ছেলেবেলা, কৈশোর ও একটি ঝাপসা আয়না! (১)
ছেলেবেলা, কৈশোর ও একটি ঝাপসা আয়না! (২)
ছেলেবেলা, কৈশোর ও একটি ঝাপসা আয়না! (৩)
ছেলেবেলা, কৈশোর ও একটি ঝাপসা আয়না! (৪)
ছেলেবেলা, কৈশোর ও একটি ঝাপসা আয়না! (৫)
(পূর্ববর্তী অংশের পর...)
কৈশোরের শুরুতে প্রথম যে পরিবর্তনটা আসে আমার মধ্যে, সেটা জমিদার পুতুল রায়ের সাথে পরিচয় হবার পর। আমি তাকে চিনতাম না। একদিন দুপুরে যখন বিছানায় শুয়ে যাদব বাবু কষছি, তখন দরজায় কেউ একজন এল। দরজা খুলে দেখি ভিক্ষুক; টাকা চায় না, ভাত চায়। ভেতরের ঘর থেকে মা ভাতের কথা শুনে, তাকে বসতে বললেন। তখন আগন্তুক বললেন, 'চারটে গরম ভাত'ই দিয়েন মাইজি!' আমি তো শুনে অবাক! সচরাচর কোন ভিক্ষুককে গরম ভাত চাইতে শুনিনি। তখন বুঝিনি, কিন্তু এখন বুঝি, তাঁর কন্ঠস্বরে হয়ত' অভ্যস্ত কোন আদেশের সুর ছিল; বাবা-মা দুজনেই বাইরের ঘরে চলে আসলেন। আগন্তুকের ভগ্নপ্রায় চেহারায় কি যেন একটা আভিজাত্যের ছাপ- চমকে গেলেন বাবা-মা দুজনেই! জমিদার পুতুল রায়! পরে শুনেছি, পুতুল রায় ছিলেন হেমরাজার সর্বশেষ বংশধর, যিনি অল্প বয়সে বিভিন্ন নেশায় আসক্ত হয়ে, একদিন রাজবাড়ির সিন্দুক হাতিয়ে কোলকাতা চলে যান। তারপর তাঁর আর কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। সেই পুতুল রায় আজ হঠাৎ আমাদের দরজায়, তাও ভিক্ষুকের বেশে, বাবা-মা বেশ কিছুক্ষন নির্বাক হয়ে রইলেন! সে যাই হোক, একসময় একথা-ওকথা, কত স্মৃতিচারণ শেষে, আমরা একসাথে খেতে বসলাম। আমি কেবল শ্রোতা। তিনজন মধ্যবয়সী মানুষের সামনে আমি আর কি বলব? আমি কেবল অবাক হয়ে দেখছিলাম একজন প্রতাপশালী মানুষের ইতিহাস হয়ে যাবার উদাহরণ আগন্তুক কে। কথায় কথায় বাবা একসময় পুতুল রায়ের বংশগৌরব, প্রতিপত্তি আর রাজত্বের কথা তুললেন। বাবার গলায় ছিল মমতার ছাপ, হয়তো অজান্তে কিছুটা করুনাও ঝরে পড়েছিল কথার মাঝে; থেমে গেলেন জমিদার। কাঁপা কাঁপা হাতে ভাতগুলো নাড়তে থাকলেন। আমার ভুল'ও হতে পারে, মনে হলো, কয়েক ফোঁটা জল যেন পড়ল চোখ থেকে। কিছুক্ষন চুপ থেকে, দ্রুতই সামলে নিলেন। তারপর উদ্দেশ্যহীন ভাবে মাথা নেড়ে, একটু হেসে বললেন, "আবার'ও পানছি (পানশি) ভাছবে (ভাসবে) মাইজি, আবারো ছাত (সাত) মহলা দালান হোবে (হবে)।" আমার স্পষ্ট মনে আছে, পুতুল রায়ের ঘোলাটে দৃষ্টিতে হতাশা ছিল না, ছিল নিজের প্রতি অবজ্ঞা। তাঁর কন্ঠস্বরে আমি আশ্বাসের বদলে পেয়েছি প্রত্যয়।
কৈশোরের শুরুতেই আমি যা শিখলাম-কখনো হাল ছাড়তে নেই। এই শিক্ষাটা জীবন থেকে পেয়েছি বলেই কিনা জানিনা, আমার এই জীবনে কখনও ধৈর্য্য চ্যুতি ঘটেনি। থাক, এসব কথা বাদ। বরং আমাদের পথ হারানোর কথা বলি।
আমাদের শৈশবের বন'টা কৈশোরে এসে নতুন করে যেন আড়ি পাতলো। তখন হাফপ্যান্ট ছেড়ে ফুলপ্যান্ট হচ্ছি মাত্র। নিজের প্রিয় 'Phoenix' সাইকেলটা নিয়ে চলে যেতাম বনে। স্কুল পালিয়ে। কখনও বা নদীর ঘাটে। নৌকায়। এমন কত দুপুর গেছে, আমরা মাঝিদের সাথে দুপুরের খাবার খেয়ে, ওখানেই ঘুমিয়ে পড়েছি! তাস খেলাটাও রপ্ত করেছিলাম ওখানেই।
বনের ভেতর আমাদের একটা জায়গা ছিল, আমরা নাম দিয়েছিলাম 'মৃন্ময়ী'। চারদিকে টিলা ঘেরা আর মাঝখানে একটা হ্রদের মত। আসলে তো ডোবা, কিন্তু আমরা বলতাম হ্রদ। তার পাশে সাইকেলটা শুইয়ে রেখে আমরা বসতাম বাতাস মুখী হয়ে। জানিনা হয়তো পরিবেশের কারণেই কিনা, নিজেদের চেনামুখ গুলোই খুব অপরিচিত লাগত'। কৈশোরের দুঃখের তো আর অভাব নেই! স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ বলে গেছেন, বারো-তেরো বয়স নাকি উপদ্রবের মত। বড়দের সাথেও মেলেনা, ছোটরাও খেলায় নেয় না। তো থোরাই কেয়ার! আমরা ততদিনে আবিষ্কার করে ফেলেছি- 'নচিকেতা' তার গানে কখনো 'কষ্ট' শব্দটা ব্যবহার করেন না। (খুব ইচ্ছে আছে, নচিকেতাকে একদিন জিজ্ঞেস করব, ব্যাপারটা ইচ্ছাকৃত কিনা)।
আজ থাক। আর লিখতে ভালো লাগছেনা। চলবে যেহেতু, জোর করে চালানোর কোন মানে হয় না। ...(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই এপ্রিল, ২০১২ দুপুর ২:৫১