজিয়ে আপন ঠিকানা করে নিয়েছে। দক্ষিণ মাঠের পুরাটার মালিক যে আদমান চৌধুরী সে কিনা একটা ভাঙা জীর্ণ কবরে শুয়ে আছেন! হায়রে জীবন! এই জীবনের জন্যই কি এত কিছু ? কথাগুলি ভাবতেই নিজাম চৌধুরীর দু’চোখ-মুখ বেয়ে ঝরঝর করে পানি পড়তে লাগল। পিতা-ভাইয়ের মৃত্যুর পর এই প্রথম নিজাম চৌধুরীর পাষাণবেদী চোখ দিয়ে কেউ পানি ঝরতে দেখল।
দ্বিতীয় নামাজে জানাজাতেও সাড়ে সাত বিঘা জমির প্রায় অর্ধেকটা পূরণ হয়ে গেছে। ঈমামতি করতে কুসুমপুর গ্রামের বড় মসজিদের ঈমাম সাহেব এসেছেন। পাশে আইলের উপর চকিত নেত্রে দাঁড়িয়ে নিজাম চৌধুরী। চোখে মুখে একেবারে বিধ্বস্থ অবস্থা। ডানপাশে গাছগাছালিতে ঘেঁরা বিশাল কবরস্থান। আর বামপাশে সফেদ টুপির বিশাল জমায়েত। কোন্থেকে এলো এত মানুষ ?
-প্রিয় ভাই সকল। আমাদের সৌভাগ্য যে আমরা আমাদের মাঝে কুসুমপুর গ্রামের বড় মসজিদের ঈমাম সাহেবকে পেয়েছি। এখন ঈমাম সাহেবের অনুমতি নিয়ে একটা বিতর্ক দূর করনের জন্য কয়েকটা কথা বলতে চাই। বলেই প্রথম জানাজা পড়ানো ঈমাম সাহেব কুসুমপুর গ্রামের বড় মসজিদের ঈমাম সাহেবের দিকে তাকালেন।
-বলুন যা বলতে চান।
-মৃত ব্যক্তির মাগফিরাতের উদ্দেশ্যে জানাজার নামাজ আদায় করা ফরজে কিফায়াহ।আর ইসলামী শরিয়তে তা একবার আদায় করার নিয়ম।কিছু মুসলমান এ নামাজ আদায় করলে এর ফরজিয়ত পালিত হয়ে যায়। আর এ নামাজটি এমন ফরজ, যার নফল আদায়ের সুযোগ নেই।তবে মৃতের ওলি বা অভিভাবক কোনো বাস্তবসম্মত কারণে জানাজা থেকে বাদ পড়লে তিনি আরো একবার জানাজা নামাজ পড়তে পারেন। সেখানে জানাজাবঞ্চিত আর কেউ থাকলে তারাও ওলির সাথে নামাজে শরিক হতে পারবেন।
আপনারা সবাই জানেন একরাম সাহেব সদরে থেকে কলেজে পড়তেন। তখন হুজুর সাহেব ছিলেন সদর মসজিদের ঈমাম।হুজুরের সঙ্গী হয়ে চৌধুরী সাহেব বেশ কয়েকবার তাবলীগও করেছেন। আমরা আজ যে একরাম চৌধুরীকে পেয়েছিলাম তা কেবল এই হুজুরের কল্যাণে।হুজুর আপন কণ্যার বিবাহ কার্যে গ্রামে গিয়েছিলেন।কিন্তু গত দুইদিন থেকে হুজুরের নিজের মোবাইল নাম্বারটি বন্ধ পাওয়ার কারণে আমরা ইচ্ছা সত্বেও যোগাযোগ করতে পারিনি। আজ কুসুমপুর থেকে আক্কাছ চাচা হুজুরের গ্রামের মসজিদের ঈমাম সাহেবের মাধ্যমে হুজুরের সাথে যোগাযোগ করতে সক্ষম হন। চৌধুরী সাহেবের মৃত্যুর খবর শুনে হুজুর সাথে সাথে একটা মোটর সাইকেল ঠিক করে রওনা দেন।লাশ নিয়ে আমরা যখন কবরস্থানের মুখে তখনই খবরটি শুনতে পাই। আমরা ঐ ঈমাম সাহেবের মাধ্যমে মোটর সাইকেল ওয়ালার মোবাইল নাম্বার সংগ্রহ করে হুজরের সাথে কথা বলি।হুজুর আমাদেরকে বেলা ১২টার সময় নির্ধারণ করে দেন।এই অনাহুত পরিস্থিতির জন্য আমরা সবাই লজ্জিত এবং ক্ষমা প্রার্থী।এখন আমি হুজুর সাহেবকে তার প্রিয় ভক্তের বাকী কাজ সম্পন্ন করার জন্য অনুরোধ করছি।
-হুজুর, অনুমতি দিলে আমি আমাদের সবার পক্ষে কিছু কথা বলতাম। সামনের কাতার থেকে বলেন আক্কাছ মিয়া।
-অবশ্যই বলবেন।সামনে এসে বলুন। বলে হুজুর।
-উপস্থিত ভাই সকল,আমরা আজ এমন একজন মানুষকে হারালাম যে ছিলেন আমাদের দু’গ্রামের সকলের কাছে ব্রীজ স্বরুপ।কুসুমপুর গ্রামের পরে কোন মানব বসতি আছে তা আগে কেউ জানত না। রামচন্দ্রপুর নামক বসতি খুঁজতে হয় পদ্মা নয়ত যমুনা ধরে এগুতে হ’ত।একরাম সাহেব গ্রামটিকে ভদ্রস্থ করে গেলেন।সেই সাথে কুসুমপুরকে বেঁধে গেলেন মিলনের বন্ধনে। উনি তেমন কেউ ছিলেন না। অথচ উনার কল্যাণেই এলাকার রাস্তা-ঘাট হয়েছে। ছেলেপেলে বখাটেপনা ছেড়ে দল বেঁধে স্কুল কলেজে যাচ্ছে তাও উনার কল্যাণে।দিনে দুপুরে শাপ শেয়ালের ভয়ে কেউ একা এই কবরস্থানে আসার সাহস পেত না। রাতে মাটি দিলে পরদিন সকালে আবার লাশের হাড় হাড্ডি পুনরায় কবর দিতে হ’ত।শেয়ালের তান্ডবের এ দৃশ্য ছিল নিত্যকার। বিগত কয়েক বৎসর থেকে দেখুন কবরস্থানটা কেমন ঝকঝকে তকতকে। রোদে ঘামা লোকজন এর ছায়ায় নির্ভয়ে বসে আজ দু’দন্ড জিরনও লয়।মৃতা মাটি দিয়ে আজ আমরা নিশ্চিন্তে বাড়ী গিয়ে ঘুমোতে পারি। এটাও সম্ভব হয়েছে কেবল একরাম সাহেবের উদ্যোগে। এমন একজন মানুষের জানাজা কেবল গ্রামের একটা মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়েই সারা হচ্ছিল। দূর গ্রামের আমরা তেমনটি কেউ জানিনা। রাতের আঁধারে যারা সওদা করে ফেরে তাদেরকেই কেবল এমনটি মানায়।তাই নয়কি ?
-এর জন্য আমরা সত্যই আপনাদের কাছে ক্ষমা প্রার্থী। এগিয়ে এসে জনতার উদ্দেশ্যে বলেন মৃতের বড় ছেলে।
-কবরস্থান একখানা বেহেস্থের জায়গা(আবার বলতে থাকেন আক্কাছ সাহেব)।এমন স্থানের সাথে মসজিদ-মাদ্রাসা,এতিমখানা বা ঈদগাঁহ রাখাটা সওয়াবের কাজ।একরাম চৌধুরীর কারণে আমরা দুইগ্রামের মানুষ এক নাড়ীতে বাঁধা হতে পেরেছি। আমাদের সৌভাগ্য চৌধুরী পরিবারেরই একান্ত নিজস্ব একটা জমিতে দাঁড়িয়ে আমরা চৌধুরী পরিবারেরই এক সন্তান আমাদের সবার প্রিয় মানুষটির জানাজা নামাজ পড়ছি। জমিটুকুন প্রায়ই আবাদহীন থাকে। ঔদ্ধত্য না নিলে চৌধুরী পরিবারের কাছে এর সম্পূর্ণ অংশ না হয় কিছু অংশ আমরা ভিক্ষা চাচ্ছি উল্লেখিত যে কোন একটি মহৎ কাজে ব্যবহারের জন্য।
-মারহাবা,মারহাবা।উত্তম প্রস্তাব,উত্তম প্রস্তাব।চৌধুরী সাহেব দয়া করে আমাদের প্রস্তাবটি ফেলে দেবেন না। নিজাম চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে সবাই সমুস্বরে বলতে থাকে।
-আমাদের গ্রামের ঈদগাঁহটি পদ্মা খেয়ে ফেলছে। তাহলে আমাদের ঈদগাহটিই এখানে চাই। রামচন্দ্রপুরের একজন জোয়ান ছেলে মাঝের কাতার থেকে বলে উঠে।
-ঈদের মাঠ হলে কেবল আপনারা কেন, আমরা কুসুমপুরের লোকজনও এখানে আপনাদের সাথে এই বেহেস্তখানার পাশে দাঁড়িয়ে ঈদের নামাজ আদায় করতে পারব। আজকের মত মৃতের জানাজা পড়ে সুন্দর মত তার শেষ কার্য করতে পারব। কিন্তু যাদের জমি তাদের সাহায্য ছাড়া এর কিছুই সম্ভব নয়। বলেন আক্কাছ সাহেব।
-আপনারা যা বলছেন তা খুবই সুন্দর প্রস্তাব। বিষয়টি আমাদেরই আগে ভাবা উচিৎ ছিল।জমির মালিক এখন যেহেতু সবাই।তাই আমরা আমাদের সবার মধ্যে কেবল একটু আলোচনা করার সময় চাচ্ছি।তবে ব্যক্তিগতভাবে আমার কোন আপত্তি নেই।আমাদের নিজেদের মধ্যে আলোচনার জন্য আমি একটু সময় চাচ্ছি।বলেন মৃতের বড় ছেলে।
-অবশ্যই আলোচনার বিষয়।আমরা চাচ্ছি, দেওয়া না দেওয়ার এখতিয়ার আপনাদের। আপনারা আলোচনা করে আমাদের প্রস্তাবটি রাখবেন,এটাই আশা করি। বলেন আক্কাছ মিয়া।
দাফন পর্ব শেষে আগত লোকেদের সবাই একে একে চলে যাচ্ছে।জানাজা পড়ানো দুই ঈমাম, নিজাম চৌধুরী,নিজ পুত্র ওয়ারেছ,মৃতের বড় ছেলে ও কুসুমপুরের আক্কাছ মিয়াসহ কিছুলোক এখনও কবর ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছেন। অনেকক্ষণ থেকে নিজাম চৌধুরী কি যেন বলতে গিয়েও বলতে পারছেন না। হঠাৎ নিজাম চৌধুরী কুসুমপুর গ্রামের বড় মসজিদের ঈমাম সাহেবের হাত ধরে হাউমাউ করে উচ্চস্বরে কাঁদা শুরু করলেন। ঘটনার আকস্মিকতায় ঘরমুখো লোকগুলির চোখ এদিকে ফিরে তাকায়। উৎসাহী কেউ কেউ ফিরেও আসে।
-চৌধুরী সাহেব,শান্ত হোন,শান্ত হোন। একদিন সবাইকে এই নশ্বর পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে যেতে হবে। বলে শান্ত্বনা দেন ঈমাম সাহেব।
-না হুজুর, আমি জীবনে অনেক পাপ করেছি। আমি আর ঐ পাপ করতে চাইনা।আমার জন্য আপনারা দোয়া করবেন। হুজুর সাহেব(প্রথম জানাজা পড়ানো ঈমাম), আপনি আমাকে সব শিখিয়ে দেবেন। আমি এখন থেকে মসজিদে গিয়ে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ বেঁধে পড়ব।
-চৌধুরী সাহেব, আপনী শান্ত হোন,শান্ত হোন। হেদায়েতের মালিক আল্লাহ। ক্ষমা করার মালিকও তিনি। বলেন প্রথম জানাজা পড়ানো ঈমাম।
-আক্কাছ কাকা, আক্কাছ কাকা। আপনারা আমাদের জমি চাচ্ছিলেন। আমার কোন আপত্তি নেই। আপনারা বলুন আমার কি সাহায্য লাগবে? অংশ কেন? পুরোটুকুই নিয়ে নিন। যাতে ঈদের মাঠ-,মাদ্রাসা-,মসজিদ একত্রে হয়ে যায়।আজকেই সব শুরু করুন। কি করতে হবে আমাকে বলুন।
--চৌধুরী সাহেব, আপনী শান্ত হোন। আপনী যেহেতু রাজি আছেন তাহলে আর চিন্তে নেই। এবার আপনিই দায়িত্ব নিয়ে এই মহৎ কাজটি করে দেন। আমরা সবাই আপনার সাথে থাকব।
-আহ্ কি সৌভাগ্য। আপনারা সবাই আমাকে ক্ষমা করবেন আর আমার জন্য দোয়া করবেন।
কবরস্থান থেকে ফিরে গোসল শেষে নিজাম চোধুরী সরাসরি চলে এসেছেন বাড়ীর ওপাড়ে মসজিদে জোহরের নামাজ পড়তে। ঈমাম সাহেব যিনি একরাম চৌধুরীর প্রথম জানাজা পড়িয়েছিলেন নিজাম চোধুরীর মসজিদে প্রবেশ করতে দেখে অতিশয় ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লেন। হাত ধরে এনে প্রথম কাতারের ঠিক ঈমামের পিছনে এনে বসিয়ে দিলেন।কানে কানে কেবল তাকে অনুসরণ ও আরও আনুসাঙ্গিক কিছু বিষয় স্বরণ করে দিয়ে ঈমাম সাহেব সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন।ঈমাম সাহেবকে দাঁড়াতে দেখে পিছনের মুসল্লিরাও দাঁড়িয়ে গেছেন। অন্যান্য দিনের মত ওয়াক্ত নামাজে আজ মুসল্লি অপেক্ষাকৃত একটু বেশিই হয়েছে। পরিচিত মুরুব্বিদের পাশাপাশি কয়েকজন তরুণ যুবাও এসেছে।মুয়াজ্জিন ইকামত দেয়া শুরু করতেই নিজাম সাহেব তাকে থামিয়ে দিলেন।
-প্রিয় মুসল্লিগিণ, আপনারা একটু বসুন। আমি কয়েকটা দরকারী কথা বলব। নিজাম চৌধুরীর কথায় সবাই আস্তে আস্তে আবার বসে পড়ে।
আজ আপনারা আমার ভাইয়ের কবরস্থান সংলগন্ন জানাজায় যারা যারা শরিক হয়েছিলেন তারা হয়ত শুনেছেন আমাদের কবরস্থান সংলগন্ন জমির কথা। এতে আমার কোন আপত্তি নেই। পরিবারের সবার পক্ষ থেকে দায়িত্ব নিয়ে পুরো জমিটি আমি এই পবিত্র মসজিদে দাঁড়িয়ে ঈদগাহ সাথে একটি মাদ্রাসা ও মসজিদ স্থাপনের জন্য দান করলাম। সেই সাথে অনুরোধ করব সামনের ইদুল ফিতরের নামাজ যেন আমরা সবাই মিলে ওখানে পড়তে পারি আসুন আমরা সে ব্যবস্থায় নেমে পড়ি।চৌধুরী সাহেবের কথা শেষ হবার আগেই পুরো মসজিদ ভবন মারহাবা-মারহাবা,নারায়ে তকবীর-আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে প্রকম্পিত হয়ে উঠল।
ভাই সকল আগামীকাল থেকেই যাতে মাটিকাটা ও অন্যান্য কাজ শুরু করা যায় তার জন্য আমি নিজে আপনাদের সামনে এই মসজিদের ঈমাম সাহেবের হাতে নগদ এক লক্ষ টাকা দান করলাম।বলেই পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা পুটলি বের করে নিজাম চৌধুরী ঈমাম সাহেবের হাতে তুলে দিলেন। আরেকবার মসজিদ ভবনটি মারহাবা-মারহাবা,নারায়ে তকবীর-আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে প্রকম্পিত হয়ে উঠল।
(চলবে)