আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় নাগরিক ও গণ মাধ্যমের মত প্রকাশের যে আইনগুলো বিদ্যমান সেগুলোর অনেকগুলোই সেই উপনিবেশ আমল থকেই আমাদের দেশে প্রচলিত হয়ে আসছে, এই উপনিবেশ আমলের আইনগুলোকে আধুনিকায়ন না করা গেলে আমাদের দেশের মানুষের সাংবিধানিক পূর্ণ স্বাধীনতাই প্রশ্নের মুখোমুখি চলে আসে বটে, এ ক্ষেত্রে বলা যায় আমরা স্বাধীন হয়েছি বটে কিন্তু উপনিবেশ আইনি শাসন ব্যবস্থার বেড়াজাল থেকে মুক্ত হতে পারিনি | আমাদের দেশের প্রধান বিচারপতি কিছুদিন আগেও এ বিষয়ে কিছু আলোকপাত করেছেন, ইদানীং কালে মত প্রকাশের স্বাধীনতা ICT-act 57 নিয়ে যে আইনি জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে তাতে অনেক সাধারণ নাগরিক, ব্লগার, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক বিভিন্ন ভাবে নাজেহাল হয়েছেন, অনেকের বিরুদ্ধে মামলা ঝুলে আছে, সাংবাদিক প্রবীর শিকদার হচ্ছে এই ধারায় নিপীড়িতদের মাঝে একজন জ্বলন্ত উধহারণ |
আমি বলছি আমাদের দেশ এই সব উপনিবেশ আইনি ধারাগুলোর কারণ ও জটিলতার কারণে পিছিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু আমাদের পূর্ণ স্বাধীনতার চিত্রটা দেখতে কি রকম | আমাদের দেশের মানুষ আজ পুলিশ প্রশাসনের নিয়মের কাছে মাথা নত করে বেচে আছে, ৫৪ ধারাতে পুলিশের যে অগ্রাধিকার তা এই বর্তমানে যুগে কল্পনা করতে গেলে মানুষকে ভাবিয়ে তুলে, আমাদের বর্তমান সরকারকে ধন্যবাদ দেরিতে হলেই এইসব উপনিবেশ আমলের আইনগুলোকে আধুনিকায়নের উপর দৃষ্টি দিচ্ছেন, কিন্তু আইনের স্বাধীনতাকে সমুন্নত রাখতে বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে খর্ব করলে সেটা হবে রাজনৈতিক ভাবে একটি আত্মঘাতী মূলক বিষয়, কাজেই বিচার বিভাগের উপর নির্বাহী বিভাগের হস্তক্ষেপ জনগণের কাছে কোন ভাবেই কাম্য নহে | পুঁজিবাদীদের আস্ফালনকে তখন আর দমানো সম্ভব হবে না | হয়তো আমার চিন্তা ধারার সাথে আপনারা অনেকই একমত নাও হতে পারেন তবে একটি সমাজতান্ত্রিক ও বৈষম্যহীন সমাজ গড়ে তুলতে আমাদের হাটতে হবে আরও অনেকখানি পথ | খুব বেশী আগে নয় মাত্র ২০০৭ এর শেষ দিকে বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা করা হয় | একটি স্বাধীন দেশে স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা আমাদের গর্ব , আর এই স্বাধীন দেশে বাক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতাই আমাদের কাম্য |
মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর সাধারণ তথ্য:
পৃথিবীর গণতান্ত্রিক দেশ গুলোতে মত প্রকাশের যে আইন আজ গৃহীত হয়েছে বা হচ্ছে তা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার নিয়মাবলী দ্বারা প্রভাবিত | জাতিসংঘের সর্বজনীন ঘোষণায় ১৯৪৮ সালেই এই হিউম্যান রাইটস আইন বা মানবাধিকার নিয়মাবলী নথি পত্র গৃহীত হয় যা পৃথিবীর সকল মানুষের মানবাধিকারকে সুরক্ষা করে | ইংরেজিতে আমরা যাকে United nations Universal Declaration of Human Rights of 1948 যেখানে Freedom of expression বা বাক স্বাধীনতাকেও সম্পৃক্ত করা হয় |
একটি গণতান্ত্রিক সমাজে মত প্রকাশ ও মতামতের স্বাধীনতা মৌলিক স্বাধীনতা ও অধিকার হিসাবেই গণ্য করা হয়. বিভিন্ন ইস্যুতে একটি মতামত প্রকাশ ও গঠনমূলক আলোচনার সুযোগ দীর্ঘ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার একটি গণতান্ত্রিক ও স্বাধীন ভাবে কাজ করার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পূর্বশর্ত হিসেবে গণ্য করা হয়েছে | মতামতের স্বাধীনতায় অবাধে বিচরণের ক্ষেত্রে মত প্রকাশ করার অধিকারও সীমিত করা যাবে এবং অন্যদের অধিকার ও স্বাধীনতাসমূহ জন্য বিবেচনায় এনে বৈষম্য বা সহিংসতার ঘটনা উস্কে দেয়া , সামগ্রিকভাবে ব্যক্তি বা সমাজের জন্য নেতিবাচক ফলাফল হয় বা যখন, সীমাহীন স্বাধীনতা ও শব্দ প্রয়োগে অপমানকর বা তথ্য প্রকাশে অন্যের অনুভূতি আক্রান্ত হচ্ছে বা হয়, উদাহরণস্বরূপ, মত প্রকাশের স্বাধীনতা দ্বারা ক্ষতি হতে পারে তাই প্রকাশের স্বাধীনতার কিছু সীমাবদ্ধতা আছে | এই কারণে বিশেষ দায়িত্ব ও আইনি প্রয়োগ করা আবশ্যক |
কেন মত প্রকাশের স্বাধীনতা:
মত প্রকাশের স্বাধীনতার পিছনে এক মৌলিক ধারণা যেটা আমরা সমাজে যৌথ ভাবেই সিদ্ধান্ত নেই যা সব বিষয় সম্পর্কে বিভিন্ন মতামত অধ্যয়ন করা একটি নাগরিক অধিকার | মত প্রকাশের স্বাধীনতা সাধারণত যতটা সম্ভব অবাধে তথ্য ছড়িয়ে দেওয়া যেটা গণতন্ত্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যার ফলে সুপ্রতিষ্ঠিত সিদ্ধান্ত পৌঁছানোর ভাল সুযোগ সৃষ্টি হয় | নাগরিক ও নেতারা সেতু বন্ধন তৈরি করতে সমাজে গণমাধ্যমে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিবেচনা করা উচিত | মত প্রকাশের স্বাধীনতা, নাগরিকদের স্বাধীন ভাবে গণমাধ্যমে পর্যালোচনা, আলোচনা ও বর্ণনা করার সুযোগ তৈরি করে দেয়াই হচ্ছে মত প্রকাশের স্বাধীনতা | সমাজের ভাল ও মন্দ দিকগুলো নাগরিকদের অবগত করা এবং তা প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে কিভাবে জন ক্ষমতা সম্পৃক্ত করা তাদের মতামত প্রকাশ করতে প্রচুর সুযোগ দেওয়া | সর্ব ক্ষেত্রেই সমাজে মত প্রকাশের স্বাধীনতা হচ্ছে একক বা যৌথ ভাবে মতামত প্রকাশ করে বিভিন্ন বিষয়ে অধ্যয়ন করে একটি যুক্তি সঙ্গত ব্যাখ্যা দেয়া হচ্ছে মানুষের মৌলিক স্বাধীনতার একটি অংশ | অবাধে তথ্য আদান প্রদান ও বিতরণ, নাগরিকদের স্বাধীন গণমাধ্যম পর্যালোচনা এবং তা প্রয়োগ করা, জনগণের ক্ষমতা সম্পর্কে তাদের মতামত প্রকাশ করতে দেয়া এবং তা প্রচারে কোনরূপ বাধার মুখোমুখি না হওয়াকেই আমার বাক ও প্রচার স্বাধীনতার বলে ধরে নিতে পারি |
মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সরকারের একটি গণতান্ত্রিক দলিল:
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতায় নাগরিকদের অবাধ বিচরণ করার সুযোগ আছে বৈকি | পশ্চিমা দেশগুলোর মাঝে স্কেন্দেনেভিয়ার দেশগুলোতে মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে সরকার গণতন্ত্রের প্রধান যন্ত্র বা মৌলিক নাগরিক অধিকার হিসাবেই চিন্হিত করেছে | এই দেশগুলো থেকেই আধুনিক মতপ্রকাশের আইন ও ধারাগুলোকেই মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে সবচাইতে সুন্দর ও গনতান্রিক হিসাবে সমগ্র বিশ্বে সাদরে অনুকরণ বা গ্রহণ করা হচ্ছে | মত প্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে সুইডেন হচ্ছে পৃথিবীর একটি অন্যতম দেশ, এখানে প্রতিটি নাগরিকের লিখিত, মৌখিক ও চিন্তা করার, তথ্য আদান প্রধান ও সরকারী ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের তথ্য গ্রহণ ও বিশ্লেষণ করার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দেয়া আছে | এক্ষেত্রে যেকোনো প্রতিষ্ঠান যে কোন নাগরিক বা গণ মাধ্যমকে যে কোন নথি বা তথ্য দিতে বাধ্য থাকে | তাই এ দেশে তথ্য আদান প্রদানের ক্ষেত্রে নাগরিকদের অবাধ বিচরণ | (In Sweden Everyone is guaranteed freedom of expression in his or her relations with public institutions, i.e. the freedom to communicate information and express thoughts, opinions and sentiments orally, in writing or pictorially, or in any other way (Chapter 2, Article 1 of the Instrument of Government). Furthermore, the Instrument of Government’s portal article clearly expresses the close correlation between the democratic form of government and freedom of expression: “All public power in Sweden proceeds from the people. Swedish democracy is founded on the free formation of opinion and on universal and equal suffrage” (Chapter 1, Article 1 of the Instrument of Government.)
মত প্রকাশের স্বাধীনতার উপর সীমাবদ্ধতা কি ও কেন:
প্রশ্ন আসতে পারে যে এখানে কি মত প্রকাশে কোনই বাধ্যকতা নাই ? অবশ্যই সে ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট ভাবেই উল্ল্যাখ করা আছে যে, জাত, ধর্ম, বর্ণ ও গোত্রকে কটাক্ষ করা যাবে না, ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধারে বা বিনা কারণে অন্য কারুর উক্তি, ছবি, চরিত্র বিশ্লেষণ অথবা তথ্য চুরি সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ সেটা অফলাইন কি অনলাইন | নির্দিষ্ট কারণ ছাড়া অন্য কারো পরিচয় যে কোন কারণে ব্যবহার করাও একটি গুরুতর অপরাধ | লিখিত বা মৌখিক ভাবেও এই আইন লঙ্ঘন করা দণ্ডনীয় অপরাধ | লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে সুইডেনের প্রতিটি নাগরিক জন্মের পর থকেই এইসব আইন সম্পর্কে অবগত আর সে কারণেই নাগরিক ও গণ মাধ্যমের জন্যে বাক স্বাধীনতায় সুইডেন আধুনিক বিশ্বে একটি অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে |
সবার জন্যেই শুভ কামনা |