একটি চার বাটন সমৃদ্ধ 'রিমোট কন্ট্রোল ডিভাইস' আবশ্যক। এই শিরোনামে একটি বিজ্ঞাপন খসড়া করলে কেমন হয়। জহির সাহেব পকেট থেকে মোবাইল বের করে একটি বিজ্ঞাপনের খসড়া করতে বসে যান। সস্তা দামের মোবাইলে ও আজকাল বাংলা লেখা যায়। ঢাকা শহরের ট্রাফিক জ্যামে তিনি এখনও শাহবাগের মোড়ে আটকে আছেন। টিকেট কেটে বাসে চড়েছেন সেই বেলা দুটোয়। কখন শ্যামলী পৌঁছুবেন জানা নেই। শ্যামলী একজনের সাথে বিকাল চারটায় অ্যাপয়েনমেন্ট দেওয়া আছে। চারটায় পৌঁছুতে পারবেন কিনা নিশ্চিত হতে পারছেন না। ভদ্রলোককে ফোন করে সংক্ষেপে জানিয়ে দেয়া যেতে পারে যে তিনি ঠিক চারটায় আসতে পারছেন না।
জরুরী আবশ্যক
একটি রিমোট কন্ট্রোল ডিভাইস জরুরী আবশ্যক। ডিভাইসে মাত্র চারটি বাটন থাকবে। ওয়ান, টু, থ্রি এবং জিরো। ০১৭৭৫৪৩২***।
বিজ্ঞাপনের খসড়াটি করে আবার তিনি ভাবতে বসলেন। বিজ্ঞাপনটি কাদের চোখে পড়বে? যাদের চোখে পড়বে তারা শুধু চার বাটন সমৃদ্ধ রিমোট কন্ট্রোল ডিভাইস কেনো বিক্রয় করবে? নতুন যুতসই কোনো ভাষা তিনি খুঁজে পাচ্ছেন না। এককথায় নিজের প্রয়োজনটাকে ফুটিয়ে তোলাই বিজ্ঞাপনের কাজ। সেই প্রয়োজনটাকে অল্প কথায় ফুটিয়ে তুলতে হবে। বিজ্ঞাপনের ভাষার সেই ভাব তিনি খুঁজে পাচ্ছেন না।
শাহাবাগ মোড়ের ট্রাফিক সিগন্যাল পেরিয়ে সাইন্স ল্যাবরেটরী অভিমুখে বাসটি চলছে। বাটা সিগনালের মোড়ে এসে আবার জ্যাম। গাড়ি চলতে থাকলে জহির সাহেবের ভাবনাটাও চলে তালে তালে। গাড়ি জ্যামে বসে গেলেই হাতে থাকা মোবাইলটা নিয়ে আবার বিজ্ঞাপনের খসড়ায় মনোনিবেশ করেন।
"দক্ষ সফটওয়্যার ডেভেলপার কর্তৃক একটি রিমোট কন্ট্রোল ডিভাইস উন্নয়ন আবশ্যক। এক, দুই, তিন এবং শূন্য এই চারটি বাটন থাকবে ডিভাইসটিতে। উপযুক্ত সম্মানীর নিশ্চয়তা। যোগাযোগ-০১৭৭৫৪৩২***।"
বিজ্ঞাপনটির খসড়া করে জহির সাহেব এবার একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন। পনের শব্দে বিজ্ঞাপনটি লিখতে পারলে এক হাজার টাকায় বিজ্ঞাপনটি ছাপানো যেতো। পনের শব্দের অতিরিক্ত প্রতি শব্দ পঞ্চাশ টাকা করে বাড়তি দিতে হবে। কিন্তু রিমোটের প্রয়োজনীয়তা বুঝাতে গিয়ে অতিরিক্ত আরও দশটি শব্দ বেশি লাগাতে হয়েছে। আগামীকাল দুপুরের মধ্যেই পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
বাস শ্যামলী পৌঁছে গেছে। বাস থেকে নেমে একটু চা বিরতি নেওয়া দরকার। বোধহীন একটা ক্লান্তিবোধ সুক্ষ্মভাবে জহির সাহেবের মনে চেপে আছে। চারটার একটু বেশি বাজে। অ্যাপয়েনমেন্টের সময় ততটা পার হয়নি। যার সাথে এখন অ্যাপয়েনমেন্ট তিনি একজন ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট। সোজা কথায় একজন কাউন্সেলর। আজই ওনার সাথে প্রথম সাক্ষাৎ। চা খেতে খেতে ভাবা যাক কাউন্সেলিংয়ের পরিবেশটা কি রকম হতে পারে।
নাম, ধাম, ঠিকানা, স্ত্রী, পুত্র, কন্যা সবার ঠিকুজি একটা পাতায় লেখা শেষে কাউন্সেলর সাহেব স্মিত হেসে জহির সাহেবের দিকে তাকান।
-তো মি. জহির, আপনার কেনো মনে হলো যে একজন কাউন্সিলরের সাহায্য আপনার প্রয়োজন?
-জ্বী, আমার একটি চার বাটনওয়ালা রিমোট কন্ট্রোল ডিভাইস দরকার।
-আমি আপনাকে কিভাবে এই ডিভাইসটি পেতে সহায়তা করতে পারি?
-আপনাকে কিছুই করতে হবে না। যা করার আমিই করবো। আগামীকাল প্রথম আলো পত্রিকায় একটি বিজ্ঞাপন যাবে।
-আচ্ছা ঠিক আছে, বিজ্ঞাপনের নমুনা কপি কি এখন আপনার সাথে আছে?
-আছে, কিন্তু আমি এখন আপনাকে এটা দেখাব না।
-আচ্ছা ঠিক আছে। এবার বলুন তো এই ডিভাইসটি পেলে আপনি কি করবেন?
-আমি শূন্য বাটনটায় চেপে দেখবো আমার জীবনে কি প্রতিক্রিয়া দেখা যায়।
প্রায় দেড় ঘন্টা কাউন্সেলিং করে জহির সাহেব বের হন। মন কিছুটা হালকা লাগছে। রিমোট কন্ট্রোল ডিভাইসের তিন বাটনের চাপাচাপিতে জীবনটা অসহনীয় হয়ে উঠছে- এই মেসেজটুকু তিনি কাউন্সেলিংয়ে দিতে পেরেছেন। কারও কাছে মন উজার করে কথা বলতে পারলে মনকে অনেকটা হালকা লাগে। কাউন্সেলিংয়ে জহির সাহেব নিজের মনের সাথেই কথা বলেছেন। টেবিলের ওপাশে জহির সাহেবেরই আরেকটা প্রতিরূপ বসা ছিল।
এবার যেতে হবে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক একজন চিকিৎসকের কাছে। সোজা কথায় একজন সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে। তিন বাটনওয়ালা রিমোটের প্রভাব জহির সাহেবের শরীরেও ছড়িয়ে পড়েছে। এই মুহূর্তে সেই অদৃশ্য নিয়ন্তা কর্তৃক তিন নাম্বার বাটনটি চেপে চ্যানেল চালু করে দেওয়া আছে। সবসময় একটা অস্থির ভাব কাজ করে এই বাটনটি চালু থাকলে। একজন মনো বিজ্ঞানীর কাছে গিয়ে এই অস্থির ভাবাপন্ন তিন নাম্বার বাটনের মনো-বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা চাওয়া দরকার। জহির সাহেব রিকশায় চড়ে বসেন। যাবেন পান্থপথ। নিয়ন সাইনের বিজ্ঞাপন দেখতে থাকেন আর একজন মানসিক স্বাস্থ্য চিকিৎসকের সন্ধান করতে থাকেন।
প্রথম আলোয় দেওয়া শ্রেণীবদ্ধ বিজ্ঞাপনটা খুব কাজে দিয়েছে। জহির সাহেবের কাছে এখন খুব ঘন ঘন ফোন আসছে। বাংলাদেশে এত্ত সফটওয়্যার ডেভেলপার আছে বিজ্ঞাপনটি দেওয়ার আগে জানা ছিল না। একটি ফোন আসলেই জহির সাহেব টুক করে ডাইরীটা বের করেন আর সবার নাম্বার নোট করে নেন। প্রত্যেকের মৌখিক পরীক্ষা নেন। মোবাইলে মৌখিক পরীক্ষা নেওয়াটা খুব মজার।
-হ্যালো স্লামালিকুম স্যার।
-ওয়ালাইকুম আসসালাম। কে বলছেন প্লিজ।
-জ্বী, আজ প্রথম আলো পত্রিকায় দেখলাম একজন সফট্ওয়্যার ডেভেলপার আবশ্যক।
-জ্বী ভাই, ঠিকই দেখেছেন। আপনি কি একটি ডিভাইস এরকম ভাবে তৈরি করে দিতে পারবেন?
-স্যার, যদি আপনার সমস্ত চাহিদা জানিয়ে আমাকে একটা মেইল করেন তাহলে ঠিক ঠিক এরকম একটি ডিভাইস তৈরি করার চেষ্টা করবো।
-আচ্ছা ঠিক আছে। আপনার মেইল অ্যাড্রেসটা দয়া করে দিন। পরে আপনার সাথে প্রয়োজনে যোগাযোগ হবে।
এ পর্যন্ত সতেরটি ফোন এসেছে সকাল ১০ টা থেকে বিকাল ৫ টা পর্যন্ত। আট ঘন্টায় সতেরটি আবেদন। ঘন্টায় দ্বিগুণেরও বেশি। তাহলে চব্বিশ ঘন্টায় গড়ে পঞ্চাশটি আবেদন পড়বে। আচ্ছা এই বিজ্ঞাপনটি যদি অন্য কোনো চাকুরির জন্য দেওয়া হতো তাহলে কিরকম আবেদন পড়তো। অন্য আর কি চাকুরি বাংলাদেশে লোভনীয়?
একটি ব্রান্ড পণ্য বিক্রয়ের জন্য জেলাব্যাপী বিক্রয়-কর্মী আবশ্যক। অথবা একটি নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানে নিরাপত্তাকর্মী আবশ্যক। একটি মাল্টিলেভেল মার্কেটিং কোম্পানির জন্য প্রবেশন অফিসার আবশ্যক। এধরনের বিজ্ঞাপন দিলে কমপক্ষে শ'খানেক কল রিসিভ করতে হতো। বাংলাদেশের বেকার যুবকদের জন্য আকর্ষণীয় চাকুরির অফার এগুলো।
রাত ৮ টার দিকে একটা ফোন আসলো।
-হ্যালো, স্লামালিকুম।
-ওয়ালাইকুম সালাম। কে বলছেন প্লীজ...
-স্যার, আজকের প্রথম আলো পত্রিকায় সফট্ওয়্যার ডেভেলপার চেয়ে বিজ্ঞাপন কি আপনিই দিয়েছেন?
-হ্যাঁ। এ বিষয়ে কি কিছু বলবেন?
-জ্বী স্যার। আপনার বিজ্ঞাপন মোতাবেক একটি রিমোট কন্ট্রোল ডিভাইস প্রোগ্রাম করে রেখেছি। এখন আপনি আপনার চাহিদা জানালে আমরা সেভাবে ডিভাইসটি ডিজাইন করে দেবো।
-আচ্ছা, আপনারা সেভাবে ডিজাইন করে দেবেন, তারমানে আপনার সাথে আরও কেউ আছে?
-জ্বী স্যার, আমরা একটি টীম হয়ে কাজ করি। আপনি ইচ্ছে করলে আমার বসের সাথে কথা বলতে পারেন।
হ্যাল্লো! হাউ মে আই হেল্প য়্যু!
অপর প্রান্ত থেকে রিনরিনে এক কণ্ঠস্বর ছুটে আসে মোবাইলের এ প্রান্তে। মেয়ে কণ্ঠস্বর। ইংরেজিতে নরম ভাবে বস জানতে চেয়েছেন কিভাবে তিনি জহিরকে সহায়তা করতে পারেন। জহির ভাবনায় পড়ে যায়। কি সাহায্য চাইবেন তিনি? বাংলায় চাইবেন না ইংরেজিতেই চাইবেন। আজকাল বাংলা ইংরেজি সব এক। বাংলায় বললেই ইংরেজিতে অনুবাদ হয়ে যায়। অপর প্রান্তের মোবালিটিতে কি এ রকম সফট্ওয়্যার ইনস্টল করা আছে?
-দেখুন মিস্টার বস, আমি সম্রাট জহিরুদ্দিন মোহাম্মদ বাবর। আমার একটি রিমোট কন্ট্রোল ডিভাইস চাই।
জহির কোনো জেন্ডার বিভেদ না করে মিস্টার বলেই বসকে সম্বোধন করে।
-থ্যাংক ইউ মিস্টার। আমি ইতোমধ্যে আমার সহকারীর সাথে আপনার কথোপকথন শুনেছি। আমরা আপনার জন্য এরকম একটি রিমোট ডিভাইস ডিজাইন করে দিতে পারবো।
-দাম কতো পড়বে আর কতদিনে আপনারা এই ডিভাইসটি আমাকে সরবরাহ করতে পারবেন?
-আমাদের খরচ কত পড়বে তা এই মুহূর্তে বলতে পারবো না তাই মূল্যের বিষয়টি আপাতত থাকুক। সময় বিষয়ে আমরা একটা নেগোসিয়েশনে আসতে পারি।
-আমি আগামী তিন দিনের মধ্যে তা চাই। সম্ভব হবে?
-অবশ্যই সম্ভব হবে। আমাদের সফট্ওয়্যার জগতে অসম্ভব বলে কিছু নেই। এটা শুধু মেধাবৃত্তিক কাজ। আমরা আমাদের টিম ওয়ার্ক পারসন বাড়িয়ে নেবো।
-ঠিক আছে। আপনার কথায় আশ্বস্ত হলাম।
-আমরা তিনদিনে মধ্যে ডিভাইসটি আপনার নিকট পাঠিয়ে দেবো। তার আগে আপনার ই-মেইল অ্যাড্রেসে একটি সাবক্রিপশন পেপার পাঠাবো। আমাদের একটি ওয়েবসাইট অ্যাড্রেসও পাবেন। ওখানে বিস্তারিত থাকবে। আপনি দয়া করে ভিসা কার্ড ব্যবহার করে অনলাইনে আমাদের পেমেন্টটা যথাসময়ে পরিশোধ করে দেবেন।
মনটা বেশ ফুরফুরে লাগছে জহিরের। আগামী তিনদিন পরে একটি চার বাটনওয়ালা রিমোট কন্ট্রোল ডিভাইস পেতে যাচ্ছে। এই রিমোটের একটি লাল রঙের শূন্য বাটন থাকবে। সাথে থাকবে আরও তিনটি বাটন। ওয়ান-টু-থ্রি। ওয়ান প্রেস করলে টিপিক্যাল সাহেব হয়ে জহির সকাল সাতটা বাজে ঘুম থেকে উঠবে। অফিস করবে। ঘর সংসারে মন দেবে। স্ত্রী-পুত্র-কন্যাদের সময়ে দেবে। দুই নাম্বার বাটনটা প্রেস করলেই জহির দুই নাম্বারী হয়ে উঠবে। নীতিকথা ভুলে গাদা গাদা টাকা উপার্জন করবে। স্ত্রী-পুত্র-কন্যাদের সাথে মিথ্যে অভিনয় করবে। তিন নাম্বার বাটনটা প্রেস করলে জহির অস্থির হয়ে জগত সংসারকে তুচ্ছ জ্ঞান করবে। এই বাটনগুলোর উপর তার নিয়ন্ত্রণ না থাকে থাকুক। শূন্য বাটনটির উপর নিয়ন্ত্রণ থাকলেই হয়।
জীবনটা ক্রমশঃ জটিলতায় আটকে যাচ্ছে। এমন জটিলতা থেকে বের হয়ে আসতে পারছে না- এই ভাবনায় জীবনটাকে মাঝে মাঝে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করে জহিরের। রিমোটের তিনটি বাটনের কোনোটির উপর জহিরের নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। কিন্তু শূন্য বাটনটির উপর নিয়ন্ত্রণ থাকবে। তাই কি রিমোট কন্ট্রোল ডিভাইসের শূন্য বাটনটি জহিরের খুব প্রয়োজন?
একটি রিমোট কন্ট্রোল ডিভাইস এবং শূন্য বাটন (১)
(আগামী পর্বে সমাপ্য)
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা ডিসেম্বর, ২০১১ রাত ৯:২৩