ড. ইউনূসের নোবেল প্রাপ্তিতে বতসোয়ানায় বসে আমি বাংলাদেশের মানুষের উল্লসিত হওয়ার কথা ভাবি। আচ্ছা বাংলাদেশের ১৫ কোটি জনগোষ্ঠীর সবাই কি ড. ইউনূসের নোবেল প্রাপ্তির বিষয়টি জেনেছে? তারা কি সবাই ঘর-বাড়ি ছেড়ে রাস্তায় নেমে এসেছে আনন্দ-উল্লাস করতে? যেমন করে ক্রিকেটে পরাশক্তির কোনো দেশকে হারিয়ে দিয়ে আমরা বাঁধভাঙা স্রোতের ন্যয় রাস্তায় নেমে আসি উল্লাস করার জন্য।
আমার হোস্টেল রুমে টেলিভিশন নেই। তাই আমি সরাসরি বাংলাদেশের মানুষের প্রতিক্রিয়া দেখার সুযোগ পাইনি। বতসোয়ানায় যে ক'জন অবস্থাপন্ন বাঙালি আছেন তাদের সবার ঘরে টেলিভিশন আছে। বাংলাদেশের একমাত্র স্যাটেলাইট চ্যানেল চ্যানেল আই সুদূর বটসোয়ানায় বসে দেখা যায়। তাই বলা যায়, এখানকার বাঙালিরা বাংলাদেশের খবরাখবর প্রতি ঘণ্টায় পেয়ে যায়।
আমার ইন্টারনেটই ভরসা। আমি ইন্টারনেটে বসে দেশের পত্র-পত্রিকাগুলো পড়ে দেশের মানুষের প্রতিক্রিয়া জানার চেষ্টা করি। পত্রিকা পড়ে মনে হয়েছে দেশের ১৫ কোটি জনগোষ্ঠীর অধিকাংশের কাছেই ড. ইউনূসের নোবেল প্রাপ্তি বিষয়ক তথ্যটি পৌঁছতে পারেনি। শুধু দেশের শিক্ষিত একটি সম্প্রদায়ের কাছে পৌঁছেছে। দেশের আপামর জনগোষ্ঠীকে ড. ইউনূসের এই নোবেল প্রাপ্তির মাহাত্ম্য বোঝাতে না পারলে আমরা জেগে ওঠার স্পৃহা খুঁজে পাবো না। ড. ইউনূস শুধু নোবেল পুরস্কারই পাননি। তিনি সেই সঙ্গে দারিদ্র্য বিমোচনের একটি পদ্ধতির কথা আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন। দারিদ্র্যের হাতকে কর্মের হাতে পরিণত করার পদ্ধতি। কিন্তু এই পদ্ধতির কথা যদি দেশের ১৫ কোটি জনগোষ্ঠীর সবার কাছে পৌঁছানো না যায় তাহলে লাভ নেই। আমাদের দেশের কৃষক, জেলে, কামার, কুমোর, তাঁতি, মুটে, মজুর সবার কাছে যদি দারিদ্র্য বিমোচনের এই পদ্ধতির কথা জানিয়ে দেয়া যেতো, তাহলে তারা সবাই তাদের দারিদ্র্য বিমোচনের উপায় খুঁজে নিতে পারতো।
এখন আসা যাক একটি দেশের ১৫ কোটি জনগোষ্ঠীর কাছে তথ্য পৌঁছানোর উপায় কি হতে পারে। আমাদের দেশে তথ্য প্রযুক্তি বা ইনফরমেশন টেকনোলজি বলতে আমরা শুধু কম্পিউটার এবং ইন্টারনেট কেন্দ্রিক চিন্তা করে থাকি। একজন ব্যক্তির কাছে শুধু চিঠির মাধ্যমে একটি তথ্য পৌঁছলে এটিকে আমরা পোস্টাল ইনফরমেশন টেকনোলজি বলতে পারি। একজন ব্যক্তির কাছে ব্যক্তির মাধ্যমে তথ্য পৌঁছলে তাকে পার্সোনাল ইনফর্মেশন টেকনোলজি বলতে পারি। রেডিওর মাধ্যমে তথ্য পৌঁছালে রেডিও ইনফরমেশন টেকনোলজি বলতে পারি। একজন পেশাজীবী কিংবা শ্রমজীবীর কাছে যে কোনো টেকনোলজি ব্যবহার করে তথ্য পৌঁছানোই হবে বড় কথা।
আমাদের দেশের অধিকাংশ জনগোষ্ঠী দরিদ্র এবং শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। দারিদ্র্যের কারণে নিজেও শিক্ষালাভ করতে পারে না এবং সন্তানদের শিক্ষালাভেও উৎসাহী হয় না। কিন্তু শিক্ষালাভের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য বুঝিয়ে যদি তার কাছে যে কোনো টেকনোলজি ব্যবহার করে তথ্য পৌঁছানো যেতো, তাহলে সে নিজের এবং সন্তানদের শিক্ষালাভে উৎসাহী হতো। এই তথ্য পৌঁছানোর উপায় হচ্ছে তার কাছে এটি ফ্রি সরবরাহ করা। প্রতি সপ্তাহে আপটুডেট তথ্য সমৃদ্ধ একটি তথ্য ভান্ডার তার কাছে ফ্রি পৌঁছে দেয়া।
দি বতসোয়ানা অ্যাডভার্টাইজর পত্রিকাটি ১৫ লাখ জনগোষ্ঠীর দেশে ৯০ হাজার কপি ফ্রি বিতরণ করা হয়। ফ্রি হওয়ার কারণে তথ্যবহুল এই সাপ্তাহিকটির জনপ্রিয়তাও বেশি। একটি পত্রিকা ন্যূনতম দুইজনও যদি পাঠ করে তাহলে বতসোয়ানার প্রতি ৮ জনে একজন দি বতসোয়ানা অ্যাডভার্টাইজর পত্রিকার পাঠক। এর অর্থ বতসোয়ানার প্রতি ৮ জনের মধ্যে একজন প্রতি সপ্তাহে স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং তথ্যসমৃদ্ধ একটি পত্রিকা পড়ার সুযোগ পায়।
সম্পূর্ণ বেসরকারিভাবে পরিচালিত শুধু বিজ্ঞাপন নির্ভর দি বতসোয়ানা অ্যাডভার্টাইজর পত্রিকাটির পাশাপাশি দি ডেইলি নিউজ নামেও আরেকটি সরকারি পত্রিকা আছে যেটি পাঠকদের কাছে ফ্রি সরবরাহ করা হয়। এর অর্থ হচ্ছে বতসোয়ানার একটা বিশাল জনগোষ্ঠী ফ্রি পত্রিকা পাঠের মাধ্যমে তথ্যসমৃদ্ধ হচ্ছে, শিক্ষিত হচ্ছে।
বতসোয়ানার মোট জনগোষ্ঠীর শতকরা ৮১ জন বয়স্ক শিক্ষায় শিক্ষিত। আমাদের দেশের বয়স্ক শিক্ষার প্রকৃত হার খুবই কম। ১৯৯১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী বয়স্ক শিক্ষার হার ৩৫.৩% হলে এই একযুগেরও অধিক সময়ে বয়স্ক শিক্ষার ক্ষেত্রে আমরা বেশিদূর অগ্রসর হতে পারিনি।
আমাদের দেশের চরম দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে পুরোপুরি শিক্ষিত করে তুলতে হলে বয়স্ক শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ বয়স্করাই হচ্ছে সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী, শিশুরা নয়। অ্যাডাল্ট এডুকেশন হচ্ছে চাইল্ড এডুকেশনের ভিত্তি। আগে অ্যাডাল্টদের পুরোপুরি শিক্ষিত করতে হবে। তবেই চাইল্ড এডুকেশন নিশ্চিত হবে। লাইফ লং এডুকেশনকে সামনে রেখে অ্যাডাল্টদের শিক্ষার হার ১০০ ভাগে উন্নীত করার প্রচেষ্টা নেয়া যায় সহজেই।
বাংলাদেশের বয়স্ক জনগোষ্ঠীকে পুরোপুরি শিক্ষিত করে তোলার প্রচেষ্টা নেয়া যায় স্রেফ একটি পত্রিকার মাধ্যমে। এটি যে একটি পত্রিকাই হবে এমন নয়। এটি হতে পারে দৈনন্দিন যা সপ্তাহের আপটুডেট তথ্য সমৃদ্ধ একটি ডেটা ব্যাংক। একজন কৃষক, যে শুধু কৃষি কাজেই পারদর্শী, কৃষি সংক্রান্ত তথ্য নিয়ে তার কাছে একটি ফ্রি পত্রিকা যাবে। গ্রামের একজন নারী যে শুধু ঘর-গেরস্থালি নিয়েই ব্যস্ত থাকে, তার কাছে যাবে গার্হস্থ্য সংক্রান্ত তথ্য নিয়ে একটি ফ্রি পত্রিকা। কামার, কুমোর, জেলে, তাঁতি, মুটে, মজুর সবার জন্যই স্ব স্ব পেশার নানান জ্ঞান-বিজ্ঞান সংবলিত তথ্য নিয়ে পত্রিকাটিতে শিক্ষার ব্যবস্থা থাকবে। প্রতি সপ্তাহে তার কাছে তথ্য সমৃদ্ধ একটি খবরের কাগজ বিনামূল্যে পৌঁছে যাবে। এক পাতা, দুই পাতার লিফলেট আকারে কিংবা পুরো একটি পত্রিকাও হতে পারে এটি।
একজন পাঠকের কাছে সপ্তাহের বা দিনের আপডেট তথ্য নিয়ে, নিত্যদিনকার জ্ঞানের ভান্ডার নিয়ে পুরোপুরি ফ্রি একটি খবরের কাগজ নিয়মিত পৌঁছবে। এই কাগজটিতে তার শিক্ষা লাভের, জ্ঞান লাভের পথ প্রদর্শিত থাকবে। ঘরে বসে বসেই সে কাগজের মাধ্যমে শিক্ষা লাভ করবে। জীবনভর সে শিক্ষা পেতে থাকবে। কি শিক্ষা সে লাভ করলো, সেই কাগজের মাধ্যমেই তার মূল্যায়নের ব্যবস্থা থাকবে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই বিষয়টিকে আমার খুবই সম্ভাবনাময় মনে হয়।
বতসোয়ানায় বসে দি বতসোয়ানা অ্যাডভার্টাইজর পত্রিকটি দেখে আমার এই ধারণা আরো দৃঢ় হয়েছে, দেশের অধিকাংশ দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে ধীরে ধীরে একটি পত্রিকার সাহায্যেই শিক্ষিত করে তোলা সম্ভব। পুরোপুরি বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত বিজ্ঞাপননির্ভর একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা যদি পুরো বতসোয়ানার জনগোষ্ঠীর এক বিশাল অংশের কাছে সপ্তাহের আপডেট তথ্য নিয়ে ফ্রি পৌঁছতে পারে, আমাদের বাংলাদেশেও তা সম্ভব। সরকারি এবং বেসরকারি উভয় ভাবেই এই ধারণাটির বাস্তবায়ন ঘটানো যেতে পারে। দরকার একটি শুভ উদ্যোগের।
বটসোয়ানা এসেছি বয়স্ক শিক্ষার ওপর পড়তে। এই বিষয়টির ওপর পড়তে গিয়ে মনে হলো এরা বয়স্ক শিক্ষাকে খুবই গুরুত্ব দিচ্ছে। অ্যাডাল্ট এডুকেশন ডিপার্টমেন্টটি বটসোয়ানা ইউনিভার্সিটির প্রাচীনতম ডিপার্টমেন্ট। বয়স্ক শিক্ষার গুরুত্ব বিবেচনা করে ইউনিভার্সিটির জন্মলগ্নেই এই ডিপার্টমেন্টটি প্রতিষ্ঠিত হয়। জন্মলগ্ন থেকেই এই ডিপার্টমেন্ট বতসোয়ানার বয়স্ক জনগোষ্ঠীকে শিক্ষিত করে তোলার নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। পুরো বতসোয়ানা জুড়ে এই একটি মাত্র ইউনিভার্সিটি। পুরো আফ্রিকা মহাদেশ তো বটেই এমনকি বিশ্বব্যাপী শিক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং মানব সম্পদ উন্নয়নে নেতৃত্বদানের সুদূরপ্রসারী চিন্তা-ভাবনা নিয়ে ইউনিভার্সিটিটি কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। ইউনিভার্সিটির প্রসপেক্টাসে সে রকমই বলা আছে।
এদের শিক্ষা ব্যবস্থা এবং তা বাস্তবায়নের পদ্ধতি দেখে মনে হলো এরা পারবে। একটি সুশৃঙ্খল জাতি এরা। পুরো বতসোয়ানার উন্নয়নে ভিশন- ২০১৬ দাঁড় করিয়ে তা বাস্তবায়নে নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছে সবাই। ব্যাংকে চুপচাপ লাইনে দাঁড়িয়ে যার যার কাজ নীরবে সেরে যাচ্ছে। লাইন মেনেই প্রয়োজনীয় কেনাকাটা সারছে। লাইন মেনেই গাড়িগুলো সারিবদ্ধভাবে চলছে। কোথাও কোনো হই চই হট্টগোল নেই। নেই রাজনৈতিক মিটিং-মিছিল, নেই শ্রমিক ধর্মঘট। দেশটির গণতান্ত্রিক সরকার পুরো বটসোয়ানার উন্নয়নে ভিশন-২০১৬-কে সামনে রেখে নানা ক্ষেত্র সমন্বিত কর্মসূচি হাতে নিচ্ছেন এবং তা বাস্তবায়ন করে যাচ্ছেন। বতসোয়ানার সার্বিক উন্নয়নে গণতান্ত্রিক সরকার কর্তৃক অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি শিক্ষার হার বাড়ানোর নতুন নতুন প্রচেষ্টা হাতে নেয়া বিশ্বায়নের এ যুগে দেশটির এগিয়ে চলার ইঙ্গিতই বহন করে।
চলবে...
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে অক্টোবর, ২০০৯ সন্ধ্যা ৬:৪৪