অ্যাপোলো- ১০ মিশনের সময় তোলাঃ ক্যাপ্টেন জন ইয়াং
১৯৬৯ সালের অ্যাপোলো-১১ মিশনে নীল আর্মস্ট্রং ও বাজ অলড্রিন এর চাঁদে অবতরণ নিয়ে নানান মুখরোচক গল্প ও বিতর্ক আমাদের মাঝে প্রচলিত আছে। এই বিতার্কিদের খুব বড়সড় একটা অংশ এইটা ফোকাসেই আনেন না যে, এই দু'জন ছাড়াও '৬৯ পরবর্তী ৩ বছরে আরও পাঁচটি এপোলো মিশনে উপরের দুইজন ছাড়াও আরও ১০জন ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তি চাঁদের বুকে পা রেখেছেন এবং লুনার রোভারও চালিয়েছেন।
ঠিক তেমন একজন ব্যক্তি হলেন অবসরপ্রাপ্ত আমেরিকান নভোচারী ক্যাপ্টেন জন ইয়াং। তিনি নবম ব্যক্তি হিসেবে ১৯৭২ সালের ২১শে এপ্রিল চাঁদে অবতরণ করেন। তিনদিন চাঁদের বুক চষে তিনি এবং তাঁর টীম ৯৫.৭১ কে.জি. নমুনা সংগ্রহ করে ২৪শে এপ্রিল তবেই চাঁদের বুক ত্যাগ করে চাঁদের কক্ষপথে ফিরে আসেন। অ্যাপোলো-১৬ এর এই মিশনের তিনি মিশন কমান্ডার ছিলেন। এই মহান নভোচারী ১৯৩০ সালের ২৪শে সেপ্টেম্বর ক্যালিফর্নিয়ার সান-ফ্রানসিসকোতে জন্মগ্রহন করেন । গতকাল ছিল তাঁর ৮৬তম জন্মবার্ষিকী। তাঁর দীর্ঘ বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে তিনি ছিলেন একাধারে নৌ-অফিসার, নভোচারী, বিমান প্রশিক্ষক এবং এরোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার।
তাঁর নামের আগে ঘটা করে "মহান" বলার কিঞ্চিৎ রহস্য আছে। কারণ তিনি অনেক দিক থেকেই পৃথিবীর মানুষদের মাঝে প্রথম এবং একমাত্র!!
চলুন সংক্ষেপে তার ছোট্ট(?!) ক্যারিয়ার থেকে একটু ঢুঁ মেরে আসি।
নৌ-বাহিনীতে চাকরীর শেষভাগে এসে ক্যাপ্টেন জন ইয়াং, ১৯৬২ সালে নাসায় যোগ দেন। এ সময় তিনি "এস্ট্রোনাট গ্রুপ-২" তে ছিলেন, যেখানে নীল আর্মস্ট্রংও একই গ্রুপের অধীন ছিলেন।
পরবর্তীতে ইয়াং ১৯৬৫ সালে "প্রথম" মনুষ্যবাহী অভিযান "জেমিনাই মিশন"এ অংশ্ নেন এবং তার পরের বছরের "জেমিনাই মিশনের" কমান্ডার হন।
এবারও আরেকদিক থেকে তিনি "প্রথম" হলেন। এবার তিনি "প্রথম স্পেস স্মাগলার" হিসেবে অভিযুক্ত হলেন!! মজার ঘটনা হল, সেবার তিনি ভুট্টা আর মাংসের তৈরী একটা স্যান্ডুইচ স্মাগলিং করেছিলেন। এজন্য অবশ্য তাকে কম মূল্য দিতে হয়নি। ফলস্বরূপ পরবর্তী কয়েকটি ফ্লাইটে তিনি আর অংশ নিতে পারেননি।
নাসা অবশ্য চতুর এই পাইলটকে নিয়ে কি করা যায় যে ব্যাপারে খুবই চিন্তিত ছিল। কারণ তিনি অন্যদের তুলনায় ছিলেন অনেক মেধাবী এবং সাহসী। তাই তাঁকে আবারও স্পেস প্রোগ্রামের আওতায় আনা হল, তবে কিছুদিন পর।
এবার ১৯৬৯ সালে অ্যাপোলো-১০ মিশনে তিনি অংশ নেন এবং "প্রথম" ব্যক্তি হিসেবে একা চাঁদের কক্ষপথ আবর্তন করেন। ২৬শে মে, ১৯৬৯ সালে পৃথিবীতে ফেরার সময় ইয়াং এর অ্যাপোলো-১০ অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে (ঘন্টায় প্রায় ৪০ হাজার কিলোমিটার বেগে) ছুটে চলে আরও একটি রেকর্ড করে। এবং এটাই ছিল মনুষ্যবাহী যেকোনো যানের পক্ষে সবচেয়ে দ্রুতগতিতে ছুটে চলা।
পরবর্তীতে ইয়াং, ১৯৭২ সালের অ্যাপোলো-১৬ মিশনে অংশ নেন। এ সময় তিনি মিশন কমান্ডার ছিলেন। তিনি এবং তাঁর দল ১৯ শে এপ্রিল চাঁদের কক্ষপথে প্রবেশ করেন এবং ২১শে এপ্রিল তিনি নবম ব্যক্তি হিসেবে চাঁদে অবতরণ করেন। এরই সাথে এবারই প্রথমবারের মত তিনি চাঁদের বুকে পা রাখেন। ২১শে এপ্রিল থেকে ২২শে এপ্রিল পর্যন্ত তিনি এবং ডিউক চাঁদের বুকে ৭১ ঘন্টা থাকেন।
এর মাঝে প্রথম দিন ৭ঘন্টা ১১মিনিট ২ সেকেন্ড , দ্বিতীয় দিন ৭ঘন্টা ২৩ মিনিট ৯ সেকেন্ড এবং তৃতীয় দিন ৫ ঘণ্টা ৪০ মিনিট ৩ সেকেন্ড সহ তিন দিনে মোট ২০ ঘন্টা ১৪ মিনিট ১৪ সেকেন্ড তাঁরা চাঁদের বুকে হেঁটে বেড়ান। এসময় ইয়াং চাঁদের বুকে "লুনার রোভিং ভেহিকল" নামক চন্দ্রযানও চালান। এই চন্দ্রযান দিয়ে তিনি চাঁদের বুকে ২৬.৭ কিলোমিটার পর্যন্ত ঘুরেও বেড়ান। চাঁদ থেকে ফেরার সময় তিনি এবং তার সহযোগী ডিউক মিলে পৃথিবীর জন্য ৯৫.৭১ কে.জি. চাঁদের নমুনা সংগ্রহ করে নিয়ে আসেন।
ক্যাপ্টেন জন ইয়াং সেই তিনজন সৌভাগ্যবান ব্যক্তির মাঝে একজন , যাঁরা দুবারের মত চাঁদ-ভ্রমণ(?) করেন।
পরবর্তীতে ইয়াং, ১৯৮১ সালে "স্পেস শাটল"এর প্রথম যাত্রা সহ দুইবার "স্পেস শাটল ফ্লাইট"এর কমান্ডার ছিলেন।
তিনি ১৯৭৪ থেকে ১৯৮৭ সাল্ পর্যন্ত "এস্ট্রোনাট অফিস"এর প্রধান ছিলেন।
ইয়াং, ২০০৪ সালে নাসা থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
দীর্ঘ ৪২ বছর নাসাতে কর্মরত অবস্থায় তিনি ছয়টি স্পেস ফ্লাইট এ অংশ নেন এবং তিনিই "একমাত্র" নভোচারী যিনি এত্তবছর যাবত নাসাতে কর্মরত ছিলেন সক্রিয় ভাবে।
তিনি আরও অনেকদিক থেকেই একমাত্র! যেমন, তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যার, নভোচারী এবং কমান্ডার হিসেবে চারটি ভিন্ন ধরণের মহাকাশযান (১. গ্যামিনি, ২. এপোলো কমান্ড/সার্ভিস মডিউল, ৩. এপোলো লুনার মডিউল এবং ৪. স্পেস শাটল) চালানোর অভিজ্ঞতা রয়েছে।
২০০৪ সালের ডিসেম্বরে নাসা থেকে অবসর নেয়া এই অদম্য সাহসী অ্যাস্ট্রোনাট ২০১২ সালে তাঁর আত্মজীবনীমূলক বই "ফরএভার ইয়ং" প্রকাশ করেন।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ রাত ৩:২৬