অনুপ্রেরণা বা ইন্সপিরেশান শব্দদু’টো আমার কাছে মাঝেমধ্যে একটু গোলমেলে মনে হয়। বিখ্যাত ব্যক্তিরা কোথাও থেকে কোন আইডিয়া নিয়ে কিছু লিখলে আমরা বলি, উনি ওখান থেকে একটু অনুপ্রেরণা নিয়েছেন। আর আমজনতা তেমনটা করলে আমরা বলি, ব্যাটা নকল করেছে বা কপি করেছে। একেবারে সরাসরি আক্রমন! যেমন দেখেন, আমাদের ব্লগার রাজীব নূর। উনার লেখায় হুমায়ুন আহমেদের প্রভাব সুস্পষ্ট। অনেকেই অতীতে বিভিন্ন সময়ে উনাকে উপদেশ দিয়েছেন, হুমায়ুন আহমেদকে নকল করবেন না। নিজের মতো করে লিখুন। এখন আল্লাহ চাহে তো রাজীব নূর যদি কোনদিন সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েই যায়, তাহলে কি দৃশ্যপট পাল্টে যাবে না? অবশ্যই যাবে। তখন সবাই বলবে, বিখ্যাত কথা সাহিত্যিক রাজীব নূর, হুমায়ুন আহমেদের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েছেন। কোন কোন দুর্মুখ হয়তো বলে বসতে পারে, কার কথা বলছেন? হুমায়ুন আহমেদ? আরে উনার অনেক লেখাই রাজীব নূরের নকল!
আমাদের বাংলা ভাষার নোবেল বিজয়ী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বেড়ে ওঠা, আরও নির্দিষ্ট করে বললে বিখ্যাত হয়ে ওঠা পুরোটাই হয়েছে ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষে। তখনকার শিক্ষিত এলিট হিন্দুসমাজে ইংরেজি সাহিত্য চর্চা ছিল একটা স্বাভাবিক ব্যাপার। রবীন্দ্রনাথও এর বাইরে ছিলেন না। পুরোটা জীবদ্দশায় বিভিন্ন সময়ে উনি সর্বমোট নয় বার যুক্তরাজ্য ভ্রমন করেন। খুব ঘনিষ্ঠভাবে মিশেছেন অনেক ব্রিটিশ কবি-সাহিত্যিকদের সাথে, পরিচিত হয়েছেন উনাদের সাহিত্যকর্মের সাথে। আর তার ছাপ রেখে গিয়েছেন উনার রচিত অনেক বিখ্যাত গানে। আজ এমনি অনেক গান থেকে দশটি গানের সাথে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেবো। এই গানগুলোর সরাসরি অনুপ্রেরণা উনি নিয়েছেন বিভিন্ন ব্রিটিশ কবি-সাহিত্যিকদের রচনা থেকে।
১। পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কিরে হায়ঃ বিখ্যাত স্কটিশ কবি ও লোক সঙ্গীত সংগ্রাহক রবার্ট বার্নস (১৭৫৯-১৭৯৬) ১৭৮৮ সালে একজন মেষপালকের কাছে একটি গান শুনেন। পরে নিজের দু’টি স্তবক মূল গানের সাথে সংযোজিত করেন। এই কবি’র মৃত্যুর পর ১৭৯৯ সালে উনার নিজের রচনা হিসাবে প্রকাশ পায় Auld Lang Syne নামের এই গানটি। এই স্কটিশ লোকগীতি পরে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পরে এবং ভীষণ জনপ্রিয়তা পায়। মূল গানের লিঙ্ক view this link
২। আহা আজি এ বসন্তেঃ আইরিশ কবি থমাস মূর (১৭৭৯-১৮৫২) রচনা করেন Go where glory waits thee. এই গান থেকেই অনুপ্রাণীত হয়ে বিশ্বকবি এই গানটি রচনা করেন। মূল গানের লিঙ্ক view this link
৩। কালী কালী বলরে আজঃ Nancy Lee গানের কথা লেখেন ফ্রেডেরিক ই. হুইদারলী (১৮৪৮-১৯২৯)। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এই ব্যক্তি ছিলেন একাধারে লেখক, আইনজীবি, সুরকার, ব্রডকাস্টার। এই গানে সুরারোপ করেন মাইকেল মেব্রিক, স্টেফান এডামস নামে। মূল গানের লিঙ্ক view this link
৪। কতোবারো ভেবেছিনু আপনা ভুলিয়াঃ বেন্জামিন জনসন (১৫৭২-১৬৩৭), বেন জনসন হিসাবে ইনি সমধিক পরিচিত। এই ইংলিশ ভদ্রলোক একজন কবি হিসাবে পরিচিতি পেলেও একইসঙ্গে উনি ছিলেন কমেডিয়ান, সাহিত্য সমালোচক এবং নাট্যকার। drink to me with only thine eyes নামের এই গানটি তিনি রচনা করেন ১৬১৬ সালে। রজার হুইটেকারের গাওয়া গানটি শুনতে পারেন
view this link
৫। ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে বহে কিবা মৃদু বায়ঃ বিখ্যাত স্কটিশ কবি ও লোক সঙ্গীত সংগ্রাহক রবার্ট বার্নসের আরেকটা অমর রচনা। এটির রচনাকাল ছিল ১৭৯১ সাল। গানটি The Banks O' Doon অথবা Ye Banks and Braes উভয়ভাবেই পরিচিত। মূল গানের লিঙ্ক view this link
৬। তবে আয় সবে আয়ঃ ইংল্যান্ডের কাম্বারল্যান্ডে এক কৃষক এবং নামকরা শিকারী ছিলেন জন পীল। এই ভদ্রলোকের বন্ধু ছিলেন সুরকার ও গীতিকার জন উডকক গ্রেভস। বন্ধুকে নিয়ে তিনি D'ye ken John Peel নামের একটি গান রচনা করে তাতে সুর দেন। এই গান রচনার আগে তিনি ততোটা পরিচিত ছিলেন না। এই গানটি-ই জন উডকক গ্রেভস এবং তার বন্ধু জন পীলকে অমর করে দেয়। মূল গানের লিঙ্ক view this link
৭। ও দেখবি রে ভাইঃ এই গানটির অনুপ্রেরণা নেয়া হয়েছিল The Vicar of Bray নামের একটি বিখ্যাত গান থেকে। বিশেষভাবে ১৫৩৩-১৫৫৯ সালের পটভূমিকায় রচিত এটি মুলতঃ এক পল্টিবাজ লোক সম্পর্কে একটা বিদ্রুপাত্বক গান। এখানে ইংল্যান্ডের চার্চ এবং রাজন্যবর্গকে নিয়েও কিছু বিদ্রুপ করা হয়, ফলে স্বাভাবিকভাবেই এর রচয়িতার কোন হদিস পাওয়া যায়নি। পরবর্তীতে এটি বিভিন্ন যাত্রাপালায় ব্যবহৃত হয় এবং ১৯৩৭ সালে এই গানের উপর ভিত্তি করে একটা চলচিত্রও তৈরী করা হয়। মূল গানের view this link
৮। তুই আয়রে কাছে আয়ঃ The British Grenadiers, এই গানটির রচয়িতাকেও খুজে পাওয়া যায়নি। ১৬৮৯ সালে এটাকে বৃটিশ সেনাবাহিনীর কুচকাওয়াজে প্রথম ব্যবহার করা হয়, যা পরবর্তীতে অব্যাহত থাকে। ১৯০৭ সালে এই গানটির রচয়িতা-বিতর্কের সবচেয়ে ভালো ব্যাখ্যা দেন বৃটিশ ভারতে জন্মগ্রহনকারী সুরকার আর্নেস্ট ওয়াকার। তিনি বলেন, এটি আসলে গত তিন শতাব্দী ধরে বিবর্তিত একটি এলিজাবেথিয় সুর। মূল গানের লিঙ্ক view this link
৯। মানা না মানিলি, তবুও চলিলিঃ আইরিশ কবি থমাস মূর (১৭৭৯-১৮৫২) রচনা করেন Go where glory waits thee. এই গান থেকেই অনুপ্রাণীত হয়ে বিশ্বকবি রচনা করেন আহা আজি এ বসন্তে গানটি। এই একই গান থেকে অনুপ্রাণীত হয়ে দ্বিতীয় রচনা এটি। মূল গানটির লিঙ্ক দুই নাম্বারে ইতোমধ্যেই দেয়া হয়েছে, তাই আর দিলাম না।
১০। সকলি ফুরালো স্বপনপ্রায়ঃ ১৭৫০ সালে লেডী ক্যারোলাইনা কেপেল Robin Adair শিরোনামের একটি গান রচনা করেন। আঠারো শতকে এটি অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠে। এই গান রচনার পিছনে একটা ইন্টারেস্টিং কাহিনী আছে। লেডী ক্যারোলাইনা, রবার্ট নামের ব্রিটিশ আর্মির এক কর্নেলকে পরিবারের অমতে বিয়ে করেন। কম-মর্যাদাপূর্ণ পরিবারের হওয়ায় রবার্টকে লেডীর পরিবার মেনে নেয়নি। পরিবারকে জবাব দেয়ার জন্য লেডী এই গানটি রচনা করেন। মূল গানের লিঙ্ক view this link
আমার এই পোষ্ট দেখে রবীন্দ্রপ্রেমীরা আবার রাগ করবেন না যেন। আমি নিজেও কিন্তু একজন রবীন্দ্রপ্রেমী। উনার সমালোচনা করার জন্য এই পোষ্ট আমি দেইনি। আমাদের মানসিকতা তুলে ধরার জন্য দিয়েছি বলতে পারেন। যে কোনও ক্রিয়েটিভিটি অনুকরন বা অনুসরন করা দোষের কিছু না, হুবহু কপি করা দোষের। এটা আমাদেরকে বুঝতে হবে। এদিকে বিশ্ববিখ্যাত স্প্যানিশ শিল্পী পাবলো পিকাসো অবশ্য এ'ব্যাপারে কিছুটা ভিন্নমত পোষণ করেন। উনি বলেছেন, নিজেকে কপি করা খারাপ, তবে অন্যকে কপি করা দোষের কিছু না!!
তথ্য এবং ছবিঃ গুগল থেকে।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে মে, ২০১৯ সকাল ১১:৩৮