-আল্লামা মুহম্মদ ওয়ালীউল্লাহ।
“প্রটোকল” পুস্তক একটি মূল্যবান দলীল। দুনিয়ার মানুষকে সর্বপ্রথম এ বইটি সম্পর্কে অবহিত করে অধ্যাপক সারকিল এ নাইলাস নামক জনৈক গোঁড়া রুশীয় পাদ্রী। ১৯০৫ সালে অধ্যাপক নাইলাস নিজে উদ্যোগী হয়ে বইটি প্রকাশ করে। বইয়ের ভূমিকায় সে উল্লেখ করে যে, ‘ইহুদী ফ্রি-ম্যাসন ষড়যন্ত্রের কেন্দ্রস্থল’ ফ্রান্সের একটি ফ্রি-ম্যাসন লজ থেকে জনৈক মহিলা (সম্ভবত হিব্রু ভাষায় লিখিত) মূল বইটি চুরি করে এনে তাকে উপহার দেয়।
উল্লেখ্য যে, এ ঘটনার পর কোনো মহিলাকেই আর ফ্রি-ম্যাসন আন্দোলনের সদস্য করা হয় না। সামাজিক অনুষ্ঠান উপলক্ষে মহিলারা ফ্রি-ম্যাসন লজে যাবার অনুমতি পেলেও বৈঠকাদির সময় তাদের বের করে দেয়া হয়।
১৯১৭ সালের জানুয়ারি মাসে অধ্যাপক নাইলাস এ বইয়ের একটা নয়া সংস্করণ তৈরি করে এবং বাজারে বের হবার আগেই ওই বছর মার্চ মাসে রাশিয়ায় কমিউনিস্ট বিপ্লব সংঘটিত হয়। জার সরকারকে উচ্ছেদ করে ক্ষমতা দখলকারী কীরিনিস্কী সরকার প্রটোকলের সকল কপি বিনষ্ট করে ফেলে। কারণ এ বইয়ের মাধ্যমে রুশ বিপ্লবের গোপন তথ্য ফাঁস হয়ে যাবার আশঙ্কা ছিল। নাইলাসকে গ্রেফতার করে জেলে নিক্ষেপ করা হয় এবং অমানুষিক দৈহিক নির্যাতনের পর তাকে রাশিয়া থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়। ১৯২৯ সালের ১৩ই জানুয়ারি সে ভøাদিমিরে মারা যায়।
কিন্তু তা সত্ত্বেও বইটির এত চাহিদা হয়েছিল যে, ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত এর ৪টি সংস্করণ প্রকাশিত হয়। ছাপানো পুস্তক ছাড়া পাতলা কাগজে টাইপ করেও এটি প্রকাশ করা হয়েছিল। ধান পাতার তৈরি এক প্রকার কাগজে লেখা একটি প্রটোকল পুস্তক সাইবেরিয়া অঞ্চলে প্রচার করা হয়েছিল। এরই এক কপি ১৯৩৯ সালে আমেরিকায় পৌঁছে এবং সেখানে এর অনুবাদ প্রকাশিত হয়।
প্রটোকলের ইংরেজি অনুবাদক ছিল ভিক্টরই মারসডেন। সে একজন ইংরেজ সাংবাদিক। দীর্ঘকাল রাশিয়ায় বসবাস করে এক রুশ মহিলাকে সে বিবাহ করে। ‘মর্নিং পোস্ট’ পত্রিকার রুশীয় সংবাদদাতা হিসেবে সে কাজ করতো। ১৯৩৭ সালের বিপ্লব সে স্বচক্ষে দেখে এর রোমহর্ষক হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ সংবাদপত্রে প্রেরণ করে। এজন্য তাকে গ্রেফতার করে দু’বছর ‘পিটার পল’ জেলে রাখা হয় এবং সেখান থেকে মুক্তির পর ইংল্যান্ডে ফিরে এসে সে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে বসে প্রটোকলের তরজমা করে। বলশেভিক বিপ্লবের পর রাশিয়া থেকে পালিয়ে যে সব লোক আমেরিকা ও জার্মানিতে আশ্রয় নেয়, তারাও অধ্যাপক নাইলাস অনূদিত প্রটোকলের কিছু কপি সঙ্গে নিয়ে আসে।
অধ্যাপক সারকিল এ নাইলাস ধর্মে খ্রিস্টান ছিল। সে স্বীয় ধর্মকে ইহুদী ষড়যন্ত্র থেকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যেই এ বইটি বিশ্ববাসীর কাছে পেশ করার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেছিল।
প্রটোকল বইটি গুপ্ত চক্রান্ত মারফত বিশ্ব সমাজ গঠনের ইহুদী পরিকল্পিত একটি নীল নকশা। এ নীল নকশায় যে ধরনের বিশ্ব রাষ্ট্রের পরিকল্পনা করা হয়েছে। এক কথায় তাকে পুলিশী রাষ্ট্র বলা যেতে পারে।
সাম্প্রতিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে, পৃথিবীতে যে কয়টি বড় ধরনের ঘটনা বা দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়েছে তার সবগুলোই প্রটোকল বইয়ে পূর্ব থেকেই ভবিষ্যদ্বাণীর মতো লিপিবদ্ধ রয়েছে।
আমরা বইটির এই গুরুত্ব উপলব্ধি করে ইংরেজি থেকে তার বাংলা অনুবাদ এখানে পেশ করছি। চিন্তাশীল পাঠক তা মনোযোগ সহকারে পাঠ করলে বিশ্বব্যাপী ইহুদী ষড়যন্ত্র সম্পর্কে একটা সুস্পষ্ট ধারণা লাভ করতে পারবেন। নিম্নে প্রটোকল পুস্তকে বর্ণিত ইহুদীদের নিজস্ব অভিমত ও মুসলমান দমনের গোপন পরিকল্পনা বা নীল নকশা তুলে ধরা হলো-
(গত কিস্তির পর)
(গত সংখ্যার পর)
মূলত ইহুদী জাতি তাদের ধর্মীয় চেতনাগত ভাবেই মুসলিম বিদ্বেষী। তাদের ধর্মগ্রন্থ ‘তালামুদ’-এ দুনিয়ার অ-ইহুদী তথা মুসলমান জনগোষ্ঠী সম্পর্কে নিম্নলিখিত চেতনাবোধ পাওয়া যায়:
১. অ-ইহুদী তথা মুসলিম জনগোষ্ঠীর ধন-সম্পদের কোনো মালিকানা নেই। ধন-সম্পদের প্রকৃত মালিক ইহুদী জাতি। অ-ইহুদী তথা মুসলমানদের অর্জিত ধন-সম্পদ ন্যায়তই ইহুদীরা দখল করে নিতে পারে।
২. অ-ইহুদী তথা মুসলিম জনগোষ্ঠী ও তাদের ধন-সম্পদের উপর কর্তৃত্ব করার জন্যই খোদা ইহুদী জাতিকে দুনিয়াতে মনোনীত করেছেন।
৩. মানুষ যেমন সৃষ্ট জীবের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, তেমনি ইহুদী জাতিও মাটির পৃথিবীতে বসবাসকারী সমগ্র মানব গোষ্ঠীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ। কারণ ইহুদী ছাড়া সকল মানুষের মধ্যেই পশুত্ব ও পাপ-প্রবৃত্তি রয়েছে।
৪. খোদা ইহুদী জাতিকে অ-ইহুদী তথা মুসলমানদের নিকট থেকে সুদ আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন এবং বিনা সুদে অ-ইহুদী তথা মুসলমানদের ধার দিতে নিষেধ করেছেন।
মূলত এহেন তীব্র মুসলমান বিদ্বেষী মনোভাব নিয়েই ইহুদীদের পদচারণা। তাদের চক্রান্ত খুবই সুদূর প্রসারী। আজকের ইসরাইলের পিছনে তাদের চক্রান্তের নীল নকশা প্রণীত হয়েছিল বহু পূর্ব থেকেই।
ফরাসী রাষ্ট্রবিপ্লব ইহুদীদের জন্য মুক্তির পয়গাম বহন করে আনে। ইহুদীদের রচিত বিশ্বব্যাপী চক্রান্তের পরিকল্পনা পুস্তক ‘প্রটোকল’ থেকে জানা যায় যে, ফরাসী রাষ্ট্রবিপ্লবের পরিকল্পনা ও পরিচালনায় ইহুদী ষড়যন্ত্রকারীদেরই গোপন হাত ক্রিয়াশীল ছিল। এ বিপ্লবের ফলে ঊনিশ শতকের শেষাংশে ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, জার্মানি, হল্যান্ড, বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, নরওয়ে, অস্ট্রিয়া এবং সুইজারল্যান্ড ইহুদীদের পূর্ণ নাগরিক অধিকার দান করে। কিন্তু পূর্ব-ইউরোপে ইহুদীদের তখনও ঘৃণার চোখে দেখা হতো এবং সেখানে আজাদীর সুখ থেকে এরা সম্পূর্ণ বঞ্চিত ছিল। ঊনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে অস্ট্রিয়ার ইহুদী সাংবাদিক থিউডর হার্টজেল সর্বপ্রথম ইহুদীদের মধ্যে আজাদীর প্রেরণা সৃষ্টি করে। এজন্য তাকে ইহুদীবাদের জনক বলা হয়।
শুরুতে থিউডর হার্টজেল ফিলিস্তিনে ইহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কোনো পরিকল্পনা করেনি। সে বরং ইংরেজদের পরামর্শে পূর্ব-আফ্রিকায় একটি আজাদ ইহুদী রাষ্ট্র স্থাপন করতে আগ্রহী ছিল। কিন্তু অন্যান্য ইহুদী নেতাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করার পর তার মনোভাব পরিবর্তিত হয় এবং তার লুব্ধ দৃষ্টি ফিলিস্তিনের প্রতি আকৃষ্ট হয়।
হার্টজেল তার উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য একদিকে দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের শাসকদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করে দেয় এবং অপর দিকে তুরস্কের সুলতান দ্বিতীয় আবদুল হামিদ-এর সঙ্গে দেখা করে ফিলিস্তিনে বসবাসের অন্য অনুমতি প্রার্থনা করে। এরপর ইহুদীরা অত্যন্ত চাতুর্যের সাথে সুলতানকে ৫ কোটি পাউন্ড অর্থসাহায্য দিয়ে তুর্কী খিলাফতের অর্থনৈতিক সঙ্কট দূরীকরণের ইচ্ছা প্রকাশ করে। সুলতান আবদুল হামিদ ইহুদীদের অসদুদ্দেশ্য বুঝতে পেরেই তাদের আবেদন নাকচ করে দেন এবং স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেন যে, তার জীবদ্দশায় ইহুদী সম্প্রদায় কখনও ফিলিস্তিনে বসবাস করার অনুমতি পাবে না।
থিউডর হার্টজেল সুলতান আবদুল হামিদ-এর নিকট থেকে নিরাশ হয়ে পুনরায় ইংরেজদের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় এবং ১৮৯৭ সালের ২৯শে আগস্ট সুইজারল্যান্ডে ইহুদী-কংগ্রেসের বৈঠক আহ্বান করে। উক্ত বৈঠকে নিম্নরূপ ফায়সালা গৃহীত হয়:
১. ফিলিস্তিনকে ইহুদীরাজ্যে পরিণত করার উদ্দেশ্যে ইহুদীদের সুপরিকল্পিত উপায়ে কৃষি ও ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে অগ্রসর করতে হবে।
২. সমগ্র দুনিয়ার ইহুদীদের সংঘবদ্ধ করার জন্য আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় পর্যায়ে সংগঠন গড়ে তুলতে হবে।
৩. ইহুদীদের মধ্যে প্রবল জাতীয় চেতনা সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে।
৪. পূর্বোক্ত তিনদফা কর্মসূচির সঙ্গে সঙ্গে ফিলিস্তিনে ইহুদী রাষ্ট্র কায়েম করার জন্য প্রয়োজনীয় চেষ্টা-তদ্বির অব্যাহত রাখতে হবে।
এরপর সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে ইহুদী সম্প্রদায় মুসলমানদের বিরুদ্ধে নানাবিধ চক্রান্ত জাল বিস্তার করে। ইংরেজদের সাথে মিলে তারা আরব ও অনারবদের মধ্যে ঘৃণা ও বিদ্বেষ সৃষ্টির মাধ্যমে তুর্কী খিলাফতের অধীনে নিয়োজিত আরব অফিসার ও সৈন্যদের মনে তুর্কী সুলতানের প্রতি বিদ্বেষ সৃষ্টি করার কাজ জোরেশোরে শুরু করে। আঞ্চলিকতাবাদ ও ভাষাগত জাতীয়তার সস্তা এবং মুখরোচক শ্লোগানের সাহায্যে মুসলমানদের মধ্যে ফাটল সৃষ্টি করে তাদের দুর্বল করার এ হীন প্রচেষ্টা নব্য সমাজকে খুব সহজেই আকৃষ্ট করে এবং এর ফলে আরব-তুর্কী সম্পর্ক বিনষ্ট হয়। আরব-অনারব দ্বন্দ্বের ফলে মুসলিম শক্তি দুর্বল হয়ে যায় এবং ‘ফ্রি-ম্যাসন’ আন্দোলনের প্রভাবে কামাল পাশার ইসলাম বিরোধী তৎপরতা ইহুদীদের উদ্দেশ্য সিদ্ধির পথ প্রশস্ত করে দেয়।
প্রধানত ইহুদীদের পরিকল্পনাই তুর্কী বিপ্লবকে সম্ভবপর করে তোলে। কামাল পাশা ইহুদীদেরই ক্রীড়নক হিসেবে ময়দানে কাজ করেছেন মাত্র। নিম্নলিখিত পুস্তকগুলোতে এ দাবির প্রমাণ মওজুদ রয়েছে, তুর্কী খিলাফত মুসলিম জাহানের ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের একটি কেন্দ্র ছিল। সমগ্র মুসলিম জাহান ও খিলাফতকে কেন্দ্র করেই পরস্পরের মধ্যে এক অবিচ্ছেদ্য ভ্রাতৃত্বের বন্ধন অনুভব করতো। কিন্তু ইংরেজ ও ইহুদী ষড়যন্ত্রের ফলে খিলাফত উচ্ছেদ হয়ে গেল এবং মুসলিম জাহানের ঐক্য-সূত্র ছিন্ন হল। তারপর থেকে মুসলিম দেশগুলো পরস্পরের সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদ করে নিজেদেরকে ইহুদী ও খ্রিস্টান চক্রান্তের খপ্পরে নিক্ষেপ করে আসছে।
কামাল পাশা ২৫,০০০ ধর্মপ্রাণ মুসলমানকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। খ্যাতনামা আলিম ও ইসলামী চিন্তাবিদদেরও পৈশাচিক আনন্দে শহীদ করে সে ‘গাজী’ উপাধি ধারণ করে। শহীদ ব্যক্তিদের একটিমাত্র ‘অপরাধ’ ছিল আর তা হলো ইসলামী আদর্শের প্রতি তাদের অটল বিশ্বাস। কামাল পাশা ইসলামী ইবাদত, ইসলামী রীতিনীতি ও আদব-কায়দা সব কিছুই নিষিদ্ধ করে দেয়, এমনকি আরবী ভাষায় কুরআন শরীফ পাঠ করাও সে অপরাধ বিবেচনা করে। এভাবে ইসলাম বিরোধী ও ইহুদী প্রভাবান্বিত পরিবেশ সৃষ্টি হবার ফলে মধ্যপ্রাচ্যে ইহুদীদের রাষ্ট্র স্থাপনের পথ প্রশস্ত হতে থাকে। আরব-অনারব দ্বন্দ্বের ফলে মুসলিম শক্তি দুর্বল হয়ে যায় এবং ফ্রি-ম্যাসন আন্দোলনের প্রভাবে কামাল পাশার ইসলাম বিরোধী তৎপরতা ইহুদীদের উদ্দেশ্য সিদ্ধির পথ প্রশস্ত করে দেয়।
ইহুদী চক্রান্ত মুসলমানদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি ও নানাবিধ ছদ্ম আন্দোলনের মাধ্যমে যুবসমাজকে ইসলামের প্রতি বিরূপ ভাবাপন্ন করে তোলার সঙ্গে সঙ্গে ফিলিস্তিনে ইহুদী রাষ্ট্র স্থাপনের আন্দোলনও চালিয়ে যেতে থাকে।
১৯১৬ সালে ইহুদীদের বিশ্ব-সংস্থা “ওয়ার্ল্ড জাইওনিস্ট অর্গানাইজেশন” ব্রিটেনের পররাষ্ট্র দফতরের সঙ্গে এক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় লিপ্ত হয়। এর ফলে ১৯১৭ সালে ব্রিটিশ সরকার কুখ্যাত ‘ব্যালফোর ঘোষণায়’ ফিলিস্তিনে ইহুদীদের জাতীয় আবাসভূমি স্থাপনের দাবি সমর্থন করে।
ব্যালফোর ঘোষণাটি ছিল নিম্নরূপ:
“আমি অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে ঘোষণা করছি যে, মহামান্য রাজকীয় ব্রিটিশ সরকার ইহুদী আন্দোলনের প্রতি আন্তরিক সহানুভূতি পোষণ করে এবং ফিলিস্তিনে ইহুদীদের জাতীয় আভাসভূমি স্থাপনের দাবি সমর্থন করে। এতদসঙ্গে আমি একথাও ঘোষণা করছি যে, ব্রিটিশ সরকার ইহুদীদের লক্ষ্য অর্জনের জন্য সকল প্রকার সাহায্য ও সহযোগিতা প্রদান করবে।”
তদানীন্তন ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রী আর্থার জেমস ব্যালফোর এ ঘোষণায় স্বাক্ষর করে।
১৯৩৭ সালে রয়েল ফিলিস্তিন কমিশনের নিকট সাক্ষ্যদানকালে তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী একথা স্বীকার করেন যে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ইহুদী সম্প্রদায় মিত্র শক্তির সঙ্গে সহযোগিতা করায় পুরস্কার স্বরূপ পূর্ব নির্ধারিত ‘গুপ্ত চুক্তি’ মুতাবিক ব্রিটিশ সরকার ফিলিস্তিনে ইহুদীদের জাতীয় আবাসভূমি স্থাপনের আন্দোলন সমর্থন করে। অবশ্য উক্ত ঘোষণায় ফিলিস্তিনে ইহুদীদের রাষ্ট্র স্থাপনের কথা উল্লেখ করা হয়নি। কিন্তু ইহুদী সম্প্রদায় এ ঘোষণাটিকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে এবং দুনিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে ইহুদীদের নিয়ে এসে ফিলিস্তিনে জড়ো করতে থাকে। এদিকে ১৯২৩ সালে জাতিপুঞ্জ ফিলিস্তিনকে ব্রিটেনের অছিগিরিতে সমর্পণ করে।
ব্যালফোর ঘোষণার পর ইহুদীদের ফিলিস্তিনে নিয়ে আসার যে অভিযান শুরু হয়েছিল, ফিলিস্তিন ব্রিটেনের অছিগিরিতে চলে যাওয়ায় সে অভিযান আরও জোরদার হল। ১৯১৮ সালে ফিলিস্তিন মুসলমানদের মোট সংখ্যার এক-দশমাংশ ছিল ইহুদী এবং তাদের সর্বমোট সংখ্যা ছিল মাত্র কয়েক হাজার। পরবর্তী বছরগুলোতে ফিলিস্তিনে ইহুদীদের সংখ্যা নিম্নহারে বেড়ে যায়:
১৯১৮ সাল থেকে ১৯২৩ সাল পর্যন্ত- ৩৫,০০০, ১৯২৩ সাল থেকে ১৯৩১ সাল পর্যন্ত ৮১,০০০, ১৯৩১ সাল থেকে ১৯৪১ সাল পর্যন্ত ২৫,০০০০।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্তির পর লক্ষ-লক্ষ যুদ্ধ বিধ্বস্ত গৃহহীন লোকদের পুনর্বাসনের সমস্যা প্রকটরূপে দেখা দেয়। এদের মধ্যে বিপুল সংখ্যক ইহুদীও ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মিস্টার ট্রু ম্যান তার সমসাময়িক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মিস্টার এটলীর সঙ্গে পত্রালাপ করে ফিলিস্তিনে এক লক্ষ যুদ্ধ বিধ্বস্ত ইহুদীদের বসবাসের ব্যবস্থা করার জন্য অনুরোধ জানায়। মিস্টার এটলী এ বিষয়ে বিবেচনা করার জন্য মার্কিন ও ব্রিটিশ প্রতিনিধিদের একটি যুক্ত কমিটি গঠনের প্রস্তাব করে। মিস্টার ট্রু ম্যান অবিলম্বে এ প্রস্তাবে সম্মতি জানায়।
১২ জন সদস্যের এ কমিটি ওয়াশিংটন, লন্ডন এবং কায়রো সফর করে ইহুদী, মুসলিম ও খ্রিস্টানদের বক্তব্য শোনে। ১৯৪৬ সালের ৩০ এপ্রিল তারিখে যুগপৎ লন্ডন ও ওয়াশিংটন থেকে কমিটির রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। ওই রিপোর্টে ফিলিস্তিনে এক লাখ ইহুদীর বসবাসের ব্যবস্থা করার স্বপক্ষে মত প্রকাশ করা হয়। তবে কমিটির সুপারিশে স্পষ্ট ভাষায় একথাও উল্লেখ করা হয়েছিল যে, ফিলিস্তিনে ইহুদী ও মুসলমান কেউ কারো উপর প্রাধান্য বিস্তার করতে পারবে না। বরং ইহুদী, মুসলমান ও খ্রিস্টান এ তিন জাতিরই সেখানে সমান অধিকার থাকবে।
রিপোর্টের শেষাংশে যে শর্তটি উল্লেখ করা হয়, তার জন্য ইহুদী সংগঠনগুলো এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানায়। কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ আমেরিকায় বিপুল সংখ্যক ইহুদীদের বসবাসের ব্যবস্থা করা সম্ভব ছিল। প্রেসিডেন্ট ট্রু ম্যান আমেরিকায় ইহুদীদের স্থান দিতে এক সময় রাজিও হয়েছিল। কিন্তু ইহুদী সম্প্রদায় এর কোনো প্রস্তাবই গ্রহণ করেনি। তারা ব্রিটেনের অছিগিরির সুযোগে সমস্ত আরব জাহানের প্রতিবাদ সত্ত্বেও দুনিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে ইহুদীদের ফিলিস্তিনে নিয়ে আসার অভিযান আরও জোরদার করে এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ সমাপ্তির পরপরই ছয় লাখ ইহুদীকে ফিলিস্তিনে এনে বসানো হয়।
এবার ইহুদী সম্প্রদায় ফিলিস্তিনে মজবুত হয়ে বসার ব্যবস্থা করে। ব্রিটিশের ছত্রচ্ছায়ায় ফিলিস্তিনে ‘হেগনা ও ইরগুন’ নামে দুটি সন্ত্রাসবাদী সশস্ত্র ইহুদী সংগঠন গড়ে উঠে। তারা মুসলমানদের উপর নির্বিচার যুলুম নির্যাতন শুরু করে দেয়। (‘ইহুদী ষড়যন্ত্র’ এবং অন্যান্য সহায়ক গ্রন্থ অবলম্বনে) ((Collected))
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১২:৪৪