ইতিহাসের এ-এক নির্মম প্রতিশোধ যে সবসময় সে খ্যাতিকে উজ্জ্বল করে না; আবার অখ্যাতিকেও অনেক সময় এনে দেয় তারকা খ্যাতি। কত চোর-বাটপার যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে ‘জাতীয় বীর’ হয়ে যান, আবার কত আবুজর গিফারী (রা

দিলরাজ বানু বেগম ছিলেন ইরানের রাজকন্যা। তার বিশ্ববিখ্যাত শাশুড়ি মমতাজমহলের মত তিনিও সন্তান জন্মদানজনিত জটিলতায় মারা যান। স্বামীর উপর শিয়া এই মহিলার প্রভাব ছিল সাংঘাতিক। তারই সন্তান কবি জেবুন্নিসা ছিলেন আওরঙ্গজেবের প্রিয়তমা কন্যা (যার কবি-তখল্লুস--মাখফি); রূপে-গুণে মুগ্ধ হয়ে যাকে বিয়ের পয়গাম পাঠিয়েছিলেন তৎকালীন দি¦তীয়-বিশ্বশক্তি পারস্যের যুবরাজ মির্জা ফারুক। কিন্তু বরাবরের মতই অহংকারে গর্বিতা মোঘল-রাজকন্যা এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। আবার কাব্য করে তীর ছোড়েন--
‘মাখফি, হে-তুমি প্রেমের কাঙাল
কাউকে পাবে না, জানি
ভাগ্য তোমার ‘যিশুর’ মতই
কাউকে নেবে না মানি।’
স¤্রাট শাজাহান চেয়েছিলেন--জেবুন্নিসার বিয়ে হোক, দারাশিকোর পুত্র সুলেমান শিকোহ’র সাথে। বাবা আওরঙ্গজেব চেয়েছিলেন আরেক ভাতিজাকে পসন্দ করুক কন্যা। কিন্তুএই সব অনিন্দ্য-সুন্দরী মোঘল গর্বিতা-রাজকন্যাদের অনেকেই রহস্যজনক কারণে পৃথিবীকে বঞ্চিত করে গেছেন তাদের সাহচর্য থেকে--হয় হিন্দু ধর্মের ব্রক্ষ্মচর্য নাহয় সুফীতত্ত্বের ফানাহ’য় প্রভাবিত হয়ে। যদিও লাহোরের গভর্নর কবি আকিল খান রাজির সাথে তার ‘প্রেম’ ও ‘প্রণয়ের’ গুজব আকাশচুম্বী, তবু তিনি অক্ষর হয়ে আছেন তার কবিতার--
রয়েছে তোমার বাঁকা কালো চুল
নি:শ্বাস-কাড়া চোখ
খঞ্জরসম দৃষ্টির ধার
কাড়ে জগতের শোক;
ভুলো না কেবল মরণের পরে
স্বর্গের আশা নিয়া
কাবাও তোমার অন্তরে আছে-
সেখানে জ্বালাও দিয়া;
কেউ কি লিখেছে সে-বই
রঙিন সব ছবি শুধু তার
এঁকেছে কি কেউ জেবুন্নিসাকে
স্বর্গের রূপ যার?
তাজের প্রধান প্রকৌশলী আহমদ লাহোরীর পুত্র আতাউল্লাহ এবং প্রকৌশলী হাংসপাত রায় বিবি-কা-মকবারার প্রধান নির্মাতা। স্ত্রীর মৃত্যুর দু’বছর পরেই (১৬৬০)-এ আওরঙ্গজেব এই মাকবারার জন্য স্থান ও বাজেট ঠিক করেন--যা পরবর্তীতে যুবরাজ আযম শাহ’র তত্ত্বাবধানে শেষ হয়। এই আযম শাহ সুলতানই বাংলার সুবেদার থাকার সময় ঢাকার লালবাগ কিল্লা নির্মিত হয়। তিনিই প্রথম ভারতের পূর্বাঞ্চল অর্থাৎ ‘অহমিয়া’ অঞ্চল দখল করেন (১৬৭৯এ)।
প্রিয় স্ত্রীর অকাল মৃত্যুর পরেই আওরঙ্গজেবের এই সমাধী-সৌধ নির্মাণ প্রকল্প অনুমোদন--তার ধর্মজীবনের এক বিস্ময়কর ব্যতিক্রম! সাত লক্ষ টাকা এর জন্য বরাদ্দ করেন তিনি। আরওঙ্গজেবের ‘অতি-ইসলামিক ভক্তরা’ এর পাশাপাশি বড় করে দেখান যে নিজের কবরের জন্য তিনিই বরাদ্দ করে গেছেন ‘মাত্র পনেরো টাকা’ বা আরো কম। উল্টোদিকে ‘বিরোধীরা’ সোচ্চার কণ্ঠে বলেন: তিনি জিজিয়া আরোপ করেছেন, ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করেছেন এবং মন্দিরের উপর মসজিদ গড়ে ভারতের মানবিক মূল্যবোধকে ভুলুন্ঠিত করেছেন। আমি এর কোন বিতর্কে না জড়িয়ে বরং তার সৃষ্টিতে নযর দেই।
তাজমহলের মত এই মাকবারাও দক্ষিণমুখী। এরও চারটি মিনার এবং সামনে বিরাট চৌকো বাগান (চারবাগ)। এরও মূল ভিত্তি তাজের মত লাল ইটে গড়া--যার উপরে সাদা মার্কেবেলর “মাকবারা”। এর গরীমা একটু কম থাকায় এরই আরেক নাম “গরীবের তাজ”। তবে ইতিহাস লেখকেরা ‘দক্ষিণের তাজমহল’ বলেই এর উল্লেখ করেছেন বেশি বার।
এখানে শুধু দিলরাজ বেগমেরই সমাধী আছে--আমি অবাক হয়ে দেখি--তাজে আবস্থিত মমতাজমহলের কবরের মতই। স¤্রাট আওরঙ্গজেবের কবর সামান্য দূরের দরগাহ কমপ্লেক্সের--উন্মুক্ত প্রাঙ্গনে। ১৭০৭ সালে আসফ জাহ’র (আওরঙ্গজেবের প্রধান সেনাপতি ও পরবর্তীতে হায়দ্রাবাদের নিযাম শাহীর প্রতিষ্ঠাতা প্রথম-নিযাম) মৃত্যু হলেও তার অসিয়ত অনুযায়ী তাকেও দাফন করা হয় হযরত শেখ জায়নুদ্দীনের দরগাহ প্রাঙ্গণে--স¤্রাট আওরঙ্গজেবের পাশেই। স¤্রাটের সেই কবর আমি পরে দেখে বিস্মিত হয়ে যাই যে সেটি একেবারেই খোলা উঠানে--চারপাশে শুধু একটি ইটের বাউন্ডারী বা সীমানা দেয়া হয়যতটুকু সেই তেরো/চৌদ্দ টাকায় সম্ভব হয়েছিল। পরে, তার এককালের প্রধান সেনাপতি, হায়দ্রাবাদের প্রতিষ্ঠাতা নিযাম এবং আরো বহু পরে লর্ড কার্জন সমাধিতে যথাক্রমে কাঠের-চাঁদোয়া এবং ঘের তৈরি করেন। কার্জনের মতে: ‘পৃথিবীর ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ স¤্রাটদের মধ্যে আওরঙ্গজেব অন্যতম।’ তার ঐতিহাসিক ভাষ্যে আমি কখনো নযরই দেইনি যেখানে তিনি লিখে গেছেন: “সবচেয়ে দক্ষ, ন্যায় বিচারক, সাহসী ও সুবুদ্ধিসম্পন্ন ছিলেন তিনিযার কবরে সম্মান প্রদর্শন আমার কর্তব্য। কিং রিচার্ড থেকে রানী ভিক্টোরিয়া পর্যন্ত কেউই তার সঙ্গে তুলনীয় নন।”
বিস্ময়করভাবে কার্জন তুলনা করে দেখিয়েছেন যে মোঘল আমলে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক হিন্দু রাজপুত্র, মারাঠা কর্মচারী, দেওয়ান ও মন্ত্রী ছিল আওরঙ্গজেবেরই দরবারে। এ ব্যাপারে উলামারা আপত্তি করলে তিনি বলেছিলেন: ‘রাজকার্যে ধর্ম কোন নিয়ামক নয়; যোগ্যতাই আসল। আর বিশ্বস্ততা না থাকলে বংশে বা ধর্মে কী আসে যায়? আল্লাহ কি বলেন নিআমার ধর্ম আমার, আর তাদের ধর্ম তাদের?’
আমি অবাক হয়ে দেখেছিলাম: খাজা বুরহান উদ্দীন, নিযামুল মুলক আসফ জাহ-ওয়ান এবং তার পুত্র নাসির জং, মালিক আম্বর (ভারতে প্রথম গেরিলা-যুদ্ধের প্রবর্তক), জেনারেল কমরউদ্দীনের পাশাপাশি কী তুচ্ছতায় দাঁড়িয়ে আছে স¤্রাট আরওঙ্গজেবের তৃণমূল সমাধীতার বোন, কবি জাহান আরার মতই নিরাভরণ, সাদাসিধে--হযরত নিযামুদ্দীন আউলিয়ার মাযার প্রাঙ্গনে আবস্থিত সেই সমাধীও প্রায় অস্তিত্বহীন । ধর্মের সবচেয়ে কঠোর অনুশোসনকারী বলে “কুখ্যাত” এই স¤্রাটের কবরের পাশেই রয়েছে নকশবন্দী (চিত্রকর), সুরাওয়ার্দী (দর্পনদর্শী), কাদরিয়া (বড় পীরের অনুসারী), চিশতিয়া (শেরে খাজার অনুসারী), সাহাত্তারি (দ্রুত পালনকারী), খাকসারী (বিলীনমুখী), জান-আল্লাহশাহী (কুরবান-গ্রুপ)-সহ বাকায়ী, বিয়াবানী, মাদারিয়া, তাবকাতী, সদা-সোহাগসহ কত তরীকার মহান দরবেশদের মাযার। সম্ভবত এই বহু-বিভক্তিরই জবাব দিয়ে গেছেন স্বয়ং স¤্রাট তার জীবদ্দশাতেই“ফতোয়া-ই-আলমগীরী” লিখে। আমি অশ্রুসজল হই এই ভেবে যে, ধর্ম কত উদার হলে--হাজার বিভক্তিকে এক-করে সেই বিভক্তির মাঝেই নিজেকে বিলীন করে দেবার “জামাত” (ব্রাদারহুড) শেখায়!
আমি একা একাই প্রতিটি দরগাহ ঘুরি আর বোঝার চেষ্টা করি তাদের ‘তরীকা’কে। বাবা শাহ মোসাফেরের মাযার একটু দূরে--পঞ্চচৌকিতে। জার-জারি জার-বক্সের মাযারও চত্বরের বাইরে। এরা সবাই এক একটি নীতি-গোষ্ঠীর প্রধান সিপাহসালার। আধুনিক চোখে তাকালে এসবকে মনে হবে ‘ক্ষুদ্রস্বার্থের-বিভক্তি’; কিন্তু সেই হিন্দু-যুগে এরাই আমাদের মত প্রাকৃতজনকে তাদের চরিত্র, কারিশমা এবং কখনো কখনো তরবারি বা সঙ্গীত দিয়েই ইসলামের সবুজ পতাকার নিচে নিয়ে এসেছিলেন। অবশ্যই একথা সত্য যে মোঘলরা ধর্ম নিয়ে প্রায় কোন বাড়াবাড়িই করেনি--না প্রচার, না বিরোধীতা--কিন্তু তাদের শাসননীতির-উদারতাই এসব দীন-হীন ফকিরদের ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র তরীকাকে পৌঁছে দিয়েছে আজকের সর্বভারতীয় বিশাল-মিল্লাতে--যার রাজনৈতিক অংশের পরচিয় বাংলাদেশ ও পাকিস্তান, অরাজনৈতিক পরিচয়; মহাভারতের মুসলিম-কওম!
হায়দ্রাবাদের নিযাম বংশের প্রতিষ্ঠাতা, আওরঙ্গজেবের প্রধান সেনাপতি আসফ জাহ্ যদিও স্বাধীন হয়ে গিয়েছিলেনতবু তিনি সমাহিত হতে চান তার স¤্রাট আওরঙ্গজেবের পাশেই। আমার আশ্চর্য লাগে ভাবতে যে মৃত মানুষেরাও একত্রে থাকতে চেয়েছিল দুনিয়ার দ্বন্দ্ব ভুলেআর আমরা ঘৃণা ছড়িয়ে চলছি সর্বত্র--পরেও। আমাদের সুমতী হবে কবে?
তুঘলকাবাদ নামের বিশ্বখ্যাত দুর্গ দেখতে যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করলে, ম্যানেজার কৃঞ্চ রাথোর বললেন: স্যার আপনাকে একজন গাইড দিয়ে দেই, আমরা?
কেন, কৃঞ্চজী?
প্রথমত, আপনি একবার বিপদে পড়েছেন--ফোর্টে যার দ্বিতীয় সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। দ্বিতীয়ত, আপনি বিবি-কা-মকবরা, রওজা নিজে নিজে দেখেছেন--নয়। ইতিহাসের মহানায়কদের সবারই একটু ভালো করে জানা উচিত, তাই নয় কি, স্যার? তৃতীয়ত--আরো হেদায়াত আছে, জনাব?
হেদায়াত নয়, স্যার--রুসুয়াত; মানে গভীর চিন্তা।
দারুণ! বলুন, আপনার তিন-নম্বর?
অজন্তা-ইলোরা দর্শন করতেই হবে।
ওগুলো এখানে নাকি!! আমি তো শুনেছিলাম মুম্বাই-পুনের কাছে কোথাও?
কী যে বলেন, স্যার--আওরঙ্গাবাদের গর্বইতো অজন্তা ইলোরা--আপনার অবশ্যই দেখে যেতে হবে।
কত দূর-দূর ওগুলো? একই রাস্তায় কি?
না, স্যার--ভিন্ন রাস্তায়। ইলোরা যেতে টেক্সিতে ঘন্টাখানেক লাগবে। আর অজন্তা যেতে ঘণ্টা আড়াই। এক দিনেও দুটো কাভার করা যাবে--কষ্ট হবে, স্যার। দুটো দিন বেশি থাকুন। ইলোরা দেখে ফেরার পথে আবারও মকবরা দেখে নেবেন। তৃতীয় দিন রওয়ানা দেবেন উত্তর দিকে--পথে; ওকে স্যার?
কৃঞ্চজীর কথাবার্তা ভালোই লাগলো। মেনে নিলাম তার পরামর্শ। গাইড কে হবে, কৃঞ্চজী?
দেখা যাক, কাকে পাই। ভালো ইংরেজী জানতে হবে তার, এটাই তো শর্ত আপনার, তাই তো?
জী, অবশ্যই--কৃঞ্চজী।
কেন যে আপনারা হিন্দি শেখেন না, ভাগবান মালুম। নেপালী-ভূটিয়ারা পর্যন্ত আজকাল হিন্দি-উর্দু বাতচিত জানে--আর আপনাদের খালি বংলা-বংলা।
দেখুন, কৃঞ্চজী--আর দশটা বছর অপেক্ষা কওে দেখুনআমাদের বুয়ারা পর্যন্ত আপনাদের সাথে হিন্দি বাতচিত করতে পারবে, বুঝলেন?
ওভি, ক্যায়সা--?
আপ কি সিরিয়াল কি কারিশমা--‘ঘর-ঘর কি-কাহানী’ হ্যায় না?
হঠাৎ কৃষ্ণ রাথোর গম্ভীর হয়ে গেল। সালে চুতিয়া টিভিআমাদের ঘর-সংসার ভেস্তে যাচ্ছে ঐ স্টার আর জিটিভির জন্য। এরা আপনাদেরও ধরেছে? সর্বনাশ--আপনাদের সরকার করে কি?
পার্মিশন দেয়--।
প্রটেকশান দেবার বদলে? তাজ্জব কি বাত, স্যার!
তোমাদের দেশেও কি তাই হচ্ছে না, কৃষ্ণজী? তাজমহলকে নিয়ে পর্যন্ত তোমরা রাজনীতি শুরু করেছো। সরকারের কাছে গরীবের আর কি প্রত্যাশা?
ঠিকই বলেছেন, স্যার--সহিহ-সাচ্চা বাত, স্যার। সারা জীবন বইপত্রে পড়লাম এক; আর এখন শিবসেনা-আর.এস.এস বলছে আরেক। লজ্জায় মরি আর কি!
মহারাষ্ট্রের লোক হয়েও আপনি এ কথা বলছেন?
যা সত্যতা মহারাষ্ট্রেও সত্য; মহাভারতে হলেও সত্য। এই খুলদাবাদ আমার জন্মস্থান, স্যার। আমি কি করে আওরঙ্গজেব-আসফ জাহ্দের নতুন করে পড়বো? আমি তো বড়ই হয়েছি রওজার গলি-ঘুপচিতে কানামাছি খেলে।
হঠাৎই চুপ হয়ে গেল রাথোর। এক রূপসী রাজকন্যা এসে ঢুকেছেন রিসেপশানে। বেশ চেনা-চেনা লাগলো। একটু পরেই এলেন ছ-ফুট লম্বা এক চশমাওয়ালা সুপুরুষ।
আরে, স্যার--আপনি? কবে এসেছেন এদিকে? খেলা আছে নাকি?
ভারতীয় ক্রিকেটের কিংবদন্তী-ক্যাপ্টেন আজহারউদ্দীনকে হঠাৎ আমি চিনতে পারলাম। চেনা চেনা লাগা সুন্দরীই তাহলে রূপালী পর্দার সেই রাজকন্যা সঙ্গীতা বিজলানী?--যিনি ঘর ভেঙ্গে সর্বনাশ করেছেন এই ক্যাপ্টেনের? এবং দেশেরও?
ছোট্ট শহর খুলবাবাদনামটাও স¤্রাট আওরঙ্গজেবের দেয়া। কেন জানি না, সবচেয়ে রক্ত-ঝরানো এই স¤্রাট জীবনের শেষ দিকে হয়ে উঠেছিলেন সবচেয়ে ধার্মিক এবং মাত্রাতিরিক্ত পরহেজগার। হতে পারে এটা তার ‘অনুতাপজনিত’ আত্মসমালোচনার ফল; হতে পারে সত্যিকারের প্রত্যাবর্তন। আমি এর গূঢ়ার্থ এখনো বুঝিনি! একদল অন্ধ-সমার্থক তাকে ‘জিন্দা-পীর’ বলে বেড়ায়তাদের সম্বোধনে তিনি ‘আওরঙ্গজের-আলমগীর’। ছোটবেলায় আমি পড়েছি--তিনি টুপি সেলাই আর কোরান-নকলের পয়সা দিয়ে দিনানিপাত করতেন! পাঠ্য-বইয়ের এই অতি-অলৌকিকতার ‘ভূত’ আমাকে এও শিখিয়েছিল যে: শেরে-বাংলা এ. কে. ফজলুল হক একসাথে ৬৪টা ফজলী আম খেতে পারতেন; কনুই দিয়ে ঝুনা নারকেল ছিলতে পারতেন। ঘটনা সত্যি হলেও আমার মনে তখন থেকেই প্রশ্ন জাগতো--সেই পাঠ্যবই প্রণেতা পন্ডিতেরা কি জানতেন না যে সুর্য না- ডোবা ইংরেজ সা¤্রাজ্যের রাজধানীর গোলটেবিল বৈঠকে লাহোর-প্রস্তাব পেশ করেছিলেন এই হক সাহেব? জানতেন না যে তিনিই জমিদারী প্রথার কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে বলেছিলেন: ‘লাঙল যার জমি তার’? সে-কথা মোসাহেবরা কোথাও উল্লেখ না-করে আওরঙ্গজেবের মত বিশাল ভূখন্ডের মহাব্যস্ত স¤্রাটকে টুপি-বিক্রেতা আর কোরান-লিপিকার হিসেবে চিহ্নিত করেছেন! আবার আমিই আশ্চর্য হয়ে দেখি: এই স¤্রাটের পীর, শেখ যায়নুদ্দীন সিরাজী বা তার পীরের-পীর (শেরে-খাজা) হযরত মঈনুদ্দীন চিশতীও তো এত কৃচ্ছতা সাধন করেছেন বলে ইতিহাসবিদরা কোথাও লিখে গেছেন বলে প্রমান পাওয়া যায় না। এটা আমাদের পাঠ্যবইয়ের ‘মহান-কান্ড’ কি শুধুই পাকিস্তানী-থৌলতদারী, নাকি আমাদের মূর্খতারই প্রমান?
বিপরীতপক্ষে আরেকদল--মারাঠা-জাঠ-রাজপুত্রদের মতই আওরঙ্গজেবকে চিহ্নিত করেন ধর্মান্ধ, গোঁড়া এবং সাম্প্রদায়িক হিসেবে--যা আদৌ সত্য হতে পারে না বলে আমরা আগেই দেখেছি। কারণ, তিনিই মোঘল-মনার্কদের মধ্যে দীর্ঘতম শাসক--প্রশাসনের শতকরা একত্রিশভাগই ছিল অমুসলিম। বলার মধ্যে একটাই বাকী থাকে--জিজিয়া বা দারুল-হার্ব ‘কর’। সেটা আসলে জাহাঙ্গীরের সময় থেকেই পুনর্বহাল হতে শুরু করেখুররম-আলমগীর যাকে শুধু সুবিন্যস্ত করেছিলেন--তাহলে দোষ শুধু আলমগীরের কেন হবে?
খুলদাবাদের দীন-হীন সমাধী আর বিবি-কা-মকবরার মধ্যেই আমি আওরঙ্গজেবের দুটি রূপ দেখতে পাইফকিরী এবং রাজকীয়।
“রওজা” নামে দেয়াল-ঘেরা বিশাল এলাকার গেটে গিয়ে দাঁড়াতেই এক মধ্যবয়স্ক-যুবক এসে সালাম দিলো: স্যার, আপ হি তো ডাক্তার সাব হ্যায়? --বাংলাদেশী মেহমান?
হাঁ-জি, আপ কৌন হ্যায়?
আপকা গাইড। মাথুর সিং--, স্যার। কৃঞ্চজী হামকো ইধার ভেজা। এনিথিং রঙ--আর আই ক্যান প্রসিড উইদ ইউ, স্যার?
নেভার মাইন্ড, মাথুর--কাম অন অ্যান্ড প্রসিড--।
আমরা বোম্বে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের পাশের ছোট রাস্তা ধরে ঢুকলাম রওজায়। প্রথমেই পড়লো স¤্রাটের সমাধী। মাত্র ছ-সাত ইঞ্চি উঁচু ঘের-দেয়া সমাধীর উপরটা পুরাই খোলা--মাটি সামান্য উঁচু--সেখানে এখন কিছু ফুল বিছানো। পুরো কবরের উপর কালো আবলুস কাঠের কাঠামো দেয়া, কিন্তু কোন ছাদ নেই। মাথুর সিং জানালো: এটা করে গেছেন হায়দ্রাবাদের প্রথম নিযাম-জাহ্যা--র কবর সামান্য দূরেই। অজ্ঞাত কারণে, বিদ্রোহী এই সেনাপতি সমাহিত হতে চেয়েছেন--বেহেশতের বাগানেই--তার ক্ষমাশীল-স¤্রাটের পাশে।
নিযামের সমাধীটি চমৎকার সাজানো--একটি ইমারতের ভেতরে। ভেতরে যেতে আমার অনীহা দেখে মাথুর সিং বললো: স্যার বোধহয় ইতিহাসের অধ্যাপক, তাই না? --নিযাম শাহীর প্রতি শ্রদ্ধা নেই!
না, তা কেন হবে--সিং?
নইলে ‘রওজা’য় এসে কবর দেখবেন না, সেটা কি করে সম্ভব, স্যার? বেশি পন্ডিতেরাই ওসব করে দেখছি; তাই ভেেিবছিলাম--।
হেসে তাকে আমি বোঝাতে চেষ্টা করি যে কবর দেখতে আমার আপত্তি নেই সিং, আপত্তি ফুল-চন্দনে। মহামানবদের কবরে আমি অনেক গিয়েছিমদিনায় নবীতে অবস্থিত হযরত মুহাম্মদ (দ

এটা আমিও মানি, স্যার---হলে আপনি ঠিকই বলেছেন। কিন্তু কি আর করা, বলুন--এটা তো হিন্দুস্থান। পূজা আমাদের রক্তে আর ফুলচন্দনেই আমাদের প্রশান্তি। বেয়াদবী না নিলে একটা উদাহরণ দেই, স্যার?
হুম্ম। মাথুরের কথাবার্তা আমাতে মুগ্ধ করে--।
ভারতীয় সাহিত্যে বা ধর্মে--যতোটা জায়গা দখল করে আছে প্রেম; তার চেয়ে কি বেশি জায়গা নেয়নি রাগ-অনুরাগ-অভিমান?
আমি আশ্চর্য হয়ে বলি: হ্যাঁ, ঠিকই তো বলেছো। কিন্তু এর সাথে ওর সম্পর্ক কী?
আর দেখুন--স্যার, অভিমান বা অনুরাগ শব্দটাই পশ্চিমে পরিচিত নয়। কারণ কি?
তুমিই বলো, মাথুর। আমি তার বক্তব্যে বাধা দিতে চাই না।
কারণ, আমরা এই অভিমানী-আবেগের মধ্যেই বড় হয়েছি, যা ‘পশ্চিম’ চেনেই না। সরাসরি কথা বলার চেয়ে তীর্যকেই আমাদের বেশি তৃপ্তি। পজিটিভলি বললে: আমরা আসলেই কাব্যিক-সভ্যতা এবং আমাদের এই রেনেঁসা ঘটেছে প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর আগেই--শ্রীকৃষ্ণ কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের আবশ্যিকতা প্রকাশ করেন ‘মৃত্যুর মধ্যে নবজীবনের জাগরণে’!
তাহলে বর্ণাশ্রম--তোমার শ্রীকৃঞ্চ? গীতায় ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রীয়, চাড়াল-চন্ডাল তুলে দেবার কথা বলা হল না কেন?
এরিস্টোটল বা প্লেটো কি এ-ব্যাপারে মানবতার পক্ষে ছিলেন, স্যার?
আমি চোখ নিচু করে বলি: না, তারাও বলেন নি। বরং তারা দাস প্রথাকে মৌন সমর্থনই দিয়ে গেছেন।
তাহলে বুঝুন--আর দোষ কি? তিনি তো আরও হাজার বছর আগেই সত্যদর্শী!
এসব বলে-বলে মাথুর সিং আমাকে আসফ জা’র কবরে নিয়েই ছাড়লো। আর আমি যথারীতি মৃত্যুচিন্তায় আপ্লুত হলাম। ...ইতিহাসের সব শ্রেষ্ঠ ও অগ্রগণ্য মানুষও কালের অতল তলে হারিয়ে গেছে। হারিয়ে গেছে তাদের সবকিছু--দু’এক শতাংশ বাদে। যাদের নাম-বা-বদনাম সমকালকে ছাড়িয়ে উঠতে পেরেছে, কেবল তারাই আসলে অমর--সে ক্যালিগুলা বা নিরো হোক; হোক বাবর কিংবা আওরেজেব। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া এই খ্যাতির-কাঙাল মানুষদের জীবনকাহিনীই তো বিশ্ব-মানবের সকরুণ ইতিহাস। স্পার্টাকাসের মতই বিশ্বপাঠকের কণ্ঠে উচ্চারিত হয় চেঙ্গিশ খানের নাম--কিন্তু তা ত দের খ্যাতির জন্য নয়। এও নিয়তীর এক নিষ্ঠুর নির্মমতা! এই ভবিতব্য চাননি বলেই হয়তো হিটলার কিংবা ইয়াহিয়া খানও কিছু ভালো কাজের চেষ্টা করেছিলেন । কিন্তু ভাগ্য তাদেরকে মেঘলা-আকাশ থেকে মুক্ত হয়ে নীল-আকাশে যেতে দেয়নি। যেমন আওরঙ্গজেব--। নিজেকে মেশাতে চেয়েছেন খুলদাবাদের ‘সাধারণ’ মাটিতে; নিরহংকারের চূড়ান্ত-উপমা করে; কিন্তু ইতিহাস তার দায়মুক্তি দেয়নি। সুতরাং তার নিন্দা, প্রশংসার মতই অমর।
এানুষের জীবনই তো এই--দেহ মরে গেলেও কর্মে বেঁচে খাকেন গান্ধী, মেন্ডেলা, নেহেরু কিংবা শেখ মুজিব। তাহলে জীবনের সাফল্য নিয়ে মানুষের এত দম্ভ কিসের? কেন মানুষ ফালতু বিতর্কে লিপ্ত হয় পারলৌকিক জীবন থাকা না-থাকা নিয়ে; যেখানে লৌকিক জীবনেরই পহু প্রশ্নেই জ্ঞান নিরুত্তর?
ছোট্ট বারান্দা পেরিয়ে আমরা ঢুকি বড়সর এক বারান্দায়। ওপাশের আঙিনাটা বেশ শক্ত পোক্ত এবং নান্দনিক।
কি এটা?আমি মাথুর সিংয়ের কাছে জানতে চাই।
এটা হলো গোলকুন্ডার শেষ রাজা তানাশাহর কবর, স্যার...।
আমরা ঢুকি শেখ বোরহানুদ্দীনের মাযারে। আশ্চর্য প্রশান্ত জায়গাটি। পুরোটাই পেস্ট কালারে রঞ্জিত। ভেতরের ছোট্ট সৌধটি ধবধবে সাদা মার্বেলে ছাওয়া। মাথুর সিং আমাকে হযরত শেখ বুরহানউদ্দীনের জীবন কাহিনী শোনায়। দিল্লীর হযরত নিযামুদ্দীন আউলিয়ার খলিফা ছিলেন তিনি। ওস্তাদের দ্বারা আদিষ্ট হয়ে তিনি খুলদাবাদে আসেন এবং ধর্ম, মানবতা, সুফীবাদ ও চিশতিয়া তরিকায় প্রচার শুরু করেন। তিনি খুবই উঁচু মাপের বুজুর্গ ছিলেন যে মুহাম্মদ তুঘলক দূর্গে প্রবেশের আগেই ভয় পেয়ে বুরহান উদ্দীনকে অন্যত্র চলে যেতে বলেন।
জবাবে বুরহানউদ্দীন জানান: হে আমার সুলতান--কারো নিয়তী জানে না--না, আপনিও না। বিনয়ী হতে শিখুন, নইলে নিজেই আপনি আপনার বিপদ ডেকে আনবেন। আল্লাহ শুধু অনুগতদেরই দয়া করেন; আর সুলতানদের উচিত নয় তার প্রতি অকৃতজ্ঞ হওয়া।
হযরত বোরহানউদ্দীন মাত্র চার বছর পরেই ওস্তাদের নির্দেশে দাক্ষিণাত্যে চলে যান; কিন্তু হযরত বুরহানউদ্দীনের খুলদাবাদ ত্যাগ করার বহু পূর্বেইসুলতান মুহাম্মদ তুঘলককে নয়া-রাজধানী ‘পরিত্যক্ত’ ঘোষণা করতে হয়--জন্য দৌলতাবাদ ছেড়ে যান। দাক্ষিণাত্যের বিভিন্ন স্থানে খানকা স্থাপন করে হযরত বুরহানউদ্দীন আবার এখানেই ফিরে আসেন এবং ১৩৪৪এ ইন্তেকাল করেন। আসির গড় দুর্গ-শহরের নাম এই মহান ঈশ্বর-সাধকের স্মরণেই বদলে রাখা হয় ‘বুরহানপুর’।
বলো কি?
জ্বি-হ্যাঁ, স্যার। তিনিই হলেন বুরহানউদ্দীন গরীব। দীন দুখিদের আশ্রয়--খুবই ভালো গায়ক ছিলেন তিনি। কোরান তেলাওয়াতও করতেন এত মধুর স্বওে যে সেই পাঠে মুগ্ধ হয়েই এলাকার বেশিরভাগ মানুষ ধর্মান্তরিত হয়ে যায়। ঐতিহাসিকরা বলেন: পনেরোশো ছাত্র ছিল তারযারা সারা ভারতে, যারা ভারতের মধ্যাঞ্চলে ইসলামের প্রদীপ জ্বালিয়েছেন।
খাজা-গরীবের কবরের ডানেই আসফ জাহ’র কবর; বামে শুয়ে আছেন তার দ্বিতীয় পুত্র নাসির জং।
আমরা হেঁটে একটু দূরে যাই--আম্বর এবং সোহান-বাউলি কূপ এখানে। মালিক আম্বরে ছিলেন আবিসিনীয় মার্সেনারী (১৫৪৮-১৬২৬)। দাস এই বালক অল্প-বয়সেই যুদ্ধ-বিদ্যায় ভয়ংকর পারদর্শী হয়ে ওঠায় আহমদ নগরের রাজসভার মন্ত্রীত্ব লাভ করেন। ভারতে গেরিলা যুদ্ধের প্রবর্তক তিনি--সুলতান সালাউদ্দীন আইউবীর বাহিনীর অনুসারী মামলুকদের কাছ থেকে এবং প্রশিক্ষিত হয়েছিলেন তাদের হাতেই। টিপু-হায়দারের উদ্ভাবিত রকেটের মত তিনিও দূর নিক্ষেপ-যন্ত্র আবিষ্কার করে বার বার হারিয়ে দেন মোঘলদেরকে। দৌলতাবাদ শহরকে তিনি খুবই ভালোবাসতেন এবং এ-শহরের বহু স্থাপনা মালিক আম্বরের হাতেই নির্মিত। তিনি এর নাম দিয়েছিলেন ‘খাদ্কী’। ১৬৫৭য় আওরঙ্গজেব একে পুনর্দখল করে নামকরণ করেনদৌলতাবাদ।
নূরজাহানের বিপক্ষে যেয়ে শাজাহানকে মসনদ দখল করতে মালিক আম্বর বিশাল ভূমিকা রেখেছিলেন বলে ঐতিহাসিকদের ধারণা। পরবর্তীতে মালিক শাহজাহানের বশ্যতা স্বীকার করে বেরার ও আহমদনগর মোঘলদের কাছে সমর্পণ করেনশাহজাহান একে মালিকের দুর্বলতা ভেবে তাকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেন--ঐতিহাসিকভাবেই চরম-ভুল ও হঠকারী সিদ্ধান্ত! কারণ, এই বীর ও বিদ্রোহী-কাফ্রি কখনোই তার তরবারি হাতছাড়া করেননি। শাহজাহানের দম্ভে ও অবিশ্বাসে ক্ষিপ্ত-মালিক মোঘলদের প্রধান-শত্রু মারাঠাদের সাথে হাত মিলান। ক্রমাগত দশ-বছর দাক্ষিন্যাত্যে শাজাহানকে মালিককে ধাওয়া করতে হয়, কিন্তু তাপরেও মালিক অজেয় ছিলেন। যাই হোক, ১৬২৬এ মালিক মারা যান এই দৌলতাবাদেই। খাজা জারজারি জারা বক্সের অনুসারী ছিলেন তিনি; এবং সেই অধিকারে এযাজত চান তার পাশেই সমাহিত হতে! আর্জী মঞ্জুর হয়--কিন্তু স¤্রাট শাহজাহান সেটা হতে দেন নি বলে রওজায় তার জায়গা হয়নি। এজন্যেই তার সমাধী এখানে; ---দেয়ালের সামান্য বাইরে।
আম্বরের কোনো বংশধর ছিল না, মাথুর?
আমরা ভুল করে হাবশীদের সবাইকে খোঁজা ভাবিবাস্তবতা কিন্তু মোটেই তা নয়, স্যার। আফ্রিকার হ্রদ অঞ্চল থেকে আসা এই মানুষগুলোর বিশাল আকার, দুর্দম শক্তি এবং চরম বিশ্বস্ততার জন্যেই স¤্রাটরা এদেরকে ‘দেহরক্ষী’ বানাতেন। খোজাও ছিলেন কোনো কোনো কাফ্রি--পাকিস্তানে যাদের বলা হয় সিদ্ধি; পারস্যে সিদি আর আরবে হাবশি! ঐাই হোক, দুই ছেলে এবং দুই মেয়ে রেখে মারা যান আম্বর।
দারুণ বললে তো! এবার বলো--তার সেই সন্তানদের কথা।
মালিক মারা যান ৮০ বছর বয়সে--তার মাত্র তিন বছর আগে তার শেষ সন্তান জন্মায়। তার প্রথম কন্যার জামাতা--নিযাম শাহ--নগরের অধিপতি হন। আরেক কন্যা হন দৌলতাবাদের গভর্নরের স্ত্রী। বড় ছেলে ফতেহ খান হায়দ্রাবাদ শাহী-দরবারের মন্ত্রী ছিলেন--কিন্তু বাপের মত অতটা সাহস বা বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিতে তিনি ব্যর্থ হন। আর শেষ-কন্যা সারকাসিয়ান কমান্ডার মুকাব্বার খানের গৃহকত্রী হয়ে মোঘল সেনাপতিদের মধ্যে উজ্জ্বল হন--টাইটেল ছিল---খান-ই খানান।
*
আমি ছোট্ট ডোমের চারপাশে হাঁটি আর বুঝতে চেষ্টা করি--মত হিং¯্র, শিয়ালের চেয়ে চতুর আর হরিণের চেয়ে ক্ষিপ্র এ সকল বীরদের সকলেই তো মাটির-কবরে থিতু হয়েছেন। মানুষের সকল শক্তি, সাহস, উল্লাস বা ক্রন্দন কিংবা নৃশংসতার পরিসমাপ্তি তো মৃত্যুতেই! হায় খোদাকি অপূর্ব রশি দিয়ে বেঁধে রেখেছো আমাদের--চাঁদে যাও কিংবা ক্লোন বানাও--সব মাত্র একশো বছরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তারপরই শীতলতার ঘুম কিংবা চির-অবকাশ।
অথচ, স্যার--এই দৌলতাবাদ নগরীর প্রতিষ্ঠাতাই মালিক আম্বর। তার গড়া খাল (নাহার) এখনো সচল। সেই যুগে তিনি বায়ুকল (উইন্ডমিল) বানিয়ে পানি তুলেছেন নদী ও লেক থেকে।
সত্যি নাকি? শুনিইনি কখনো।
আম্বরের আরেকটি কুখ্যাতি বা গুজব আছে, স্যার--?
না-তো, কি সেটা?
লজ্জা পাচ্ছি, তবু অভয় দিলে বলতে পারি! মাথির সিং হযরত জারজারি জারা বক্সের সমাধীর বারান্দায় বসে পড়ে। আমিও বসি। কবরস্থানে সব সময়ই ঠান্ডা বাতাস বয়--চোখে ঘুম নেমে আসতে চাইলো।
...মালিক আম্বরের পৌরুষ ছিল এত বেশি যে নিযামশাহী থেকে আহমদ-নগর, বিজাপুর থেকে শিবাজী-মারাঠা পরিবার এবং দৌলতাবাদের থেকে দিল্লীর বহু রাজনন্দিনী বা মহিষীই তাকে কামনা করতেন। একজন ঐতিহাসিক এও বলেছেন যে শিবাজী, বিজাপুরের সুলতান, হায়দ্রাবাদের নিযাম, দিল্লীর সুলতান সহ বহু রাজা বাদশার ঘরে তার বেশুমার সন্তান নিয়ে সম্ভ্রান্ত মহলে বহু ফিস ফিস গুঞ্জরিত হতো। অনেকেই তাকে ডাকতেন---কৃষ্ণ সম্বোধনেই।
মনে হচ্ছিলো আমি তন্দ্রার ভেতর আরও স্পষ্ট করে কিছু নাম শুনেছি--সচেতন হবার পর যা স্মৃতিতে নেই।
চলুন, স্যার--করি। আপনি ক্লান্ত হয়ে গেছেন।
ক্লান্ত না হলেও আমি তার হাত ধরে উঠলাম। চলো, মাথুর সিং--। মিল যায়েগা।
খুলদাবাদ শহর থেকে সাকুল্যে চার-কিলো দূরে দৌলতবাদ রিক্সায় যেতে চাইলাম আমি। মাথুর সিং হেসে বললো তাহরে গাড়ির কি করবো? এখানেই রেখে যাবো?
পারবে?
কেন নয়, স্যার?
আচ্ছা, থাক--মাথুর, চলো, গাড়ি নিয়েই যাই।
সে হেসে বললো: আপ বহুতই পাগলা-আদমী, স্যার--লাইক মির্জা গালিব। সেই মহান কবি নাকি বহুবার আজান শুনে মসজিদ পর্যন্ত গেছেন, তারপর মসজিদের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে না-ঢুকেই আস্তে ফিরে আসতেন।
কেন-কেন?
কারণ, তিনি বুঝতে পারতেন না, তার মুর্শিদ কোথায়--কাবায়, মসজিদে, মন্দিওে, না হৃদয়ে। তার কবিতার ছত্রে ছত্রে এই দ্বিধা ও বেদনার আর্তি খুঁজে পাবেন আপনি।
তুমি কিভাবে জানো?
গালিব যে উর্দুতে কবিতা লিখেছেন--সেটা ঠিক দিল্লীর নয় স্যার--দৌলতাবাদের। আমাদের এই উর্দু ঘরানাকেই লক্ষেœৗয়ের ভাষাবিদরা স্বীকৃতি দিতে নারাজ। এজন্যেই গালিব লক্ষেœৗয়ের ‘সভাকবি’ হতে রাজি ছিলেন না, স্যার।
বাহনতুন জিনিস জানলাম। আচ্ছা--কবিতা শোনাও তো দু-চার লাইন গালিবের।
মাথির সিং ড্রাইভিং হুইলে হাত রেখে হাসলো--। স্যার, আমি তো রিসাইটার নই। দু এক পংক্তি সাদা ভাষায় বলতে পারি।
তথাস্তু। তাই ই চলুক।
এলো তার চিঠি বিরহের শেষে
এলোনা খুশির দিন
দুই ঠোঁট যেই কাছাকাছি হলো
হাঁকলো মুয়াজ্জিন।
গালিবে এমন দ্বিধা ও বেদনার আর্তি বার বার খুঁজে পাবেন আপনি।
তুমি তো দারুণ রসিক, মাথুর। আরো দু-এক ফোঁটা সিরাজী আছে নাকি, সোরাহিতে?
ভেবো না অলস মূর্খের সাথী
গাল-ভরা বুলি সার
বাইরে গালিব কাফের হলেও
ভেতরে ঈমানদার।
আমি, এমনকি প্রশংসা করতেও ভুলে গেলাম। মাথুর সিং মুখ কালো করে বললো: পছন্দ হয়নি আপনার, তাই না?
আশি শশব্যস্তে বললাম--না-না, মাথুর, মোটেই তা নয়--আমি মুগ্ধ, অভিভূত, আপ্লুত। রাজনৈতিক কারণে আমরা উর্দুকে শত্রু বানিয়েছি--কিন্তু উর্দু-ফার্সি যে কত কাব্যময় ভাষা--রঙধনুর সাত রঙ দেখেও কেউ সেটা আন্দাজ করতে পারবে না।
থ্যাংকিউ, স্যার। তাহলে পেশ করি আরো দুটি পংক্তি?
জরুর।
গালিবের দিল ‘কোহিনুর’ নয়
মানলাম কিছু নয়
বিনে কড়িতেই নিতে সেই দিল
তবে কেন তার ভয়?
*
‘প্রেম’ দাবি করে ‘ ধৈর্য’, গালিব!
সুকঠিন হও আরও
‘বুঝলাম!’- সেই কঠিনের তরে
আছে কি ধৈর্য তারও?
*
কেন দিলি তারে হৃদয় ‘আসাদ’
পিষে মারে তিলে তিলে
নামে সে হলেও মুসলিম, তার
কুফরি রয়েছে দিলে।
*
দৌলতাবাদে লাঞ্চ সেরে আমরা আবার তাজ হোটেলে ফিরি। মাথুরকে বলি: বিকেল পাঁচটার দিকে বেরুবো। ফোর্ট দৌলতাবাদ ঘুরে আসতে চাই, বন্ধু।
ঘন্টা তিনেক সময় চাই, তার জন্য--।
আমার হাত একেবারে খালি--অত সময় কই পাবো?
তার মানে আপনি শুধু চক্কর দিয়ে চলে আসবেন--“মহাভারতের পথে-তিন” থেকে)
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জুলাই, ২০১৮ সকাল ১০:০৩