somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ব্যাবিলনের শুন্যোদ্যান ( Hanging Garden of Babylon)

১১ ই জানুয়ারি, ২০১২ রাত ৯:০১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


আধুনিক কালের ইরাক , সিরিয়া, তুরস্ক,ইরান দেশগুলোর অংশ নিয়ে গঠিত ইউফ্রেটিস এবং টাইগ্রীস নদীর অববাহিকা স্থল হল প্রাচীন কালের মেসোপটেমিয়া। খৃস্টজন্মের দু হাজার বছর আগ থেকে দেড় হাজার বছরের বেশী সময় ব্যাপি গড়ে ওঠে এক বিষ্ময়কর সভ্যতা যার প্রানকেন্দ্র ছিল ব্যাবিলন। মানব সভ্যতার সে সময়কাল ছিল ব্রোঞ্জ যুগ থেকে লৌহ যুগ পর্যন্ত। সে যুগে টিন এবং তামার মিশ্রনে তৈরী ধাতুসঙ্কর ব্রোঞ্জ ছিল অস্ত্রশস্ত্র এবং গৃহস্থালী সামগ্রী তৈরীর প্রধান উপকরন। ইরাকের রাজধানী বাগদাদের ৮৫ কিলোমিটার দক্ষিনে ইউফ্রেটিস নদীতীরে ছিল তখনকার দিনের অন্যতম প্রধান নগরী ব্যাবিলন। আমাদের সময়ের ইরাকের ব্যাবিল প্রদেশের আল হিল্লা নগরী হল প্রাচীন যুগের ব্যাবিলন। তখনকার দিনের রাস্ট্র ব্যাবস্থা ছিল নগরকে ঘিরে। ৬০৫ খৃস্টাব্দ থেকে ৪৩ বছর ব্যাবিলনে রাজত্ব করেন নেবুচাদনেজার-২ খ্যাতির শীর্ষে থাকা ব্যাবিলন নগরীতে সম্রাট গড়েছিলেন সুন্দর সুন্দর প্রাসাদ, রাস্তা ঘাট, মন্দির ইত্যাদি। সবেচে উচু ছিল “ব্যাবেল টাওয়ার যা ছিল দেবতা “মারডুক” এর উদ্দেশ্যে নির্মিত মন্দির। জনশ্রুতি ছিল যে টাওয়ার চুড়া চলে গেছে স্বর্গ অবধি । প্রাচীনযুগের সপ্তাশ্চর্য্যের একটি ছিল ব্যাবিলনের শুন্যোদ্যান। আনুমানিক ৬০০ খৃস্টপূর্বাব্দে গড়ে ওঠে এই শুন্যোদ্যান।
মোগল সম্রাট শাহজাহান যেমন প্রিয়তম পত্নী মমতাজমহলের স্মৃতিতে গড়েছিলেন অমর কীর্তি তাজমহল, ব্যাবিলন সম্রাট নেবুচাদনেজার-২ তার প্রিয়তমা পত্নী আমিতিসকে উপহার দিয়েছিলেন এই শুন্যোদ্যান। আমিতিস ছিলেন ইরানের উত্তরের কাস্পিয়ান তীরের মেডিয়া রাজ্যের রাজকন্যা। ব্যাবিলন সম্রাট নেবুচাদনেজারের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে মেডিয়া রাজ নিজ কন্যাকে বিয়ে দেন নেবুচাদনেজারেরে সাথে । আমিতিস পতিগৃহে এসে দেখলেন সেই পাহাড় নেই, নেই সেই সবুজ গাছপালা। সমতল রুক্ষ মরুভূমির ব্যাবিলনে আমিতিস থাকেন সদা বিষন্ন। সম্রাজ্ঞীকে তার জন্মস্থান মিডিয়ার পরিবেশ এনে দিতে সম্রাট নেবুচাদনেজার ব্যাবিলনে গড়ে তুলতে চাইলেন পাহাড় আর গাছপালা ঘেরা উদ্যান।
শুন্যোদ্যান বা hanging Garden প্রকৃত অর্থে কোন ঝুলন্ত উদ্যান নয় বরং ব্যালকনির উপর গড়ে তোলা বাগান বলা যেতে পারে একে। পাথরের স্তম্ভের উপর গড়া হয় পাথর বা ইটের প্লাটফর্ম। প্লাটফর্মের উপর শীসার আস্তরন দিয়ে তাকে করাহয় নিশ্ছিদ্র যাতে পানি চুইয়ে মূল ফ্রেমের ক্ষতি সাধন না করতে পারে পানি। তার উপর মাটি দিয়ে সেখানে লাগানো হয় গাছপালা। আর সেই উদ্যানে পশুপাখি দিয়ে ফিরিয়ে আনার চেস্টা করেন পার্বত্য পরিবেশকে। অনেক গুলো স্তর ছিল এই উদ্যানে। সবচে উচু ছাদের উপর ছিল বিশাল বাগান। স্থাপনার বাইরে দিয়ে ছিল উপর ওঠার সিড়ি।

কতবড় ছিল এই উদ্যান? এটি ছিল ৪০০ ফুট লম্বা ৪০০ ফুট প্রশস্ত এবং ৮০ ফুট এবং কারো কারো মতে নগর প্রাচীরের সমান বা ৩২০ফুট উচু। সমতল মরুভূমি থেকে উপর গড়ে ওঠা কৃত্রিম পাহাড় ছিল নিসন্দেহে এক অপরুপ নয়নাভিরাম স্থাপনা।
এত উচুতে বিভিন্ন স্তরের বাগানগুলোতে কিভাবে পানি দেওয়া হত তা এক রহস্য। প্রতিদিন প্রায় ৮,২০০ গ্যালন পানির প্রয়োজন পড়ত এই বাগানের জন্য। ধারনা করা হয় সংলগ্ন ইউফ্রেটিস নদি থেকে বালতি এবং চেইন পাম্প দিয়ে চাকার সাহায্যে উপর তোলা হত পানি। পানি তোলা ছাড়াও অন্য প্রশ্ন ছিল এই উদ্যানকে ঘিরে যেমন এর আশে পাশে ছিল না কোন পাথরের উৎস, কোথা থেকে পাথর এল? কিভাবে মুল ফ্রেমকে রক্ষা করে এই স্থাপনাকে টিকিয়ে রাখা হয়েছিল ইত্যাদি।

আনুমানিক খৃস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে ভূমিকম্পে ধ্বংস প্রাপ্ত হয় এই বাগান।

শুন্যোদ্যান বিতর্ক।
প্রাচীন যুগের সপ্তাশ্চর্য্যের মধে আজ ও টিকে থাকা একমাত্র স্থাপনা হল মিশরের গিজের পিরামীড। অনান্য ৬টি- ব্যাবিলনের শুন্যোদ্যান, আলেকজান্দ্রিয়ার বাতিঘর, জিউসের মুর্তি, আরটেমিসের মন্দির, রোডসের কলোসিয়াম, হালিকারনেসাসের সমাধিক্ষেত্র গুলো আজ ধ্বংশপ্রাপ্ত। পিরামিড এবং শুনয়োদ্যান ছাড়া বাকী পাঁচটী গ্রীকদের তৈরী। ব্যাবিলনের এই উদ্যান নিয়ে বিতর্ক অনেক। আদৌ কোন উদায়ন ছিল কিনা তা প্রশ্ন তোলেন অনেকে। কারন হল ব্যাবিলনের শুন্যোদ্যানের ধংশাবশেষ সন্দেহাতীত ভাবে নির্নয় করা সম্ভব হয় নি। সে সময়ে পাথরের ফলকে“কিউনিফর্ম” বা গোঁজ আকৃতির হরফে লিখে রাখার যে রেওয়াজ ছিল সে রকম কোন ফলক পাওয়া যায় নি। গ্রীক ও রোমান ঐতিহাসিক যেমন, ডিওডোরাস সিকুলাস , স্ট্রাবো, কুইন্টাস কার্টিয়াস রুফুস দের লেখায় বর্ননা মেলে এই শুন্যোদ্যানের ।
খৃস্টপূর্ব ৪৫০ অব্দে গ্রীক ঐতিহাসিক হেরোডেটাস ব্যাবিলনের যে বর্ননা দেন সেখানে শুন্যোদ্যানের উল্লেখ নেই। না থাকার কারন হিসেবে অনেকে উল্লেখ করেন সেই সময়ের মেসোপটেমিয়াতে দেবতাদের টাওয়ার মন্দির নির্মান করা হত যাদের বলা হত “জিগুরাত” স্তরে স্তরে গড়ে ওঠা এই মন্দির শীর্ষে থাকত দেবতার পীঠস্থান আর বাইরে দিয়ে থাকত উপরে ওঠার সিড়ি। শুন্যোদ্যানকে এই জিগুরাতের অংশ হিসাবেই বিবেচনা করা হত। আবার অনেকের ধারনা ইউফ্রেটিস নদী ক্রমশ পুবদিকে সরে আসার কারনে নদীগর্ভে বীলিন হয়ে গেছে ধ্বংশাবশেষ।
অনেক শতাব্দী ধরে ব্যাবিলনের ধংশাবশেষ ছিল মরুভূমির মধ্যে কতগুলো উচু ঢিবি। ১৮৯৯ সালে জার্মান প্রত্নতত্ববিদ রবার্ট কোল্ডওয়ে ১৪ বছর ধরে খনন কাজ চালান ব্যাবিলনে। তিনি খুজে পান ব্যাবিলন নগরীর প্রাচীর দেওয়াল, ব্যাবেল টাওয়ার, নেবুচাদনেজারের প্রাসাদ ইত্যাদির ধ্বংশাবশেষ।দক্ষিনদিকে খননকাজ চালিয়ে তিনি খুজে পান ১৪টি কক্ষের পাথরের প্লাটফর্ম যা ধারনা করা হয় শুন্যোদ্যানের নীচের অংশ হিসেবে।

শুন্যোদ্যানের নির্মাতা সম্রাট নেবুচাদনেজার নাকি এসীরিয় রানী সেমিরিস, নাকি চেলদেনাজের সে প্রশ্ন ও তোলেন অনেকে ? সম্রাজ্ঞী এমিতিস নামে কেউ ছিলেন কিনা তা ও জিজ্ঞাস্য অনেকের। হয়ত একদিন খুজে পাওয়া যাবে ব্যাবিলনের শুন্যোদ্যানের কিউনিফর্ম প্রস্তরফলক। সম্রাজ্ঞী এমিতিস তার উপহার পেয়ে খুশি হয়েছিলেন কিনা তা আমরা জানি না তবে অধিকাংশ মানুষের বিশ্বাস ব্যাবিলনে শুন্যোদ্যান ছিল এবং তা ছিল প্রাচীন যুগের এক অত্যাশ্চার্য্য স্থাপনা ।


৯টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

আত্মপোলব্ধি......

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:৫১

আত্মপোলব্ধি......

একটা বয়স পর্যন্ত অনিশ্চয়তার পর মানুষ তার জীবন সম্পর্কে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায়। এই বয়সটা হল পঁয়ত্রিশ এর আশেপাশে। মানব জন্মের সবকিছু যে অর্থহীন এবং সস্তা সেটা বোঝার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি !

লিখেছেন হাসানুর, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:৩২



হঠাৎ ইলিশ মাছ খেতে ইচ্ছে হল । সাথে সাথে জিভে ..জল... চলে এল । তার জন্য একটু সময়ের প্রয়োজন, এই ফাঁকে আমার জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প ক্ষমতায় আসছে এটা ১০০% নিশ্চিত। আমেরিকায় ইতিহাসে মহিলা প্রেসিডেন্ট হয়নি আর হবেও না।

লিখেছেন তানভির জুমার, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৩৩

আর এস এস সহ উগ্র হিন্দুদের লিখে দেওয়া কথা টুইট করেছে ট্রাম্প। হিন্দুদের ভোট-আর ইন্ডিয়ান লবিংএর জন্য ট্রাম্পের এই টুইট। যার সাথে সত্যতার কোন মিল নেই। ট্রাম্প আগেরবার ক্ষমতায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প জিতলে কঠোর মূল্য দিতে হবে ইউসুফ সরকারকে?

লিখেছেন রাজীব, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৪২

ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক মন্তব্যে বাংলাদেশের মিডিয়ায় ঝড় উঠেছে। ৫ তারিখের নির্বাচনে ট্রাম্প জিতলে আরেকবার বাংলাদেশের মিষ্টির দোকান খালি হবে।

আমি এর পক্ষে বিপক্ষে কিছু না বললেও ডায়বেটিসের রুগী হিসেবে আমি সবসময়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×