বিখ্যাত মনীষিদের জীবনী সম্পর্কে জানতে আমাদের একটু বেশিই ভাল লাগে। আপনি লক্ষ্য করলে দেখবেন, বিখ্যাত মনীষিদের বেশিরভাগই তাদের লেখাপড়ার গন্ডি পাড় করতে পারেননি। প্রথম কথা হচ্ছে আপনি বিখ্যাত নন। আপনাকে বিখ্যাত হতে হবে এমন ধারনা থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে আনুন আর মনের মধ্যে সেট করে নিন আপনি বিখ্যাত না হলেও আপনাকে অবশ্যই ভাল কিছু করতে হবে। মনে করুন আপনার জানা শোনা কোন লোক সামান্য লেড়াপড়া করেই ভাল একটি চাকরী পেয়ে গেল এর অর্থ এই নয় যে ঐলোকটির মত আপনিও পাড় পেয়ে যাবেন। আপনাকে কঠোর পরিশ্রমী ও অধ্যাবস্বায়ী হতে হবে। আমি ধরে নিচ্ছি আপনি একজন স্টুডেন্ট। আপনি নিয়মিত লেখাপড়া করেন না। আজকে এমন কিছু বিষয় তুলে ধরব যেটা ফলো করলে আপনিও ভাল কিছু করতে আগ্রহবোধ করবেন। আমি পরীক্ষার খাতায় প্রচুর কোটেশন ব্যবহার করে থাকি আপনাদের সুবিধার্থে কথাগুলি আজও কোটেশন আকারে প্রকাশ করব। মেনে চলা না চলা একান্তই আপনার ইচ্ছার উপর ডিপেন্ড করবে আমি আমার মত করে লিখে দিচ্ছি। (আপনার প্রয়োজনে কোটেশন এড কিংবা রিমুভ করে নিবেন)। আপনি আপনার মত করে গ্রহন করবেন।
১. নিয়মিত পড়ুন: আপনি কিছুই জানেন না এই ধারনা মনের মধ্যে পোষণ করুন। আপনাকে শিখতে হবে এই ধারনা রেখে প্রতিদিনই কিছু নতুন নতুন জিনিস শিখে নিন। লেখাপড়াটা প্রতিদিনই করুন। ছোট ছোট লক্ষ্য সেট করুন শুরুতেই অবাস্তব কিংবা অবান্তর লক্ষ্য সেট করবেন না। একবার লেখাপড়ার প্রতি বিরক্তি চলে আসলে পূনরায় মন বসানো বেশ কঠিন।
২. লেখাপড়ার মাঝে ব্রেক নিন: বিজ্ঞানীরা বলেছেন, মানুষের ব্রেইন একটানা ২৫-৩০ মিনিট একই কাজ করার পর ধীরেধীরে ব্রেইন হ্রাস পেতে থাকে। তাই ব্রেইনকে একটু বিশ্রাম দিতে ৩০ মিনিট লেখাপড়া করার পর ৫-১০ মিনিটের ছোট্ট ব্রেক নিন। ব্রেক যেন কোন অবস্থায়ই বড় না হয়। এই ব্রেকের সময় আপনার যা করতে ভাল লাগে আপনি তাই করুন। মন চাইলে ২মিনিটের জন্য ফেসবুকে টু মেরে আসুন, গান শুনতে মন চাইলে শুনুন, নাচতে মন চাইলে নাচুন। মোটকথা আপনার যা করতে ভাল ভাল লাগে তাই করুন। একবার আমার এসএসসি পরীক্ষার সময় গনিত পরীক্ষা। আমি ব্রেক পেলেই ফুল রিদমে গান শুনে যাচ্ছি এমন সময় আশে পাশের সবাই এসে বলতেছে তোমার না কাল ম্যাথ এক্সাম? তো কি হইছে? কাল এক্সাম দেখে কি আজ গান শুনা যাবে না এমন বিধান আছে! পরেরদিন এক্সাম দিয়ে বলেছিলাম গনিতে ৯৫ তে A+ হলেও আমি পাব।
৩. পড়ার জন্য নো কিউজ: আমাদের সমাজের এখনো অনেক মানুষ আছেন যারা ভাবেন সকল কাজ করার পরে যদি টাইম হয় তবেই লেখাপড়া করা হবে। বরং এখন উল্টোভাবে ভাবা হয় লেখাপড়া করার পরে টাইম হলে অন্য কাজ করবেন। আপনাকে বিনয়ী ভাবে বলছি, পড়ার টাইমে না পড়ার জন্য একান্ত প্রয়োজন না হলে কোন কিউজ দাঁড় করাবেন না।
৪. কখনোই বাজে চিন্তা করবেন না: বাজে চিন্তা শুধুই আপনার হতাশা বাড়াবে সেটা যে ব্যাপারেই হোক। এবং আপনার সময়কেও নষ্ট করবে। তাই অযথা উদ্বিগ্ন না হয়ে ঐ সময়টাকে পড়ার মধ্যে ব্যয় করুন। হতাশা, ক্লান্তি ও আক্ষেপ সব জীবনেই থাকে। আপনাকে দমে গেলে চলবে না। দমে গেলেই হেরে যেতে হয়। পৃথিবীর সবাই একত্রে সুর মিলিয়েও যদি বলে আপনি পারবেন না আর আপনার যদি কোনক্রমে মনে হয় আপনি পারবেন তবে আমি বলছি আপনি পারবেন। আপনি কি পারবেন তা একান্তই আপনি জানেন। কি প্রতিভা আছে আপনার মাঝে! শুধু মুখ থুবড়ে লেগে থাকুন।
৫. আপনাকে শ্রেষ্ঠ পাঠক হতে হবে: আপনি মানেন আর নাই বা মানেন লেখাপড়া অবশ্যই ধৈর্য্যশীলদের কাজ। হটমেজাজী বাঁচাল ও উদ্ভট টাইপ ছেলেমেয়ে দিয়ে আর যাই হোক লেখাপড়া হবে না। বরং ধৈর্য্য ধরে, বিনয়ী হয়ে আপনাকে উত্তম পাঠক হতে হবে। পাঠ্য বইয়ের পাশাপাশি অন্যান্য বই অধিক পড়বেন। দ্রুত পত্রিকা পড়ার অভ্যেস করে ফেলুন। আমি কলেজ লাইফে পাঠ্য বই পড়ার পর অন্যান্য বই পড়ার জন্য একটা নিয়ম ফলো করতাম। দুপুরে কিংবা রাতে শোয়ার পর ঘুমিয়ে যাওয়ার পূর্ব মূহুর্তে বাইরের বই পড়তে পড়তে ঘুমাতাম। উল্লেখ যে, আমি শুয়েও ঘন্টার পর ঘন্টা পড়তে পারতাম। শুয়ে পড়লে নাকি অনেকেই ঘুমিয়ে যান। আমার এমন হয়েছে খুব অল্প সময়েই। বিভিন্ন লেখকের মিনিমাম ১০০-১৫০ বই পড়ে নিন। পারলে আরো বেশি পড়বেন। তবে পাঠ্য বই বাদ দিয়ে নয়।
৬. কোটেশন ও ফলো চার্ট ব্যবহার করুন: প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে কোটেশন, ডাটা, চিত্র বা ফলো চার্ট, ফলো আপ ও তথ্যবহুল করে পড়ুন। কোটেশন করে পড়লে পড়া দ্রুত আয়ত্তে চলে আসে। তাই আমি বলব যথা সম্ভব কোটেশন ব্যবহার করবেন। নিজের আইডিয়ার প্রতি গুরুত্ব দিন। একটা বিষয় সম্পর্কে আপনার কি মতামত এটার গুরুত্ব সবচাইতে বেশি তবে খেয়াল রাখুন কোন মতেই যেন তথ্যগুলি মিথ্যা, বানোয়াট ও অবান্তর না হয়। যে বিষয়ে আপনি ভাল জানেন না, সে বিষয়ে অন্যকে জ্ঞানদান করতে যাবেন না। সেক্ষেত্রে শতভাগ নিশ্চিত হলে সমস্যা নেই।
৭. একই পড়া বিভিন্ন সোর্স থেকে পড়ুন: যে কোন বিষয় সম্পর্কে এক বই থেকে না পড়ে বিভিন্ন বই থেকে ধারনা নিন। সেক্ষেত্রে ইন্টারনেটের সাহায্য নিতে পারেন। যদিও ইন্টারনেটে লেখাপড়া একটু সময়সাপেক্ষ তবুও সহজে প্রাপ্তির জন্য পড়তে পারেন।
৮. গ্রুপ স্টাডি করুন: একা মানুষ বোকার সমতূল্য। যথাসম্ভব ভাল এবং মেধাবী বন্ধু সিলেন্ট করে গ্রুপ স্টাডি করতে পারেন এটা খুবই ফলপ্রসূ। বাজে ও উদ্ভট ও অন্য মানুষকে সম্মান করে না এমন বন্ধু এড়িয়ে চলুন কেন না উদ্ভট লোকের কাছ থেকে তেমন কিছু শেখার নেই। তবে খেয়াল রাখুন গ্রুপ স্টাডি যেন গ্রুপ আড্ডায় পরিনত না হয়। আড্ডা করবেন তবে তা যেন আপনার পড়ার পরেই হয়।
৯. আধা না পড়া, আধা না জানা: আপনার মাথার মধ্যে সেট করে নিন, "আধা পড়ে গাঁধায়" এখন আপনি ভাবেন আপনার গাধা হওয়ার ইচ্ছে আছে কিনা? কোন কিছু জানতে হলে পরিপূর্ন জ্ঞান রাখুন নতুবা জানার দরকারই নেই। একটি সহজ প্রশ্ন করি। আচ্ছা আপনাকে সবকিছু জানতেই হবে কেন? আপনার স্কিল যত ভালই হোক আপনি সব জানবেন না এটা মেনে নিয়েই পড়তে থাকুন।
১০. যে কাজটি করবেন ঐকাজে সফল ব্যক্তিদের পরামর্শ নিন: কিছুদিন আগে আমার এক বন্ধু পরের বৌকে পাহারা দিতে গিয়ে কঠিনতম ধরা খায়। বুঝতেই তো পারছেন প্রেমে ছ্যাকা খেয়েছে। তার প্রেমিকার অন্যত্র বিয়ে হয়ে গেছে। সে তার প্রেমিকাকে ফেরত পেতে চায়, এই মর্মে সে আমার কাছে পরামর্শ চায়। আমিও এমন একজন ব্যক্তি যে নিজেই ছ্যাকা খেয়ে প্রেমিকাকে ছাড়া সুখেই আছি। এখন আমি আমার বন্ধুকে বললাম, প্রেমিকাকে ছাড়া কিভাবে থাকতে হয় আমি এই ব্যাপারে পরামর্শ দিতে পারি কারন আমি এই ব্যাপারে মোটামুটি এক্সপার্ট। প্রেমিকাকে কিভাবে পেতে হয় এই ব্যাপারে আমার নূন্যতম জ্ঞান নেই কারন তাহলে আমিই আমার প্রেমিকাকে পেতাম। আমার পরামর্শ বন্ধুর কাছে যুৎসই মনে হল না। আমি বলতে চাচ্ছি যে কাজের পরামর্শ একজন অসফল ব্যক্তির পরামর্শ হবে সেই পরামর্শটি যত সুন্দরই হোক না কেন আপনি সেই কাজটাতে ৭৫% অসফল হবেন। তাই সবার পরামর্শ নেয়া যাবে না এটা মাথায় রাখুন। আর যদি একান্তই পরামর্শের দরকার হয় নিজের পরামর্শ নিন।
১১. সহজ বিষয়কে প্রাধান্য দিন: একটা কঠিন প্রশ্ন থেকে পাঁচটা সহজ প্রশ্ন আঠস্থ করুন। কঠিন প্রশ্ন সহজ প্রশ্নকে ভূলিয়ে দেয়। সহজ প্রশ্ন পড়াকালীন দুএকটা কঠিন প্রশ্ন বুঝে পড়ুন। নিজেই প্রশ্ন উত্তর করার ভিন্ন ধাপ তৈরী করুন। প্রত্যেকটা প্রশ্নের সারাংশ বা মূলকথা খুঁজে বের করুন। পাশাপাশি প্রশ্নের সারাংশ থেকে ভাব-সম্প্রসারণ করার অভ্যেস করুন। দেখবেন কিছুদিনের মধ্যেই আপনার পার্থক্য নিজেই খুঁজে পাবেন।
১২. না বুঝে মুখস্থ করবেন না: যদি একটা প্রশ্ন মুখস্থ করতে পাঁচ মিনিট লাগে এবং বুঝতে যদি তা ২৫ মিনিটও লাগে তবে বুঝেই পড়ুন মুখস্থ করার দরকার নেই। কারন হচ্ছে, বুঝে পড়লে সারাজীবনেও সেই বিষয়টি আর ভূলবেন না। আমরা ছোটবেলায় দাড়ি কমাসহ কবিতা মুখস্থ করার কারনে আমাদের মধ্যে এই ধারনা হয়ে যায় লেখাপড়া আসলে মুখস্থ বিদ্যা। আপনার মুখস্থ বিদ্যা ততটা কাজে দিবে না যতটা আপনি আশা করে বসে আছেন। আমি পঞ্চম শ্রেনীতে পড়াকালীন ইংরেজী Application এর ধরন বুঝে পড়ছিলাম। আমাকে লেখাপড়ার কোন ক্লাসেই আর Application পড়তে হয়নি শুধু চোখ বুলিয়ে যেতাম।
১৩. পড়ার টাইম সেলেক্ট করা: মাক্সিমাম মানুষই এই জায়গাটায় ভূল করে। আমি যখন মাধ্যমিক স্কুল লেভেলে ছিলাম তখন আমার ক্লাসের অন্যান্য সাধারন ছাত্ররা যেভাবে চলত আমিও ওদের সাথে চলতাম ঘুরতাম। খুব সম্ভবত ৯-১০টার আগে বাসায় ফিরতাম না। বছর শেষে আমি ক্লাসের ফার্স্ট বয় হতাম আর ওদের পাশ করতেই ধুম ছুটে যেত। কারনটা কি? কারনটা খুবই সিম্পল। ওরা রাতে বাসায় ফিরে ঘুমাত আর ঐ সময়টায় আমি রাতের খাবার খেয়েই পড়তে বসতাম। বলতে লজ্জা নেই তখন পড়ার জন্য আমার পড়ার টেবিলটাও ছিল না। খাটের উপর বসে, আধাশুয়ে, শুয়ে এমনকি চিৎ হয়েও পড়তাম। সত্যিকথা বলতে কি, তখন একটুও বিরক্তি লাগত না। পড়ার আনন্দটা আমাকে এতটাই পেয়ে বসেছিল (সেই সময়কার কিছু ঘটনা মনে হলে এখনো চোখের কোনে জল এসে যায়, ঐঘটনা আরেকদিন বলব কোন এক গল্পে)। আপনি পড়ার জন্য একটা টাইম সিলেক্ট করবেন। হয়ত আপনি রাতে দেরি করে ঘুমাতে যাবেন নয়ত সকালে খুব ভোরে ঘুম থেকে জাগবেন। এক্ষেত্রে প্রথম পদ্ধতিটাই শ্রেয় কেন না, গভীর রাতে আপনাকে ডিস্টার্ব করার মত কেউ থাকবে না। পরিবেশ শান্ত ও নিরব থাকবে। তখন সকালে লেট করে ঘুম থেকে জাগলেও সমস্যা হবে না। খেয়াল রাখবেন, ঘুমটা যেন প্রয়োজনের অতিরিক্ত না হয়।
১৪. পড়াকালীন খেয়াল রাখবেন: পড়ার সময় সবকিছু যুক্তিতর্ক দিয়ে বিচার করবেন না বিশেষ করে ধর্মীয় বিষয়। এগুলি বিশ্বাস করেই পড়বেন। আবার কিছু বিষয় থাকবে যেগুলি যুক্তিতর্ক ছাড়া মেনে নিবেন না। শুধু আপনাকে বুঝতে হবে কোথায় যুক্তিতর্ক করবেন আর কোথায় মন থেকে বিশ্বাস করেই পড়বেন।
১৫. শিক্ষার পাশাপাশি বিনোদন: আগেই বলেছি লেখাপড়ার মাঝে একগেয়েমি কিংবা বিরক্তিভাবকে স্থান দেয়া যাবে না। মাঝে মাঝেই ভ্রমন করুন। সপ্তাহে ছয়দিন পড়ুন আর একদিন ঘোরাফেরার জন্য রাখুন। ঐ দিনটা কেবল আপনারই। ঐদিন ফোন বন্ধ করে দিন এইবার বেরিয়ে যান। ঘোরাফেরার সময় কোন প্রকার টেনশন করবেন না। আপনি একজন শৌখিন বিশালপ্রিয় ও পরিব্রাজক পরিবারের সদস্য তখন এমন ভাবেন চলুন। নিজেকে ঐসময়টাতে এই জগৎ সংসার থেকে মুক্ত করে দিন। প্রচুর প্রান সঞ্চার করুন যেন বাকি ছয়টা দিন আপনার আনন্দেই কেটে যায় তবে আনন্দের জন্য লেখাপড়াকে ভূলে যাবেন না। লেখাপড়া আপনার সর্বউত্তম বন্ধু এটা হৃদয়পটে গেঁথে রাখুন।
এই মূহুর্তে এগুলোই ফলো করতে পারেন। যে বিদ্যা মনুষত্যের বিকাশ ঘটাতে পারে সেটাই তো প্রকৃত বিদ্যা। আপনি বিনয়ী ও পরিশ্রমী হলে বিশ্বাস রাখুন আপনার দ্বারাই ভাল কিছু হবে। মনে রাখবেন, যেকোন কাজের শেষটায় বেশটা থাকে। সুতরাং যাই করুন পরিপূর্ন করাটাই আপনার নৈতিক দায়িত্ব।
সৃষ্টিকর্তার উপর ভরসা রেখে এগিয়ে যান।
শুভ কামনা রইল।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে অক্টোবর, ২০১৮ রাত ১:৩৯