জাফর ইকবাল স্যার বলতে চাচ্ছেন যে জীবনটা প্রতিযোগিতামূলক নয়-জীবনটা সহযোগিতামূলক। ছোট ছেলেমেয়েদের জোর করে প্রতিযোগিতার মাঝে ঠেলে দিতে তিনি অভিভাবকদের নিষেধ করছেন-বলছেন তাদেরকে শৈশব উপভোগ করতে দিতে।
আমি এখানেই স্যারের সাথে দ্বিমত পোষণ করি। আমার কাছে মনে হয়না যে ছেলেমেয়েকে প্রতিযোগিতা থেকে আগলে রাখার মধ্য দিয়ে তাদের শিক্ষা, বা তাদের শৈশব কোনভাবে সুন্দর হয়ে যাবে। সত্যি কথা বলতে, প্রতিযোগিতা থেকে কাউকে কোনভাবে আগলে রাখার কোন উপায় নেই। একজন শিশুকে আপনি কেমন করে আপনি প্রতিযোগিতার থেকে দূরে রাখবেন? তাকে যদি কোন স্কুল কলেজে না পাঠিয়ে ঘরের মাঝে বন্ধ করে রেখে দেন-তাহলে দেখবেন সে নিজের দুইটা হাত পাশাপাশি লাগিয়ে মাপামাপি শুরু করবে-দেখি তো আমার ডানহাতটা বড়ো, নাকি বামহাতটা বড়ো!
প্রথম যখন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে এসে আমি নিজের খরচ চালাবার জন্য চাকরিবাকরি খোঁজা শুরু করলাম-তখন আমি হুট করে আবিস্কার করলাম যে আমি দেশে থাকতে যেরকম হার্টথ্রব টিচার গোছের ছিলাম-এখানে তার ছিটেফোঁটাও নই। ইংরেজি এখানে সবাই জানে, বাংলা এখানে কারও জানার দরকার নাই-কাজেই আমার ভাষার দক্ষতা হঠাৎ করে অন্তঃসারশূণ্য হয়ে গেলো। আমি খুজতে চেষ্টা করলাম, আর কোন ভাষা আমার জানা আছে যেটা আমি কাউকে শিখাতে পারি। তখন আমার মনে পড়লো গণিতের কথা-পৃথিবীর যেকোন প্রান্তের জন্য সার্বজনীন ভাষা। তখন থেকে আমি গণিত পড়াতে শুরু করলাম।
রাজউক কলেজে একবার মিডটার্ম পরীক্ষায় উচ্চতর গণিতে পঁচাত্তরে চার পেয়েছিলাম-এইরকম ফেল্টুস মার্কা অংকের জ্ঞান নিয়ে গণিতের মাস্টার হতে সাহস হচ্ছিলো না। পেটের তাগিদে ভয়ে ভয়ে বেসিক বীজগণিত পড়াতে শুরু করলাম। পড়াতে পড়তে একসময় ধরলাম ত্রিকোণমিতি। সেখান থেকে প্রিক্যালকুলাস হয়ে একসময় ক্যালকুলাস পর্যন্ত পড়ানো শুরু করলাম।পড়াতে পড়াতে একটা সময়ে বুকের মাঝে গণিতের জন্য তীব্র ভালোবাসা নাড়াচাড়া দিয়ে উঠলো-ঠিক সেই ক্লাস এইটের ভালোবাসা, যখন আমি রাফিদ আর ইফতু ঢাকায় জাতীয় গণিত অলম্পিয়াডে একসাথে যাবার সময় দিনরাত একসাথে বসে অংক করতাম-তখনকার ভালোবাসা। চোখ বন্ধ করে মাথার মাঝে সাদামাটা দুনিয়ার যোগসূত্রের প্যাটার্ন দেখতে পাবার ভালোবাসা।
ভালোবাসা আরো বাড়লো যখন সোশ্যাল মুভমেন্টের ডক্টোরাল সেমিনারে বেড়াতে গিয়ে পলিটিকাল সায়েন্সের মাঝে গণিতের ব্যবহার দেখতে পেলাম। গেম থিওরি আর গ্রুপ থিওরি দেখে মাথার মগজ নাড়াচাড়া দিয়ে উঠলো। মনে হলো পলিটিকাল সায়েন্সের সাথে ইকোনমিকসে ডাবল মেজর না করে এখনই গিয়ে রেজিস্ট্রার অফিসে গিয়ে ম্যাথ নিয়ে ডাবল মেজর বানায়ে ফেলি। এইসব হাবিজাবি যেদিন আমার মাথাচাড়া দিয়ে মাথা খাবার জোগাড় তার পরের দিন আমার ক্যালকুলাস পরীক্ষা। আগেরদিন আমি সারাদিন উচ্চতর ক্যালকুলাস পড়ালাম-পরের দিন আমার তারথেকেও অনেক সহজ বিষয়ের পরীক্ষা, রাতের বেলা ডাল আর ডিমভাজি দিয়ে ভাত খেয়ে শান্তিমতন ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরদিন পরীক্ষার ‘হলে’ প্রশ্নের দিকে তাকিয়েই কেমন যেন আমার দুনিয়াটা এলোমেলো হয়ে গেলো। সবকিছু অপরিচিত লাগতে শুরু করলো। মনে হলো-এতো কঠিন অংক আমি কেমন করে করবো? এইসব অংক তো আমি পরীক্ষার আগে পাচবার করে করে মাথায় গেঁথে ফেলিনাই! মাত্র এক ঘন্টার মাঝে এতোগুলো অপরিচিত অংক আমি কেমন করে করবো? সেই ছোটবেলার মতন সব ঠিকঠাক করে শেষ ধাপের আগে বোকামি ধরণের ভুল করে বসে থাকবো!
গলা শুকিয়ে এলো। মনে হলো দৌড় দিয়ে ঘরটা থেকে বের হয়ে যাই। ভয়ে আমার খাতার দিকেই তাকাতে ইচ্ছা করছিলো না। তাও কোনমতে কয়েকটা সমস্যা আমি অর্ধেক অর্ধেক করে রেখে দিলাম।
প্রফেসর আসেপাশে হাটাহাটি করে ছেলেপেলেকে জ্বালাতন করে বেড়াচ্ছিলো। আমার কাছে এসে বললো-কি অবস্থা রয়? কদ্দুর হলো? কি করতেসো দেখি! আচ্ছা, এইটা তো সহজ জিনিস-বলোতো কেমন করে করা যায় এইটা!
সাথে সাথে আমার কি জানি হলো! শরীরের মাঝে দুইটা ঝাকি দিয়ে গেলো আর এক ধাক্কায় আমি টিচার মোডে চলে গেলাম। মনে হলো আমার কোন একটা কিশোর বসে আমাকে বুঝিয়ে দিতে বলছে। সাথে সাথে আমি বললাম, লিমিট ইনফিনিটির দিকে আগাইলে তো ছোটখাটো কনস্টান্টের ভাত থাকবে না। তখন শুধু ভেরিয়েবলের এক্সপোনেন্ট নিয়ে হিসাব করলেই এন্ড বিহেভিয়ার বোঝা যাবে!
আমি অবাক হয়ে গেলাম! যেই মুহুর্তে আমার মনে হয়েছে যে আমি পরীক্ষার হলে না, বরং আমার পড়ানোর টেবিলে, সেই মুহুর্তে আমি পনের মিনিট ধরে হাঁ করে তাকিয়ে থাকা অংকের উত্তর পেয়ে গেছি পাঁচ সেকেন্ডে! তাহলে যে পরীক্ষাটি আমি দিচ্ছিলাম, সেটা আমার ক্যালকুলাসের জ্ঞানের কতটা পরিচায়ক?
পরীক্ষা দিয়ে ফিরেই আমি চাকরিস্থলে বসে ইফতুর শেয়ার করা পোস্টে জাফর ইকবাল স্যারের লেখাটা পড়ছিলাম। স্যারের লেখা সবসময়ই আনন্দজনক। যেসকল সমস্যা নিয়ে আমি সবসময় কথা বলতে চাই-সেইসব নিয়েই তিনি সবসময় কথা বলেন। একমাত্র সমস্যা হলো-সমাধানের দিকে স্যার যেমনভাবে আগান, আমি আগাই তার ঠিক বিপরীতভাবে।
জাফর ইকবাল স্যার বলতে চাচ্ছেন যে জীবনটা প্রতিযোগিতামূলক নয়-জীবন সহযোগিতামূলক। ছোট ছেলেমেয়েদের জোর করে প্রতিযোগিতার মাঝে ঠেলে দিতে তিনি অভিভাবকদের নিষেধ করছেন-বলছেন তাদেরকে শৈশব উপভোগ করতে দিতে।
আমি এখানেই স্যারের সাথে দ্বিমত পোষণ করি। আমার কাছে মনে হয়না যে ছেলেমেয়েকে প্রতিযোগিতা থেকে আগলে রাখার মধ্য দিয়ে তাদের শিক্ষা, বা তাদের শৈশব কোনভাবে সুন্দর হয়ে যাবে। সত্যি কথা বলতে, প্রতিযোগিতা থেকে কাউকে কোনভাবে আগলে রাখার কোন উপায় নেই। প্রকৃতি সারাক্ষণ কোন না কোন প্রতিযোগিতার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন প্রাণসত্ত্বা প্রতিযোগিতা করছে সীমিত প্রাকৃতিক সম্পদ নিজের করে নেবার জন্য, রাষ্ট্র প্রতিযোগিতা করছে খনিজ সম্পদ নিজের করে নেবার জন্য, গোষ্ঠীরা প্রতিযোগিতা করছে প্রভাব প্রতিপত্তি নিজের করে নেবার জন্য, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিযোগিতা করছে মুনাফা নিজের করে নেবার জন্য আর ব্যক্তিমানুষ প্রত্যেকটা দিন প্রতিযোগিতা করছে আরেকটা ব্যক্তিমানুষের সাথে-নিজের জীবন জীবিকা নিশ্চিত করবার জন্য। প্রতিযোগিতা একটি প্রাকৃতিক নিয়ম-এটা কোন জীবন ধ্বংসকারী-সৌন্দর্য নিষ্পেষণকারী-শৈশব কলুষকারী ব্যাপার নয়। এটা একটা সুস্থ, স্বাভাবিক আর অবশ্যম্ভাবী প্রক্রিয়া। একজন শিশুকে আপনি কেমন করে আপনি প্রতিযোগিতার থেকে দূরে রাখবেন? তাকে যদি কোন স্কুল কলেজে না পাঠিয়ে ঘরের মাঝে বন্ধ করে রেখে দেন-তাহলে দেখবেন সে নিজের দুইটা হাত পাশাপাশি লাগিয়ে মাপামাপি শুরু করবে-দেখি তো আমার ডানহাতটা বড়ো, নাকি বামহাতটা বড়ো!
তার কারণ হচ্ছে এই মেয়েটা জন্মের পরের থেকে পৃথিবীকে দেখতে শিখেছে তুলনামূলক হিসাবে। দুই বলেছে এক এর চেয়ে এক বড় আরেকটা অংককে আর চার বলেছে ছয়ের চেয়ে দুই কম একটা অংককে। বাম হাতের উল্টোদিকের হাতকে বলছে ডানহাত-দুনিয়াকে সে দেখে তুলনামূলক হিসেবে, সবকিছু একই আর সবাই সমান-এই ব্যাপার তার মাথায় ঢুকবে কেনো? আজকে তার এই সমাজে জন্মানোর পেছনে রয়েছে হাজার হাজার বছরের মানবসভ্যতার ইতিহাস, যেটা একটা মারাত্মক বৈষম্য লড়াই করা মারাত্মক প্রতিযোগিতার ইতিহাস। মানুষ প্রথমে অপরাপর বন্যপ্রাণীদের সাথে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকলো-আর এই প্রতিযোগিতার তাগিদেই সে আগুন জ্বালানো শিখলো, চাকা বানানো শিখলো, বিজ্ঞানের শুরু করলো। এরপরে সীমিত সম্পদ ব্যবহার করে অন্যান্য জীবন্ত প্রাণীর সাথে বেঁচে থাকার লড়াই করতে গিয়ে দেখলো যে সবকিছু তার নিজের পক্ষে করা সম্বব নয়। একটা সময়ে দেখা গেলো একজন খুব ভালো রুটি বানাতে পারে কিন্তু সে ভালো শিকার করতে পারেনা। কাজেই সে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্যেই সহযোগিতার জন্ম দিলো- নিজের একটুকু মাংসের বদলে প্রতিবেশীকে মেরে না ফেলে তার কাছ থেকে একটু রুটি চেয়ে নিলো। আজকের সমাজ সেভাবেই ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে। এমনকি যে স্বাধীনতার মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমরা এতো গর্ব করি-সেটাও একটা প্রতিযোগিতা। একটা ভূমির অধিকার নিয়ে দুইটি জাতিস্বত্তার প্রতিযোগিতা। সেই প্রতিযোগিতায় বাঙালি কাধে কাধ মিলিয়েছে প্রতিযোগিতাকে গালিগালাজ করে মানবতার ছড়াগান গেয়ে নয়- নিজের স্বার্থ উদ্ধারের লড়াইয়ে টিকে থাকার তাগিদে সহযোগিতা নামক, জাতিয়তাবাদ নামক আর দেশপ্রেম নামক পদ্ধতিগুলো ব্যবহার করে। সেই প্রতিযোগিতা কি কোন বিচ্ছিরি নোংরা প্রতিযোগিতা ছিলো নাকি খুব চমৎকার সাহস আর ভালোবাসার জন্ম দেয়া একটা প্রতিযোগিতা ছিলো?
তাহলে যদি প্রতিযোগিতার অবস্থান সমস্যা না হয় তাহলে সমস্যাটা কোথায়? সমস্যাটা হলো প্রতিযোগিতার সংকটে। যখন সমাজে পরীক্ষা নামের একটা সস্তা একমাত্রিক প্রতিযোগিতায় সব ছাত্রকে ঠেসে গাদায়ে ঢুকানো হয় তখন প্রতিযোগিতার একটা মনোপলি সৃষ্টি হয়। একটা অর্থহীন টার্ম ফাইনাল, অর্থহীন এসএসসি, অর্থহীন এইচএসসির গোল্ডেন অর্থহীন গোল্ড নামক ধাতুর মতই কেবল পর্যাপ্ত যোগানের অভাবে বিরাট চাহিদার বস্তু হয়ে ওঠে। একটা মাত্র কেন্দ্রীয় পরীক্ষাকে আমরা মহার্ঘ্য বস্তু বানিয়ে তুলেছি কেবলমাত্র এটা এক বছরে একবার হয় বলে।
অথচ এই পরীক্ষাগুলো একজন মানুষের মেধার নিতান্তই অপূর্ণাঙ্গ বিকলাঙ্গ বিচারিক মানদন্ড। আমরা যখন স্কুলে কলেজে পরীক্ষা নিচ্ছি-তখন আমরা শুধু একটামাত্র প্রতিযোগিতার সুযোগ দিচ্ছি-একটা নির্দিষ্ট সময়ের মাঝে নির্দিষ্টসংখ্যক সমস্যা ঠিক কতোজন সর্বোচ্চ সংখ্যক প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পারে, সেটা বের করছি। আমরা এদের মাঝে কেউ কেউ যে একটু বেশি সময় নিয়ে একটা গবেষণাপত্র লিখে আমাদের সব ভুলঠিকের আন্সার শিট ওলট পালট করে দিতে পারে-সেই প্রতিযোগিতাটি আমরা করতে দিচ্ছিনা।
যখন একট সময় বাঁধা পরীক্ষার মাঝে এত্তোগুলা সমস্যার সমাধান করতে হয় তখন সেই সমস্যা সমাধানের স্কিলের চেয়ে পরীক্ষা পাসের বিভিন্ন পদ্ধতিতে পারদর্শী হওয়া বেশি জরুরি হয়ে পড়ে। যেহেতু একটা সময় বেধে দেয়া পরীক্ষার মাঝে যত বেশি প্রশ্নের উত্তর করা-তত বেশি নাম্বার, কাজেই সবাই সবচেয়ে বেশি প্রশ্নের উত্তর দিতে চেষ্টা করে সবচেয়ে কম সময়ের মাঝে। কাজেই এই তাড়াহুড়ার মাঝে তাদের যে একিউরেসি লেভেল অর্থাৎ সাধারণ পরিস্থিতিতে তাদের সেই বিষয়ে সমস্যা সমাধানের যে পারদর্শীতা, সেটা ব্যাপকভাবে কমে যায়। তারমানে দাঁড়ায় যে কখনোই একটা সময় বেধে দেয়া পরীক্ষায় একজন ছাত্রের পরিপুর্ণ মেধার যাচাই করা সম্ভব নয় কারণ হয় তাকে সর্বোচ্চ সংখ্যক প্রশ্নের উত্তর দেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে, অথবা সর্বোচ্চ পারদর্শীতা প্রদর্শন করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
যেহেতু বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানের চেয়ে পরীক্ষা পাশের টেকনিক জানা বেশি দরকারি, সেহেতু বাজারে সেই বিষয়ের পাঠ্যবইয়ের চেয়ে শর্টকাটে পরীক্ষা পাস করবার গাইড বইয়ের চাহিদা বেড়ে যায়। সাথেসাথে শিক্ষার বাজারে সকল শিক্ষার্থীর জন্য একমাত্র মেধার মাপকাঠি হয়ে পড়ে পরীক্ষার নাম্বার, যেহেতু অন্য কোন গুণাবলি মাপবার মতন কোন ব্যতিক্রম পদ্ধতি আমাদের হাতে নেই। কাজেই স্কুলে যাবার চেয়ে পরীক্ষা পাস করবার ট্রেনিং সেন্টার-কোচিং সেন্টার যাওয়াই তাদের জন্য বেশি যুক্তিযুক্ত হয়ে পড়ে। কাজেই দুনিয়ার যেখানেই সময়ভিত্তিক পরীক্ষা রয়েছে, সেখানেই কোচিং সেন্টার কমবেশি রয়েছে আর সেখানেই গাইড বইও কমবেশি রয়েছে (আমেরিকাতে প্রিন্সটন রিভিউ, ব্যারন্স ইত্যাদি বিরাট বিরাট বড় কম্পানি।)
সময়ভিত্তিক পরীক্ষার উপর নির্ভর করা কাজেই একটা গোড়ার বাজে সিদ্ধান্ত যেখানে একজন ছাত্র যতটুকু পারদর্শী তারচেয়েও অনেক কম পারদর্শীতা ফুটে ওঠে। কিন্তু সেটাকে এক ও অদ্বিতীয় করে তোলা মোটামুটি সর্বোচ্চ পর্যায়ের ভুল একটা কাজ। কারণ প্রাথমিক হিসেবের বাইরে রাখা কিছু ভ্যারিয়েবল, যেমন ওইদিন পরীক্ষার্থীর শরীর খারাপ থাকা, মন খারাপ থাকা, বাসায় কাজের বুয়া না থাকা, বয়ফ্রেন্ডের সাথে কথা কাটাকাটি হওয়া, অপছন্দের কূটনী মেয়েটার পাশে সিট পড়া ,দেরী করে পরীক্ষার হলে পৌঁছানো অথবা বারো বছর ধরে মহাযন্ত্রণাময় পরীক্ষাপদ্ধতির মাঝে নিষ্পেষিত হয়ে সারাজীবনের জন্য পরীক্ষাভীতি মনে ঢুকে যাওয়া ইত্যাদি। এইসব সমস্যা যাতে কম হয় সেই কারণে সাধারণত গুরুত্বপূর্ণ যেকোন পরীক্ষা একবারের বেশি দিতে পারা উচিত। এসএটি বছরে যতবার ইচ্ছা দেয়া যায়, জিআরইর ক্ষেত্রেও সেটা সত্য। যেকোন সায়েন্টিফিক রিসার্চে খুব সহজ কোন প্রাকৃতিক ঘটনা ব্যখ্যা করার সময়েও এক এক্সপেরিমেন্ট তিনবার-চারবার করে দেখতে হয় যে ফলাফল কাছাকাছি আসছে কিনা, আর সেখানে মানুষের মতন একটা হাজার লক্ষ ভ্যারিয়েবল অস্তিত্বে নিয়ে ঘুরে বেড়ানো প্রাণীর মেধাকে একটামাত্র তিন ঘন্টার পরীক্ষার ফাংশন হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করা একটা অকাট মূর্খামি ব্যতীত আর কিছু না।
কিন্তু এই অকাট মূর্খামি আমরা মহানন্দে প্রত্যেক বছর করে যাচ্ছি। একটামাত্র ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে একটা মাত্র বুয়েট, একটামাত্র ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে একটামাত্র মেডিকেল আর এইগুলো শুরু হবার আগেও একটামাত্র এইচএসসি পরীক্ষার গুষ্টি দিয়ে বাকি পরীক্ষাগুলো দেয়ার যোগ্যতা নির্ধারণ করা!
কাজেই আমাদের বারো বছরের শিক্ষার দর্শনও তাক করা থাকে এই একমেবদ্বিতীয়ম পরীক্ষাগুলোতে ভালো ফলাফল করার দিকে। অর্থাৎ খুব স্বাভাবিক এবং যুক্তিযুক্ত ব্যাপার যে যেকোন ছেলে বা মেয়ে যত পারে স্কুল ফেলে কোচিংয়ে যাবে আর পাঠ্যবই ফেলে গাইডবই পড়বে। সত্যি কথা হচ্ছে, যে ছেলেটির মাথায় সবচেয়ে বুদ্ধি সে কম সময়ের মাঝে সর্বোচ্চ পারদর্শীতা নিশ্চিত করবার জন্য কোন উপায়ে দেখাদেখি করবে, নকল করবে বা প্রশ্নপত্র ফাঁস করবার চেষ্টা করবে।
আমার খুব বিরক্ত লাগে যখন আমি দেখি যে জাফর ইকবাল স্যারের মতন একজন বুদ্ধিমান মানুষ এই সমাধান বের করা ছেলেমেয়েদেরকেই সমস্যা বলে চালিয়ে দিচ্ছেন। আমি ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি, তিনি বলছেন-গাইড বই নিষিদ্ধ করো, কোচিং ব্যবসা বন্ধ করো, প্রশ্নপত্র ফাঁস বন্ধ করো-আর লজ্জা কুৎসা দিয়ে বুদ্ধিমান ছেলেপেলের মাথা কাটানোর ব্যবস্থা করে রেখেছেন। যে ছেলেটা সময়ের দামে নিজের পারদর্শীতা এবং একই সাথে নিজের ক্যারিয়ার বিকিয়ে দিতে রাজি হয়নি এবং মূলধারার বাইরে গিয়ে বাস্তব সমস্যার বাস্তব সমাধান বের করেছে, তাকে ইকবাল স্যার ভিলেন বানিয়ে দিচ্ছেন। যে ছেলেটা মাত্রই স্কুলকলেজের গন্ডি পেরিয়ে বাবা মায়ের টাকায় আয়েশ করে না বেড়িয়ে নিজের উদ্যোগে কোচিং খুলেছে-তার মতন আর দশটা ছেলের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করছেন-তাদের ভিলেন বানিয়ে দিচ্ছেন।
যারা পরীক্ষার হলে দেখাদেখি করেছে তাদের আমি খুব কাছের থেকে চিনি-কারণ আমিও তাদের একজন। আমি জানি কেউ স্বীকার করতে চাইবে না, কিন্তু অধিকাংশ ছেলেপুলেই কখনও না কখনো দেখাদেখি, নকল, প্রশ্নফাস বা প্রশ্ন ফাঁস করনেওয়ালার থেকে দেখাদেখি আর নকল করবার কাজটি করেছে। অনেক অনেক চমৎকার মানুষ বিভিন্ন সময়ে কোচিং সেন্টারে ক্লাস নিয়েছে। আমি জানি কারণ আমি কোচিং ক্লাস করেছি এবং আমি কোচিং ক্লাস পড়িয়েছি। সেটাতে আমার কোনরকম লজ্জা নেই। জাফর ইকবাল স্যার যতই সাপ্লাইকে দোষ দিন না কেনো, আমরা জানি যে সাপ্লাই যদি বাজারে টিকে থাকে অবশ্যই কোথাও না কোথাও ডিমান্ডটা টিকে আছে। সেই ডিমান্ডকে এড্রেস না করে যখন সাপ্লাইকে গালিগালাজ করা হয়-তখন আমার সেটাকে অর্থহীন বোকামি বলে মনে হয়।
অথচ এমন যদি হতো যে জাফর ইকবাল স্যারদের মতন শিক্ষাবিদেরা মিলে একটা বেসরকারী পরীক্ষার মতন বানালেন-অনেকটা আমেরিকার এসএটির মতন। কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নয়-কোন সরকারী ক্ষমতার অধীনে নয়। যেকোন ছাত্রছাত্রী যতবার ইচ্ছা ততবার এই পরীক্ষা দিতে পারবে। (সবচেয়ে চমৎকার হতো যদি সেই পরীক্ষাটি হতো ওপেন বুক, আনলিমিটেড টাইম আর কোন হল গার্ড ছাড়া তবে সেই দাবি আমি এখনই করছিনা।) আমি নিশ্চিত বাংলাদেশের হাজার হাজার ছেলেপেলে এমনিতেই মনের আনন্দে এই পরীক্ষাটি দিতে যেতো। আর আমি এও নিশ্চিত, যে কিছু কিছু বিশ্ববিদ্যালয় একসময় এই পরীক্ষার ভিত্তিতে ছাত্র নির্বাচন শুরু করতো আর তারচেয়েও চমৎকার ব্যাপার হতো যে পুরোপুরি একটা স্বাধীন পরীক্ষার উপর বিশ্বাস না করতে পেরে বরং যে টাকায় ভর্তি পরীক্ষা হতো, সেই টাকায় বরঞ্চ ছাত্রের সার্বিক পাঠানুক্রমিক সহ পাঠানুক্রমিক কর্মকান্ডের একটা বিচার বিবেচনা করার টিম গড়া হতো। তখন দেখা যেতো যে এইচএসসি পরীক্ষার মারাত্মক ডিমান্ডটা পড়ে গেছে। স্কুল কলেজ আর এইচএসসির জন্যে ছেলেপেলেকে ট্রেনিং না দিয়ে তাদের সত্যিকারের শিক্ষা দেয়া শুরু করেছে। একজন টিচার একদিন ক্লাসে দাড়ায়ে বললেন যে কোন ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা হবেনা। প্রতিদিন একটা করে পরীক্ষা হবে আর বছর শেষে একটা রিসার্চ পেপার-তাই সব মিলিয়ে নাম্বার দেবো। তখন ছেলেপেলেরা উঠতে বসতে পরীক্ষা দেবে। এতো পরীক্ষা দেবে যে পরীক্ষার তখন আর কোন পাত্তা থাকবে না। পরীক্ষার সাপ্লাই বাড়ায়ে দিলে পরীক্ষার দাম কমে যাবে।
কাজেই সমাধানটা কখনই কমসংখ্যক প্রতিযোগিতা না-বরং অসংখ্য সংখ্যক বৈচিত্র্যময় প্রতিযোগিতার মঞ্চ তৈরি করে দেয়া। যখন আমরা জাতীয়ভাবে ব্যক্তিগত নাচগানের প্রতিযোগিতা করছি তখন যেমন আমরা একজন ব্যক্তিগত শিল্পীর বাকি সব পারফরমারকে পেছনে ফেলে নিজে ভালো করবার ক্ষমতার প্রতিযোগিতা করছি-তেমনি যেনো আমরা একটা বিতর্ক দলে নিজের বক্তৃতার চিন্তা মাথার পেছনে ফেলে দলের সবার জন্যে গোছানো একটা স্ট্যান্ডপয়েন্ট বের করতে পারা দলনেতাটার সবাইকে সাথে নিয়ে উপরে ওঠবার চমৎকার নেতৃত্ব দেবার ক্ষমতাকে প্রতিযোগিতার মঞ্চে উঠে আসবারও সুযোগ সৃষ্টি করি। গণিত উৎসবের থেকে ফিজিক্স অলিম্পিয়াড হয়েছে, সায়েন্স অলিম্পিয়াড হয়েছে, দাবা অলিম্পিয়াড যেমন হচ্ছে, তেমনি যেনো একেকটা ইকোনমিকস অলিম্পিয়াডও হয়-অথবা সবার জন্য উন্মুক্ত একটা রিসার্চ সিম্পোসিয়াম যাতে হয়, যেখানে যে কেউ এসে তাদের রিসার্চ প্রজেক্ট জমা দিতে পারবে-কে জানে, তাহলে হয়তো আমাদের সেই শিশুটা, যে প্রতিযোগিতাহীন ঘরে বসে ডান হাত আর বাম হাতের মাঝে হাইট চ্যাম্পিয়নশীপের আয়োজন করেছিলো, সে হয়তো স্কলার ডট গুগল ডট কমে গিয়ে সার্চ দেবে, 'কেইস স্টাডি অফ লংগার রাইট হ্যান্ডেড মেন'। হয়তো একটা ফুটবল অলিম্পিয়াড হবে যেখানে সারাজীবন নিজেকে গবেট মনে করা একটা ব্যকবেঞ্চের ছেলে স্কুলটিমের গোলকিপার হয়ে যাবে। হয়তো এরকম একটা প্রতিযোগিতা শুরু করবে একদল ছেলেপেলে, যেরকম প্রতিযোগিতা পৃথিবীর আর কোথাও কখনও হয়নাই। সেই প্রতিযোগিতার আয়োজন করতে গিয়ে তারা আবিস্কার করবে যে তারা আসলে খুব সন্দর করে প্রতিযোগিতা আয়োজন করতে পারে-প্রতিযোগিতা আয়োজন করবার প্রতিযোগিতায় তারা সবার থেকে এগিয়ে।
একটা দুইটা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করা সবার হাতে একটা করে টিফিনবাটি সান্তনা পুরস্কার ধরিয়ে দিয়ে সবার মন একসাথে খারাপ না করিয়ে দিয়ে বরং অসীম সংখ্যক প্রতিযোগিতায় আয়োজন করা হোক যাতে সবাই কোথাও না কোথাও নিজের শ্রেষ্ঠত্ব, নিজের স্বকীয়তা খুঁজে পেতে পারে। প্রতিযোগিতার থেকে পালানো নয় বরং নিজের মতন করে প্রতিযোগিতা গড়ে নেয়াটাই শিখতে হবে। বাস্তবতার থেকে পালিয়ে রূপকথা খুজলে চলবেনা-নিজের বাস্তবতাকে নিজের রূপকথার মতন করে তোলবার ক্ষেত্র গড়ে তুলতে হবে।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৬ দুপুর ১:২৪
১. ১৮ ই মে, ২০১৭ দুপুর ১:৫৩ ০