সাত হাজার একশ সাতটি দ্বীপের দেশে বাস করার মজাই আলাদা ! সুযোগ পেলেই পাড়ি জমাও এক দ্বীপ হতে অন্য দ্বীপে! এপ্রিলের হলি উইকের ছুটিতে তাই বেড়িয়ে পড়েছিলাম সাগরে ভেসে দ্বীপ থেকে দ্বীপান্তরে।
সকাল আটটায় লস বানোস থেকে যাত্রা শুরু , বার বার নস্টালজিক হয়ে যাচ্ছিলাম AFSTRI এর সাথে এটাই শেষ ট্রিপ বলে! লুজোন ছেড়ে খুব একটা বের হই না আমরা , এবারও তাই রিসোর্ট ঠিক করা হলো লুজোনরই এক প্রান্তে Zambales এ, সেখানই আমাদের রাত্রিযাপনের ব্যবস্থা আর সেই বিচ থেকেই নৌকা করে যাওয়া হবে আশে পাশের ছোট ছোট দ্বীপগুলোতে। আমাদের সাথে ছিলো আরও দুটি বাঙালী পরিবার, একটি ইন্ডিয়ান পরিবার , মাদাগাস্কার, ইন্দোনেশিয়ান আর চাইনিজ কলিগরা!
মধ্যাহ্নভোজনের বিরতিতে ছবি নিলাম নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলার! নানা হাস্যরসে আর হুটোপুটিতে বিকেলের ঠিক আগে আগেই পৌঁছে গেলাম পূর্ব নির্ধারিত রিসোর্টে। একটু রেস্ট নিতে না নিতেই বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামি নামি করে! সাগরপাড়ে যাবো আর সূর্যাস্ত দেখবো না , তা কি হয়? ছোটবোনের সযত্নে বানিয়ে পাঠানো আমব্রেলা ড্রেস পড়ে হাজির হলাম সাগরতীরে।
সাগরের তীর ঘেষে পাহাড়, পাহাড়ের কোল ঘেষে মেঘ! আহ্! সেকি দৃশ্য!
ধীরে ধীরে আকাশ কমলা হতে শুরু করলো!
গোধূলি গগনে মেঘে ঢেকেছিলো তারা , আমার যা কথা ছিলো, হয়ে গেলো সারা
সূর্যাস্তের পর পরই বীচে আগুন জ্বালিয়ে ক্যাম্প ফায়ারের আয়োজন ! কিন্তু এপ্রিলের উত্তপ্ত সন্ধ্যায় আগুনে ঝলসানো পপকর্ন খাবার চেয়ে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত আরামদায়ক রুমকেই বেছে নিয়েছিলাম, তাছাড়া পরের দিনের জন্য অগ্রীম বিশ্রামও নিয়ে নিচ্ছিলাম। রাতে ভিডিওকে চালানোর ইচ্ছে থাকলেও সঙ্গী সাথী কাউকে না পেয়ে ক্ষান্ত দিলাম।
পরদিন সকাল আট টার মধ্যে ব্রেকফাস্ট সেরে সবাই বীচে। বীচে গিয়ে নৌকা দেখে তো ভয়ে আমার আত্মারাম খাঁচা ছাড়ার উপক্রম ! কাগজের খেলনার মত ছোট্ট একটা নৌকা, তার উপর মেঘলা আকাশ , সাগরে ইয়া বড় বড় ঢেউ! ঢেউয়ের চোটে নৌকা তীরে ধরে রাখা যাচ্ছে না । এই নৌকায় চড়তে হবে ভেবেই আমার কান্না পেয়ে গেলো! এরমধ্যেই দেখি সবাই বিপুল আগ্রহে নৌকায় চড়া শুরু করলো।আমি বার বার এন্ডোকে বলতে লাগলাম, আমি সাঁতার জানি না, বেশী দূরের দ্বীপে যাবার দরকার নাই। নৌকায় উঠে আমি একমনে আয়াতুল কুরশি পড়া শুরু করলাম! আমার ভয় দেখে আমার বর আর এক কলিগ খন্দকার ভাই গান গাওয়া শুরু করে দিলেন তীরহারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেব রে
সাগরের ঐ প্রান্তরে শুনি পর্বতচূড়ায় চাঁদ জাগে, জলপথে আমি দেই পাড়ি, ফিরি চাঁদ জাগা ঐ বন্দরে
মেঘ বলেছে যাব যাব , রাত বলেছে যাই, সাগর বলে কুল মিলেছে , আমি তো আর নাই
ঐ দূর পাহাড়ের ধারে, দিগন্তেরই কাছে নিঃসঙ্গ বসে একটি মেয়ে
গাইছে, আপন সুরে আপন সুরে আপন সুরে
চলনা দীঘার সৈকত ছেড়ে ঝাউবনে ছায়ায় ছায়ায় , শুরু হোক পথচলা, শুরু হোক কথা বলা
Anawangin beach
এখানে আমাদের প্রথম নামিয়ে দেয়া হলো।আমি তো নৌকা থেকে নামতে পেরেছি , সেই খুশিতেই আত্মহারা! এটি একটি ছোট্ট দ্বীপ, এই দ্বীপের আকর্ষণ হলো পাহারী ঝর্না এবং গুহা! যদিও এপ্রিলে ঝর্নায় পানি থাকে না অজুহাতে আমাদের সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়নি। আমাদের বসার জন্য একটা সেডের ব্যবস্থা করা হলো। ফিলিপিনোরা এই দ্বীপে আসলে একেবারে তিন চারদিনের আগে ফেরে না, অনেক রঙ বেরঙের তাঁবু ফেলা দেখলাম, বাথরুম যে কোথায় করে আল্লাহই জানে!
এর মাঝেই শুরু হয়ে গেলো স্যুভেনির কেনা কাটা! আমি ছবি তোলা শুরু করতেই অক্ষয় ভাইয়া বললেন ক্রেতাসহ ছবি তুলতে।
তাদেরকে যেভাবে দেখিয়ে দিয়েছি, সেভাবেই পোস দিয়েছে! হাহা!
খন্দকার ভাইয়ের পুত্রকন্যা, পিতৃগর্বে গর্বিত, এই মাছ তাদের বাবা কিভাবে যেনো ধরে নিয়ে আসছে!
এই না হলে ভেকেশান?
মেঘের কোলে রোদ হেসেছে , বাদল গেছে টুটি, আহা হাহা হা, আজ আমাদের ছুটি , ও ভাই আজ আমাদের ছুটি
লান্চের পর মন খালি ফিরে যেতে চাইছিলো, কিন্তু আমাদের নৌকার তো কোনো খবর নাই ! নৌকা আসলো লান্চের অনেক পরে এবার পাড়ি জমালাম কাপোনস আইল্যান্ডের পথে। যদিও আমি রিসোর্টে ফিরে যাবার পক্ষেই ছিলাম!
কাপোন্স যেনো স্বর্গের এক টুকরো ছেঁড়া অংশ! কাপোন্স এর স্বচ্ছ সবুজাভ নীল পানি দেখে আমি সব কিছু ভুলে গেলাম। আমার বর বললো, দেখো যদি ভয় পেয়ে না আসতে , তাহলে এত সুন্দর একটা জায়গা অদেখা রয়ে যেত!
সাগরের সৈকতে কে যেনো দূর হতে আমাকে ডেকে ডেকে যায়, আয় আয় আয়...........
ঐ ঝিনুক ফোটা সাগর বেলায় আমার ইচ্ছে করে , আমি মন ভেজাবো ঢেউয়ের মেলায় তোমার হাতটি ধরে ...
সাগরের তীর থেকে মিস্টি কিছু হাওয়া এনে তোমার কপালে ছোঁয়াবো গো ভাবি মনে মনে
ওরে নীল দরিয়া আমায় দে রে দে ছাড়িয়া..........
এই সেই ঐতিহাসিক নৌকা
কাপোন্স এর পরের গন্তব্য কামারা আইল্যান্ড। আমি তো রাগে গজগজ করছি , না তারা লাইট হাউজ দেখবে!
ঐ যে উপরে দেখা যাচ্ছে সাদামত, সেটাই লাইট হাউজ। অনেক কস্টে সবাইকে এখানে নামা থেকে বিরত করেছি, উফফ! এরপরে ফেরার পালা । ফেরার পথে আবার সেই বড় বড় ঢেউ! এক কলিগের মেয়ে তো কেঁদেই দিলো, ওর সমান বয়স হলে আমিও কাঁদতাম ওর সাথে। অনেক ভাবলাম বসে বসে, আমি কি তাহলে মৃত্যুকে ভয় পাই, এটা তো অনিবার্য! ভেবে দেখলাম , নাহ , শুধু মৃত্যুকে ভয় পাই না, আমি ভয় পাই সলীল সমাধিকে ! ভেবে দেখুন, আপনি পানিতে ডুবে যাচ্ছেন, নাক কান দিয়ে পানি ঢুকছে, নিশ্বাস নিতে পারছেন না! কি ভয়ংকর!
ফেরার পথে ওরা ফ্লাইয়িং ফিশ দেখে খুব হৈ হুল্লোর করলো, আর আমি যথারীতি আয়াতুল কুরশি পড়া শুরু করলাম। বড় বড় ঢেউয়ের ভয়ে আমি পিছনের দিকে মুখ ফিরিয়ে রাখলাম, তাতেও কোনো সুবিধা হলো না, যেদিকে চোখ যায় খালি পানি আর পানি। আর এত পানি দেখে আমার কেবলই গলা শুকিয়ে আসতে লাগলো!
মেঘ থম থম করে , কেহ নেই
আমায় ডুবাইলি রে আমায় ভাসাইলি রে , অকুল দরিয়ার বুঝি কূল নাই রে ......
নাহ, সলীল সমাধি হয়নি, ঠিক ঠাকভাবেই ফিরতে পেরেছিলাম। রিসোর্টে ফিরেই গোসল করে বিছানায়! এদিকে ঐদিন রাতেই ছিলো আমাদের গ্রুপ ডিনার , যা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম এবং পরে আমার জন্য অন্যদের অপেক্ষা করতে হয়েছে! তবে ডিনারের পর অনেক মজা করেছিলাম। আমি আর এন্ডো গিয়ে ভিডিওকে দখল করলাম! প্রথমে কেউ পাত্তা না দিলেও পরে এসে আমার বর আর খন্দকার ভাই জুটলেন। আমার বর এমনিতে সাই হলেও গলা ভালো তার মাশাল্লাহ , আমার চেয়ে ভাল গায়। সে খুবই এনজয় করলো। যাহ্ বাবা, আমাদের আনন্দটা কারেন্ট বাবাজির সহ্য হলো না, তিনি চেঁচামেচিতে বিরক্ত হয়ে প্রস্থান করলেন আর আমাদের গান গাওয়াও শেষ হলো। শুরু হলো ম্যারাথন আড্ডা! সব কিছুরই শেষ থাকে , আড্ডা শেষ করে যখন একেবারেই হতাশ হয়ে রুমে ফিরছিলাম, তখনই কারেন্ট বাবাজী হাজির! বাহ!
পরদিন ফেরার পালা! ফেরার পথে আমরা ঢুঁ মারলাম সুবিক বে এর লাইট হাউসে আর শপিং মল গুলোতে ! সুবিক এ আমার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা এই লাইট হাউজ সুবিক বে!তবে দিনের চেয়ে রাতের সাজ সজ্জা অনেক বেশী দৃস্টিনন্দন! আসুন সুবিকের কিছু ছবি দেখতে দেখতে না হয় বিদায় নেই।
( গানের ব্যাপরে আমি সর্বভূক, তাই সব ধরনের গানই দিয়েছি,আশা করি ভাল লাগবে। সাথে থাকার জন্য সবাইকে শুভকামনা! )
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই জুন, ২০১৩ দুপুর ২:৫৮