আগেরগুলো পড়তে চাইলে- ডুমেলা বতসোয়ানা-১৪
রাজনীতি এবং ব্যবস্থাপনার তিনটি পাঠ
বতসোয়ানা গণতান্ত্রিক দেশ। এখানে আমাদের দেশের মতো সংসদীয় পদ্ধতির গণতন্ত্র বিরাজমান। ১৯৬৪ সালের জুনে বৃটেন বতসোয়ানার নিজস্ব গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা মেনে নেয়। ১৯৬৫ সালে বতসোয়ানার সংবিধান রচিত হয় এবং দক্ষিণ আফ্রিকার সীমান্ত শহর মাফি কিং থেকে বতসোয়ানার রাজধানী গ্যাবরনে স্থানান্তরিত হয়। স্যার সেরেস্তে খামা ((Sir Seretse Khama) ) দেশটির প্রথম প্রেসিডেন্ট। Ketumile Masire দ্বিতীয় এবং Festus Mogae তৃতীয় প্রেসিডেন্ট। ১৯৬৬ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর স্বাধীনতা লাভের পর থেকে এ দেশে সরকার পরিবর্তনের ক্ষেত্রে একটি চমৎকার ব্যবস্থা অনুসৃত হয়ে আসছে। স্যার সেরেস্তে খামা বতসোয়ানার স্বাধীনতা আন্দোলনের নায়ক হিসেবে পর পর তিনবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ১৯৮০ সালে তিনি মারা যান। এরপর ভাইস প্রেসিডেন্টের ওপর প্রেসিডেন্সি দায়িত্ব অর্পিত হয়। ভাইস প্রেসিডেন্ট স্যার মাশিরে ১৯৮৪ সালের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তারপর আরো দু’বার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে ১৯৯৮ সালে অবসরে যান। তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট ফেস্টার মুগে’র ওপর প্রেসিডেন্সি দায়িত্ব অর্পিত হয়। স্যার ফেস্টার মুগে ১৯৯৯ সালের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট মনোনীত হয়ে পাচ বছর দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৪ সালের ৩০ অক্টোবর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জয়ী হয়ে আরো এক টার্মের জন্য প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। তিনিও তার পূর্বসূরিদের মতো তিন টার্মে প্রেসিডেন্সি দায়িত্ব পালন করে অবসরে যাবেন বলেই বটসোয়ানার অধিবাসীদের ধারণা।
একটি গণতান্ত্রিক দেশে বিভিন্ন মত ও পথের অনুসারী বিভিন্ন দল থাকবে। তারা তাদের আদর্শ নিয়ে জনগণের কাছাকাছি যাবে এবং জনগণের সমর্থন চাইবে। জনগণ যে দলের আদর্শকে গ্রহণ করে সমর্থন দেবে সেই দলই সরকার গঠন করবে। বতসোয়ানার সরকার ব্যবস্থাও সে রকমই। বতসোয়ানা বহুদলীয় গণতন্ত্রের দেশ হিসেবে পরিচিত। বতসোয়ানা ডেমক্রেটিক পার্টি বর্তমানে বতসোয়ানার সরকার পরিচালনা করছে। এই পার্টির জনপ্রিয়তাও বিশাল। ২০০৪ সালের ৩০ অক্টোবরের নির্বাচনে বতসোয়ানা ডেমক্রেটিক পার্টি বা বিডিপি পুরো বতসোয়ানার মোট ৫৭টি ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির আসনের মধ্যে ৪৪টি আসনে জয়ী হয়ে সরকার পরিচালনা করছে। বিরোধী দলগুলোর মধ্যে বতসোয়ানা ন্যাশনাল ফ্রন্ট (বিএনএফ) ১২টি আসন এবং বতসোয়ানা কংগ্রেস পার্টি (বিসিপি) একটি আসন নিয়ে সংসদে প্রতিনিধিত্ব করছে। উপরোক্ত রাজনৈতিক দল দুটো এ দেশের প্রধান দুটি বিরোধী দল। এছাড়াও আরো কয়টি বিরোধী দল আছে। যেমন বতসোয়ানা অ্যালায়েন্স মুভমেন্ট (বিএএম) এবং বতসোয়ানা পিপলস পার্টি (বিপিপি)। সংসদে এদের কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই।
বতসোয়ানার রাজনীতিতে মাইগ্রেটেড ইনডিয়ানদের আধিপত্যও লক্ষ্যণীয়। এখানে সাত্তার দাদা নামে একজন প্রভাবশালী ইনডিয়ান মুসলিম আছেন। এমনও প্রবাদ আছে সাত্তার দাদা'র হাতে বতসোয়ানার ব্যবসায় জগত নিয়ন্ত্রিত হয়। সাত্তার দাদা বতসোয়ানার সরকার ব্যবস্থার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। প্রিন্স ভাই, মোল্লা ভাই, সুশীলদার কাছ থেকে সাত্তার দাদার অনেক গল্প শুনেছি। একদিন প্রফেসর অধুয়ারানের ক্লাশে বতসোয়ানার সমসাময়িক রাজনীতি নিয়ে আলোচনা শুনছি। আলোচনায় সহপাঠী ডমিনিকের কাছ থেকে সাত্তার দাদা সম্পর্কে তাদের মনোভাব জানার সুযোগ হলো। শুধু সাত্তার দাদাই নন, আরো অনেক প্রভাবশালী ইনডিয়ান আছে যারা বতসোয়ানার অর্থনীতি, রাজনীতি, বাণিজ্য ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করছে। ইনডিয়ানদের এ আধিপত্যকে বতসোয়ানার কালো নেটিভরা মেনে নিতে পারছে না। ধীরে ধীরে ওদের মধ্যে ইনডিয়া বিরোধী মনোভাব জাগ্রত হচ্ছে। একদিন আমার সঙ্গে এক কালো নেটিভের গায়ে পড়ে ঝগড়া করার মানসিকতা দেখে আমার সে রকমই মনে হলো। ও আমাকে ইনডিয়ান ভেবে উত্ত্যক্ত করার জন্য আমার উদ্দেশে নানান বাজে মন্তব্য ছুঁড়ে দিচ্ছিল। আমি তাকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলাম যে আমি ইনডিয়ান নই। আমি বাংলাদেশি। কিন্তু তার রুদ্রমূর্তি দেখে মনে হচ্ছিল, সে পারলে এখনই সব ইনডিয়ানদের ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়। সে রাগান্বিত স্বরে বারবার করে বলছিল, গো ব্যাক, গো ব্যাক।
ইনডিয়ানদের প্রতি এখানকার অধিবাসীদের রাগেরও কারণ আছে। ব্যবসা-বাণিজ্যের অধিকাংশই ইনডিয়ানদের দখলে। একটি দেশের জনগোষ্ঠী অন্য আরেকটি দেশের লোকদের আধিপত্য মেনে নেবে না, এটাই স্বাভাবিক। বতসোয়ানার বর্তমান অবস্থাও তাই। ইনডিয়া বিরোধী মনোভাব আস্তে আস্তে দানা বাঁধতে শুরু করলেও এখনো তেমন জোরালো আকার ধারণ করেনি। এই মনোভাবের কারণেই কি না কে জানে, ইনডিয়ানদের বাসা-বাড়িতে, দোকান-পাটে ইদানীং চুরি-ডাকাতির ঘটনা বেড়ে গিয়েছে। শুধু ইনডিয়ান নয় বাঙালি, পাকিস্তানি, চায়নিজ যারা বতসোয়ানায় ব্যবসা-বাণিজ্য করে প্রচুর অর্থ-বিত্তের মালিক হয়েছে, তারা সবাই আতঙ্কে আছে। ডাকাত দল সুযোগ পেলেই বাসা-বাড়িতে গিয়ে হানা দিচ্ছে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হানা দেয়ার সুযোগ পায় না। প্রতিটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সিকিউরিটি সিস্টেম এতো কঠোর যে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ডাকাতি করে পার পাওয়া যাবে না। তবে রাতের অন্ধকারে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে চুরির ঘটনা ঘটছে বেশি। যেসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব সিকিউরিটি ব্যবস্থা জোরদার নয়, সে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেই চুরির ঘটনা ঘটছে। এসব বিচ্ছিন্ন ঘটনা ব্যতীত বতসোয়ানার সামাজিক এবং রাজনৈতিক অবস্থা স্থিতিশীলই বলা যায়। এর কারণ হচ্ছে বটসোয়ানার রাজনৈতিক দলগুলোর শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান।
একটি রাজনৈতিক দল জনগণের জন্য রাজনীতি করবে। দলটির আদর্শ কিংবা নীতিসমূহের জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের জন্য নির্বাচনে যাবে। দলটির আদর্শের প্রতি অধিকাংশ জনগণের মতামত পেলে সরকার গঠন করবে এবং দেশ চালাবে। গণতান্ত্রিক যে কোনো দেশে এই মতামত যাচাইয়ের পদ্ধতির নাম হচ্ছে ভোট গ্রহণ। বতসোয়ানাতে প্রতি পাঁচ বছর পর পর নির্বাচন হয়। জনগণ তাদের পছন্দের দলকে ভোট দেয়। শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমেই ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৬৬ সালে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে এ পর্যন্ত নির্বাচনে কোনো ছেদ পড়েনি। আটটি নির্বাচিত সরকার বিগত ৪০ বছর ধরে দেশটি শাসন করছে। প্রেসিডেন্ট হয়েছেন তিনজন। এ দেশের শাসন ব্যবস্থা পরিবর্তনে কখনো কোনো জরুরি অবস্থা জারি করতে হয়নি। এ দেশের পরবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ২০০৯ সালের অক্টোবরে। প্রতি পাঁচ বছর পর অক্টোবর মাসে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং শান্তিপূর্ণ উপায়ে নির্বাচিত দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হয়। এটি একটি সিস্টেমে দাঁড়িয়ে গেছে। এর ব্যত্যয় হওয়ার কোনোই উপায় নেই। এই সুশৃঙ্খল জাতিটি সংবিধানকে এভাবেই মেনে চলে দেশকে উন্নতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
বতসোয়ানার রাজনীতির ট্রেনটি গণতন্ত্রের পথে সেই যে ১৯৬৬ সালে যাত্রা শুরু করেছে, একবারের জন্যও লাইনচ্যুত হয়নি। চল্লিশ বছর ধরে তিন তিনজন দক্ষ ড্রাইভার বতসোয়ানা দেশটিকে এ পর্যন্ত চালিয়ে এনেছেন। গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু থেকেই দেশটি ৫০ বছর পরের একটি ভিশন দাঁড় করিয়ে ফেলেছে। আর মাত্র দশ বছর আছে ভিশন-২০১৬ বাস্তবায়িত হওয়ার। ভিশন-২০১৬ কে বতসোয়ানার অধিবাসী সবার মজ্জাগত করে দেওয়ার প্রচেষ্টা হাতে নিয়েছে সরকার। রাস্তার পাশে, পাবলিক প্লেসে, গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে বড় বড় প্লাজমা টিভি স্ক্রীণ বসিয়ে অনবরত প্রচার চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে সরকারের নীতি সম্পর্কিত বিষয়ে। নারী নির্যাতন, এইডস, মাদকাসক্তি, সন্ত্রাস, সামাজিক সমস্যা ইত্যাদির পাশাপাশি শিক্ষা, সমাজ, রাষ্ট্র ইত্যাদি বিষয়েও জনগণকে সচেতন করে তোলার প্রচেষ্টা হাতে নেওয়া হয়েছে। উপরোক্ত বিষয়গুলো নিয়ে দুই চার মিনিটের ছোট ছোট স্লাইড শো প্রদর্শিত হয় এই টিভিগুলোতে। জাতিকে শৃঙ্খলার সাথে পরিচালিত করার জন্য যে পথ নির্দেশনা দরকার তাও অনবরত প্রচার করা হয়। সবাই সরকারের এই পথ নির্দেশনাগুলো মেনে চলার চেষ্টা করে।
একটি দেশের সামনে যদি কোন ভিশন না থাকে, তাহলে দেশটি অন্ধের মত লাঠি ঠুকে ঠুকে পথ চলতে থাকবে। আমাদের পুরো জাতির সামনে কোন ভিশন নেই। তাই আমরাও অন্ধের মত লাঠি ঠুকে ঠুকেই পথ চলছি। এই পথ চলতে গিয়ে অন্ধকারে হোঁচট খাচ্ছি। হাত-পা ভাঙ্গছে। সেই ভাঙ্গা হাত-পা নিয়েই আবার উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে অনিশ্চিত পথে যাত্রা শুরু করছি। আমাদের সামনে ‘সম্মিলিত প্রয়াসে বাস্তবায়ন করার মত’ কোন ভিশন দাঁড় করানো নেই। টিআইবি বেসরকারি উদ্যোগে একটি ভিশন দাড় করিয়েছে ২০২১ সালকে সামনে রেখে। ড. ইউনূস ও ২০৩০ কে সামনে রেখে একটি ভিশনের কথা বলেছেন। কিন্তু সরকারি পর্যায়ে এরকম কোন ভিশন বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা আমাদের হাতে নেই। আমাদের পুরো জাতির সামনে যদি একটি ভিশন বা গন্তব্য থাকতো, তাহলে সেই গন্তব্যে পৌঁছে আমরা বিশ্রাম নিতে পারতাম। ভাঙ্গা হাত-পা জোড়া লাগিয়ে আবার নতুন উদ্যমে যাত্রা শুরু করতে পারতাম। আমাদের সামনে কোন ভিশন না থাকার কারণে আমরা অন্ধকারেই পথ হাতড়ে মরছি। অন্ধের মত পথ হাতড়ে অন্ধকার থেকে বের হতে না পেরে ক্রমশই গভীর অন্ধকারে পতিত হচ্ছি।
ভিশন হচ্ছে ভবিষ্যত দৃষ্টি। বর্তমান অবস্থানে দাঁড়িয়ে সুদূর ভবিষ্যতে আমি কোথায় পৌঁছতে পারব তার একটি রূপরেখা দাঁড় করানোই হচ্ছে ভিশন। দশ বছর পরে আমি কি করব, বিশ বছর পরে আমার অবস্থান কি হবে তা এখনই পরিকল্পনা করে নেওয়ার নামই ভিশন। একটি দেশের ক্ষেত্রে এটি পঁচিশ কিংবা পঞ্চাশ বছর পরের দৃষ্টিও হতে পারে। এই দৃষ্টিকে সামনে রেখে পুরো জাতি পরিচালিত হবে। সরকার আসবে সরকার যাবে কিন্তু ভিশনের কোন পরিবর্তন হবে না। শিক্ষাকে সমস্ত রাজনীতির ঊর্ধ্বে রেখে সরকার ইচ্ছে করলে এরকম একটি ভিশন এখনই দাঁড় করাতে পারে। ২০২১ সালে আমাদের দেশ পঞ্চাশ বছর পূর্ণ করবে। হাতে আরও ১৪ বছর সময় আছে। এখনই আমরা ভিশন-২০২১ নামে একটি ভিশন দাঁড় করাতে পারি। আমাদের দেশের অর্থনীতি, সমাজনীতি, রাজনীতি, শিক্ষা, বাণিজ্য সবকিছুই এই ভিশনকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হবে। বতসোয়ানার ভিশন-২০১৬ এই লক্ষ্যেই পরিচালিত। বতসোয়ানার রাজনৈতিক সরকার পরিবর্তিত হয় কিন্তু ভিশনের কোন পরিবর্তন হয় না। গণতান্ত্রিক সব সরকারই এই ভিশন বাস্তবায়নের ব্যাপারে আন্তরিক। রাজনৈতিক দলগুলোও সরকারকে এ ব্যাপারে সর্বাত্মক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে।
চলবে...
(প্রায় দেড় বছর আগে যায়যায়দিনে এ পর্বটি প্রকাশিত হয়েছিল। আওয়ামী লীগ সরকার দিন বদলের সনদে ভিশন-২০২১ নামে একটি রূপকল্প দাঁড় করিয়েছে। পাঠক, ভাববেন না যেনো আমি এটি এখন জুড়ে দিয়েছি।)
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে অক্টোবর, ২০০৯ বিকাল ৪:৩৫