একটা ছেলে যখন অনার্স শেষ করে পাগলের মতো চাকরি খুঁজে বেড়াচ্ছে। তখন আপনি তাকে কি মোটিভেশন দিবেন?
ছেলেটার গ্রামের বাড়ি বগুড়ায়, বাড়িতে ছোটো এক ভাই এক বোন। বোনটা ছোটো, মা অসুস্থ।
তখন কি তাকে বলবেন আরে ভেবো না কিছু একটা হয়ে যাবে।
এই শহরে মোটিভেশন দেয়া সহজ কিন্তু যে ছেলেটার পায়ের তলায় মাটি নাই তাকে মোটিভেশন এর সামনে দাড় করানোটা বোকামি।
গত কালকেই একটা ছেলের সাথে আমার পরিচয় হয়েছে।
সন্ধ্যায় বাসার পাশেই শহীদ মিনারে বসে মোবাইলে 29 Card Games খেলছিলাম।
একটা মিনারে হেলান দিয়ে বসে ছিলাম মিনারের পিছন দিক থেকে কিছু কথা কানে আসতে থাকে।
- চাকরিটা হয়নি আব্বা, ওরা ওখানে নাকি কার ভাগিনাকে ঢুকিয়েছে। সাফায়ত ভাই অনেক অনুরোধ করেছিলো কিন্তু বলেছে লোক তো অনেক আগেই ঠিক করা ছিলো আমি জানতাম না। তো ভাই চেষ্টা করছি।
মা কে বইলেন না ( কথার মধ্যে রাজশাহীর আঞ্চলিক ভাষার একটা টান আছে)
সাফায়েত ভাই বলেছে ব্যবস্থা একটা করে দিবে।
চিন্তা করবেন না, হয়ে যাবে।
রাজু কি ঠিক মতো পড়ে তো? ওরে বলবেন লেখাপড়াটা যেনো ঠিক মতো করে।
অপর প্রান্ত থেকে কি রকম উত্তর আসছিলো আমি জানিনা।
কিন্তু এখন আমি ছেলেটার মুখোমুখি, ছেলেটার আর আমার মধ্যে ৪/৫ হাতের গ্যাপ।
ছেলেটার হাতে একটা স্যাম্ফোনি ৯১০ টাকা দামের মোবাইল।
বুক পকেট থেকে একটা ডার্বি সিগারেট বের করে ধরালো। মিনারের সাথে হেলান দেয়া।
আমি চেয়ে আছি, অনুমান করার চেষ্টা করছি ছেলেটা কি ভাবছে। সে যেটা এই মুহূর্তে ভাবছে এটা আমি ভাবতে পাড়ছিনা। এই ছেলেটার পায়ের তলায় মাটিনেই। এই শহরে যার পায়ের তলায় মাটি নেই সে এই শহরের এক এতিম বাসিন্দা ।
আমি আরেকটু এগিয়ে তার সামনে গেলাম -
- হ্যালো ব্রদার আগুনটা হবে?
- হুম শিওর।
- ধন্যবাদ
- ডার্বি? স্বাধ কেমন এটার?
- আর ভাই স্বাধ।
- নাম কি ভাইয়ের?
- আবুবকর সিদ্দিক ফরম বগুড়া।
- ওহ আচ্ছা, আচ্ছা
- জানেন আমার বরিশালের ভাষার পর রাজশাহী ভাষাটা অস্থির ভালো লাগে।
- অহ তাই নাকি
- হুম। তা ভাই কি করছেন?
- একটা কম্পানিতে জব করি।
- তা কম্পানিতে জব করেন ডার্বি খাচ্ছেন যে?
- মাস শেষ তো ভাই।
- আপনি গুছিয়ে মিথ্যা বলতে পাড়েন, খুব সুন্দর অভিনয় ও জানেন।
- মানে?
- সাফায়েত ভাই কি চাকরি সত্যি দিতে পাড়বে?
- আপনি জানলেন কি করে?
- কিভাবে জেনেছি সেটা বড় কথা নয়। এতো সুন্দর অভিনয় কিভাবে পাড়ে মানুষ?
- সিদ্দিক ভাই চুপ করে আছেন যে।
- তা সার্টিফিকেট ঝুলিতে কয়টা ঢুকেছেন?
- গ্রাজুয়েশন কম্পিলিট হলো এক বছর হলো।
- এই এক বছর ধরেই কি চাকরী খুঁজে বেড়াচ্ছেন।
- হ্যা ভাই। অবশ্য এখন একটা ফাস্টফুড এর দোকানে ৭ হাজার টাকা বেতনের চাকরি করছি।
বাড়িতে মা অসুস্থ, ভাই আছে একটা বোন আছে। বাবা কৃষি কাজ করে যা আয় করে তাতে হয় না।
আমার থাকা খাওয়া সাড়ে ৪ হাজার টাকা চলে যায়। বাড়িতে ২ হাজার টাকা দিতে পাড়ি তাতে মায়ের ঔষধ হয় না।
ম্যাচের এক বড় এই ফাস্টফুডের দোকানে চাকরীটা দিয়ে দিয়েছে।
১০ দিন আগে সেই বড় ভাই এক জায়গায় নিয়ে গিয়েছিলো জবের জন্য, জবটা প্রায় হয়েই যাচ্ছিলো কিন্তু সেখানে কার ভাগিনাকে বসিয়ে দেয়া হয়েছে।
আমার থেকে বড় ভাইটা কষ্ট পেয়েছে বেশি, সে লজ্জায় এক দিন আমার সামনে আসেনি।
ভাগ্য কে দোষ দিতে দিতে এখন বড্ড ক্লান্ত।
সিদ্দিক ভাইয়ের চোখে পানি ছল ছল করছে। সিগারেট টা টান দিয়ে শেষ করার আগেই শেষ হয়ে গেছে।
এই সিদ্দিক ভাইকে যদি বলি সুলেমান সুখন নামে একজন ব্যাক্তি আছেন যিনি সবাইকে ইন্সপায়ারড করেন, আপনিও তার ভিডিও গুলো দেখতে পাড়েন তাহলে এটা চরম লেভেলের বোকামি হবে।
আমি যদি তাকে শাহরুখ খান কিংবা স্টিভ জবসের কাহিনী শুনাতে যাই সেটাও হবে আমার জন্য চরম বোকামি।
ছেলেটার সামনে আমি মোটিভেশন দিতে গেলে উল্টো তার কাছে বিরক্তকর হয়ে যাবো।
বাস্তবতার মুখোমুখি হলে তখন উপদেশগুলো কে মনে হয় গুলিস্থানের কোনো মলম আর উপদেশ দাতাকে মনেহয় ডেসটিনির পন্য বিক্রিতা।
তারপর তো তিনি আমার ৩ বছরের সিনিয়র।
সিদ্দিক ভাই আরেকটা সিগারেট খাবেন?
আমি আপনাকে খাওয়াবো।
- না ভাই আমার কাছে আছে।
- জানি আপনার বুক পকেটে ডার্বি সিগারেট আছে। আমি আপনাকে B&H খাওয়াবো।
আমি সিগারেটা হাতে দিয়ে বললাম সিদ্দিক ভাই আসি। কাজ আছে একটু যেতে হবে।
- জ্বী ভাই। নামটা তো জানা হলো না?
- আরিফ আহমেদ।
- সুন্দর নাম
চোখে পানি নিয়েও ছেলেটা হাসি দিয়ে বললো সুন্দর নাম। নিখুঁত অভিনয়।
আমার কোনো কাজ ছিলো না, আমি তাকে এড়িয়ে এসেছি কারন তার প্রতিটা কথা আমার ভিতরে টার্চ করছিলো। সিদ্দিক ভাইয়ের সাথে আর কিছুক্ষন থাকলেই আমিও তার সাথে কেঁদে দিবো এমনিতেই তার প্রতি অনেক মায়া জন্ম হয়েছে।
আরো কথা বললে মায়া ট বেড়ে দ্বীগুন হয়ে যাবে।মানুষের কষ্ট দেখার ক্ষমতা আমার হয়নি।
এই জন্য বুঝি এই কষ্টের ফেরিওয়ালারা আমার সামনে ঘুরেঘুরে আসে।
আমি কিছু দূর গিয়ে আড়াল থেকে দেখছি।
ছেলেটা সিগারেটটা ধরিয়ে মিনারে মাথা ঠেকিয়ে আকাশ দেখছে।
জানিনা কতোক্ষন এইরকম আকাশ দেখবে।
তার আকাশ কষ্টে জরজড়িত।
আর আমার আকাশ রোমান্টিকে ভরপুর কারন আমার প্রেমিকা আছে। একটু আগেও তার সাথে রোমান্টিক কথা বার্তা হয়েছে।
- আরিফ রুমি
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে এপ্রিল, ২০১৭ রাত ৯:৫৬