
"এই মুমু, খাট থেকে একদম নামবে না!"
"এই ডল, খাট থেকে একদম নামবে না, মামনি কিন্তু বকা দিবে!"
ছোটবেলায় আমার মায়ের এমন কঠিন শাসনের মধ্যে দিয়েই বড় হয়ে উঠেছি আমি! আমি আমার বাবা মায়ের প্রথম সন্তান! তাই আমার মায়ের কাছে ছিলাম তার একটা জীবন্ত খেলার পুতুল! ডিজাইনার ফ্রক, কাবুলি সেট, নানারকম ডিজাইনের ড্রেস পড়াতো আমাকে! গোলাপি হলো তার প্রিয় রঙ! ছোটবেলা থেকে যখনই তার সাথে ড্রেস কিনতে গিয়েছি সব সময় গোলাপি!! এতো বেশী গোলাপি ড্রেস পরেছি যে একটা সময় আমি গোলাপি রং থেকে দূরে ভাগতাম! তবে এটা ঠিক যে আমার কমপ্লেক্সসনে গোলাপি রং বেশী মানায়! সে ঠিক জানত আমার জন্য কোনটা ভালো হবে!
আমার কথাবলা, লেখাপড়া, ম্যানার সবকিছু নিয়েই সে প্রচন্ড রকমের কর্নসার্নড! সব সময় আমাকে বেস্ট দেখতে চাইতেন। আমার জন্য এতোবেশী মাতামাতি করেছে যে , আমার ছোট বোনের সময় টায়ার্ড হয়ে গিয়েছিলো, আমার মতো কড়া ডিসিপ্লিনের মধ্যে দিয়ে তাকে যেতে হয়নি!
মামনি ছোটবেলা থেকেই খুব শৌখিন এবং ঘরোয়া। নানাভাইয়ের খুব আদরের মেয়ে ছিলেন! খাওয়া দাওয়া নিয়ে ছোটবেলা থেকেই তার সমস্যা! এটা খাবনা , ওটা খাব না! কিছু হলেই রাগ করে খাওয়া বন্ধ! নানাভাই তখন চুপি চুপি গিয়ে বলতেন, "আচ্ছা কিছু ভাল না লাগলে একটা ডিম ভাজি করে খাও!" তার একটাই শখ ছিলো, জামা বানানো (যেটা এখন আমার ছোটবোনের মধ্যে সংক্রমিত হয়েছে)! হাতে টাকা থাকলেই কাপড় কিনে সেলাই মেশিনে সেলোয়ার কামিজ বানিয়ে ফেলতেন! নানাভাই ও তার আদরের মেয়ের জন্য পাকিস্তান আমলের দামি কটন কিনতে পিছপা হতেন না!
সাত ভাইবোনের মধ্যে মেজখালা আর মামনি পিঠাপিঠি। আর দেখতেও অনেকটা একই রকম হওয়াতে অনেকই জমজ বলে ভুল করত! তার ভাইবোনরা হলো তার জান!
তরুনী মামনি যথেস্ট সুন্দরী ছিলো! তাকে সেসময় অনেকে কবরীর সাথে তুলনা করতো। আমি সেই সময়ের ছবি দেখেছি, তারা ভুল তুলনা করতো না! তার চুলের গোছা নিয়ে আমি এখনও জেলাস! আমি তার এতো কিছু পেলাম, চুলটা কেনো পেলামনা! আমার বোনটা কিছুটা পেয়েছে! একবার নাকি গার্হস্থ্য বিজ্ঞান প্র্যাকটিক্যালে রান্না করতে গিয়ে চুলে আগুন লেগে গিয়েছিলো!
তার বিশাল বান্ধবী সার্কেল ছিলো! তাদের সেই সময়কার স্টাইল, এক রকম শাড়ি পড়ে ছবি তোলা, পিকনিক, আমি ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দিতাম এসব ছবি দেখে!
বাবার সাথে মামনির বিয়ে হবার কিছুদিন পর বাবার চাকরীর সুবাদে তাকে ঢাকা ছেড়ে যেতে হয়! ছোটবেলা থেকে বড় হয়ে ওঠার প্রানের ঢাকা এবং তার ভাই বোনদের ছেড়ে যাওয়াটা সে কখনোই মেনে নিতে পারেনি!ছোটবেলায় দেখেছি, তার একটাই স্বপ্ন ছিলো, সে ঢাকায় থাকবে!
ঢাকা থেকে সামান্য দূরে এক সরকারী কোয়ার্টারে আমার বাবা মায়ের ছোট্ট সাজানো সংসার! মামনি একটা স্কুলে শিক্ষকতা পেশায় জয়েন করলো! একদিন স্কুল থেকে ফিরে এসে দেখে যে বাবা অফিস থেকে ফিরে না খেয়ে কোথায় জেনো গিয়েছে! ব্যাস্, অমনি তার মনে হলো সে চাকুরী করলে তার সংসারের সৌন্দর্য থাকবেনা! সাথে সাথে রিজাইন করলো! পরবর্তী জীবনে সে আর চাকরী করেনি, তবে ক্যাম্পাসের মহিলা সমিতিতে সে দীর্ঘসময় প্রেসিডেন্ট ছিলো।
আমার বাবা মায়ের আন্ডার্স্ট্যন্ডিং দেখে সবাই প্রশংসার চোখে তাকাত! আমার বাবা আমার মাকে যে প্রায়রিটি, যে সম্মান সারাজীবন দিয়ে গেছেন, তা তুলনাহীন। কখনও যদি বাবাকে একটা বিস্কিটও খেতে দেই, বাবা খাবার আগে প্রথম জিগ্গেস করবে , "তোমার আম্মুকে দিয়েছো?"
আমার বাবা মায়ের সীমিত আয়ের প্রথম জীবনে টাকাপয়সা কম ছিলো , কিন্তু সংসারটাকে সাজানোর জন্য, আরও সুন্দর করার জন্য মামনির মেধা, শ্রম এবং আত্মত্যাগের কোনো তুলনা ছিলো না! আমাদের বাসায় যেই আসত আমার মায়ের রুচির প্রশংসা না করে পারতো না! তাকে কখনও গয়না কেনার জন্য , দামি শাড়ী কেনার জন্য হা হুতাশ করতে দেখিনাই।টাংগাইলের পার ওয়ালা সুতি শাড়ি পড়ত, কিন্তু অবশ্যই সেটা মাড় দিয়ে এবং আয়রন করে! শাড়ী গয়না কেনার চেয়ে, ঘরের পর্দা বদলানো, একটা নতুন ফুলদানি কেনা, ড্রইংরুমে একটা সুন্দর কার্পেট বিছানো - এসব করতেই তার ভালো লাগে!
অফিসে সারাদিন কাজ করে এসে আমি ঘর গোছানোর সময় পাই না, মনে মনে হাসি, ভাগ্গিস আমি এখন প্রবাসে! নাহলে আমার ঘরের এই হাল দেখে মামনি কি বলত! তারপরও মাঝে মাঝে প্রজাপতি কিনে আনি, দেয়ালে সোপিস লাগাই, আমার হেলপার হাসে, "তুমি যে এসব কিনো, তুমি কি এগুলি দেশে নিতে পারবা?" যখন আমার ঘরের লাইট ল্যাভেন্ডার কালারের পর্দা দেখে আমার কলিগ মার্কেট চসে বেড়ায়, তখন বুঝি মামনির রুচি আর ঘর গোছানোর নেশা আমার মধ্যে জেনটিক্যালীই চলে আসছে!
ছোটবেলায় আগে খেতে বসলেই প্রথমে জিগ্গেস করতাম, 'আজকে কি তুমি রান্না করেছো? তাই তো এতো মজা হয়েছে!' সবার কাছেই নাকি তার মায়ের রান্না প্রিয়! কিন্তু আমার মা হলো বিক্রমপুরের মেয়ে, বিক্রমপুরের মেয়েদের হাতের রান্না জগৎবিক্ষাত!
ছোট বেলাটা আমি ভীষন মিস করি, তখন একটু জ্বর হলে অথবা পরীক্ষার সময় মামুনি খাইয়ে দিত। আমার ছোট বোন আর আমি অবাক হয়ে ভাবতাম, আমরা নিজেরা খেলে যেটা ভালো লাগে না, মামুনি খাওয়ায় দিলে সেটা এতো ভালো লাগে কেনো?
যখন হলে থাকতাম, মামনি কিছু ভালো রান্না করতো না, আমি বাসায় গেলে একসাথে ভালো কিছু খাওয়া হতো! এমনকি আমি যখন চাকরি পেয়ে ঢাকার বাইরে গেলাম, তখনও একই অবস্থা! এখন দেশের বাইরে আসছি এখনও প্রতিদিন তাকে বলতে হয়, কি খেলাম না খেলাম, না হলে তো সে খাবে না!
প্রবাসে অসুখ হলে , চোখে ভাসে মামনি ওড়না দিয়ে মাথা পেচিয়ে দোয়া পড়ে ফুঁ দিচ্ছে! কিশোরী বয়সে মামনির সাথে প্রবল যুদ্ধ হতো আমার , কিছুতেই তার মনের মত হতে পারতাম না, প্রচন্ড রাগ করতাম, ঝগড়া করতাম।কিন্তু মাঝে মাঝে সারা পৃথিবীটা যখন অন্ধকার হয়ে যেত, একমাত্র আমার মায়ের বুকেই আমি শান্তি খুঁজে পেতাম!
আমার জন্য সে যেকোনো কিছু করতে পারত! আমার সাথে কোনো বন্ধু বা কাজিনের ঝগড়া হলে সে গিয়ে বকা দিয়ে আসত! এমনকি স্কুলের টিচাররাও বাদ যেত না! পরে এটা নিয়ে আমার বন্ধুরা আর কাজিনরা খেপাতে ভুলতো না!
আমি খুবই অলস প্রকৃতির , আমার লেখপড়া এবং যা কিছু অর্জন, পুরোটাই আমার বাবামার ঠেলাঠেলিতে! নেপোলিয়ান জ্ঞানী ব্যাক্তি ছিলেন, তিনি ঠিকই বলে গেছেন, "Give me an educated mother, I shall promise you the birth of a civilized, educated nation." আজ আমরা দুই বোন বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রীধারী, আমি প্রায়ই ভাবি, আমার মা যদি এভাবে আমাদের পিছে লেগে না থাকতেন , তাহলে আজকে আমরা যে অবস্থানে এসেছি, এখানে কি পৌছাতে পারতাম?
গান শোনা গল্পের বই পড়া এসব নেশাও কিন্তু সেই ধরিয়েছে! সেই ক্লাস ফাইভে পড়ার সময় আমার জন্মদিনের উপহার কিনে দিয়েছিলো হুমায়ুন আহমেদ-এর নীল হাতি! ঐ বইয়ের সব গল্প দাড়িকমাসহ আমার মুখস্থ ছিলো!
আমার মায়ের কাছ থেকে আরও পেয়েছি সেন্টিমেন্ট, জেদ, প্রবল আত্মসম্মানবোধ, ফ্যামিলিকে ভালোবাসার অসাধারণ ক্ষমতা, প্রিয়জনের জন্য অপরিমেয় টেনশন আর তার অসুখগুলো!
প্রবাসে সারাদিন ব্যস্ততার পর বাসায় এসে , মাঝে মাঝে টায়ার্ড লাগে , হয়ত একদিন ফোন করলাম না, নির্দিস্ট সময় পার হওয়ার সাথে সাথে ফোন করবে, " কেমন আছ? শরীর ভালোতো? ঠিক মত খাওয়া দাওয়া করছো? তুমি টায়ার্ড? তোমার গলাটা শোনার জন্য ফোন করলাম, নাইলে রাত্রে ঘুম আসবেনা।" একদিন ফোন না করলে মামনি অস্থির হয়ে যায়! তার অতিরিক্ত টেনশনের জন্য ক্খনও রাগ লাগলে, সাথে সাথে নিজেকে বোঝাই, আমার যে শিশুটি পৃথিবীতে আসেনি তার কথা চিন্তা করলে চোখ উপচে পড়ে , আর আমিতো তার গর্ভধারন করা সন্তান, তার শরীরের বিচ্ছিন্ন অংশ!
আমি মন থেকে আমার মায়ের জন্য আল্লাহ-র কাছে দোয়া করি, আল্লাহ যদি আবার কখনও আমার মা-কে দুনিয়াতে পাঠায়, তার সেই জীবনটা যেনো খুব আনন্দময় হয়, সব সময় যেনো সে হাসিমুখে থাকে, কোনো কিছু নিয়ে যেনো তাকে টেনশন করতে না হয়, তার জেনো কোনো অসুখ না থাকে, কোনো কস্ট না থাকে ! আমিন।
মাঝে মাঝে ওদের জন্য খুব কষ্ট হয়, যাদের মা নেই . . . মা ছাড়া সন্তানের মনের কথা এভাবে আর কে বোঝে? এত যত্ন করে কে খাওয়ায়? মন থেকে কে দোয়া করে? কার বুকে আছে এতো মমতা আর প্রশান্তি? পৃথিবীর সব মায়েদের শ্রদ্ধা জানাই।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই মে, ২০১২ রাত ৯:২২